Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেফিয়্যাহ: ঐতিহ্যবাহী পোশাক থেকে প্রতিরোধের প্রতীক

ঐতিহ্যবাহী পোশাক তো বিশ্বের প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীরই আছে। কিন্তু কয়টা পোশাক দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়তে পারে সমগ্র বিশ্বে? বিশেষ করে সেই পোশাকটা যদি হয় কেবল পুরুষদের মাথায় পরিধান করার একটুকরো সাধারণ বস্ত্র?

বিশ্বের অনেক দেশেই মাথা ঢাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় বস্ত্র ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের কেফিয়্যাহর মতো জনপ্রিয় আর কোনোটি হতে পারেনি। বিশ্বের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কেফিয়্যাহ পরতে দেখা গেছে নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ম্যারাডোনা, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থেকে শুরু করে হালের জনপ্রিয় মডেল জিজি হাদিদ এবং বেলা হাদিদকে।

এবং এই কেফিয়্যাহ তারা নিছক ফ্যাশনের অংশ হিসেবে কিংবা ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যকে সম্মান দেখানোর জন্য পরেননি। পরেছেন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে। কারণ কেফিয়্যাহ শুধু ঐতিহ্যবাহী পোশাকই নয়, এটা একইসাথে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধের প্রতীক। ফিলিস্তিনের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় পতাকা

ফিলিস্তিনি শিশুদের সাথে কেফিয়্যাহ পরা অবস্থায় কিউবার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল ক্যাস্ট্রো; Image Source: Twitter

কী এই কেফিয়্যাহ?

কেফিয়্যাহ হচ্ছে একটি চারকোণা কাপড়, যা প্রধানত লেভান্ত তথা শাম অঞ্চলের মানুষরা মাথায় পরিধান করে। এই অঞ্চলের বাইরে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতেও অবশ্য মানুষ মাথা ঢাকার জন্য চারকোণা কাপড় ব্যবহার করে, কিন্তু রং এবং নকশার ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। প্রধানত ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত সাদা-কালো রঙের চেক বিশিষ্ট নকশার চৌকোনা কাপড়গুলোই কেফিয়্যাহ নামে পরিচিত।

কেফিয়্যাহ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত আছে। তবে ধারণা করা হয়, কেফিয়্যাহর আরবি কুফিয়্যাহ শব্দটি এসেছে ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত ইরাকের কুফা নগরীর নাম থেকে। শহরের নাম অনুসারে কাপড়ের নামকরণ খুব একটা বিরল না। মসুল থেকে মসলিন, আলেপ্পো থেকে আলেপাইন, বাগদাদ থেকে বালদাচিনের মতোই তাই কুফা থেকে কুফিয়্যাহর উৎপত্তির ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, শক্তিশালী কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও।

ঠিক কবে থেকে কুফাবাসী বা লেভান্তবাসীরা কেফিয়্যাহ পরিধান করে আসছে, সে ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। এক বর্ণনা অনুযায়ী, কেফিয়্যাহর প্রচলন শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দীতে আরব এবং পারস্য বাহিনীর মধ্যকার একটি যুদ্ধের সময় থেকে। বিখ্যাত আরব কবি এবং ইতিহাসবিদ ইউসুফ নাসেরের বর্ণনা অনুযায়ী, কুফা শহরের নিকটে সংঘটিত এই যুদ্ধে আরব যোদ্ধারা একে অপরকে চেনার জন্য উটের পশম থেকে তৈরি ইঘাল নামক একধরনের দড়ি দিয়ে মাথায় পরিধান করার কাপড় বেঁধে রেখেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও জয়ের স্মৃতি হিসেবে তারা এই কাপড় এবং দড়ি সংরক্ষণ করে রেখেছিল।

