![](https://assets.roar.media/assets/FC5WT9sNkNIATSuU_1.jpg?w=1200)
১৪ ডিসেম্বর, ১৯১৭। রাত ৩টা বেজে ১ মিনিট। ইয়াসি রেল স্টেশন, ইয়াসি, রোমানিয়া। এই সময়ে স্টেশনটিতে জনমানবের চিহ্ন থাকার কথা নয়, কিন্তু এই দিনটি ব্যতিক্রম। রোমানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও অর্থবিষয়ক কর্মকর্তারা স্টেশনটিতে জড়ো হয়েছেন। ২৫টি বগিযুক্ত একটি বিশেষ ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে, যেকোনো মূহুর্তে রওনা হওয়ার প্রতীক্ষায়। এই ২৫টি বগির ৪টিতে রয়েছে বিশেষভাবে বাছাইকৃত ২০০ জন রোমানীয় সৈন্য। এরা সবাই রোমানীয় আধা–সামরিক বাহিনী ‘জান্ডার্মেরিয়া রোমানা’র (Jandarmeria Romãnâ) বিশেষ সদস্য। এদের দায়িত্ব হচ্ছে, বাকি ২১টি বগিতে থাকা জিনিসপত্র পাহারা দেয়া।
ট্রেন ছেড়ে দিল। স্টেশনে থাকা রোমানীয় কর্মকর্তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। পূর্বদিকে রওনা হওয়া ট্রেনটির গতিপথের দিকে তাকিয়ে তারা ভাবলেন, রোমানিয়ার জাতীয় সম্পদ অস্ট্রো–জার্মান হানাদারদের হাতে পড়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। সেদিন সেই স্টেশনে থাকা কর্মকর্তাদের কেউই ধারণা করতে পারেননি যে, রোমানিয়া তার জাতীয় সম্পদ আর কখনোই ফিরে পাবে না।
রোমানীয় ট্রেজার (Tezaurul României) ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুত হারানো ট্রেজারগুলোর একটি। অদ্ভুত, কারণ অন্যান্য হারানো ট্রেজার কোথায় আছে সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু রোমানীয় ট্রেজার কোথায় আছে সেটা সবাই জানে। সমস্যা হলো, এই ট্রেজার উদ্ধার করার কোনো উপায় নেই। কোথায় আছে এই ট্রেজারটি? থাকবে আর কোথায়, আছে সেই প্রাচ্যীয় বরফের দেশে, যেখানে ড্রাগন জমেই গোরিনিচ, দানব অমর কোশ্চেই, ডাইনি বাবা ইয়াগা আর জাদুকরী ভাসিলিসাদের আস্তানা। সহজ বাংলায়, রোমানীয় ট্রেজার এখন রয়েছে রাশিয়ায়।
![](https://assets.roar.media/assets/6D27sDqxg1wg17Vo_583px-Tesaurul_de_la_Petrosa.jpg)
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়, তখন মিত্রশক্তির (Allied Powers) অংশ ছিল রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সার্বিয়া, বেলজিয়াম, মন্টিনিগ্রো ও জাপান, আর তাদের বিরুদ্ধে থাকা কেন্দ্রীয় শক্তির (Central Powers) অংশ ছিল জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি। উভয় পক্ষই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে নিজেদের দলে আনার প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে ১৯১৪ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও ১৯১৫ সালে বুলগেরিয়া কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগ দেয়। অন্যদিকে, বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়। এই রাষ্ট্রগুলোর একটি ছিল রোমানিয়া।
১৮৬৬ সালে হোহেনজোলার্ন রাজবংশ রোমানিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। হোহেনজোলার্ন রাজবংশের আরেকটি শাখা ছিল জার্মানির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই রোমানিয়ার শাসকরা ছিলেন জার্মানপন্থী। ১৮৭৭–১৮৭৮ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধের সময় রোমানিয়া রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করে এবং যুদ্ধের শেষে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৮৩ সালে রোমানিয়া জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও ইতালির সমন্বয়ে গঠিত ‘ত্রিপক্ষীয় মৈত্রীজোটে’র (Triple Alliance) সঙ্গে একটি গোপন সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রোমানিয়া নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তি উভয়পক্ষই রোমানিয়াকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। মিত্রশক্তি রোমানিয়াকে অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির জাতিগত রোমানীয়–অধ্যুষিত ট্রান্সিলভেনিয়া অঞ্চলটি প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ১৯১৬ সালে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় ও জার্মানদের বিরুদ্ধে রুশদের সাফল্য রোমানীয় নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধে মিত্রশক্তির সম্ভাব্য সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী করে তোলে।
