Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলদস্যুদের স্বর্ণযুগের বিস্ময়কর যত কাহিনী

‘জলদস্যু’, এমনই এক নাম যা একইসাথে আমাদের মাঝে অদম্য আগ্রহ আর ভীতির শিহরণ জাগিয়ে তোলে। যখন তাদের নানা নৃশংসতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে নানা উদ্ভাবনী কৌশলের কথা ইতিহাস আমাদের জানায়, তখন বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে যায় অনেকের। আনমনেই হাসতে শুরু করে দেয় কেউ কেউ। এ হাসি আনন্দের না, এ হাসি বিস্ময়ের। এ হাসির সময় মন বলতে থাকে, “শিট ম্যান! ক্যামনে সম্ভব এইগুলা?”

জলদস্যুদের স্বর্ণযুগের তেমনি বিভিন্ন মজাদার কাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এ লেখাটি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আজ আপনি যে কাহিনীগুলো পড়বেন, সবগুলোই আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ ‘পৃথিবী কমলালেবুর মতো গোল, তাই কখনো না কখনো আমাদের আবার দেখা হবে’ টাইপের দার্শনিক কথার মতো এখানে উল্লিখিত প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে চলার পথে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। আর দেরি কেন? চলুন তবে মজাদার সেই কাহিনীগুলোই জানা যাক।

দ্য ফ্লায়িং গ্যাং

ইংরেজ প্রাইভেটিয়ার ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড যুদ্ধ করতেন স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে। শত্রুপক্ষের জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ধন-সম্পদ লুট করা এবং পরবর্তীতে সেগুলো জ্যামাইকার পোর্ট রয়্যালে বিক্রির অনুমতিও ছিলো তার। ১৭১৩ সালে স্প্যানিশদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের অবসান ঘটে। তখন হর্নিগোল্ডকে স্প্যানিশ জাহাজগুলোয় আক্রমণ করা ছেড়ে দিতে বললে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান।

Source: thewayofthepirates.com

১৭১৫ সালের কথা, ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ স্প্যানিশদের একটি জাহাজে আক্রমণ করে হর্নিগোল্ডের দল। সেখান থেকে প্রাপ্ত বিপুল লুন্ঠিত দ্রব্য তারা বিক্রি করতে যান জ্যামাইকায়। কিন্তু জ্যামাইকার গর্ভনর তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। আসলে যুদ্ধের পর স্পেনের চিনি, রাম ও ক্রীতদাসের ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছিলো ইংরেজরা। আর সেখান থেকে ভালোই লাভ হচ্ছিলো তাদের। তাই দু’পক্ষের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে তারা প্রাইভেটিয়ারদেরকে স্প্যানিশ জাহাজগুলোয় আক্রমণ বন্ধের নির্দেশ দেয়। সেটা না করলে যে তাদের ‘জলদস্যু’ হিসেবে গণ্য করা হবে- এমন হুমকিও দেয়া হয়েছিলো।

এমন পরিস্থিতিতে মহা ঝামেলায় পড়ে গেলেন হর্নিগোল্ড। তার সাথে আছে জাহাজ, আছে একগাদা নাবিক, কিন্তু তাদের নেই কোনো চাকরি! লুট করা মালামাল ফিরিয়ে দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার ছিলো না। তাই তিনি দল নিয়ে ফিরে গেলেন বাহামাসের ছোট্ট বন্দর নাসাউয়ে। সেখান থেকেই কালোবাজারে পণ্য বিক্রি করে চালাতে লাগলেন তিনি। দলটিকে সবাই চিনতে লাগলো ‘দ্য ফ্লায়িং গ্যাং’ নামে। আস্তে আস্তে হর্নিগোল্ড ও তার দলের লুটতরাজ এবং বিপুল অর্থকড়ি কামানোর কথা সবদিকে ছড়াতে লাগলো। নাবিক ও দুর্ধর্ষ আরো অনেক লোকই এসে যোগ দিতে লাগলো তাদের সাথে। হর্নিগোল্ড হলেন সেই ফ্লায়িং গ্যাংয়ের রাজা।