অবশ্য অন্য কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, এই যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই এই অঞ্চলে কেফিয়্যাহর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। এমনকি আজ থেকে ৫,০০০ বছর পূর্বে সুমেরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতার শাসকরাও সম্মানের প্রতীক হিসেবে মাথা ঢাকার জন্য কেফিয়্যাহর মতো কাপড় ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে অবশ্য কৃষক এবং বেদুইনরা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ থেকে মাথাকে রক্ষার জন্য এই পোশাককে আপন করে নেয়।

১৯৪৮ সালে তোলা ছবিতে সিরিয়ান শরনার্থী শিবিরে সাদা কেফিয়্যািহ পরা এক ফিলিস্তিনি শরনার্থী; Image Source: Adnanmuf

বিশ্বের অন্য অনেক দেশে টুপি বা হ্যাট জাতীয় মাথায় পরিধানের বস্ত্র ব্যবহার করা হলেও মধ্যপ্রাচ্যে যে এক টুকরো কাপড় ব্যবহার করা হয়, তার কারণ এই এলাকার বৃষ্টিপাতহীন শুষ্ক জলবায়ু, সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ এবং একইসাথে মরুঝড়। চৌকোণা এই কাপড় দিয়ে একদিকে যেমন মাথাকে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করা যায়, তেমনি মরুঝড়ের কবলে পড়লে নাকমুখ পেঁচিয়ে ধুলাবালি থেকেও নিজেকে রক্ষা করা যায়।

সম্ভবত কেফিয়্যাহর মতো মাথায় পরিধানের কাপড় লেভান্ত অঞ্চলের মানুষরা শতশত কিংবা হাজার হাজার বছর ধরেই পরিধান করে আসছে। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর কুফার ঐ যুদ্ধের কারণেই হয়তো কাপড়টি পরবর্তীতে কুফিয়্যাহ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

কেফিয়্যাহর বৈশিষ্ট্য এবং প্রকারভেদ

সাধারণত মাথায় পরিধানের জন্য ব্যবহৃত চারকোণা যেকোনো কাপড়কেই কেফিয়্যাহ বলা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রেও পুরুষরা মাথা ঢাকার জন্য চারকোণা বস্ত্র পরিধান করে, নকশা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে এদের ভিন্ন ভিন্ন নামও আছে

যেমন- সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোতে যে শুধু সাদা রঙের চারকোণা কাপড় মাথায় দেওয়া হয়, তাকে বলা হয় ঘুত্রা। অন্যদিকে সাদা-লাল চেক বিশিষ্ট মাথার কাপড়, যার ব্যবহার প্রধানত সৌদি আরব এবং জর্ডানে দেখা যায়, তাকে বলা হয় শেমাগ। ঘুত্রা এবং শেমাগকেও অনেক সময় তাদের সাধারণ নাম কেফিয়্যাহ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনি যে সাদাকালো ছককাটা নকশার কেফিয়্যাহ, সেটাকে সাধারণত অন্য কোনো নামে অভিহিত করা হয় না।

ফিলিস্তিনি কেফিয়্যাহর নকশা সাদাকালো ছককাটা হওয়ার পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। কিন্তু এই নকশা দ্বারা কী প্রকাশ পায়, অনেকেই তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে আছে মাছ ধরার জাল, মৌচাক এবং শস্যের মঁজরী। এছাড়াও অনেকে একে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবাদী জনতা কিংবা কাঁটাতারের বেড়ার সাথেও তুলনা করেছেন।

কেফিয়্যাহর নকশার বিভিন্ন অর্থ; Image Source: Twitter

অধিকাংশ কেফিয়্যাহর মাঝখানের বিশাল জায়গা জুড়ে মূল নকশাটা সাদাকালো ছককাটা হলেও দুই প্রান্তে একটু ভিন্ন ধরনের কারুকাজ দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দুই সারি রাস্তার মতো লম্বালম্বি চলে যাওয়া মোটা দুটো কালো দাগ, যার মাঝে থাকে পাখির ঝাঁকের মতো কিছু চিহ্ন। এই রাস্তার মতো দাগকে তুলনা করা হয় ফিলিস্তিনের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া প্রাচীন বাণিজ্য পথের সাথে, এবং পাখিঁর ঝাকের মতো চিহ্ণকে তুলনা করা হয় ফিলিস্তিনের জাতীয় বৃক্ষ জয়তুন গাছের পাতার সাথে।

ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালের কেফিয়্যাহগুলো সম্ভবত উলের তৈরি হতো। কিন্তু পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগে যখন প্রাচ্য থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সুতার আমদানি শুরু হয়, তখন থেকে কেফিয়্যাহগুলো অধিকতর আরামদায়ক সুতার কাপড় দ্বারা নির্মিত হতে শুরু করে।

সাধারণ চারকোণা কাপড়ের টুকরা হওয়ায় কেফিয়্যাহ সহজেই মাথা থেকে খুলে পড়ে যেতে পারে। সেজন্য ইগাল নামে পরিচিত একধরনের কালো রঙের দড়ি দিয়ে সেটাকে দুই প্যাঁচ দিয়ে মাথার উপর বেঁধে রাখা হয়। এই ইগাল তৈরি করা হয় ছাগলের অথবা উটের পশম থেকে। এবং কেফিয়্যাহ বেঁধে রাখা ছাড়াও এর আরও একাধিক ব্যবহার ছিল। ইগাল প্রধানত ব্যবহৃত হতো চাবুক হিসেবে, উটকে প্রহার করে তার চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং এর দুই পা একত্রে বেঁধে রাখার জন্য।

অবশ্য ইগাল ছাড়াও কেফিয়্যাহ পরা যায়। বিশেষ করে অনেককেই পাগড়ির মতো করে অথবা গলার চারপাশে পেঁচিয়ে কেফিয়্যাহ পরতে দেখা যায়। এছাড়াও কেফিয়্যাহর নিচে সাধারণত তাগিয়া নামে এক ধরনের সুতার কাপড়ের টুপি পরিধান করা হয়, যা একে মাথার সাথে শক্ত করে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

কেফিয়্যাহ এবং ইগাল; Image Source: desertcart.com

 

কেফিয়্যার রাজনীতিকরণ

শত শত বছর ধরে কেফিয়্যাহ ছিল ফিলিস্তিন এবং এর আশেপাশের এলাকার বেদুইন এবং কৃষকদের মস্তকাবরণ। শিক্ষিত, শহুরে, সম্ভ্রান্ত শ্রেণি সাধারণত কেফিয়্যাহ পরিধান করত না। অটোমান শাসনাধীনে থাকার কারণে তারা ছিল তুর্কি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। ফলে তারা পরিধান করত তুর্কি টুপি ফেজ। কেফিয়্যাহ ছিল কেবল সমাজের দরিদ্র শ্রেণির পোশাক। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমানদের পতন ঘটলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে শুরু করে।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফেজ পরিধান করা তুর্কিরা এবং স্থানীয় আরব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে। বিজয়ী ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নিলে সেখানকার ক্ষমতায় আসে যুদ্ধ জয়ে তাদেরকে সাহায্য করা আরব বেদুইনরা। এই আরবদের অনেকেই কেফিয়্যাহ পরিধান করত। ফলে তাদের মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেণির গণ্ডি পেরিয়ে কেফিয়্যাহ প্রবেশ করে রাজদরবারেও। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করেছিলেন মক্কার গভর্নর শেরিফ হুসেইন বিন আলি এবং ছেলেরা। তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত আরব বিদ্রোহের ফলেই ব্রিটিশরা সহজে অটোমানদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা তাই শেরিফ হুসেইনের এক ছেলেকে সিরিয়ার, এক ছেলেকে ইরাকের এবং অপর এক ছেলেকে জর্ডানের বাদশাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এসব এলাকাতেই পরে কেফিয়্যাহ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