![](https://assets.roar.media/assets/HflcBm8uvFFmzqPy_513px-WWI_Poster_Rumania.jpg)
ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ সালের ২৭ আগস্ট রোমানিয়া অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর দু’দিনের মধ্যে জার্মানি, বুলগেরিয়া ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য রোমানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং রোমানিয়া নিজেকে কয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধরত অবস্থায় আবিষ্কার করে। প্রাথমিকভাবে রোমানীয় সৈন্যরা ট্রান্সিলভেনিয়ায় সাফল্য অর্জন করলেও দ্রুত জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা রোমানিয়ার অধিকাংশ ভূমি এবং বুলগেরীয় সৈন্যরা জাতিগত বুলগেরীয়–অধ্যুষিত উত্তর দব্রুজা দখল করে নেয়। ১৯১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জার্মান সৈন্যরা রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট দখল করে নেয় এবং রোমানীয় সরকার বুখারেস্ট থেকে ইয়াসিতে পশ্চাৎপসরণ করে।
এমতাবস্থায় সমগ্র রোমানিয়া কেন্দ্রীয় শক্তির দখলে চলে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং রোমানিয়ার সমস্ত অর্থসম্পদ বিদেশি শত্রুদের হস্তগত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে রোমানীয় সরকার রোমানিয়ার জাতীয় ব্যাংকের রিজার্ভসহ অন্যান্য জাতীয় সম্পদ কোনো মিত্র রাষ্ট্রের কাছে আমানত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। জার্মান সৈন্যরা বুখারেস্ট দখল করার দুদিন পর ১৯১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর রুমানিয়ার অর্থমন্ত্রী এমিল কোস্তিনেস্কু আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং এই প্রসঙ্গে ফ্রান্সের উদাহরণ টেনে আনেন। সেসময় জার্মান সৈন্যরা ফ্রান্সের একাংশ দখল করে রেখেছিল এবং ফরাসি সরকার তাদের জাতীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমানত রেখেছিল।
দুই দিন ধরে রোমানীয় মন্ত্রীপরিষদ এই বিষয়ে আলোচনা করে। তারা রোমানিয়ার জাতীয় সম্পদ ব্রিটেনে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করার সম্ভাবনা বিবেচনা করে, কিন্তু সেসময় মধ্য ইউরোপের অধিকাংশ ছিল কেন্দ্রীয় শক্তির দখলে এবং এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে এই ট্রেজার ব্রিটেনে পাঠানো সম্ভব ছিল না। সমুদ্রে জার্মান ডুবোজাহাজের দৌরাত্ম্যের কারণে সমুদ্রপথে এই ট্রেজার ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করাও সম্ভব ছিল না। এজন্য রোমানীয় সরকার প্রতিবেশী মিত্র রাষ্ট্র রাশিয়ার কাছে রোমানীয় ট্রেজার আমানত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
![](https://assets.roar.media/assets/AZB4TgGholgqNM9K_640px-Falkenhayn%27s_cavalry_entering_Bucuresti_on_December_6%2C_1916.jpg)
তা সত্ত্বেও রোমানীয় ব্যাঙ্কার মরিসিউ ব্লাঙ্ক রোমানীয় প্রধানমন্ত্রী ইয়ন ব্রাতিনাউকে ব্রিটেন কিংবা কোনো নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের (যেমন: ডেনমার্ক) কাছে রোমানীয় ট্রেজার আমানত রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু ব্রাতিনাউ যুক্তি দেখান যে, ডেনমার্কে রোমানীয় ট্রেজার প্রেরণ করলে পথিমধ্যে জার্মান সৈন্যরা সেটি দখল করে নিতে পারে, কারণ উত্তর ইউরোপেও জার্মানির যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি আরো যুক্তি দেখান যে, রোমানীয় ট্রেজার আমানত রাখার জন্য ব্রিটেনকে বেছে নেয়া হলে রাশিয়া অসন্তুষ্ট হতে পারে।
