ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নাম শোনে নি, এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপে জন্ম নেয়া শিশুটিই এককালে হয়ে উঠেছিলো একটি দেশের সম্রাট। ১৮০৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর প্রথম মেয়াদে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরবর্তীতে আবার ১৮১৫ সালে কিছুদিনের জন্য সম্রাট হন নেপোলিয়ন।
নেপোলিয়ন কী করেছেন বা তিনি কে ছিলেন, এটা যদি কেউ না জানে, তবুও তার নানা উক্তি আমাদের ঠিকই পড়া লেগেছে বাংলা ও ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রের নানা রচনা আর অনুচ্ছেদের কারণে। স্কুল-কলেজ জীবন শেষ করেছি অনেক দিন হলো। এখনো মনে পড়ে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পড়ার সময় রচনার জন্য বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির বাণী খুঁজতাম। এগুলোর মাঝে নেপোলিয়নের বাণীগুলো বেশ প্রচলিত ছিলো। ‘শ্রমের মর্যাদা’ অথবা ‘অধ্যবসায়’ পড়ার সময় পড়তাম- ‘Impossible is a word to be found only in the dictionary of fools’। ‘সংবাদপত্র’ রচনায় এর ভয়াবহ দিক নিয়েও ছিলো তাঁর উক্তি- ‘Four hostile newspapers are more to be feared than a thousand bayonets’। এছাড়া বিভিন্ন সময়ই ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ছবির সাথে ক্যাপশন দেখেছি- ‘A picture is worth a thousand words’, যা আসলে নেপোলিয়নেরই উক্তি।
চমৎকার, উদ্দীপনামূলক এসব উক্তির জনক নেপোলিয়নের জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে খুবই কষ্টের মাঝে। বন্দী করার পর তাকে আটলান্টিক মহাসাগরের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এখানেই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ১৮২১ সালের ৫ মে মারা যান তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ফ্রাঙ্কোইস কার্লো অ্যান্টোম্মার্চি ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ হিসেবে পাকস্থলীর ক্যান্সারের কথা জানান। পরবর্তীতে অবশ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয় যেখানে দাবি করা হয় যে, ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার পানীয়র সাথে আর্সেনিক প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে তাকে খুন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালের দিকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে বলা হয় পেপটিক আলসার ও গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারই নেপোলিয়নের মৃত্যুর কারণ।
আমাদের আজকের কাহিনী শুরু হচ্ছে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর থেকেই। সেই সাথে মনে রাখুন তার চিকিৎসকের নামটি- ফ্রাঙ্কোইস কার্লো অ্যান্টোম্মার্চি।
ডাক্তার ফ্রাঙ্কোইস কার্লো অ্যান্টোম্মার্চি ১৭৮০ সালের ৫ জুলাই ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপের মর্সিগ্লিয়া কমিউনে জন্ম নেন। ১৮১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হওয়ার নিয়োগপত্র পান। এরপরই তিনি চলে যান সেখানে। নেপোলিয়নের মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রে অ্যান্টোম্মার্চির দক্ষতায় খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না নেপোলিয়ন। ফলে বেশ কয়েকবারই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন তিনি। আচ্ছা, একবার চিন্তা করুন তো- আপনার অফিসের বস যদি আপনাকে বারবার বলে, “You are fired!”, কিন্তু তবুও দুর্ব্যবহার করে আপনাকে রেখেই দেয়, তাহলে তার প্রতি কি আপনার কোনো শ্রদ্ধাবোধ অবশিষ্ট থাকবে? শেষের এ কাল্পনিক অংশটুকুর কথা মাথায় রাখুন।
ময়নাতদন্তের টেবিলে পড়ে আছে নেপোলিয়নের নিথর দেহ। সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নেপোলিয়নের বাড়িতেই সারা হয়েছিলো এ আনুষ্ঠানিকতা। সেদিন লাশটির চারদিকে ছিলেন মোট ১৭ জন মানুষ। এদের মাঝে ছিলেন কয়েকজন ব্রিটিশ ও ফরাসী কর্মকর্তা, ৭ জন ব্রিটিশ ডাক্তার, নেপোলিয়নের দুজন সহকারী, ফাদার আঞ্জে ভিগনালি এবং আলী নামক এক ভৃত্য। এদের সকলের সামনেই নেপোলিয়নের যকৃৎ, পাকস্থলী ও পুরুষাঙ্গ (!) কেটে ইথাইল অ্যালকোহল ভর্তি এক জারে রাখলেন অ্যান্টোম্মার্চি। অনেকেই অবশ্য ধারণা করেন যে, অ্যান্টোম্মার্চি ইচ্ছে করে পুরুষাঙ্গটি কাটেন নি। বরং দুর্ঘটনাবশতই ওটা কেটে যায়। আবার অনেকেই অ্যান্টোম্মার্চির প্রতি নেপোলিয়নের পুরনো বিদ্বেষের গন্ধও এখানে খুঁজে পান। আসল কারণ যা-ই হোক, যা যাওয়ার তা তো গেলোই!
