যুগে যুগে বিপ্লবীদের বিপ্লবের আগুন থেকে জন্ম নিয়েছে রাষ্ট্র। প্রত্যেক বিপ্লবী নিজের আদর্শে লড়েছেন, কখনো জিতেছেন, কখনো হেরেছেন, কখনো বা প্রাণও দিয়েছেন। ইতিহাস তাদেরকে অলঙ্কৃত করেছে নানাভাবেই। ইতিহাসের পাতা থেকে এক অমর নায়কের প্রেমিকাকে তুলে আনা হয়েছে আজকের লেখায়।
সেই অমর নায়কের নাম ফিদেল কাস্ত্রো। পুরো নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। কিউবার প্রয়াত লৌহ কঠিন সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ও রাজনৈতিক নেতা। প্রতিপক্ষ কম-বেশি ৬৩৮ বার যার জীবন হননের চেষ্টা করেছিলো। আমাদের প্রেমিকা প্রবর মারিতা লরেঞ্জ প্রথম কিউবায় এসেছিলেন ছদ্মবেশী আততায়ী হয়ে। লক্ষ্য ছিলো কাস্ত্রো। কিন্তু ভালোবাসার অমোঘ টানে মারিতা ভুলে যান কর্তব্যের ডাক। বাস্তবতা যে চলচ্চিত্রকেও হার মানায় তার সাক্ষী কাস্ত্রো ও লরেঞ্জের ভালোবাসা।
মারিতা লরেঞ্জের ব্যক্তিগত জীবনকে যতই চিত্রায়িত করবেন, ততই আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন, ঈশ্বরের সৃষ্ট নারীর পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে রহস্যের অন্তর্জাল। না, এখানে নারীর অবমাননা করা হচ্ছে না। আমি সেই নারী, সেই মারিতাকে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যার জীবনের ২৫টি বছর কেটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র গোপন তথ্যদাতা ও গুপ্তচর হিসেবে। একজন নারী গুপ্তচর, যিনি লাস্যময়ী, সুতীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী, গুপ্তহত্যায় সিদ্ধহস্তু, একনজরে পুরুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সক্ষম; যেমনটি রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসে পড়ে আমরা শিউরে উঠি, ঠিক তেমনই একজন অঘটন ঘটন পটিয়সী মারিতা লরেঞ্জ।
একপলকে মারিতার নাটকীয় জীবন
লাতিন আমেরিকার দুই প্রবাদ পুরুষ কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো এবং ভেনেজুয়েলার জেনারেলিসিমো মারকোস পেরেজ জিমেনেজের প্রেমিকা ছিলেন লরেঞ্জ। যাদের প্রত্যেকেই তার ঔরসে নিজ সন্তান জন্মের দাবি করেছেন। সিআইএ’র ব্ল্যাক অপারেশনে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে মারিতার বিরুদ্ধে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনটি বিয়ের কথা শোনা যায়। এমনকি এক গ্যাংস্টারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আরেকটি শিশুর জন্মদানের গুজবও শুনতে পাওয়া যায় লরেঞ্জকে নিয়ে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকান্ড উন্মোচনের মূল চাবিকাঠিও নাকি মারিতার হাতে ছিল। সেই শীতল গল্পের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। মারিতা লরেঞ্জ নিজেই এক সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেন, তাকে গুলি করা হয়েছে, বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে, অগ্নিদগ্ধ করার চেষ্টা চলেছে, মাদকের শিকার বানানো হয়েছে, তার উপর পিস্তলের আঘাত হানা হয়েছে, চাবুকপেটা করা হয়েছে। এমনকি আমাজনের রেইন ফরেস্টে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে আসা হয়েছে। কিন্তু লরেঞ্জ প্রতিবার হিমশীতল মৃত্যুকে হার মানিয়েছেন।
কীভাবে গুপ্তচর বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়লেন মারিতা; তার জবানীতেই শুনে আসা যাক।
মারিতার শৈশব ও পরিবার
