
ভাস্কো দা গামা মালাবার উপকূলের কালিকট বন্দরে পা রাখার সাথে সাথে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সূচনা হয়েছিল নতুন অধ্যায়ের। বাণিজ্যের অমিত সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাথে ইউরোপীয় বণিকদের স্রোত আছড়ে পড়তে থাকে ভারতের বিভিন্ন উপকুলে। ভাস্কো দা গামাকে ভারতে পা রাখার প্রথম কৃতিত্ব দেওয়া হলেও তার সাত শতাব্দী আগে একই মালাবার উপকূলে নোঙ্গর করেছিলেন আর্মেনীয় বণিক থমাস কানা। কিন্তু সেই আমলে আর্মেনীয়রা ভারতে থিতু হয়নি, ব্যবসার পাট চুকিয়ে নিজের দেশে রওনা হয়েছে।
তবে মোঘল সম্রাট আকবরের সময় এই আর্মেনীয়রা আবার ভারতের দিকে আসতে শুরু করে। সম্রাট আকববের অনুমতিক্রমে আর্মেনীয়রা আগ্রা এবং এর আশপাশের এলাকায় বসবাস শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটার সাথে সাথে আগ্রার সমাজে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এই সম্প্রদায়। এমনকি আকবরের দরবারেও বেশ কয়েকজন আর্মেনীয়র যাতায়াত ছিলো। ১৫৬২ সালে আগ্রাতে চার্চ নির্মাণের অনুমতি পায় আর্মেনীয়রা।
১৬০০ সালের দিকে আর্মেনীয়দের ভারতমুখে যাত্রা বাড়তে থাকে। আগ্রা ছাড়াও সুরাট, হুগলি, কলকাতায় বসতি স্থাপন করতে থাকে আর্মেনীয়রা। কলকাতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূর্গ স্থাপনের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই পাকাপোক্তভাবে বসতি স্থাপন করে এই বণিকদল। কলকাতার আর্মেনীয় সমাধিসৌধের সবচেয়ে প্রাচীন সমাধিটি ১৬৩০ সালের। আর এই সমাধিসৌধের কাছেই আর্মেনীয় চার্চ, ১৭২৪ সালে নির্মাণ করা হয়েছিলো এটি। আর্মেনীয়রা ব্যবসা আর বাণিজ্যের প্রসারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে।

কলকাতার আর্মেনীয় চার্চ; Image Source: Navrang India
পূর্ব বাংলার সমৃদ্ধ নগরী ঢাকার খ্যাতি তখন কাঁচা পাটের কেন্দ্র হিসেবে। ঢাকা থেকে নদীপথে যাওয়া কাচা পাটের উপর ভর করে কলকাতায় গড়ে উঠেছে বড় সব জুটমিল। তাই পাটের ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন ঢাকার আর্মেনীয়রা। আব্রাহাম পোগজ, এম ডেভিড, জে সি সারকিস, জে জি এন পোগজ, মাইকেল সারকিস, পি আরাতুন পাটের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। ডেভিডকে ডাকা হতো ‘মার্চেন্ট প্রিন্স অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে। ১৮৪৬ সালে ঢাকা ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলে এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জে জি এন পোগজ।1
ইউরোপীয় বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে দোকান দিয়েছিলেন অনেক আর্মেনীয়। জি এম সিরকোর ১৮৫৭ সালে ‘সিরকোর এন্ড সন্স’ নামের একটি দোকান চালু করেন ঢাকার শাখারিবাজারে। এই সিরকোরই ঢাকায় চালু করেন ঘোড়ার গাড়ি, যা কালক্রমে ‘ঠিকাগাড়ি’ হিসেবে পরিচিত হয়। সময়ের সাথে ঢাকার অভিজাত শ্রেণীর চলাচলের প্রধান যানবাহন হয়ে ওঠে এই ঠিকাগাড়ি। ১৮৮৯ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রায় ছয় শতাধিক ঠিকাগাড়ি চোখে পড়তো।