যুদ্ধ শেষে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল বৃহত্তর সিরিয়ার অংশ। সে সময় সিরিয়ার বাদশাহ ছিলেন শেরিফ হুসেইনের তৃতীয় পুত্র, প্রিন্স ফয়সাল। ফয়সাল যে শুধুমাত্র সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনেই কেফিয়্যাহ পরিধান করতেন, তা-ই না। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময়ও তিনি কেফিয়্যাহ পরিধান করেন এবং একে আরব ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। সে সময় তার সফরসঙ্গীদেরকে, এমনকি তার মিত্র এবং উপদেষ্টা, ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা অফিসার টি.ই. লরেন্সকেও কেফিয়্যাহ পরিধান করতে দেখা যায়।

প্যারিসে কেফিয়্যাহ পরা অবস্থায় প্রিন্স ফয়সাল, টি.ই. লরেন্স এবং তাদের সফরসঙ্গীরা; Image Source: Wikimedia Commons

ফিলিস্তিনের বাইরে জর্ডানে লাল-সাদা ছককাটা কেফিয়্যাহর উত্থানের পেছনে সরাসরি ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিল। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর শুধু সাদা রংয়ের ঘুত্রা এবং ফিলিস্তিনের সাদাকালো কেফিয়্যাহর ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও জর্ডানে এ সময়ই প্রথমবারের মতো লাল-সাদা শেমাগের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যদিও এর আগেও সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজসহ অনেককে এ ধরনের কেফিয়্যাহ পরতে দেখা গেছে, কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এর ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত। ব্যাপকভাবে এটার প্রচলন ঘটান ট্রান্সজর্ডানের বেদুইন ডেজার্ট ফোর্সের প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশ অফিসার, স্যার জন ব্যাগট গ্লাব তথা গ্লাব পাশা। বিভিন্ন গোত্র থেকে আগত বেদুইনদের মধ্যে একত্ববোধ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি এই কেফিয়্যাহকে তার অধীনস্থ বেদুইন সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন।

সে সময় ডেজার্ট ফোর্সে এবং আরব লেজিয়নে যোগ দিতে পারাকে মর্যাদার বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো। ফলে লাল-সাদা কেফিয়্যাহ ধীরে ধীরে জর্ডানে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এখনও জর্ডানের রাজপরিবারের সদস্যদেরকে এই ধরনের কেফিয়্যাহ পরিধান করতে দেখা যায়। জর্ডানের বাইরেও ফিলিস্তিন এবং সৌদি আরবেও এই লাল-সাদা কেফিয়্যাহ তথা শেমাগ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

প্রতিরোধের প্রতীকে রূপান্তর

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত কেফিয়্যাহ ছিল আর দশটা সাধারণ ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মতো। কিন্তু ত্রিশের দশক থেকেই ব্রিটিশরা যখন ফিলিস্তিনে ইহুদিদেরকে এনে স্থান দিতে শুরু করে, তখন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে।

ফিলিস্তিনিদের এই আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা ছিলেন শেখ আইজুদ্দিন আল-কাসসাম। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি শহিদ হন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এবং পরের বছর জেরুজালেমের মুফতি হাজ আমিন আল-হুসেইনি যখন ‘ফিলিস্তিন দিবস’ ঘোষণা করে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন, তখন শুরু হয় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা আরব রিভোল্ট বা প্যালেস্টিনিয়ান গ্রেট রিভোল্ট নামে পরিচিতি পায়।

আরব রিভোল্টের সময় কেফিয়্যাহ পরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা; Image Source: https://www.jewishvirtuallibrary.org/

এই বিদ্রোহে সকল শ্রেণির ফিলিস্তিনিরা অংশগ্রহণ করে। এবং ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষের সময় তারা নিজেদের চেহারা ঢাকার জন্য কেফিয়্যাহ ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন কেফিয়্যাহর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তখন বিদ্রোহীরা ছাড়াও সর্বস্তরের ফিলিস্তিনি জনগণ কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করে, যেন ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে না পারে। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই সাধারণ ঐতিহ্যবাহী একটুকরা কাপড় থেকে কেফিয়্যাহ হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনিদের ঐক্য, বিদ্রোহ, জাতীয়তাবাদ এবং প্রতিরোধের প্রতীক।