মারিতা বলেন, আমি আমার পরিবারের সবচেয়ে অযোগ্য সন্তান। মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর হেনরি কেবট লজ ছিলেন আমার মায়ের চাচাতো ভাই। আমার বড় ভাই জোয়াকিম লরেঞ্জ, একজন ফুলব্রাইট স্কলার এবং সাবেক স্টেট ডিপার্টমেন্ট কূটনীতিক, সিনেটর হাওয়ার্ড বেকার জন্য কাজ করেন। আমার অন্য ভাই, প্রয়াত ফিলিপ লরেঞ্জ, একজন পিয়ানোবাদক এবং বিশ্বনন্দিত চিলিয়ান পিয়ানোবাদক ক্লডিও আরাউর শিষ্য ছিলেন। আর বোন ভ্যালেরি ছিলেন পিএইচডিপ্রাপ্ত স্কলার। তিনি মেরিল্যান্ডে পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন।
তবে, গুপ্তচরবৃত্তি মারিতার পারিবারিক ধারার মধ্যেই ছিল। তার মা-ও ছিলেন গুপ্তচর। এমনকি তার বাবা যে একজন ডাবল এজেন্ট ছিলেন এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। লরেঞ্জের মা অ্যালিস লফল্যান্ড ব্রডওয়েতে অভিনেত্রী এবং নৃত্যশিল্পী হিসেবে জীবন শুরু করেন। ত্রিশের দশকের প্রথমদিকে ফ্রান্সে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে তার সাথে জার্মান নৌবাহিনীর অধিনায়ক হেইনরিখ লরেঞ্জের সাক্ষাত ঘটে। অ্যালিস দেখামাত্রই বিত্তশালী হেইনরিখ লরেঞ্জের প্রেমে পড়ে যান।
হেইনরিখ লরেঞ্জ অ্যালিসকে অভিনয় ছেড়ে তার সাথে জার্মানির ব্রেমেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব দেন। অ্যালিস সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে হেইনরিখকে বিয়ে করেন। হেইনরিখ-অ্যালিস দম্পতির ঘরে চার সন্তানের জন্ম হয়। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মারিতা, যিনি ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে জন্মগ্রহণ করেন। মারিতার জন্মের ঠিক দুই সপ্তাহ পর জার্মানি পোল্যান্ডের উপর আক্রমণ করে বসে। যুদ্ধের মুহূর্তে তৎকালীন জার্মান নৌবাহিনী হেইনরিখ লরেঞ্জকে ইউ-ফ্লিটের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেয়।
এদিকে হেইনরিখের সহধর্মিণী অ্যালিস লরেঞ্জের জার্মানি ছাড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কথিত রয়েছে, যুদ্ধের শুরুতে অ্যালিস অজ্ঞাত এক ফরাসি সৈন্য এবং ব্রিটিশ পাইলটকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন, যার কৃতজ্ঞতা স্বরূপই হোক বা তথ্যের প্রয়োজনে, অ্যালিসকে ফরাসি গুপ্ত বিপ্লবী দল ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের সভ্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
১৯৪৪ সালে অ্যালিস লরেঞ্জকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে বার্গেন-বেলসেন বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়। এদিকে তার স্বামী হেইনরিখের জাহাজটি যুদ্ধের ময়দানে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর হাতে আটকা পড়ে এবং হেইনরিখকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ব্রিটিশ বন্দী শিবিরে পাঠানো হয়। এ সময় মাতৃ-পিতৃহীন ৫ বছর বয়সী মারিতাকে বার্গেন-বেলসেনের ভয়াবহ শিশু সংশোধনাগারে আটকে রাখার জন্য পাঠানো হয়।
বন্দীজীবন থেকে মুক্তি পেলেও বৈরী জীবন হতে মুক্তি পাননি মারিতা
মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তি পেয়ে, বিচ্ছিন্ন লরেঞ্জ পরিবার ব্রেমার হেভেনে চলে যায়। যেখানে মারিতার মা অ্যালিস প্রথমে মার্কিন সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে এবং পরে সিআইএ’র অগ্রদূত ওএসএসে কর্মরত ছিলেন। পরিবারের সাথে পুনর্মিলনের কিছুদিন পরেই সাত বছর বয়সী মারিতা এক পাষণ্ড আমেরিকান সৈনিকের হাতে ধর্ষিত হয়।
লরেঞ্জের নিকটবর্তী অনেকেই পরবর্তীতে বলেছেন, শৈশবে ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো শিশু মারিতা যে মুহূর্তে অপরাধী সৈনিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তখনই তার নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। পুরুষ শাসিত সমাজ ও সম্পর্কের প্রতি বিতৃষ্ণাই মারিতাকে সহিংসতা ও প্রতিশোধের জীবনযাপনের পথে ঠেলে দেয়।