১৯১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর রোমানিয়ায় নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত জেনারেল আলেক্সান্দর মাসোলভ রোমানীয় সরকারকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন যে, রুশ সরকার যুদ্ধ চলাকালে রোমানিয়ার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিরাপদে রাখবে এবং যুদ্ধ শেষে রোমানিয়ার নিকট প্রত্যর্পণ করবে। ১২ ডিসেম্বর রোমানীয় মন্ত্রীপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে রোমানীয় ট্রেজার রাশিয়ার কাছে গচ্ছিত রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।
১৪ ডিসেম্বর ইয়াসি রেল স্টেশনে একটি বিশেষ ট্রেনের ২১টি বগিতে রোমানিয়ার জাতীয় ব্যাঙ্কের সম্পূর্ণ স্বর্ণমজুদ এবং রুমানিয়ার রাণীর সমস্ত অলঙ্কার উত্তোলন করা হয়। ১,৭৩৮টি বাক্সে থাকা এই সম্পদগুলো ছিল স্বর্ণখণ্ড, স্বর্ণমুদ্রা ও অলঙ্কারের আকারে। এখানে থাকা স্বর্ণখণ্ড ও স্বর্ণমুদ্রাগুলোর মূল্য ছিল তৎকালীন রোমানীয় মুদ্রায় ৩১,৪৫,৮০,৪৫৭ লিউ এবং অলঙ্কারগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ৭০ লক্ষ লিউ। ট্রেনটিতে সর্বমোট ১২০ টন স্বর্ণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। ট্রেনটির নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল ২০০ বিশেষ রোমানীয় আধা–সামরিক সৈন্য।
ট্রেনটি ছাড়ার পূর্বে রাশিয়া ও রোমানিয়ার মধ্যে এই ট্রেজার সম্পর্কে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তিটির ৩টি কপি করা হয়, যেগুলো যথাক্রমে রাশিয়া, রোমানিয়া ও রোমানীয় জাতীয় ব্যাঙ্কের নিকট গচ্ছিত থাকে। ২১ ডিসেম্বর ট্রেনটি মস্কোয় পৌঁঁছায় এবং রুশ সম্রাটের বাসভবন (পরবর্তীতে রুশ রাষ্ট্রপতির বাসভবন) ক্রেমলিনে রোমানীয় ট্রেজারকে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়। ১৯১৭ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রুশরা রোমানীয় ট্রেজারে থাকা সমস্ত জিনিসের একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও রোমানিয়ার মধ্যে এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/ttdhga0eXxAtf3fn_images-%288%29.jpeg)
১৯১৭ সালের মার্চে সংঘটিত বিপ্লবে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং একটি অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা লাভ করে। এই সরকার রোমানীয় সরকারকে রোমানীয় ট্রেজার রক্ষার ব্যাপারে দেয়া প্রতিশ্রুতি বজায় রাখে। এদিকে ১৯১৭ সালের মাঝামাঝিতে পূর্ব রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং ১৮ জুলাই রোমানীয় অর্থমন্ত্রী নিকোলাই তিতুলেস্কুর পরামর্শক্রমে রোমানীয় সরকার দেশটি থেকে আরো কিছু ট্রেজার রাশিয়ায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সে মোতাবেক ১৯১৭ সালের ২৭ জুলাই ২৪ বগির একটি বিশেষ ট্রেনে রোমানিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলো উত্তোলন করা হয়। এর ৩টি বগিতে ছিলরোমানীয় জাতীয় ব্যাংকের অবশিষ্ট সম্পদ, যার মূল্য ছিল তৎকালীন রোমানীয় মুদ্রায় ১৫৯,৪৮,৩৬,৭২১ লিউ, এবং বাকি ২১টি বগিতে ছিল অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সম্পদ, যার মূল্য ছিল প্রায় ৭,৫০০ কোটি লিউ।
![](https://assets.roar.media/assets/EpkIHSWHkqMunia5_images-%287%29.jpeg)
এই ট্রেনটিতে ছিল রোমানীয় রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান শৈল্পিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সম্পদ। রোমানীয় আকাদেমির (Academia Românã) সম্পূর্ণ আর্কাইভ, ৩,৫০০ বছরের পুরোনো স্বর্ণালঙ্কার, সুপ্রাচীন ডাসিয়ান স্বর্ণালঙ্কার, মোলদাভিয়া ও ওয়ালাসিয়ার শাসকদের সম্পদ, রোমানীয় রাজপরিবারের সম্পত্তি, হাজার হাজার চিত্রকর্ম, রোমানীয় মঠগুলোর মালিকানাধীনে থাকা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্পত্তি (যেগুলোর মধ্যে ছিল চতুর্দশ শতাব্দীর আইকন ও রোমানীয় ভাষার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি), বিভিন্ন ব্যাংকে রোমানীয় জনসাধারণের সঞ্চিত অর্থ– সবই ছিল এই ট্রেনে।
