ইহুদীরা যখন ইউরোপ ছেড়ে দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে জমি কিনে নতুন নতুন বসতি স্থাপন করতে শুরু করে, তখন প্রথমদিকে আরবরা সেটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় আলিয়া (ইহুদী পুনর্বাসন) শেষে ফিলিস্তিনে বহিরাগত ইহুদীর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ৭০ হাজার। নতুন স্থাপিত বসতিগুলোতে তো বটেই, পুরাতন বসতিগুলো থেকেও স্থানীয় আরবদেরকে বহিষ্কার করে সেগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে থাকে ইহুদীরা। বসতিগুলোর নিরাপত্তার জন্য প্রথমে নিয়োগ করে গুপ্ত সংগঠন বার গিওরাকে এবং পরবর্তীতে হাশোমারকে, যাদের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আমাদের এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বগুলোতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিলে আরবরা নড়েচড়ে বসে। নিজেদের ভূমি দখল করে বহিরাগত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং ভিন্ন জাতির অধিবাসীদের জন্য আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করার সিদ্ধান্তটি স্থানীয় আরবদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে ক্রমবর্ধমান ইহুদী অভিবাসনের বিরুদ্ধে, ইহুদী বসতিগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এবং গোপন সশস্ত্র ইহুদী সংগঠনগুলোর দৌরাত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হতে থাকে। অনেক সময়ই এসব প্রতিবাদ রূপ নিতে শুরু করে দাঙ্গা এবং সংঘর্ষে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণে ছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু ১৯২০ সালের এপ্রিলে সংঘটিত আরব দাঙ্গার পর ইহুদীরা বুঝতে পারে, ব্রিটিশরাও তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেষ্ট না। ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদীদেরকে টিকে থাকতে হলে তাদেরকে গঠন করতে হবে আরো বড় এবং সুসংগঠিত একটি বাহিনীর, যার কাজ হবে সমগ্র ফিলিস্তিনের ইহুদী অধিবাসীদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। ফলে ১৯২০ সালের জুন মাসে হাশোমারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং সৃষ্টি করা হয় নতুন একটি সংগঠন ‘হাগানা‘ (Haganah, הַהֲגָנָה)। হাগানা শব্দটির অর্থ প্রতিরক্ষা।
আইনগতভাবে হাগানার মতো একটি সশস্ত্র প্রতিরক্ষাবাহিনী তৎকালীন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনস্থ ফিলিস্তিনে বৈধ ছিল না। কিন্তু তারপরেও ব্রিটিশরা হাগানার অস্তিত্ব এবং তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড একপ্রকার মেনে নেয়। শুরুর দিকে হাগানার কর্মকান্ডগুলো ছিল তাদের পূর্বসূরী হাশোমার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, আক্রমণাত্মক, কখনো সন্ত্রাসবাদী এবং কখনো ব্যক্তিগত প্রতিশোধমূলক। ১৯২১ সালের পহেলা মে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে জাফ্ফা শহরে ‘জিউইশ কমিউনিস্ট পার্টি’ একটি মিছিল বের করলে স্থানীয় আরবদের সাথে সংঘর্ষ হয়। পরবর্তীতে ইহুদী অভিবাসীদের হোটেলে আরবদের আক্রমণে ১৪জন ইহুদী নিহত হয়। হাগানার সদস্যরা ঐ ঘটনার পেছনে তৌফিক বে নামের এক আরব পুলিশ অফিসারকে দায়ী করে এবং তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে।
তৌফিক বের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে আরবদেরকে ঐ হোটেলে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিল। হাগানার নেতৃবৃন্দ তৌফিককে হত্যার জন্য একদল প্রশিক্ষিত ঘাতক নিয়োগ করে। দীর্ঘদিন অনুসন্ধানের পর তারা তৌফিককে খুঁজে বের করে এবং ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি তেল আবিবের রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ঘাতকদলের এক সদস্যের মতে, এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল আরবদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যে, ইহুদীদের উপর কোনো আক্রমণের কথা তারা সহজে ভুলবে না এবং দেরিতে হলেও তাদের দিন একদিন ঠিকই আসবে।
