
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা শুনলেই আমাদের চোখে চোখে ভেসে ওঠে ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর কথা। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, ইতালি– ইউরোপের এই দেশগুলোকেই মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কুশীলব হিসেবে দেখানো হয় ইতিহাসে। ইউরোপীয় মহাদেশের বাইরের দেশের প্রসঙ্গ যদি তোলা হয়, সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আমেরিকা ও জাপানের নাম উঠে আসবে। ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা অনেক বেশি– এরকমটা দাবি করলে সেটি অযৌক্তিক বলা যাবে না। শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, দুটো বিশ্বযুদ্ধেই আমেরিকার উপস্থিতি ও নেতৃত্বে মিত্রপক্ষ পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ইউরোপের পরাশক্তি দেশগুলো কিংবা আমেরিকা ও জাপান ছাড়াও যে অসংখ্য দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, গতানুগতিক ইতিহাস পড়লে সেটি বোঝার উপায় নেই। যেমন, ভারতবর্ষের কথাই ধরা যাক, বার বার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারববর্ষের ভূমিকা আড়ালেই রাখা হয়।
ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি কথা আমরা প্রায়শই শুনতে পাই, “ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের হাতে”। এই বাক্যটি গতানুগতিক ইতিহাসের প্রতি একধরনের বিদ্রুপ, কারণ গতানুগতিক ইতিহাস সত্যিকার অর্থেই লেখা হয় বিজয়ীদের হাতে, যেখানে বিজয়ীরা বাস্তব প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে নিজেদের কৃতিত্ব অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে, পরাজিতদের যেখানে ‘মানবতার শত্রু’ হিসেবে দেখানো হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা সেরকমই। ভারতবর্ষের সৈন্যরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করেছেন, মিত্রপক্ষের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছেন, যুদ্ধে ভারতবর্ষের সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়, তারপরও কোনো এক অজানা কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অবদানকে কখনও গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি। শুধু ভারতবর্ষই নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উপনিবেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাদের ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্দেশে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করার পরও ইতিহাসে তাদের অবদানকে পরিকল্পিতভাবে আড়ালে রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষ কোনো স্বাধীন দেশ ছিল না, তখনও ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন জারি রেখেছিল। তাই ভারতবর্ষের সৈন্যরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সৈন্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেননি, তারা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির সাথে যখন মিত্রপক্ষের পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়, তখন ঔপনিবেশিক দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উপনিবেশগুলো থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা গ্রহণ করার। ভারতবর্ষের বিশাল জনসংখ্যা ব্রিটিশদের প্রলুব্ধ করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয়দের মধ্য থেকে যুবকদের বেছে নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় পঁচিশ লাখ ভারতীয় সেনা ব্রিটিশদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, যাদের মধ্যে ত্রিশ হাজারেরও বেশি সৈন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর যখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়, তখন ভারতীয়রা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিতে শুরু করে। তৎকালীন কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষীয় সমাজে কৃষি কিংবা ছোটখাট ব্যবসায় যে আয় হতো, তার তুলনায় অনেক বেশি আয় হতো সেনাবাহিনীতে চাকরির মাধ্যমে। এছাড়া, ভারতীয় সমাজে কৃষির চেয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরির সামাজিক মর্যাদা বেশি ছিল। ব্রিটিশরা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে বাছাই করা সৈন্যদের বেশ কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল, যেগুলোর মাধ্যমে চাইলে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জীবিকা নির্বাহ করা যেত। এছাড়াও, জমি প্রদান, মাসিক বেতন-ভাতা ও মাসিক রেশন প্রদানের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের অধিবাসীদের প্রলুব্ধ করেছিল সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। ভারতবর্ষে এর ফলে এক গণজোয়ার শুরু হয়। দলে দলে ভারতবর্ষীয় যুবক যোগ দিতে শুরু করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতীয়-ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য ছিল, কিন্তু গণজোয়ারের পর তাদের আধিপত্য কমে যায়।

