Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো: ইতিহাসের ভয়ংকরতম নারী স্নাইপার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জার্মানদের পরাজয়ে লেখা হয়েছে অনেক বীরত্বগাথা। ১৯৪১ সালের  ২২ জুন যখন জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করে, তখন হয়তো তারা ভাবেওনি কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনারা পদে পদে সোভিয়েত স্নাইপারদের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছে। SVT-40 সেমি-অটোমেটিক রাইফেল আর টেলিস্কোপিক লেন্সে চোখ লাগিয়ে থাকা যমদূতের রাজ্যে এসে পড়েছিল যেন জার্মানরা।

একজন লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো এবং ৩০৯ জন জার্মান

কিন্তু লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো নামে এক নারী স্নাইপার ছাড়িয়ে গিয়েছেন সবাইকে। এই নারী একাই জার্মানের শিবিরে থাকা সৈনিকদের রক্ত হিম করে দিয়েছেন। তিনি একাই ৩০৯ জন জার্মান সেনার জীবন কেড়ে নিয়েছেন, যাদের মধ্যে আছে ৩৬ জন দক্ষ জার্মান স্নাইপারও। অসামান্য এই দক্ষতার কারণে জার্মান সৈনিকদের মাঝে লুডমিলা পরিচিত ছিলেন ‘লেডি ডেথ’ নামে। লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়, সারা বিশ্বের সবচেয়ে সফল স্নাইপারদের একজন আর পৃথিবীর সেরা নারী স্নাইপার।

বন্দুক হাতে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো; Source: businessinsider.com

স্কুলজীবনে শখের বশে শার্প শুটিংয়ের হাতেখড়ি লুডমিলার। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলাই তাকে বেশি টানতো। কিন্তু বাবা-মায়ের চাপে স্কুল-কলেজ শেষ করে ১৯৪১ সালে জার্মানরা যখন সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু করে, তখন কিয়েভ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ছিলেন লুডমিলা। জার্মান আক্রমণে কিয়েভের অন্য সব প্রতিষ্ঠনের পাশাপাশি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিও। সেনাবাহিনীর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দলে সোভিয়েত তরুণরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো যোগ দিতে আবেদন করলেন। স্নাইপার হিসেবে তার আবেদন একরকম হেসেখেলেই উড়িয়ে দিয়েছিলো সেনা কর্মকর্তারা। তাদের তখনও কোনো ধারণাই ছিলো না এই লুডমিলাই হয়ে উঠবেন বিশ্বের সেরা নারী স্নাইপার।

স্নাইপার হিসেবে যোগদান

লুডমিলা তার আবেদনের সাথে যোগ করলেন তার স্কুলজীবনে শার্প শুটিংয়ের সার্টিফিকেটও। কিন্তু নারী হওয়ায় তার আবেদনকে একরকম গুরুত্বই দিচ্ছিলেন না সোভিয়েত সেনা কর্মকর্তারা। তারা লুডমিলাকে নার্স হিসেবে যোগ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। কিন্তু লুডমিলা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি স্নাইপার হিসেবে যোগ দিতেই চান। উপায় না দেখে সোভিয়েত মিলিটারির ২৫তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনে শুটার হিসেবে সাময়িক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেনিং নেওয়ার পর্যাপ্ত সময়ও ছিলো না। নিয়োগের পরেই তাকে চলে যেতে যেতে হয় রণক্ষেত্রে। ১৯৪১ সালে আগস্ট মাসে তাকে এবং তার দলকে বেলায়েভকা নামক গ্রামের কাছেই এক পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। নতুন স্নাইপার হওয়ায় এবং রণক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় লুডমিলার সাথে আরো একজন দক্ষ স্নাইপারকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সেই স্নাইপার ঠিকঠাক পজিশন নেওয়ার আগেই জার্মান বুলেট কেড়ে নেয় তার প্রাণ। এই ঘটনা লুডমিলাকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার আগে ঘরে ফিরবেন না।

রণক্ষেত্রে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো; Source: www.businessinsider.com