হাশোমারের মতোই হাগানাও তাদের জায়নবাদী লক্ষ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যেকোনো ইহুদীকে হত্যা করার ক্ষেত্রে পিছপা ছিল না। এরকম একজন ইহুদী ছিল জেরুজালেমে বসবাসরত জ্যাকব ডে হান, যে ছিল নেদারল্যান্ড থেকে আগত হারেদি গোত্রের ইহুদী। হারেদি হচ্ছে ইহুদীদের একটি গোঁড়া সম্প্রদায়, যারা বিশ্বাস করে যে, কেবলমাত্র ‘মেসাইয়াহ’ (মসিহ, যীশুখ্রিস্ট, হযরত ঈসা (আ)) এর পক্ষেই ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই সিদ্ধান্ত নিবেন কখন ইহুদীরা তাদের পূর্বপুরুষের ভূমিতে, তথা ফিলিস্তিনে ফিরতে পারবে। হারেদিদের মতে তাই ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাটা একটা ধর্মবিরোধী কাজ।
জ্যাকব ডে হান তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন না। তিনি এর পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। ধর্মে ইহুদী হলেও জায়নবাদের বিরোধিতা করায় হাগানার নেতারা জ্যাকব ডে হানের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সে সময় হাগানার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন সাবেক বার গিওরার প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইৎজাক বেন জাভি। তিনি জ্যাকব ডে হানকে জায়নবাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাকে হত্যার নির্দেশ দেন।
১৯২৪ সালের ১লা জুলাই জ্যাকবের লন্ডন সফরে যাওয়ার কথা ছিল ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করার জন্য প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আগেই জুনের ৩০ তারিখে হাগানার দুই গুপ্তঘাতক জ্যাকবকে গুলি করে হত্যা করে। সে সময় জ্যাকব জেরুজালেমের জাফ্ফা রোডের একটি সিনগগ (ইহুদীদের প্রার্থনালয়) থেকে সবেমাত্র প্রার্থনা সেরে বেরিয়ে আসছিলেন।
তবে হাগানার ইতিহাসের প্রথম এক দশকে এ ধরনের হত্যাকান্ডের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কারণ প্রতিষ্ঠার পরপরই, ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে হাগানার অপারেশনগুলো অনুমোদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হিস্টাডরাট (Histadrut) তথা জেনারেল ফেডারেশন অফ লেবারকে, যার নেতা ছিলেন ডেভিড বেন গুরিয়ন। সমসাময়িক অন্য অনেক ইহুদী নেতার তুলনায় বেন গুরিয়ন ছিলেন অনেক পরিণত, কৌশলী এবং বাস্তবাদী, যিনি প্রথমদিকে একান্ত প্রয়োজনীয় না হলে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ সমর্থন করতেন না।
বেন গুরিয়নের জন্ম ১৮৮৬ সালে, পোল্যান্ডে। ছোটকাল থেকেই তিনি বাবার জায়নবাদী আদর্শে বড় হয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে তিনি ফিলিস্তিনে আসেন এবং জাফ্ফাতে বসতি স্থাপন করেন। অধিকাংশ অভিবাসী ইহুদীর মতোই তিনিও ছিলেন একজন শ্রমিক, যিনি ক্ষেত থকে কমলা তোলার কাজ করতেন। ১৯০৯ সালে হাশোমার গঠিত হলে তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেখানে যোগ দেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিজের মেধা এবং দূরদর্শিতার বদৌলতে সমগ্র ইশুভের (ফিলিস্তিনে ইহুদী জনগোষ্ঠী) অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেন গুরিয়নের অবস্থান ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে, এবং সেই সুবাদে অটোমান সাম্রাজ্যের পক্ষে। তিনি অটোমানদের পক্ষ হয়ে লড়াই করার জন্য ১০,০০০ ইহুদী সদস্যের একটি বাহিনী গঠনের জন্যও কাজ করেছিলেন। কিন্তু বেলফোর ঘোষণার পর তার অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে যায়। বেন গুরিয়ন এবং তার সমমনা অন্যান্য ইহুদীরা পক্ষ পরিবর্তন করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধীনস্থ ‘জিউইশ লেজিয়ন’ ব্রিগেড গঠন করেন এবং ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বেন গুরিয়ন ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সহিংসতার পরিবর্তে তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে তার লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতি ক্ষমতাসীন ব্রিটিশদের সমর্থন আদায় করতে হলে তাদেরকে কিছুটা হলেও সহিংসতা পরিহার করে নিজেদেরকে মধ্যপন্থী এবং নমনীয় বাহিনী হিসেবে পরিচিত করতে হবে।