শুধু যে সৈনিক সরবরাহের ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অবদান সীমাবদ্ধ আছে, এরকমটা ভাবলে ভুল হবে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষীয় শিল্পকারখানাগুলোকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য প্রায় আড়াই কোটি জোড়া বুটজুতো, সাঁইত্রিশ হাজার সিল্কের প্যারাশ্যুট সরবরাহ করেছিল ভারতবর্ষীয় শিল্পকারখানাগুলো। এই বিশাল পরিমাণ শিল্পপণ্য তৈরির জন্য ভারতীয় কলকারখানাগুলোতে অনেক ভারতীয় শ্রমিকের দরকার হয়েছিল। বাড়তি অর্থের আশায় অসংখ্য ভারতীয় এই সময় শিল্পকারখানাগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের ডাকে নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করার পরও তাদের বর্ণবাদী নীতির কারণে বাংলায় চালের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। ভয়াবহ এই মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ত্রিশ লাখ লোক। এই দুর্ভিক্ষের দায় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের উপর চাপানো হয়। তার বর্ণবাদী নীতি গ্রহণের কারণেই পূর্ববঙ্গে এমন ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ তৈরি হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করতে হয়েছে ভারতবর্ষীয় সৈন্যদের। সুদূর আফ্রিকা মহাদেশের সুদান থেকে শুরু করে লিবিয়া কিংবা প্রতিবেশী বার্মা থেকে শুরু করে ইম্ফল– কোথায় ছিল না ভারতবর্ষীয় সৈন্যদের পদচারণা? এছাড়া অক্ষশক্তির হাত থেকে ইরাকের তেলকুপগুলো পাহাড়া দেয়ার ক্ষেত্রেও ভারববর্ষীয় সৈন্যদের দ্বারস্থ হয়েছিল ব্রিটিশরা। যেখানেই ভারতবর্ষীয়রা যুদ্ধ করেছেন, সেখানেই কৃতিত্বের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাফল্যের নিদর্শনস্বরূপ যতগুলো ভিক্টোরিয়া ক্রস পদক দেয়া হয়েছিল, তার ১৫ শতাংশ পদক লাভ করেছিল ভারতবর্ষীয় সেনাবাহিনীর সেনাসদস্যরা। বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতার জন্য ভিক্টোরিয়া ক্রস পদক লাভই প্রমাণিত করে ভারতবর্ষের সৈনিকেরা কতটা গুরুত্বের সাথে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সৈন্যদের পাশাপাশি ভারতীয় ডাক্তাররা অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের চিকিৎসা সেবাপ্রদানের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।

image source: thenational.scot
ভারতবর্ষীয় সৈন্যরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন মিত্রবাহিনীর সাফল্যের জন্য, তা দুটি মানুষের মন্তব্য বিশ্লেষণ করলেই জানা যাবে। ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একবার বলেছিলেন, “দুটো বিশ্বযুদ্ধেই ভারতবর্ষীয়রা না থাকলে ব্রিটিশদের পরাজয়ের মুখ দেখতে হতো।” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতবর্ষীয় মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী ধারণা পোষণ করতেন। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের জন্য তার বর্ণবাদী নীতিকে পুরোপুরি দায়ী করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতবর্ষীয় সৈন্যদের বীরত্বগাঁথা দেখে তিনিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

image source: indiandefencereview.com
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতানুগতিক ইতিহাস পাঠ করলে বোঝা যাবে কীভাবে ভারতবর্ষ ও পৃথিবীর অন্যান্য যেসব উপনিবেশের বিশাল অবদানকে মিত্রপক্ষের শক্তিশালী দেশগুলোর ইতিহাস রচয়িতারা পরিকল্পিতভাবে আড়ালে রেখেছেন। একদিক থেকে দেখলে ভারতবর্ষের এই যুদ্ধের সাথে তাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন জড়িত ছিল না। এমন ছিল না, যে যুদ্ধে জয়লাভ করলে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তারপরও ভারতীয়রা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বস্ব দিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর ভারতবর্ষের যেসব সৈন্য হতাহতের শিকার হয়েছিলেন, তাদেরকে কোন সহযোগিতা করা হয় নি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারববর্ষের সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছিল তাদের স্বাধীনতার আন্দোলন তরান্বিত করার ক্ষেত্রে। যুদ্ধের সময়ই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবে, যুদ্ধের পর ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে নাজুক হয়ে পড়েশ উপনিবেশগুলো পরিচালনার মতো অর্থ তাদের কোষাগারে ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অবদান ছোট করে দেখার অবকার নেই কোনোভাবে।