বউয়ের সাথে ঝগড়া করে জলদস্যু

বার্বাডোজের জমিদার স্টিড বনেটের ধন-সম্পদের কোনো অভাব ছিলো না। অভাব ছিলো শুধু পারিবারিক শান্তির। বউয়ের খিটখিটে মেজাজ তার কাছে আর ভালো লাগছিলো না। পরিবারের বন্ধন থেকে তাই পালাতে চাইতেন তিনি, হতে চাইতেন এক জলদস্যু! একদিন স্বপ্নপূরণে কাজে নেমে যান বনেট। বিপুল অর্থকড়ি খরচ করে ‘দ্য রিভেঞ্জ’ নামে চমৎকার এক দস্যু জাহাজ বানান তিনি। এরপর প্রয়োজনীয় নাবিক ভাড়া করে বনেট স্ত্রীকে ত্যাগ করে জাহাজে করে রওয়ানা হন নাসাউয়ের পথে, উদ্দেশ্য ফ্লায়িং গ্যাংয়ের সাথে যোগ দেয়া।

স্টিড বনেট; Source: Charles Johnson

সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। বনেট আসলে আবেগে ভাসছিলেন। জাহাজ চালানো কিংবা সমুদ্রে দিকনির্দেশনা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলো শূন্যের কোঠায়। তাই অল্প কিছুদিনের ভেতরেই নাবিকদের অপছন্দের পাত্রে পরিণত হন তিনি। বেশ ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে নাসাউতে পৌঁছাতে সক্ষম হন বনেট। তার আগ্রহ দেখে তাকে দলে নিতে সম্মত হন হর্নিগোল্ড। তবে শর্ত জুড়ে দেন তখন হর্নিগোল্ডের সাথে কাজ করা উঠতি জলদস্যু এডওয়ার্ড টিচ (পরবর্তীতে যিনি ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’ হিসেবে খ্যাতি পান)। টিচ জানান, তিনি বনেটকে তাদের সাথে নেবেন কেবলমাত্র যদি বনেট তার নতুন জাহাজটি টিচকে দিয়ে দেন। নিরুপায় বনেট আর কোনো উপায় না দেখে টিচের প্রস্তাব মেনে নেন, দায়িত্ব নেন টিচের পুরনো জাহাজের।

তবে হারানো সেই সম্মান যেন আর ফিরে পেলেন না স্টিড বনেট। উপরন্তু একবার এক বণিক জাহাজ দখল সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়ায় নাবিকদের কাছে তার জনপ্রিয়তা গিয়ে ঠেকে একেবারে তলানীতে। তার জাহাজের সকল নাবিক গিয়ে যোগ দেয় ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজে। বনেটও তখন নিজের জাহাজ দ্য রিভেঞ্জে ফিরে যান। কিন্তু তখন তিনি আর এর ক্যাপ্টেন ছিলেন না, বরং সবাই করুণা করে তাকে জাহাজটিতে একজন অতিথি হিসেবেই দেখতো।

প্রেমিকার জন্য জলদস্যু

১৭১৫ সালের কথা। ম্যাসাচুসেটসের এক সরাইখানায় স্যাম বেলামি নামক এক দরিদ্র নাবিকের সাথে দেখা হয় ম্যারি হ্যালেট নামক এক ধনী কৃষকের মেয়ের। ‘Love at first sight’ কথাটির সার্থক প্রয়োগ দেখিয়ে প্রথম দেখাতেই তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। স্যাম ম্যারির বাবা-মায়ের কাছে তাদের মেয়ে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাবার ইচ্ছার কথা জানান। কিন্তু তারা স্যামের মতো এমন কপর্দকশূন্য কারো সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না।

এমন অপমান সহ্য হয়নি স্যামের। ম্যারিকে আপন করে নিতে তাই জিদের বশে চাকরিটা ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন ক্যারিবিয়ান সাগরে, লক্ষ্য গুপ্তধন খুঁজে বের করে বড়লোক হবেন। কিন্তু এ কাজে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর স্যামও যাত্রা করেন নাসাউয়ের দিকে, যোগ দেন ফ্লায়িং গ্যাংয়ে। ততদিনে নিজের দল গড়ে তুলতে ব্ল্যাকবিয়ার্ড ফ্লায়িং গ্যাং ছেড়ে দিয়েছেন। তাই নিবেদিতপ্রাণ ও দক্ষ এক নাবিকের খুব প্রয়োজন ছিলো হর্নিগোল্ডের। ওদিকে ডাকাতির পেশায় স্যামও তার দক্ষতা দেখাতে থাকায় অল্পদিনের ভেতরেই হর্নিগোল্ডের সুনজরে এসে যান তিনি।