নেপোলিয়নের জীবনী লেখক রবার্ট অ্যাসপ্রে অবশ্য দাবি করেছেন অন্য কথা। তার মতে, অ্যান্টোম্মার্চি আর ভিগনালি হয়তো লাশটি নিয়ে কিছু সময় আলাদা থাকতে পেরেছিলেন। তখনই এ ঘটনাটি ঘটতে পারে। ওদিকে ১৮৫২ সালে প্রকাশিত এক স্মৃতিকথায় আলী জানায় যে, সেদিন ময়নাতদন্তের এক ফাঁকেই সে এবং ভিগনালি নেপোলিয়নের শরীরের কিছু অংশ কেটে ফেলে। এ ‘কিছু অংশ’ কি নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গকেও বোঝাচ্ছে কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত না। তবে অনেকের মতে এ সময়ই আসলে ওটা কাটা হয়ে গিয়েছিলো।
ওদিকে নেপোলিয়নের ময়নাতদন্তের কিছু সময় পরই প্যারিসে গুঁজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ডাক্তারের সহকারীরা রক্তাক্ত বিছানার চাদর, দাঁত, নেইল ক্লিপিং, পাঁজরের কিছু টুকরা, চুলের গোছা এবং নাড়ী-ভুড়ি গোপনে সরিয়ে ফেলেছে। অ্যান্টোম্মার্চি নিজেও নেপোলিয়নের ডেথ মাস্ক ও অন্ত্রের দু’টুকরো নিয়ে সটকে পড়েন। তিনি এগুলো লন্ডনে তার বন্ধুদের কাছে রেখে যান।
আবার ফিরে আসা যাক ভিগনালির কাছে। নেপোলিয়নের শেষকৃত্যানুষ্ঠান তিনিই পরিচালনা করেছিলেন। উইল মারফত তিনি ১,০০,০০০ ফ্রাঙ্ক লাভ করেন। এছাড়া সম্রাটের ছুরি, কাটা চামচ, একটি রুপার কাপ এবং আরো কিছু ব্যক্তিগত জিনিসও তিনি পান। প্রায় দু’দশক পর ব্রিটিশ সরকার নেপোলিয়নের দেহটি (অথবা দেহাবশেষ) প্যারিসে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়। আর তখনই এক অকাজ করে ভিগনালির আত্মীয়-স্বজনেরা। তারা নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গটি রেখে দেয় নিজেদের কাছে!
১৯১৬ সাল পর্যন্ত নেপোলিয়নের ব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি ও শরীরের অংশবিশেষ ভিগনালির বংশধরদের কাছেই থাকে। ১৯১৬-তে তারা এগুলো নিলামে তোলে। সেখানে নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গের ক্যাটালগে লেখা ছিলো, ‘A mummified tendon taken from [Napoleon’s] body during postmortem’। এক ব্রিটিশ বইয়ের ফার্ম সেগুলো কিনে নেয়। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে তারা এগুলো ফিলাডেলফিয়ার এ.এস.ডব্লিউ. রোসেনবাকের কাছে ২,০০০ ডলারে বিক্রি করে দেয়। এর কয়েক বছর পর রোসেনবাক নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ ফ্রেঞ্চ আর্টে চমৎকার নীল রঙের মরক্কো চামড়া (ছাগলের ছাল থেকে তৈরি নরম, পাকা চামড়া) ও মখমলের চাদরে পুরুষাঙ্গটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। তৎকালীন এক পত্রিকা এ নিয়ে লিখেছিলো, ‘In a glass case [spectators] saw something looking like a maltreated strip of buckskin shoelace or shriveled eel’।
১৯৬৯ সালে সংগ্রহগুলো নিয়ে আসা হয় লন্ডনে। কিন্তু নেপোলিয়নের পুরুষাঙ্গটি তখন বিক্রি হয়নি। আট বছর পর প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক নিলাম থেকে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. জন কে. ল্যাটিমার প্রায় ২,৯০০ ডলারে পুরুষাঙ্গটি কিনে নেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় একজন ইউরোলজিস্ট। কলাম্বিয়া প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতাল থেকে এক্স-রে করে তিনি নিশ্চিত হয়ে নেন যে, এটি আসলেই একটি পুরুষাঙ্গ। এরপর তিনি এটি নিয়ে চলে আসেন নিউ জার্সিতে তার বাসায়। সেখানে ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এটি তার খাটের নিচে রাখা সুটকেসেই বন্দী ছিলো। পরবর্তীতে তার মেয়ে এটি বিক্রির জন্য ১,০০,০০০ ডলার দাবি করেন। এটি তিনি শুধু লেখক Tony Perrottet-কেই দেখিয়েছেন যিনি দেখার পর বলেছেন, ‘Certainly small, shrunken to the size of a baby’s finger, with white shriveled skin and desiccated beige flesh’।