ধারণা করা হয়, ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ায় প্রেরিত ট্রেনটিতে থাকা স্বর্ণের মূল্যের চেয়ে এই ট্রেনে থাকা বস্তুগুলোর মূল্য ছিল অনেক বেশি। ১৯১৭ সালের ৩ আগস্ট ট্রেনটি মস্কোয় পৌঁছায় এবং ট্রেনটির সামগ্রী ক্রেমলিনে জমা রাখা হয়। আক্ষরিক অর্থে, রোমানিয়ার প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদই ছিল রাশিয়ায় প্রেরিত রোমানীয় ট্রেজারের অংশ।
![](https://assets.roar.media/assets/vcOv81DLAm1O9Me9_images-%286%29.jpeg)
১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে এবং সমগ্র রাশিয়া জুড়ে চলমান বিশৃঙ্খলা রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। যে কোসাক রক্ষীদের ওপরে রোমানীয় ট্রেজার সুরক্ষার দায়িত্ব ছিল, তারা বলশেভিকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে রোমানীয় ট্রেজারের ওপর বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ নভেম্বর রোমানীয় সরকার এদের হাত থেকে রোমানীয় ট্রেজারের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেয়ার জন্য ২০ জন রুমানীয় আধা–সামরিক বাহিনীর সদস্যকে ছদ্মবেশে মস্কোয় প্রেরণ করে, কিন্তু এরা ‘লাল কোসাক’ সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে, ফলে তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়।
তখন পর্যন্ত সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত রুশ সরকার রুমানীয় ট্রেজার আত্মসাৎ করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রোমানীয় সরকার মস্কো থেকে রোমানীয় ট্রেজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেয়ার জন্য মিত্রশক্তিকে অনুরোধ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীকে রোমানীয় ট্রেজার দখল করে বিশাল সাইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রুশ সমুদ্রবন্দর ভ্লাদিভোস্তকে নিয়ে যেতে হত। রোমানিয়ার জন্য এত ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযান পরিচালনা করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনোটাই মিত্রশক্তির রাষ্ট্রগুলোর ছিল না।
এদিকে রোমানিয়া সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করতে শুরু করে এবং ১৯১৮ সালের ২০ জানুয়ারি রোমানীয় সৈন্যরা রাশিয়ার কাছ থেকে জাতিগত মোলদাভীয়–অধ্যুষিত বেসারাবিয়া দখল করে নেয়। সোভিয়েত রাশিয়া এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ২৬ জানুয়ারি রোমানিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিয়ন ত্রৎস্কি ঘোষণা করেন, রোমানীয় ধনিকশ্রেণি রোমানীয় ট্রেজার ফেরত পাওয়ার উপযুক্ত নয় এবং উপযুক্ত সময়ে সোভিয়েত রুশ সরকার রোমানীয় জনসাধারণের কাছে তাদের সম্পদ ফিরিয়ে দেবে।
![](https://assets.roar.media/assets/oc0705x1x0qEmdHC_589px-%D0%9B%D0%B5%D0%B2_%D0%94%D0%B0%D0%B2%D0%B8%D0%B4%D0%BE%D0%B2%D0%B8%D1%87_%D0%A2%D1%80%D0%BE%D1%86%D0%BA%D0%B8%D0%B9.jpg)
পরবর্তী সময়ে রোমানিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে এই ট্রেজার ফেরত পাওয়ার জন্য আলোচনার প্রস্তাব করলে মস্কো শর্ত প্রদান করে যে, রোমানিয়া বেসারাবিয়া অঞ্চলটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফিরিয়ে দিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন রোমানীয় ট্রেজার ফিরিয়ে দেবে। বুখারেস্ট এই শর্তে রাজি হয়নি।