ডে হান হত্যাকান্ডের পর বেন গুরিয়ন এ ধরনের ব্যক্তি বিশেষের উপর টার্গেটেড হত্যা কিংবা গুপ্ত হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তিনি হাগানার অনিয়মিত, স্বেচ্ছাসেবী ঘোড়সওয়ার ঘাতকদেরকে প্রতিস্থাপন করে অনেকটা নিয়মিত এবং সাংগঠনিক আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করেন। এ সময় তিনি হাগানার অনেকগুলো হত্যাকান্ডের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এসব প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জেরুজালেমের মুফতি হাজ আমিন আল-হুসেইনি, স্থানীয় বেশ কিছু প্রভাবশালী আরব নেতা, এবং এমনকি ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার নামও।
সব ইহুদী নেতা অবশ্য বেন গুরিয়নের মতো বাস্তববাদী বা দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী ছিল না। তাদের অনেকেই ছিল সহিংস আক্রমণের মাধ্যমে আরব এবং ব্রিটিশদেরকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী। এরকম একজন ছিলেন ডে হানের হত্যাকারীদের একজন, আভ্রাহাম তেহোমি। ১৯৩১ সালে তিনি বেন গুরিয়নের মধ্যপন্থী নীতির বিরোধিতা করে হাগানা থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার অনুসারীদেরকে নিয়ে গঠন করেন উগ্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘ইরগুন‘।
ইরগুনের ভেতরেও বিভেদ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরগুনের ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করার নীতির বিরোধিতা করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় ততধিক উগ্র সন্ত্রাসবাদী একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন আভ্রাহাম স্টার্ন। তাদের গঠিত দলটি পরিচিতি পায় স্টার্ন গ্যাং তথা লেহি নামে, যাদের একটি অপারেশন নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম এই সিরিজের প্রথম পর্বে।
হাগানা থেকে উদ্ভূত এই দুটি সংগঠন ইরগুন এবং লেহি সমগ্র ত্রিশ এবং চল্লিশের দশক জুড়ে ফিলিস্তিনে আরব এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। বের গুরিয়ন প্রথমে হাগানাকে তাদের পথ অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখেন, কিন্তু চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের উপর নাৎসি বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
যে হাগানা প্রথমদিকে ছিল রাজনৈতিকভাবে জায়নবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী, সেই হাগানাকেই পরবর্তীকালে বেন গুরিয়ন পরিণত করেন পুরোদস্তুর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইসরায়েল, পরিচিতি লাভ করেন ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর এই হাগানাই রূপান্তরিত হয় ইসরায়েলের প্রধান প্রতিরক্ষা বাহিনী, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স তথা আইডিএফে। আর ডেভিড বেন গুরিয়ন হন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
তথ্যসূত্র: Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো:
(১) সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা, (২) উগ্র জায়নবাদের উত্থান, (৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস, (৫) নাৎসিদের উপর ইহুদী ব্রিগেডের প্রতিশোধ
ফিচার ইমেজ: segulamag.com