ইতিহাসের একটা পর্যায়ে এসে পৃথিবীর কালো মানুষগুলো সাদাদের দাসে পরিণত হয়েছিল। যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল আরবদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি। আরব বণিকরা ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে আরবরা দীর্ঘ একটা সময় ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।
উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশ থেকেই আরবরা দাস কিনে নিত। তারপর তাদের আরব এবং ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে বিক্রি করত। এভাবেই বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে অন্যরকম একটি ব্যবসা আরব দেশগুলোর সঙ্গে সঙ্গে এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ল।
মালিক অম্বরও দাসত্বের এই ব্যবস্থার কারণে কয়েক হাজার আফ্রিকান নারী-পুরুষের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। যারা মরুর উত্তপ্ত প্রান্তরে পেরিয়ে ভারত মহাসাগরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু অন্য সবার মতো ভাগ্য তাকে নগণ্য হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে দেয়নি। বরং তিনি ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ শাসক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।
১. জন্ম ও বেড়ে ওঠা
এই কৃষ্ণাঙ্গ শাসক ১৫৪০-১৫৪৮ এর যেকোনো সময় হারার দেশে জন্মেছিলেন, যা বর্তমানে ইথিওপিয়া নামে পরিচিত। তাকে তার পরিবার শেম্বু বা চপু বলে ডাকত। ১২ বছর বয়সে আরবরা তাকে ক্রয় করে নেয় এবং দক্ষিণ আরবের (বর্তমান ইয়েমেন) মোচা বন্দরে বিক্রি করে দেয়। তাকে প্রথমে ইয়েমেনে নিয়ে যাওয়া হয়, পরবর্তীতে আবার বিক্রি হওয়ার পর তৎকালীন সাংস্কৃতিক রাজধানী বাগদাদে চলে আসেন।
এখানে তিনি কাজী হুসেন নামক এক সম্ভ্রান্ত লোকের অধীনে কাজ শুরু করেন। সৌভাগ্যক্রমে অন্য দাসদের মতো তাকে বন্দিজীবন শুরু করতে হয়নি। বরং এই মালিকের অধীনে তিনি শিক্ষার সুযোগ পান। তার নতুন নাম দেওয়া হয় ‘অম্বর’।
দাসত্বের অনেকগুলো শাখা রয়েছে। তার মধ্যে আরবরা দাসদের ‘ভূমিদাস’ হিসেবে পালন করত। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে, আরবরা মূলত দাসদের উপর বর্বর আচরণ করেছিলেন, যা ইতিহাসের অন্যান্য দাস ব্যবসায়ের মতো একই রকম। যদিও এখানে বিতর্কের অবকাশ থাকে।
তবে মালিক হিসেবে কাজী হুসেন অম্বরের প্রিয় ছিলেন। কিন্তু হুসেন কিছুদিন পরই মারা গেলে অম্বরকে আবার বিক্রি করে দেওয়া হয়। এবার অন্য ইথিওপিয়ানদের সঙ্গে তাকে ভারতীয় এক মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়।
২. ক্ষমতায় আরোহণ ও মুঘল বধ
দক্ষিণ ভারতের আহমদনগর রাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চেঙ্গিস খান অম্বরকে কিনে নেন। চেঙ্গিস খান নিজেও হাবশী দাস ছিলেন, পরবর্তীতে স্বাধীন জীবন শুরু করেন। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে অম্বর কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ, সামরিক কৌশল এবং রাজনৈতিক সংগঠনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। খানের অধীনে ২০ বছর কাজ করার পর অম্বর আহমেদনগরের সর্বোচ্চ পদস্থ হাবশী সৈনিক হিসেবে নিয়োগ পান।
১৫৯৪ সালে খান মৃত্যুবরণ করলে অম্বর একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। অম্বর সর্বপ্রথম ১৫০ জন সদস্যের একটি ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তোলেন। দেখতে দেখতে তার ভাড়াটে বাহিনী ১৬০০ সালের দিকে হাজার সৈনিকের একটি সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়, যার প্রধান জেনারেল ছিলেন মালিক অম্বর। ১৬২০ সালে অম্বরের সেনাবাহিনীতে ৫০,০০০ নিয়মিত সৈনিক ছিল, যাদের ভেতর ৪০,০০০ সৈনিক ছিল স্থানীয় মারাঠা এবং ১০,০০০ হাবশী সৈনিক।
অম্বর এই অঞ্চলে এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, তার সহায়তায় দুজন রাজকুমার নিজাম সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিল। তাদের মন্ত্রিপরিষদে অম্বর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব লাভের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতাও আদায় করে নেন। সেখান থেকেই তার পদবি দেওয়া হয় ‘মালিক’, যার অর্থ রাজা।
প্রকৃতপক্ষে মারাঠাদের ভেতর ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মালিক অম্বর মুঘলদের চোখের বিষ ছিলেন। সম্রাট আকবর তাকে ‘অহংকারী’ এবং ‘দু’মুখো সাপ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে তিনি ছিলেন ‘বিপর্যয়ের জন্য একটি বাড়তি উপদ্রব’। তবে মুঘলদের এই বৈরিতা অম্বরকে আরও উচ্চাসনে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ অম্বরের প্রতিরোধের মুখে পড়ে মুঘলরা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলে নিজেদের বিস্তৃতি ঘটাতে পারেনি।