সময়ের সাথে সাথে কেফিয়্যাহর ব্যবহার এবং জনপ্রিয়তা কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে। বিশেষ করে ষাটের দশক থেকে ইয়াসির আরাফাতের হাত ধরে এটা আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর দুই ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ফিলিস্তিনি যুবকরা আবারও নিজেদের পরিচয় গোপন করে ইসরায়েলি সেনাদের উপর আক্রমণ করার জন্য কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করে। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে ফিলিস্তিনের পতাকা নিষিদ্ধ করে রাখার কারণেও কেফিয়্যাহর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। কেফিয়্যাহ হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনের বিকল্প জাতীয় পতাকা। 

কেফিয়্যাহর আন্তর্জাতিক পরিচিতি

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেফিয়্যাহ পরিচিত হয়ে ওঠে ষাটের দশক থেকে, প্রধানত ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতের মাধ্যমে। আরাফাত প্রায় কখনোই সাদা-কালো কেফিয়্যাহ ছাড়া মাথায় অন্য কিছু পরতেন না। কেফিয়্যাহ হয়ে উঠেছিল তার এবং সেই সুবাদে ফিলিস্তিনের অনন্য প্রতীক। তিনি সব সময় কেফিয়্যাহর একটা দিক এমনভাবে ভাঁজ করে বুকের উপর এনে রাখতেন, যার ত্রিভুজাকৃতিকে ফিলিস্তিনের মানচিত্রের মতো দেখাতো।

ফিলিস্তিনের মানচিত্রের মতো করে কেফিয়্যাহ পরা ইয়াসির আরাফাত; Image Source: vanityfair.com

ইয়াসির আরাফাত নিজে বাম ধারার রাজনৈতিক সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। এবং সে সময় বিশ্বব্যাপী বামপন্থী সংগঠনগুলোর সাথে তার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। তার মাধ্যমেই মূলত বিশ্বব্যাপী বামপন্থী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কেফিয়্যাহ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ সময় থেকেই ইউরোপের বামপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এবং ফ্যাশনের অংশ হিসেবে কেফিয়্যাহ পরতে শুরু করে

প্রাচীনকাল থেকে কেফিয়্যাহ মূলত পুরুষদেরই মস্তকাবরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের বিখ্যাত নারী গেরিলা লায়লা খালেদ যখন একটি মার্কিন বিমান ছিনতাই করেন, তখন হিজাবের আদলে কেফিয়্যাহ পরা তার কয়েকটি ছবি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এরপর থেকে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে নারীরাও এটা পরিধান করতে শুরু করে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কেফিয়্যাহর ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পায় দুই ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে আয়োজিত মিছিল-সমাবেশগুলোর মধ্য দিয়ে। সর্বশেষ এ বছর মে মাসেও আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে আয়োজিত মিছিলগুলোতে কেফিয়্যাহর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে। বিশেষ করে মার্কিন তারকা জিজি হাদিদ এবং বেলা হাদিদের কেফিয়্যাহ পরা ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গেছে।

হিজাবের আদলে কেফিয়্যাহ পরা ফিলিস্তিনি নারী গেরিলা লায়লা খালেদ; Image Source: AFP

 

কেফিয়্যাহর অন্যান্য ব্যবহার এবং তার প্রভাব

ফিলিস্তিনে সাদা-কালো কেফিয়্যাহ প্রধানত ফাতাহর সদস্য এবং সমর্থকদের মধ্যেই বেশি জনপ্রিয়। বিপরীতে বিভিন্ন মার্ক্সিস্ট গ্রুপ, যেমন পিএফএলপির সদস্যদেরকে অনেক সময়ই লাল-সাদা কেফিয়্যাহ পরতে দেখা যায়। অন্যদিকে হামাসের সদস্যদেরকে সাদাকালো এবং লাল-সাদার পাশাপাশি সবুজ রংয়ের কেফিয়্যাহও পরতে দেখা যায়।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেফিয়্যাহ মূলত ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার পর পশ্চিমা বিশ্ব কেফিয়্যাহকে সন্ত্রাসের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে দেখতে শুরু করে, যেহেতু ওসামা বিন লাদেনসহ আল-কায়েদার অনেক নেতাও কেফিয়্যাহ পরতে পছন্দ করতেন। তাদের এই নেতিবাচক ধারণা আরও বৃদ্ধি পায় যখন আল-কায়েদা ইন ইরাক, আল-শাবাবসহ বিভিন্ন জিহাদী সংগঠনের সদস্যরা কেফিয়্যাহ দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় ভিডিও বার্তা প্রকাশ করতে শুরু করে।