১৯৫০ সালে লরেঞ্জ পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে এবং ম্যানহাটনে বসতি স্থাপন করে। সেখানে হেইনরিখ লরেঞ্জ সাগরে মাছ ধরার বিলাসবহুল জাহাজের মালিক হিসেবে জীবন শুরু করেন। এদিকে তার স্ত্রী আমেরিকান গোয়েন্দা গোষ্ঠীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে জীবন শুরু করেন। ধারণা করা হয়, লরেঞ্জ মিলিটারি গোয়েন্দা এবং পেন্টাগনের হয়েই কাজ করতেন।
মারিতার বোন ভ্যালেরি লরেঞ্জ এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
আমি কখনো নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমার মা আসলে কার জন্য কাজ করছিলেন। আমি শুধু জানতাম, তিনি ইন্টেলিজেন্সে কাজ করেন এবং তার সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স রয়েছে। কেন যেন মা আমাকে কখনোই বিশ্বাস করেননি, কিন্তু তিনি মারিতার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ভ্যালেরি জোর দাবী করেন, তিনি কোনো অংশেই বোন মারিতার চেয়ে কম যোগ্য ছিলেন না।
তিনি আরও বলেন, “আমি যখন পেনসিলভানিয়ায় তিন সন্তানকে লালন পালন করতে ব্যস্ত ছিলাম, ঈশ্বর জানেন তখন মারিতা কার কাছে গিয়েছিল।” কোথায় ছিলেন মারিতা?
কাস্ত্রোর সাথে প্রথম পরিচয়
মুখ দর্শনেই উভয়ের হৃদয়ে কি ঝড় উঠেছিলো? মানব হৃদয়ের অব্যক্ত কথন কি একবাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব? কী ছিলো ৩৩ বছর বয়স্ক সুপুরুষ কাস্ত্রোর চোখে ১৯ বছরের মারিতার জন্য? তা কি প্রেম নাকি উন্মাদ কামনার অভিলাষ? জবাবটি জীবদ্দশায় না কাস্ত্রো দিয়েছেন, না মারিতা। কী ঘটেছিলো সেদিন?
নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সমাপ্ত না করেই কিশোরী মারিতা বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ভ্রমণ করছিলেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯। বিলাসবহুল জাহাজ বার্লিনের হাভানা বন্দরে নোঙ্গর করে। জাহাজটি যখন বন্দরে পৌঁছায়, তখন কিউবার নবনির্বাচিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো স্বয়ং মারিতাদের অভ্যর্থনা জানাতে বন্দরে আসেন।
বন্দরে ভেড়ার পূর্বে সশস্ত্র নৌকা জাহাজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ১৯ বছর বয়সী মারিতা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি দেখেন, সবাই সশস্ত্র। সকলের মুখে একই ধরনের দাড়ি। অগ্রসরমান দলটিকে নেতৃত্বদানকারী মানুষটি ছিলেন সবচেয়ে লম্বা। কাস্ত্রোকে দেখে কেন যেন মারিতার ভয় ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিলো। উল্টো মনে স্থান করে নিচ্ছিলো কৌতূহল আর দুর্নিবার আকর্ষণ। অনুভূতিটা যেন পারস্পরিক ছিলো। কাস্ত্রো ছিলেন মারিতার জীবনের প্রথম প্রেমিক। যে প্রেমের দাবানল পরবর্তীতে মাসের পর মাস দীর্ঘসূত্রিতা লাভ করে। জন্ম দেয় প্রেম, কামনা, ষড়যন্ত্রের এক অন্তহীন গাঁথার, যার অস্তিত্ব কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান ছিলো। সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণ মারিতা লরেঞ্জ ঠিক এভাবে করেন,
আমি জাহাজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা লঞ্চ আমাদের জাহাজের দিকে আসছিলো। লঞ্চটিতে প্রায় ২৭ জন অস্ত্রধারী পুরুষ ছিলো। সকলের মুখভর্তি একই স্টাইলের দাঁড়ি। সকলের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি অন্যদের তুলনায় বেশ লম্বা। তিনি লঞ্চের গলুইতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে রাইফেল ছিল। দূর থেকে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “আমি জাহাজে আসতে চাই।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কে? তা শুনে তিনি অট্টহাসি হাসতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, আমিই কিউবা। অধমের পরিচয় ‘কম্যান্ডান্ট ফিদেল কাস্ত্রো’।