হর্নিগোল্ডের সাথে কাজ করে অনেক কিছুই শিখতে থাকেন স্যাম। তবে ম্যারিকে বিয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ তখনও তার জমা হয় নি। তাই আরো জাহাজ লুট করতে চাইতেন তিনি। কিন্তু হর্নিগোল্ড ব্রিটিশ ও ডাচ জাহাজগুলো লুটের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে স্যামের পাশাপাশি ফ্লায়িং গ্যাংয়ের অন্য সদস্যরাও হর্নিগোল্ডের প্রতি নাখোশ হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৭১৬ সালের জুলাইয়ে ভোটের মাধ্যমে হর্নিগোল্ডকে কমান্ড থেকে অপসারণ করা হয়। নতুন ক্যাপ্টেন হন স্যাম বেলামি।

ছোট একটি নৌকায় করে হর্নিগোল্ডকে চলে যেতে বলা হয় নাসাউয়ে, যেন বাকি দিনগুলো সেখানে তিনি কিছুটা হলেও সম্মান নিয়ে কাটাতে পারেন। নিয়তির খেলা সত্যিই বড় বিচিত্র।

সাগরের রবিন হুড

অল্প কিছুদিনের ভেতরেই স্যাম বেলামির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছে যায়। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘সাগরের রবিন হুড’ হিসেবে। কারণ তিনি ধনী বণিকদের সম্পদ লুট করে সেগুলো বিলিয়ে দিতেন গরীব বণীকদের মাঝে। পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারেও ফ্যাশন সচেতন ছিলেন তিনি। তার কোমরে সবসময় ঝুলতো চারটি পিস্তল। অনেকের কাছেই স্বপ্নময় এক চরিত্র ছিলেন এই স্যাম বেলামি। দেখতে দেখতে তার দস্যুবহরে সদস্য সংখ্যা দু’শতে গিয়ে ঠেকলো।

হোয়াইডাহ্‌র ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া রুপা; Source: Wikimedia Commons

১৭১৭ সালটা স্যামের জন্য ছিলো সত্যিই বিশেষ কিছু। এ বছরই তিনি ক্যারিবিয়ান সাগরের সবচেয়ে সম্পদশালী জাহাজ ‘দ্য হোয়াইডাহ গ্যালে’ দখল করতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী জলদস্যু। ততদিনে ম্যারিকে বিয়ে করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ এসে গিয়েছিলো তার হাতে। তাই এবার তিনি রওয়ানা দিলেন ম্যাসাচুসেটসের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ম্যারির সাথে বহুদিন পর দেখা করা, তাকে চিরতরে আপন করে নেয়া। কিন্তু বিধাতা এই জলদস্যুর কপালে তেমনটা লিখে রাখেন নি। পথিমধ্যে মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজ হোয়াইডাহ গ্যালে। সেই ঝড়ের কবল থেকে মাত্র দশজন নাবিকই জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিলো। স্যাম সহ বাকি সবাই সেদিন সাগরজলে ডুবে মারা যায়।

রাজকীয় ক্ষমা

ওদিকে হর্নিগোল্ড তখন অবস্থান করছিলেন নাসাউয়ে। একদিন শোনা গেলো রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে উডস রজার্স নামে নতুন একজন গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাহামাসে যার মূল লক্ষ্য দস্যুবৃত্তিকে সমূলে উৎপাটন করা। রজার্স নিজেও আগে প্রাইভেটিয়ার ছিলেন। রজার্স একা আসেন নি, তার সাথে ছিলো ব্রিটিশ নৌবাহিনী। এসেই তারা নাসাউ বন্দর এমনভাবে ঘিরে ফেলে যেন কেউ সেখান থেকে পালাতে না পারে।