শত্রুবধের নেশায় হন্যে হয়ে উঠেন এই সোভিয়েত তরুণী। ৩.৫ এক্স টেলিস্কোপিক লেন্স আর SVT-40 সেমি-অটোমেটিক রাইফেলে প্রথম যাত্রায়ই কেড়ে নেন দুই জার্মান সেনার প্রাণ। তার এই অসামান্য দক্ষতা শুধু মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে দেখেছিলেন তার পাশে থাকা বাকি স্নাইপাররা। লুডমিলার যাত্রা সেই শুরু, টেলিস্কোপিক লেন্সে চোখ লাগিয়ে একের পর এক জার্মান সেনাকে বধ করে তিনি হয়ে উঠেছেন সোভিয়েতের জাতীয় বীরাঙ্গনা।

রণক্ষেত্রে কতটা ভয়ংকর ছিলেন লুডমিলা?

লুডমিলার পরবর্তী রণক্ষেত্র ছিলো সোভিয়েত শহর ওডেসাতে। ওডেসা শহরে যুদ্ধরত অবস্থায় প্রথম দুই মাসে ১৮৭ জন বিপক্ষ সেনাকে যমদূতের হাতে সঁপে দিয়েছেন। তার এই অসাধারণ নৈপুণ্যের কথা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো। তাকে রেড আর্মির পঁচিশতম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন থেকে ‘সেকেন্ড কোম্পানি অফ স্নাইপার’ প্লাটুনের সিনিয়র সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তার অবস্থানের সাথে তার রাইফেলও বদলায়। সেকেন্ডে ২,৮০০ ফুট গতিতে বুলেট বের হওয়া আইকনিক ‘Moisin-Nagant’ রাইফেল নিয়ে দক্ষ এই নারী স্নাইপার নেতৃত্ব দিয়েছেন পুরো স্নাইপার বাহিনীকে।

আইকনিক ‘Moisin-Nagant’ রাইফেলটি এখনো সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে; Source: www.businessinsider.com

তার সুনাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো দ্রুতগতিতে। রেড আর্মিতে তাকে দেখে দলে দলে নারীরা স্নাইপার হিসেবে ট্রেনিং নেওয়া শুরু করলো। পুরো দেশ জুড়ে প্রায় ২,০০০ নারী স্নাইপার তাকে দেখে যোগ দিয়েছিলো রেড আর্মিতে। এর মধ্যে বেঁচে ফিরেছেন মাত্র ৫০০ জন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সোভিয়েতের জাতীয় বীর লুডমিলা কি বেঁচে ফিরেছিলেন?

মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে

লুডমিলার খ্যাতির সাথে সাথে দায়িত্বও বাড়তে থাকে। শত্রুশিবিরের মাঝে কাঁপন বইয়ে দিতে ক্যাম্প থেকে ৬০০-১,০০০ ফুট এগিয়ে থাকতেন। খাবার-দাবার ফুরিয়ে গেলেও দিনের পর দিন নিশ্চুপ লুডমিলা বসে থাকতেন শ্ত্রুর অপেক্ষায়।

প্রতিকূল পরিবেশে, দলছুট হয়ে যুদ্ধ করে গেছেন লুডমিলা; Source: www.businessinsider.com

নির্ঘুম রাতেও বন্দুকের সাথে থাকা টেলিস্কোপিক লেন্সে চোখ লাগিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন শত্রুপক্ষের সেনাদের উপরে। ১৯৪২ সালের জুনে তার খুব কাছে মর্টার শেলের বিস্ফোরণ হয়। ক্যাম্প থেকে অনেক দূরে বন্ধুহীন অবস্থায় তিনি গুরুতর আহত হলেন। একবার-দু’বার নয়, চতুর্থবারের মতো মৃত্যু হানা দিয়ে গেলো ৩০৯ জন জার্মান সেনার মৃত্যুদূতের কাছে। দলের সবাই তার কোনো খোঁজ না পেয়ে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে তখন। কিন্তু সাড়া দিচ্ছেন না তিনি। দল থেকে বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির মাঝে মিশে থাকা স্নাইপারকে খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হয়েছে তার সহযোদ্ধাদের। গুরুতর আহত এবং দুর্বল অবস্থায় তাকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। সুস্থ হয়ে তিনি ফিরতে চাইলেন আবারও রণক্ষেত্রে।

রণক্ষেত্র না ট্রেনিং গ্রাউন্ড?

