গত শতকের সত্তরের দশক, স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরের শক্তির দেয়াল ভাঙতে বদ্ধপরিকর। এজন্য গোয়েন্দাগিরিকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতো। গোয়েন্দাদের মধ্যে কেউ কেউ গোয়েন্দাগিরি করত আদর্শিক দিক থেকে, আবার কেউ করতো স্রেফ অর্থের বিনিময়ে। জন অ্যান্থনি ওয়াকার, আমেরিকান নৌবাহিনীর চিফ ওয়ারেন্ট অফিসার এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, ছিলেন শেষোক্ত ধরনের গোয়েন্দা। তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর শুধুমাত্র অর্থের লোভে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আমেরিকান নৌবাহিনীর লাখ লাখ ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন।
ওয়াকারের ছোটবেলা অর্থের কারণে অস্থিতিশীল ছিল। তার বাবার অতিরিক্ত অ্যালকোহল আসক্তি তাদের আর্থিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটায়। ফলে তিনি হাই স্কুলে থাকাবস্থায় চুরির দিকে পা বাড়াতেও দ্বিধা করেননি। চুরিতে ধরা খেয়ে পুলিশের কাছ থেকে জেল অথবা সামরিক বাহিনী বেছে নেওয়ার শর্তে জেল এড়ানোর জন্য মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যে সিদ্ধান্ত পরবর্তী দুই দশকে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫৫ সালের শেষের দিকে নৌবাহিনীতে রেডিও ম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে তার অধ্যবসায়, বুদ্ধিমত্তা এবং কর্মদক্ষতার জোরে মাত্র আট বছরের মধ্যে পেটি অফিসার, চীফ পেটি অফিসার থেকে ওয়ারেন্ট অফিসার বনে যান। ওয়ারেন্ট অফিসার থাকাবস্থায় ওয়াকার এক নিউক্লিয়ার মিসাইল সাবমেরিনের রেডিও ইউনিট সামলানোর দায়িত্ব পান। সেখানে তার হাতের উপর দিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর তথ্য আসা-যাওয়া করত। এখান থেকেই ওয়াকারের আবার পতন শুরু হয়। তিনি দক্ষিণ ক্যারোলিনায় একটি মদের বার খুললেন। বারের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ঋণে জর্জরিত ওয়াকার সোভিয়েতদের কাছে মার্কিন নৌবাহিনীর স্পর্শকাতর তথ্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে চীফ ওয়ারেন্ট অফিসার ওয়াকার এনক্রিপটেড মেসেজ ডিক্রিপ্ট করার ম্যানুয়াল KL-47 key list নিয়ে ওয়াশিংটনে সোভিয়েত দূতাবাসে হাজির হলেন। সেখানকার কেজিবি স্টেশন চীফ বরিস এ. সোলোমাটিন ওয়াকারের আনা নথিপত্র এবং অন্য একজন গোয়েন্দার আনা নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখলেন ওয়াকারের আনা ডকুমেন্ট আসল। এরপর তার সাথে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে আলাপ করে কেজিবি স্টেশন চীফ বুঝতে পারলেন- সে শুধু অর্থের জন্য এটা করছে, কমিউনিজমের প্রেমে পড়ে নয়, যা অনেকে নিয়োগদাতাকে প্রভাবিত করার জন্য বলে থাকে।
সোলোমাটিন তখনই ওয়াকারকে একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দিলেন, যা ছিল সোলোমাটিনের জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত। KL-47 key list ছিল সোভিয়েতের জন্য মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো, কেননা এর আগেও সোভিয়েত নৌবাহিনী মার্কিন নৌবাহিনীর কোডেড মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হতো, কিন্তু সেগুলো পড়তে সক্ষম হতো না, কেননা সেগুলো ছিল এনক্রিপটেড। ওয়াকারের দেওয়া ওই লিস্টি ছিল সেগুলো ডিক্রিপ্ট করার ক্ষেত্রে সোভিয়েতের জন্য অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করে ফেলা, বাকি অর্ধেক কাজ ছিল সাইফার মেশিন সংগ্রহ করা।
সেটি সোভিয়েতরা উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করে মার্কিন নৌবাহিনীর একটি গোয়েন্দা জাহাজ দখল করানোর মাধ্যমে। এভাবে মস্কো ওয়াকারের মাধ্যমে আমেরিকান নেভাল কমিউনিকেশনে পুরোপুরি প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞ পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ইউএসএস স্করপিয়ন ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সরবরাহ করা ওয়াকারের KL-47 key list-কে দায়ী করে থাকেন, যার মাধ্যমে সোভিয়েতরা মার্কিন সাবমেরিনটির গতিবিধি নজরদারি করতে পেরেছিল হেডকোয়ার্টার থেকে দেওয়া নির্দেশনা ডিকোড করার মাধ্যমে।
এভাবেই তিনি নিয়মিত ক্রিপ্টোগ্রাফিক কী, টেকনিক্যাল ম্যানুয়াল এবং অন্যান্য ফটোকপি ও ছবি তোলা নথিপত্র সোভিয়েত গোয়েন্দাদের সাথে ঠিক করা পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন স্থানে রেখে যেতেন, বিনিময়ে প্রচুর অর্থ পেতেন। মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ওয়াকার গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রায় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার কামিয়েছিলেন। তার দেওয়া গোপন নথির মাধ্যমে সোভিয়েতরা মার্কিন মিলিটারি অপারেশন্সের প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয় যার মধ্যে ছিল আমেরিকান গোয়েন্দা উপগ্রহের অভ্যন্তরীণ তথ্য থেকে শুরু করে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের অথেন্টিকেশন কোড এবং রাশিয়ান সাবমেরিন চিহ্নিত করার জন্য সাগরের তলদেশে রাখা সেন্সরের সম্পূর্ণ নির্ভুল অবস্থান।
একজন পক্ষত্যাগকারী উচ্চপদস্থ কেজিবি কর্মকর্তা ভিতালি ইউরশেনকোর মতে, “ওয়াকারের স্পাই রিং ছিল কেজিবির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন।” পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯৭৬ সালে নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে ওয়াকার একজন ব্যক্তিগত তদন্তকারীর আড়ালে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। এক্ষেত্রে, নৌবাহিনীতে থাকা তার বন্ধু, নৌবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ঠিকাদার ভাই আর্থার আর তার ছেলে মাইকেল, যে তখন বিমানবাহী রণতরীর একজন নাবিক, তাদের মাধ্যমে গোপন তথ্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি তার স্ত্রী এবং কন্যাকেও তার দলে ভেড়াতে চেয়েছিলেন, তবে তা ব্যর্থ হয়।
শেষমেষ ওয়াকারের সাবেক স্ত্রী, যে তার গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে অনেক বছর ধরে জানত, এবং তার মেয়ে এফবিআই-এর কাছে তার গোয়েন্দাগিরির বিষয়টি ফাঁস করে দেয়। এফবিআই ১৯৮৫ সালে তাকে তার ছেলে, ভাই এবং বন্ধুসহ গ্রেফতার করে। কৌসুলিদের সাথে ছেলে মাইকেলের জন্য কম সাজার শর্তে তিনি তার দোষ স্বীকার করে নেন এবং তদন্তকারীদের তার গোয়েন্দাগিরির আদ্যোপান্ত খুলে বলেন। বিচারে ওয়াকার এবং তার ভাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তার ছেলে মাইকেলের ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয়, এবং তার বন্ধুকে ৩৬৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় ওয়াকার এবং তার ভাই আর্থার মারা যান।