মাত্র দুই মাস আগে, বাতিস্তার স্বৈরাচারী শাসন থেকে কিউবাকে মুক্ত করেছিল ফিদেল কাস্ত্রো। মারিতা ফিদেল কাস্ত্রোকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, এটা জার্মান মাটি।
ফিদেল প্রত্যুত্তরে জানান,
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমার আশ্রয়ে আছেন।
সেই মুহূর্তে আরেক সুদর্শন ব্যক্তি এগিয়ে এসে মারিতাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন,
আমি চে গুয়েভারা। আমার একটি জার্মান বিয়ার চাই।
মারিতা, যিনি কখনো একান্তে কোনো ছেলেবন্ধুর সাথে সময় কাটাননি, তার কাছে সুদর্শন কাস্ত্রোর সাথে প্রথম আলাপের মুহূর্তটি ছিলো রোমাঞ্চকর। তিনি বলেন, আমি বুঝতেও পারিনি ঠিক কখন কাস্ত্রোর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছি। তিনি আরও বলেন,
যখন আপনার সাথে ফিদেল কথা বলবে, বুঝবেন তিনি খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলছেন। তিনি আপনার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলবেন। কাস্ত্রোর সঙ্গ উপভোগ করতে করতে কেমন যেন মনে ভীতি কাজ করে। আমার বাবা তখন গভীর ঘুমে। আরো দুই ঘন্টা পর তিনি জেগে ওঠেন। এই পুরোটা সময় কাস্ত্রোকে সঙ্গ দিতে হবে আমাকে। আমি কাস্ত্রোকে পুরো জাহাজ ঘুরিয়ে দেখালাম। অতঃপর তার সঙ্গ এড়িয়ে নিজের কেবিনে ফিরে গেলাম। কারণ আমি কাস্ত্রোর চোখে নিজেকে আকর্ষণীয়া করে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম।
তারপরের সবকিছু কেমন যেন সিনেমার মতো ঘটে চলে। কাস্ত্রো মুহূর্ত পরেই সর্বক্ষণের সঙ্গী সিগার হাতে মারিতার কেবিনে অ্যাশট্রে খোঁজার বাহানায় হাজির হন। কাস্ত্রো মারিতাকে বলেন,
এক কমান্ড্যান্টের ভালোবাসা আরেক কমান্ড্যান্টের প্রতি।
কাস্ত্রো তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন,” তুমি কি সত্যিই আমার সম্পর্কে জানো না?” মারিতা জবাব দিয়েছিলেন,
না। বাবা আমাকে বলেছিলেন, বাতিস্তা কিউবা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন, তার বদলে অন্য কেউ ক্ষমতায় আছেন। আমি অনুমান করি যে আপনি সেই অন্য কেউ।
মারিতা ফিডেল কাস্ত্রো প্রসঙ্গে বলেন, আর কারো প্রতি এমন মন্ত্রমুগ্ধ ভালোবাসা এমন কঠিনভাবে আমার হৃদয়ে আঘাত হানেনি। কাস্ত্রো ছিলেন আমার জীবনে প্রথম পুরুষ, আমার প্রথম প্রেমিক।
সেই স্মৃতিমধুর রাতে লরেঞ্জের সাথে মারিতা ও ফিদেল কাস্ত্রো একত্রে রাতের খাবার খান। কয়েকদিন পর, মারিতা পশ্চিম ৮৭তম স্ট্রিটের পারিবারিক অ্যাপার্টমেন্টে অবস্থান করছিলেন। মারিতার ভাষ্যে, আমি প্রেমে মগ্ন ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করেই টেলিফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। টেলিফোন ধরতেই ওপার হতে ভেসে ওঠে কাস্ত্রোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। পরের দিনই মারিতাকে কিউবায় ফিরিয়ে নিতে নিউ ইয়র্কে অবতরণ করে কাস্ত্রোর ব্যক্তিগত বিমান।
গর্ভাবস্থায় মারিতার উপর মাদক প্রয়োগ ও কাস্ত্রোর সন্তানের কথিত অন্তর্ধান
১৯৫৯ সালের অক্টোবরে মারিতা ৭ মাসের গর্ভবতী ছিলেন এবং ফিদেল কাস্ত্রোর সন্তানের মা হতে চলেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারের প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান লুইস বারদচের সাথে সাক্ষাতকারকালে মারিতা দাবি করেন, তার রাতের খাবারে নেশা জাতীয় মাদক প্রয়োগ করা হয়েছিল। সন্দেহ করা হয়, কাজটি আসলে কাস্ত্রোকে হত্যা ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছিলো, যার শিকার হন মারিতা। হাসপাতালে আধো সজ্ঞান, আধো অজ্ঞান অবস্থায় মারিতা নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