মুঘলরা আহমদনগরের রাজধানী পর্যন্ত নিজেদের এগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এর চারপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ মুঘল প্রভাব থেকে টিকে যায়। একবার মালিক অম্বর বিজাপুরের রাজপুত্রের কাছে লেখেন,
‘’যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকবে, ততদিন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো।‘’
মালিক অম্বর কখনোই এই অঞ্চলে কারও অধীনে নিজ সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করেননি। আহমদনগরে তার বাহিনী ছিল অনেকটা চুক্তিভিত্তিক সেনাবাহিনীর মতো। যদিও এই সেনাবাহিনীকে লালন-পালন করার জন্য অত্র অঞ্চলের রাজপুত্ররা অঢেল অর্থ ঢালতেন। এখানকার এক রাজপুত্রের কাছে অম্বর নিজ মেয়ের বিয়েও দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার ব্যাপারে মালিক অম্বর সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
নিজের সেনাবাহিনীকে তিনি গেরিলা আক্রমণের জন্য তৈরি করেছিলেন। যাদের কৌশলগত হামলা মোকাবেলা করা মুঘলদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জে হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। মালিক অম্বর নিজে কোনো রাজ্য পরিচালনা করেননি। কিন্তু যখনই তিনি নিজের জন্য কোনো রাজপুত্রকে হুমকিস্বরূপ দেখতেন, তাকে সঙ্গে সঙ্গে সিংহাসন থেকে সরানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবেই ক্ষমতার আড়ালে থেকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার চর্চা করেছেন। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পরও অম্বরকে তার অবস্থান থেকে নড়াতে অপারগ সম্রাট জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে বলেছিলেন,
“কেউ যদি এই অভিশপ্তকে এখান থেকে বিদায় করতে পারতো!’’
একসময় সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের হতাশা ঢাকতে অম্বর বধের চিত্র অঙ্কন করেন। যেখানে দেখা যায়, সম্রাট একটি পৃথিবীর গোলকের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। মালিক অম্বরের কাটা মুণ্ডুটি শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর সম্রাটের হাতের তীরটি অম্বরের মাথায় নিশানা করা!
৩. জনহিতকর কাজ ও মৃত্যু
শুধুমাত্র যুদ্ধের ময়দানে না থেকে জনহিতকর কাজের দিকেও নজর ছিল মালিক অম্বরের। ১৬১৯ সালে অম্বর খিরকি শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে আওরঙ্গবাদ নামে পরিচিতি পায়। এই শহরজুড়ে মালিক অম্বরের পরিশীলিত স্থাপত্য জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
বিশেষ করে সুলতানের জন্য তৈরি করা প্রাসাদ ‘সবুজ বাংলো’ এবং স্থানীয় বাজারের কাছেই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এছাড়াও শহরজুড়ে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার তৈরি করেন। আওরঙ্গবাদে সেই সময় যেসব মসজিদ তৈরি হয়েছিল, তার প্রায় সবগুলোর সঙ্গে মালিক অম্বরের নাম জড়িয়ে আছে। নিজের সমাধিটিও তিনি তৈরি করেছিলেন পরম যত্নে। তার সমাধির আশপাশেই নিজের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সমাধি তৈরি করা হয়।
আওরঙ্গবাদে সেচ ব্যবস্থার জন্য উত্তরে ২৪ মাইল দূরবর্তী হিমালয়ের পাদদেশে খাল খনন করেন, যার নাম নহর-ই-অম্বরি। দীর্ঘ ১৫ মাসের নিরলস পরিশ্রমের পর খালটি তৈরি করা হয়। প্রায় সাত ফুট গভীরতার এই ভূগর্ভস্থ খালটি অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো দেখতে।
নহর-ই অম্বরি শহরে ঢোকার পথে কিছু কিছু জায়গায় নদীর সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। পুরো খালজুড়ে ১০০টিরও বেশি ম্যানহোল বসানো হয়। যদিও কালের পরিক্রমায় সেগুলো চিহ্নিত করা দুরূহ একটি ব্যাপার।
নহর-ই অম্বরির সংস্কারকাজ করার আগপর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এটি সুন্দরভাবে কাজ করছিল। ১৯৩১ সালে যখন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো, তখন খালের মূল নকশা অনুসন্ধান করে দেখা হয়, যে নকশাটি ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে একজন ক্রীতদাস রাজা তৈরি করেছিলেন।
ক্ষুদ্র একটি জীবনে মালিক অম্বর ভারতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছিলেন। সেই সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও উদাহরণ হয়ে ছিলেন। তার সন্তানদের ভারতের নামী পরিবারগুলোতে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নিজের সকল দায়িত্ব সম্পাদন করে ১৬২৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন মালিক অম্বর। এই ভূমিকে ভালোবাসার অবদান আর ত্যাগের কথা এখানকার মানুষ ভুলে যায়নি। তাই তো আওরঙ্গবাদের মানুষ এখনো মালিক অম্বরকে স্মরণ করেন পরম শ্রদ্ধাভরে।