সুদানে অবস্থান কালে কেফিয়্যাহ পরা ওসামা বিন লাদেন; Image Source: The Independent

বাস্তবে অবশ্য হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত কেফিয়্যাহর সাথে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন তো বটেই, এমনকি ইসলাম ধর্মেরও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই। কেফিয়্যাহ ইসলামিক বা আরব পোশাকও না। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই, এমনকি আরবরা ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক জয় করার আগে থেকেই কেফিয়্যাহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কেফিয়্যাহ মূলত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মস্তকাবরণ, যা সময়ের সাথে পরিণত হয়েছে প্রতিরোধের প্রতীকে। এবং পশ্চিমা বিশ্বের সরলীকরণের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কেফিয়্যাহর জনপ্রিয়তা হ্রাস না পেয়ে বরং সময়ের সাথে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা যুবক-যুবতীদেরকেও এখন ফ্যাশনের অনুসঙ্গ হিসেবে কেফিয়্যাহ পরিধান করতে দেখা যায়।

একসময় কেফিয়্যাহ শুধুমাত্র ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য আরব দেশেই তৈরি হতো। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারা বিদেশেও কেফিয়্যাহ রপ্তানি করতে পারত। কিন্তু পরপর দুটি ইন্তিফাদার পর কেফিয়্যাহর জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর অন্যান্যরাও তা তৈরি করতে শুরু করে। এবং বর্তমানে চীন এত স্বল্পমূল্যে কেফিয়্যাহ তৈরি করছে যে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ফিলিস্তিনের কারখানাগুলো আর টিকে থাকতে পারছে না।

পাঁচ দশক আগে ফিলিস্তিনে যেখানে অন্তত ৩০টি কেফিয়্যাহ তৈরির কারখানা ছিল, সেখানে এখন টিকে আছে মাত্র একটি কারখানা- দখলকৃত পশ্চিম তীরের হেবরন তথা আল-খালিল শহরের হিব্রাউই কারখানা। ১৯৯০ সালেও যেখানে তারা ১৬টি মেশিনে দিনে ৭৫০টি করে কেফিয়্যাহ তৈরি করত, সেখানে এখন তারা মাত্র দুটি মেশিনে সপ্তাহে ৩০০টি করে কেফিয়্যাহ তৈরি করে। 

কেফিয়্যার জনপ্রিয়তা তাই এক অর্থে অর্থনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনিদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে বিশ্বব্যাপী যে বিপুল সংখ্যক মানুষ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে গিয়ে কেফিয়্যাহ পরিধান করে মিছিল-সমাবেশে যোগদান করছে, সেই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল করছে, সেগুলো দেখে অন্য অনেকেও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম নিয়ে জানতে আগ্রহী হচ্ছে, সেগুলো বিবেচনা করলে ফিলিস্তিনের জন্য কেফিয়্যাহর অবদান কম না। শুধু ফ্যাশন হিসেবে কেফিয়্যাহ পরিধান করলে হয়তো তেমন কোনো লাভ নেই, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে কেফিয়্যাহ পরিধান করাটা সাংস্কৃতিক লড়াইয়েরই একটা অংশ।

This article is in Bangla language. It's about the history of the Palestinian headdress, Keffiyeh. All the references are hyperlinked inside the text.

Featured Image: AFP

Related Articles