ইতোমধ্যে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। অর্ডার অফ লেনিনে ভূষিত করে তাকে রেড আর্মির মেজর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সরাসরি রণক্ষেত্রে অংশগ্রহণের বদলে তাকে রেড আর্মির স্নাইপিং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

লুডমিলার সম্মানে প্রকাশিত সোভিয়েত ডাকটিকেট; Source: Wikimedia Commons

তাকে দেখে তরুণ স্নাইপাররা অনুপ্রেরণা পাবে বলেই সোভিয়েত সেনাবাহিনীর হাই কমান্ডের এই আদেশ। অনেক কষ্টে এই আদেশ মেনে নিয়েছিলেন এই নারী স্নাইপার। আর একদিকে যখন জার্মানরা রেডিও বার্তায় লুডমিলাকে ৩০৯ টুকরো করে কাটার হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলো, অকুতোভয় লুডমিলা তখন মুচকি হেসে বলেছিলেন তারা আমার স্কোরের হিসাব খুব ভালো করেই রেখেছে তাহলে।

যুদ্ধশেষে লুডমিলার আমেরিকা সফর

যুদ্ধের পরে লুডমিলা কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়াশোনা শেষ করতে যান। ইতিহাসে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষে লুডমিলা সোভিয়েত নৌবাহিনীতে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি স্নাইপিং প্রশিক্ষক হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার দায়িত্ব বহাল ছিলো।

স্নাইপিং প্রশিক্ষক হিসেবে লুডমিলা; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধ চলাকালে তার এই অসাধারণ বীরত্বগাথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রথম সোভিয়েত নাগরিক হিসেবে হোয়াইট হাউজে যান লুডমিলা। তবে আমেরিকান গণমাধ্যমের নানা ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্নে খানিকটা বিব্রত হয়ে যান তিনি।

ফার্স্ট লেডি ইলিয়ানর রুজভেল্টের সাথে লুডমিলা; Source: www.smithsonianmag.com

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফার্স্ট লেডি ইলিনর রুজভেল্টের সাথে তার গড়ে উঠে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাকে সাথে নিয়ে ফার্স্ট লেডি আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে সাধারণ আমেরিকান নারীদের মাঝে তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। ২৫ বছরের তরুণী লুডমিলা ফার্স্ট লেডির ডাকে সাড়া দিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন। যেখানেই গিয়েছেন, সাধারণ মানুষ আর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মনোযোগের সাথে। এই নিয়ে ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি তাকে।

ভারি ইউনিফর্ম আর তাতে ঝোলানো অনেক মেডেলের ব্যাপারে তাকে কটাক্ষ করেছেন অনেক আমেরিকান; Source: smithsonianmag.com

একবার তাকে এক সাংবাদিক তো তার ভারি ইউনিফর্ম আর তাতে ঝোলানো অনেক মেডেলের ব্যাপারে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করেন। নারীদের পোশাকের প্রতি আমেরিকান সাধারণ মানুষ আর গণমাধ্যমের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে ক্ষোভে ফেটে না পড়লেও তা চেপে রাখতে পারেননি পৃথিবীর সেরা এই নারী স্নাইপার। টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,

“I wear my uniform with honor. It has the Order of Lenin on it. It has been covered with blood in battle.It is plain to see that with American women what is important is whether they wear silk underwear under their uniforms. What the uniform stands for, they have yet to learn.”

১৯৫৭ সালে আমেরিকার সাবেক ফার্স্ট লেডি ইলিইয়ানর রুজভেল্ট যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসেন দেখা করে যান আবারো লুডমিলার সাথে। ১৯৭৮ সালের ১০ অক্টোবর জীবনাবসান ঘটে লুডমিলার। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়া এই নারীকে সমাহিত করা হয় মস্কোতে।

ফিচার ইমেজ- businessinsider.com (Edited by Jakaria Hasan)

Related Articles