তিনি দাবি করেন, জ্ঞান ফেরার পর তিনি নিজেকে হাভানা হিলটনের একটি বিছানায় আবিষ্কার করেন। তিনি অনুমান করেন, হাসপাতাল থেকে তাকে ইনজেকশন প্রয়োগ করে অজ্ঞান করে পুনরায় হোটেলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই হোটেলেই তিনি কাস্ত্রোর সাথে সচরাচর থাকতেন। যখন তিনি জেগে উঠলেন, তখন তিনি কিউবান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ক্যামিলো সিয়েনফুগোসকে তার স্যুটকেস গোছগাছ করতে দেখতে পান।
ক্যামিলো মারিতাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করছিলেন। ক্যামিলো বলেন, কাস্ত্রোর প্রতিপক্ষদের হামলার আশঙ্কায় কাস্ত্রো ও তাদের সন্তানকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ঘটনার এই অংশটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ নিউ ইয়র্কে ফিরে আসার পরপরই মারিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসক বলেন, হাভানায় তার অপরিকল্পিত গর্ভপাত ঘটানোর কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছিলো। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, সত্যিই কি মারিতা কাস্ত্রোর সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন?
যদিও মারিতা নিজের আত্মজীবনীতে দাবি করেন, তার ও ফিদেল কাস্ত্রোর সন্তানের নাম আন্দ্রে, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার ও ফিদেলের আশ্রয়ে বড় হয়েছেন। মারিতার সাথে আন্দ্রের ১৯৮১ সালে কিউবায় শুধুমাত্র একবার দেখা হয়, যার অনুমোদন ফিদেল কাস্ত্রো দিয়েছিলেন। কথিত আছে, আন্দ্রে তখন ডাক্তারি পড়ছিলেন। মারিতা তার মা জানতে পেরে আন্দ্রে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। তবে এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মারিতা কিউবায় ফিরেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিলো কাস্ত্রোকে হত্যা করা
মারিতা যখন নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন, তখন তার মা অ্যালিসা লরেঞ্জ তাকে ফটো জার্নালিস্ট, সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান অ্যালেক্সান্ডার রোর্ক জুনিয়রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মারিতাকে তার মা ও অ্যালেকজান্ডার কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে নানাভবে প্ররোচিত করেন। পরবর্তীতে এতে প্রভাবিত হয়ে মারিতা ক্যাস্ট্রো বিরোধী নানা রকম কর্মসূচীতে জড়িয়ে পড়েন।
ঘটনাচক্রে এসব আন্দোলন ও প্রচারণার পেছনে সিআইএ বিনিয়োগ করেছিলো। মারিতা সিআইএ’র কর্তাব্যক্তিদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। এদিকে মারিতার অলক্ষ্যেই অ্যালিসা ও অ্যালেক্সান্ডার রোর্ক জুনিয়র ১৯৬০ সালের মে মাসে গোপনে একটি ম্যাগাজিনের কাছে একটি নিবন্ধ বিক্রি করে দেন। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিলো, Fidel Castro Raped My Teen-Age Daughter।