১৯৩৫ সালের জুনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘সদিচ্ছার নিদর্শন’ হিসেবে রোমানীয় আকাদেমির আর্কাইভের অংশবিশেষ তাদের নিকট প্রত্যর্পণ করে। ১৭টি বগিযুক্ত একটি বিশেষ ট্রেনে ১,৪৪৩টি ক্রেটে রোমানীয় ট্রেজারের এই অংশটি সোভিয়েতরা রোমানিয়ায় পৌঁছে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন রোমানিয়ার কাছ থেকে বেসারাবিয়া অঞ্চলটি পুনর্দখল করে নেয়। বেসারাবিয়ার জাতিগত মোলদাভীয়–অধ্যুষিত কেন্দ্রভূমিতে গঠিত হয় মোলদাভীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র (বর্তমান মলদোভা), আর বেসারাবিয়ার উত্তর ও দক্ষিণাংশের স্লাভিক–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ইউক্রেনীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান ইউক্রেন) নিকট হস্তান্তর করা হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/lkJZDAIsdPTHVRy5_640px-Soviet_occupation_of_Bessarabia_and_Northern_Bukovina_44.jpg)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে রোমানিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগদান করে। এর ফলে মস্কো রোমানীয় ট্রেজারের আরেকটি অংশ প্রত্যর্পণ করতে রাজি হয়। ১৯৫৬ সালের জুন থেকে আগস্টের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন রোমানীয় ট্রেজার থেকে ৩৯,৩৮৩টি সামগ্রী রুমানিয়ার নিকট হস্তান্তর করে, যার মধ্যে ছিল ৩৩,০৬৮টি স্বর্ণমুদ্রা, ২,৫০০টি মেডেল, ২,৪৬৫টি মধ্যযুগীয় বস্তু এবং ১,৩৫০টি চিত্রকর্ম।
মস্কো হয়তো ধীরে ধীরে রুমানীয় ট্রেজারের সম্পূর্ণটাই ফিরিয়ে দিত, কিন্তু রোমানিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে নিকোলাই চওসেস্কুর উত্থান এই প্রক্রিয়ায় বাধাদান করে। চওসেস্কুর দীর্ঘ শাসনকালে রোমানিয়া সোভিয়েত জোটের অংশ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোভিয়েতবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন: ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেও রোমানিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করলেও রোমানিয়া এই আক্রমণে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য মোতায়েনের পর পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র রোমানিয়া এর নিন্দা জানায়। ১৯৮৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস বর্জন করলেও রোমানিয়া এতে অংশগ্রহণ করে। দেশটির মস্কোবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মস্কো রোমানীয় ট্রেজারের বাকি অংশ তাদের সরকারের উপর্যুপরি অনুরোধ সত্ত্বেও ফিরিয়ে দেয়নি।
![](https://assets.roar.media/assets/y8Q37xZzZ7hlKT55_520px-Nicolae_Ceau%C8%99escu.jpg)
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বর্তমানে রোমানিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য এবং রোমানিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে। তারা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তখনই মস্কো রোমানিয়াকে রুমানীয় ট্রেজারের ১২০ টন স্বর্ণের মধ্যে ফেরত দিয়েছে মাত্র ৩৩ কিলোগ্রাম! অতএব, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্রে পরিণত হওয়া রোমানিয়াকে যে মস্কো রুমানীয় ট্রেজারের কতটুকু ফিরিয়ে দিতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমান রুশ সরকার রোমানীয় ট্রেজার যে রাশিয়ায় আছে, এই বিষয়টিই স্বীকার করে না। কিন্তু রোমানিয়া এখনও এই ট্রেজার ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়নি।
তবে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়!’ রোমানিয়াও ট্রেজারের এই ঘটনা থেকে যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছে। এজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোমানীয় সরকার তাদের জাতীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কোনো ‘মিত্র’ রাষ্ট্রে পাঠায়নি। এই যুদ্ধের সময় তারা গোর্জ কাউন্টির তিসমানার একটি পাহাড়ের গুহায় এই রিজার্ভ লুকিয়ে রাখে। যুদ্ধ শেষে রোমানীয় সরকার এটি সেখান থেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।