ঢাকায় ঠিকাগাড়ির প্রচলন করেছিল আর্মেনীয়রা; Image Source: khaboronline.com
তবে ততদিনে সব ব্যবসাতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ইংরেজদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। লবণ ব্যবসাতে একাধিপত্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। ইস্ট কোম্পানি সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারলে লবণ ব্যবসা করা ছিলো অসম্ভব। কারণ এই ব্যবসার ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো কোম্পানি থেকেই। পূর্ব বাংলায় প্রভাবশালী লবণ ঠিকাদারদের বেশিরভাগই ছিলেন আর্মেনীয়। পানিয়াটি আলেকজান্ডার নামে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ী লবণের ব্যবসা করেই অর্জন করেছিলেন ৬,৪৫০ টাকা। এভাবে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রভাবশালী আর্মেনীয়রা ঢাকায় তাদের আবাস গড়তে থাকে।
পোগজ, আরাতুন, পানিয়াটি, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সার্কিস এই পরিবারগুলো ঢাকায় তাদের বিত্ত আর বৈভবের জন্য পরিচিত ছিলো। ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থে তারা ঢাকায় জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন। ১৮৬৮ সালে করা ঢাকায় জমিদারদের এক তালিকায় ছয়জন অবাঙ্গালী জমিদারের পাচজনই ছিলেন আর্মেনীয়। জে জি পানিয়াটি, জে স্টেফান, জে টি লুকাস আর ডাব্লিউ হার্নি ছিলেন ঢাকার প্রভাবশালী আর্মেনীয় জমিদার।
ধনী আর্মেনীয়দের অনেকেই ঢাকায় নির্মাণ করে তাদের জাকজমকপূর্ণ সব বাড়ি। বুড়িগঙ্গা ঘেষে ফরাশগঞ্জের যে ভবনটি এখন রূপলাল হাউজ তা নির্মাণ করেছিলেন আরাতুন। রমনা এলাকায় এখন যেখানে আণবিক শক্তি কমিশন সেখানে ছিলো তার বাগান বাড়ি। মানুক পরিবারের নিবাস ছিলো সদরঘাটে। আরমানিটোলায় নিকোলাস পোগজের বাড়ি। ঢাকার স্থানীয় মানুষের কাছে নিকোলাস পোগজ পরিচিত ছিলেন ‘নিকি সাহেব’ নামে। আরমানিটোলার বাড়ি পরিচিত ছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’ নামেই। স্টেফান পরিবারের আবাস ছিলো আনন্দ রায় স্ট্রিটে। মধ্যবিত্ত আর্মেনীয়দের অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন আরমানিটোলা, মৌলভিবাজার আর নলগোলায়।

‘নিকি সাহেবের কুঠি’; Image Source: commons.wikimedia.org
১৮৩২ সালের এক হিসেব অনুযায়ী, ঢাকায় আর্মেনীয়দের মোট বাড়ির সংখ্যা ছিলো বিয়াল্লিশটি। মোট আর্মেনীয় ছিলো ১২৬ জন। বেশিরভাগই থাকতেন আরমানীটোলা এবং তার আশপাশে। অনেক আগে আর্মেনীয়রা যখন আরমানিটোলায় বসবাস শুরু করেন, তখন এই এলাকায় ধোলাইখালের একটি অংশ বদ্ধ ঝিলে পরিণত হয়েছিলো। ফলে এই এলাকায় বসবাস করা রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। আর্মেনীয়দের অনুরোধে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ডস সাহেব খাল কেটে এই বদ্ধ ঝিলকে বুড়িগঙ্গার সাথে সংযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য ছিলেন জে সি সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের দুজনই ছিলেন পোগজ পরিবারের এন পি পোগজ এবং জে জি এন পোগজ (নিকি পোগজ)।

নিকোলাস পোগজ; Image Source: Charles Pote
শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে আর্মেনীয়রা ছিলো যথেষ্ঠ সচেতন আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ। তার সময়ে এই স্কুল বেশ খ্যাতি লাভ করে। নিকি পোগজ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘পোগজ স্কুল’। সময়ের পরিক্রমায় নাম বদলে ‘পোগজ ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ’ হলেও ঢাকার চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে এখনো দেখা মিলবে সেই স্কুলের।