রজার্সের মূর্তি; Source: badassoftheweek.com

জলদস্যুদের প্রতিনিধি হিসেবে হর্নিগোল্ড যান রজার্সের সাথে দেখা করতে। তাকে জানানো হয় ১৭১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বরের মাঝে যেসব জলদস্যু আত্মসমর্পন করবে, তাদের জন্য রয়েছে নিঃশর্ত ক্ষমা। আর যারা করবে না, তাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। হর্নিগোল্ডের জন্যও ছিলো বিশেষ সুযোগ। তাকে প্রস্তাব দেয়া হয় জলদস্যুদের ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিতে।

হর্নিগোল্ড এ প্রস্তাব লুফে নেন। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো অনেকেই দস্যুবৃত্তিকে চিরতরে বিদায় জানায়। এমনকি এই পথ থেকে সরে আসেন ব্ল্যাকবিয়ার্ডও। আসতে চান নি স্টিড বনেট। যে স্বপ্নকে পুঁজি করে তিনি ঘর ছেড়েছেন, সেই স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেটা তার ছিলো না।

বনেটের মতো এমন আরো অনেকেই ছিলো। এদের মাঝে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলেন চার্লস ভেন এবং তার কোয়ার্টারমাস্টার ক্যালিকো জ্যাক। জলদস্যুতাকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা তাদেরও ছিলো না। তাই তার খুঁজতে লাগলেন পালানোর পথ। এরপর তারা এমন এক কাজ করে বসলেন যা এখন শুধু সিনেমাতেই কল্পনা করা যায়। বিষ্ফোরকে পরিপূর্ণ এক জাহাজে আগুন ধরিয়ে তারা সেটি চালিয়ে দিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অবরোধের দিকে। দারুণ গোলযোগ লেগে গেলো চারদিকে। এই বিশৃঙ্খলার মাঝে সুযোগ বুঝে ভেন তার দলবল নিয়ে পালিয়ে গেলেন। এবার হর্নিগোল্ডের দায়িত্ব পড়লো ভেনকে ধরার।

দস্যু শিকার

ভেনের জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে পারে নি হর্নিগোল্ডের জাহাজ। তাই ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হয় তাকে। তবে আসার সময় তিনি এমন দশজন দস্যুকে ধরে আনেন যাদের সাথে ভেনের লেনদেন ছিলো। সেই দশজনকে ফাঁসি দেয়া হয়। এরপর হর্নিগোল্ডকে আবারো পাঠানো হয় ভেনের সন্ধানে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলতে হবে সাবেক এ দস্যু রাজার। কারণ এটাই ছিলো তার শেষ সমুদ্রযাত্রা। এক ঝড়ে সাঙ্গপাঙ্গসহ নিখোঁজ হয়ে যান হর্নিগোল্ড। এরপর আর কোনোদিনই তার দেখা কেউ পায় নি।

ওদিকে ভেন তখন যাত্রা করেছিলেন নর্থ ক্যারোলাইনার উদ্দেশ্যে, সেখানেই তখন অবস্থান করছিলেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। তিনি ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে প্রস্তাব দেন একজোট হয়ে নাসাউ পুনর্দখলের জন্য। কিন্তু এতে তেমন একটা সাড়া মেলে নি ব্ল্যাকবিয়ার্ডের পক্ষ থেকে। কয়েকদিন একসাথে মৌজমাস্তি করে অবশেষে বিদায় নেন ভেন। তাদের এ সাক্ষাতের বিষয়ে কোনোভাবে খবর পেয়ে যান ভার্জিনিয়ার গভর্নর। এতে নতুন করে জলদস্যুতার বিস্তারের আশঙ্কায় কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায় তার।

ব্ল্যাকবিয়ার্ড; Source: thewayofthepirates.com

এক রাতের কথা, ব্ল্যাকবিয়ার্ড আর তার দলের লোকেরা সবাই মাতাল হয়ে ঢুলছিলো। এমন সময় তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় ব্রিটিশ নৌবাহিনী। উপর থেকে নির্দেশ ছিলো সব দস্যুকে যেন মেরে ফেলা হয়। মারাত্মক যুদ্ধ হয় দু’পক্ষের মাঝে। শেষপর্যন্ত বিজয়ীর হাসি অবশ্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীই হাসে। কেটে টুকরো টুকরো করা হয় ব্ল্যাকবিয়ার্ডের দেহটি, ছিন্ন করা হয় মাথাটিও। এরপর সেটি ঝুলিয়ে রাখা হয় মাস্তুলে!