এদিকে মারিতার জীবনে কিন্তু নাটকীয়তা থেমে থাকেনি। তিনি যেমন একদিকে এফবিআই এর গোপন প্রতিনিধি হিসেবে তথ্য সংগ্রহ ও আদানপ্রদানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, অপরদিকে সিআইএ মারিতাকে গোপন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে মিয়ামিতে গুপ্তচর প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছিলো। মিয়ামিতে মারিতা আলট্রা সিক্রেট ফোরটি নামক সিআইএর গোপন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন, যার প্রধান ছিলেন এডুয়ার্ডো। এডুয়ার্ডো ছিলেন ধনকুবের। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হবার পর মারিতা এডুয়ার্ডোর আসল পরিচয় জানতে পারেন, যাকে বিশ্ববাসী ই. হাওয়ার্ড হান্ট নামে চেনে।
১৯৬০ সালের ৪ ডিসেম্বর, মারিতা কিউবাতে ফিরে আসেন; লক্ষ্য ফিদেল কাস্ত্রোকে চিরদিনের মতো নিস্ক্রিয় করা, তথা হত্যা করা। সিআইএ মারিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলো বটুলিজম নামক দুটি বিষাক্ত ট্যাবলেট। মারিতার উপর নির্দেশ ছিলো বিষাক্ত ট্যাবলেট দুটি পানীয়তে মিশিয়ে কাস্ত্রোর হাতে তুলে দেবার, যা মাত্র ৩০ সেকেন্ডে নিশ্চিত করবে কাস্ত্রোর মৃত্যু। এমনকি এই কাজ সম্পন্ন করার আগে মারিতার হাতে গাটস পিল নামক দুটি ট্যাবলেট তুলে দেওয়া হয়েছিলো, যা খেলে মারিতার চিন্তাশক্তি একাগ্র হবে, হত্যাকান্ডে তিনি বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হবেন না। মারিতা বিষাক্ত ট্যাবলেট দুটি প্রসাধনী ক্রিমের মাঝে লুকিয়ে কিউবায় নিয়ে আসেন।
হত্যাকান্ডের সুযোগ
কিউবায় কিলিং মিশন হাতে পৌঁছান মারিতা লরেঞ্জ। সেই চিরপরিচিত হোটেল হাভানা হিলটন। স্যুইট নাম্বার ২৪০৮। এই কক্ষেই কত না রাত কাটিয়েছেন তিনি। আজ সেই কক্ষে দুরু দুরু বক্ষে তার প্রেমিক কাস্ত্রোকে হত্যা করতে হবে। বাইরে সিআইএ’র গুপ্তচর অপেক্ষমান। তারা একইসাথে সময় ও মারিতার উপর নজর রাখছেন, যেন কিলিং মিশন ব্যর্থ না হয়। অবশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত কাস্ত্রো তার কক্ষে ফিরে এলেন।
কাস্ত্রোকে দেখার পূর্বেই স্মৃতিকাতর মারিতা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি তার ভালোবাসাকে হত্যা করতে পারবেন না। কাস্ত্রো মারিতাকে দেখেই প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন, তুমি কি এখনো আমার বিরোধীদের সাথে মিয়ামিতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছো? মারিতার উত্তর ছিল, হ্যাঁ। কাস্ত্রোর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তুমি কি সিআইএ’র হয়ে কাজ করছো? মারিতার উত্তর ছিল, আমি শুধু নিজের হয়ে কাজ করি। কাস্ত্রোর পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, তুমি কি আমায় হত্যা করতে ফিরে এসেছো? মারিতার উত্তর ছিল, হ্যাঁ। কিন্তু আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। কাস্ত্রো প্রত্যুত্তরে খুশি হয়ে বলেছিলেন, ভালো, খুব ভালো।
ইতোমধ্যে দুঃসাহসী কাস্ত্রো মারিতার হাতে নিজের লোডেড .৪৫ পিস্তলটি তুলে দিয়েছেন। মারিতা পিস্তলের চেম্বার চেক করে গুলিভরা পিস্তলটি কাস্ত্রোর দিকে তাক করেন। কাস্ত্রো একনজর মারিতার দিকে চেয়ে বলেন,
তুমি আমায় মারতে পারবে না, কেউ আমাকে হত্যা করতে পারবে না।
এই বলে কাস্ত্রো মারিতাকে জড়িয়ে ধরেন। পরদিন কাস্ত্রোকে ঘুমের মধ্যে রেখেই ব্যর্থ মারিতা লরেঞ্জ মিয়ামিতে ফিরে আসেন। এই একবারই মারিতা লরেঞ্জ তার মিশনে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি তার প্রথম ভালোবাসা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তী বহু মিশন তিনি সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন। কিন্তু সেটা তার জীবনের তৃতীয় অধ্যায়। সেই গল্প নাহয় আরেকদিন বলা যাবে।
শেষ জানা পর্যন্ত মারিতা নিউ ইয়র্ক শহরের কুইন্সের কোনো এক হাসপাতালে ছিলেন। তখন তার বয়স ৭৯ বছর, আর ফিদেল কাস্ত্রো ৯০ বছর বয়সে ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর পরলোকগমন করেন।