পোগজ ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ; Image Source: commons.wikimedia.org
উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা এবং প্রভাব কমতে শুরু করে। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ দায়ী। ভারতবর্ষের ব্যবসা বাণিজ্যে ইস্ট ইন্ডিয়ার দাপট বাড়ার সাথে আর্মেনীয়দের ব্যবসার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। ইংরেজসহ বাকি ইউরোপীয় বণিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে পেরে না ওঠায় অনেক আর্মেনীয় জমিদারির দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যে সেটিও তাদের হাতছাড়া হতে থাকে। এসব পরিবারের সন্তানদের একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে পাড়ি জমায়। পড়া শেষ করে অনেকেই আর ফিরে আসেননি, কিংবা আসলেও জমিদারি পরিচালনা করতে পারেননি। ফলে ঢাকা থেকে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী কমতে থাকে। পাশাপাশি আর্মেনীয়রা ছিলো বিয়ে এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল, বিয়ে এবুং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক নিজেদের মধ্যেই রাখতে চাইতেন তারা। এ ব্যাপারে ঢাকার আর্মেনীয়দের সাথে কলকাতায় বসবাসরত বৃহত্তর আর্মেনীয় জনপদের বেশ সখ্যতা ছিলো। ঢাকার আর্মেনীয় ছেলেদের একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর ফলে ঢাকার থাকা আর্মেনীয় মেয়েদের বেশিরভাগ বিয়ে করে কলকাতায় চলে যান। ক্রমান্বয়ে উচ্চবিত্ত আর্মেনীয়দের সবাই ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমান।

সদ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ‘নিকি সাহেবের কুঠি’; Image Source: dhakatribune.com
আরাতুনের উত্তরাধিকারীরা খাজা আলিমুল্লাহর কাছে জমিদারি বিক্রি করে পাড়ি জমান কলকাতায়। লুকাস পরিবারের জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন আনন্দচন্দ্র রায়। পোগজ পরিবারের একাংশ তাদের জমিদারি বিক্রি করে পাড়ি জমায় লন্ডনে। তবে কেউ কেউ রয়ে গিয়েছিলেন। পোগজ পরিবারের গ্রেগরি জে পোগজ লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আবারো দেশে ফিরেছিলেন। জে ডি বাগনার নামে আরেক আর্মেনীয় ১৮৯৩ সালে ঢাকা থেকে ‘সাহিত্য, আর্মেনীয় ইতিহাস আর রাজনৈতিক মাসিকপত্র’ নামে পত্রিকাও ছাপতেন। তিনিও ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি ঢাকায় আর্মেনীয়দের নির্মিত সুরম্য চার্চটি দেখাশোনা করার জন্য থেকে গিয়েছিলেন অনেকেই।

ঢাকার আর্মেনীয় চার্চ; Image Source: panoramio.com
অনেকেই শুধু ভালোবাসার টানে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে নেফিয়েট স্টেফান নামে নারায়ণগঞ্জে বসবাসরত আর্মেনীয় মারা যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে আর্মেনীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। আরমানিটোলার চার্চের পাশের সমাধিসৌধে ১৮৭৪ সালে মারা যাওয়া এক শিশুর এপিটাফের লেখাটা ছিলো অনেকটা এরকম,
“আমার জন্য কেঁদো না তোমরা, কেন শোক করো আর/আমিতো হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু আগে চলে গেছি।”
আরমানিটোলার চার্চ, পোগজ স্কুল কিংবা সদ্য ভেঙ্গে ফেলা নিকি সাহেবের কুঠির সামনে দিয়ে এখনো হাঁঁটার সময় মনে হবে, হারিয়ে যায়নি আর্মেনীয়রা, শুধু একটু আগেই কোথায় যেন চলে গেছে।
তথ্যসূত্র:
- মুনতাসির মামুন। ঢাকা – স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ১৫-২১
Feature image source: Joybrata Sarker