বিদ্রোহ

ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে পরাস্ত করে পালিয়ে থাকা এতটা সহজ ছিলো না। তারপরেও সেটি বেশ দক্ষতার সাথেই করে যাচ্ছিলেন চার্লস ভেন। একসময় ধরা পড়ে যান স্টিড বনেটও। ফাঁসিই হয় তার চূড়ান্ত নিয়তি।

বহিঃশত্রুর আক্রমণ ভেনের পতন ঘটায় নি, তার জন্য কাল হয়েছিলো নিজের দলের সদস্যরাই। এজন্য অবশ্য তার দোষও কম ছিলো না। বন্দী এবং অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে ভেনের ব্যবহার ছিলো খুব খারাপ। এতে তার দলের সদস্যরা খুব ক্ষিপ্ত ছিলো তার উপর। পাশাপাশি একবার এক ফরাসি জাহাজে আক্রমণ করতে না চাওয়াটা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয় সদস্যদের মনে। কোয়ার্টারমাস্টার ক্যালিকো জ্যাক র‍্যাকহাম এমনটা আর মেনে নিতে পারলেন না। সদস্যদের কাছে ভেনের পদচ্যুতির জন্য আবেদন জানালেন তিনি, সাড়াও মিললো অধিকাংশের। ফলে ছোট এক পাল তোলা জাহাজে করে বিদেয় করে দেয়া হয় ভেনকে।

চার্লস ভেন; Source: thewayofthepirates.com

নিজের দল আবারো নতুন করে গড়ার দিকে মনোযোগ দেন ভেন। কিন্তু এক ঝড় তার সেই পরিকল্পনায় বাগড়া বাধিয়ে দেয়, তাকে নিয়ে যায় হন্ডুরাসের এক দ্বীপে। সেখানে মাসখানেক থাকার পর এক উদ্ধারকারী জাহাজের সহায়তায় আবারো মানবজাতির দেখা পান ভেন। সেখানে উঠে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় তার পক্ষে ছিলো না এবার। কারণ সেই জাহাজে এমন এক ব্যক্তি ছিলো যাকে এককালে ভেন বন্দী হিসেবে রেখেছিলো। সেই লোকটি সাথে সাথেই ভেনকে চিনতে পারে এবং বন্দী করার ব্যবস্থা করে। এরপর ভেনকে ফিরিয়ে দেয়া হয় পোর্ট রয়্যালে। ১৭২০ সালের নভেম্বর মাসে ফাঁসির মাধ্যমে অবশেষে ভেনও চিরবিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।

নারী জলদস্যু অ্যান বনি

ক্যারোলাইনায় ধনী বাবার সাথে সুখ-শান্তিতেই থাকতেন অ্যান বনি। কিন্তু তবুও তার মনের ভেতর সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ঘুরে বেড়াতো, তিনি হতে চাইতেন অন্য কিছু। এই অন্য কিছু হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি বিয়ে করেন জলদস্যু জেমস বনিকে, যিনি এককালে একজন সাধারণ নাবিক ছিলেন। এরপর স্বপ্নকে ছুঁতে দুজনই রওয়ানা দেন নাসাউয়ের উদ্দেশ্যে।

অ্যান বনি; Source: thewayofthepirates.com

কিন্তু নাসাউয়ে পৌঁছে মন পরিবর্তন হয় জেমসের। তিনি তাই নাম লেখান ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে, উদ্দেশ্য জলদস্যু ধরা। স্বামীর এমন পরিবর্তনে বেজায় নাখোশ হন অ্যান। সরাইখানায় মদ গিলে অলস সময় কাটাতে থাকেন তিনি। সেখানেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় ক্যালিকো জ্যাক র‍্যাকহামের। একসময় তারা দুজন একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেন। র‍্যাকহাম জেমসকে প্রস্তাব দেন নির্ধারিত অর্থমূল্য দিয়ে অ্যানের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদের। কিন্তু এমনটা সহ্য হয় নি জেমসের। তিনি গিয়ে নালিশ জানিয়ে দেন গভর্নর উডস রজার্সের কাছে।

র‍্যাকহাম; Source: thewayofthepirates.com

রজার্স অ্যানকে নির্দেশ দেন তার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে। পাশাপাশি আর কখনো যেন তিনি এমন দুঃসাহস দেখাতে না পারেন সেজন্য শাস্তি হিসেবে জনতার সামনে তাকে উলঙ্গ করে বেত্রাঘাতের নির্দেশও দেয়া হয়। এমতাবস্থায় অ্যান আর র‍্যাকহাম মিলে নতুন পরিকল্পনা করলেন। এক জাহাজ চুরি করে তারা পালিয়ে যান নাসাউ থেকে, নতুন করে শুরু করেন দস্যু জীবন।

স্বামী-স্ত্রীর দস্যুপনা বেশ ভালোভাবেই চলতে থাকে। একসময় অ্যান গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তবে সন্তানের জন্য অ্যান দস্যুবৃত্তিকে ছাড়তে চান নি। তাই কিউবায় দস্যুবৃত্তির কাজ থেকে অবসর নেয়া এক দম্পতির কাছেই রেখে আসেন তাদের সন্তানকে।

একবার এক ডাচ জাহাজ আক্রমণ করে বেশ কয়েকজন নাবিককে নিজেদের দলে ভেড়ান তারা। সেই দলে এক মেয়ে ছিলো যার নাম ম্যারি রিড। তলোয়ার ব্যবহারে তার দক্ষতা মুগ্ধ করে অ্যানকে। ফলে অল্প সময়ের মাঝেই অ্যানের সাথে তার বেশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ম্যারি রিড; Source: thewayofthepirates.com

একবার এক জাহাজ দখলের আনন্দে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে ফেলেছিলো র‍্যাকহামের লোকেরা। ওদিকে রিড আর অ্যান এই ভয়ে ছিলো যে দস্যু শিকারীরা হয়তো তাদের আক্রমণ করে বসতে পারে। আর হলোও তাই। ক্যাপ্টেন বার্নেট তার বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালান তাদের উপর। অ্যান আর রিড যখন ডেকে তাদের মোকাবেলা করছিলেন, মাতাল পুরুষ দস্যুরা তখন প্রাণ বাঁচাতে কার্গোতে লুকিয়েছিলো। অ্যানের ভর্তসনাও তাদেরকে বের করে আনতে পারে নি সেখান থেকে। একসময় এতজনের সাথে আর পেরে উঠলেন না এ দুই নারী। তারা দুজনই আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন, ধরা পড়ে যায় তাদের পুরো দস্যু দলটিই।

র‍্যাকহাম আর তার পুরো দলের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। জেলে শেষবারের মতো অ্যানের সাথে যখন তার দেখা হয়েছিলো, তখন অ্যান তাকে বলেছিলেন, “তোমাকে এখানে দেখে আমার খারাপ লাগছে জ্যাক। কিন্তু সেদিন যদি তুমি পুরুষের মতো লড়তে, তাহলে আজ কুকুরের মতো ফাঁসিতে ঝুলতে হতো না।” মৃত্যুর পর র‍্যাকহামের পচতে থাকা মৃতদেহটি পোর্ট রয়্যালের একটি ফাঁসিকাষ্ঠে সবাইকে দেখানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো।

অ্যান আর রিড দুজনেরই বিচার হয়েছিলো। কিন্তু তারা দুজনই নিজেদের গর্ভবতী দাবি করায় তাদের প্রাণদণ্ড স্থগিত করা হয়। তারপরও খুব বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেন নি রিড। ১৭২১ সালের এপ্রিলে জ্বরে ভুগে জেলেই মৃত্যু হয় তার। আর অ্যানের ভাগ্যে যে কী ঘটেছিলো তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন- এমন কোনো প্রমাণ নেই। অনেকে ধারণা করে থাকেন, অ্যানের ধনী বাবা অর্থের বিনিময়ে অ্যানকে মুক্ত করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর মেয়েকে নিয়ে তিনি চলে যান সাউথ ক্যারোলাইনায়। সেখানে নতুন করে বিয়ে করে আবারো নতুন জীবন শুরু করেন অ্যান।

ফিচার ইমেজ- kinogallery.com

Related Articles