১
ভাটিতে একের পর এক ব্যর্থতার দরুন ক্ষুব্ধ মুঘল সম্রাট আকবর শাহবাজ খান কাম্বোকে বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন। পরে সাদিক খান, উজির খান আর সাইদ খানের হাত ধরে বাংলার সুবাদারির এই দায়িত্ব শেষপর্যন্ত চলে আসে রাজা মানসিংহের হাতে।
সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম একজন সদস্য এবং আকবরের বিশ্বস্ত এই সেনাপতি রাজা মানসিংহ ছিলেন আম্বারের রাজা ভগবান দাসের ভ্রাতুষ্পুত্র। নিঃসন্তান হওয়ায় রাজা ভগবান দাস মানসিংহকে লালন পালন করে বড় করেছিলেন। সম্রাট আকবর মানসিংহকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি তাকে ‘ফরজন্দ’ বা ‘পুত্র’ বলে সম্বোধন করতেন। রাজা মানসিংহের সাথে সম্রাট আকবরের আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। সম্রাট আকবর মানসিংহের ফুপু হীরা কুনওয়ারিকে বিয়ে করেছিলেন।
মানসিংহও সম্রাট আকবরের প্রতি অসম্ভব অনুগত ছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের হয়ে অসংখ্য যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এসবের মাঝে নিজ জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে হলদিঘাটের যুদ্ধে বৃহত্তর স্বার্থে মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। পাঞ্জাবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, উদ্ধত আর বিদ্রোহপ্রবণ আগফান জাতিগুলোকে শান্ত করার ক্ষেত্রেও তার অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও তিনি বিহারের আফগান বিদ্রোহ দমনে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন।
ভগবান দাসকে যখন পাঞ্জাবের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, রাজা মানসিংহ তখন সিন্ধুর তীরের কিছু গ্রাম দেখাশোনা করতেন। ১৫৮১ সালে সম্রাট আকবর যখন তার বিদ্রোহী ভাই মির্জা মুহাম্মদ হাকিমকে দমন করতে কাবুলে গিয়েছিলেন, তখন তার সাথে মানসিংহকে নিয়েছিলেন। মির্জা মুহাম্মদ হাকিম সেই যাত্রায় পরাজিত হয়ে পিছু হটেছিলেন, আকবর তার সৎ বোন বখত-উন-নিসাকে কাবুলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। তবে তিনি মির্জা মুহাম্মদ হাকিমের কাবুলে আসার রাস্তা খোলা রেখেছিলেন, এবং কাবুলের গভর্নর হিসেবে তিনিই মূল দায়িত্ব পালন করতেন। ১৫৮৫ সালে মির্জা মুহাম্মদ হাকিম মারা যাওয়ার পর আকবর কাবুলে গভর্নর হিসেবে রাজা মানসিংহকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
১৫৮৮ সালে মানসিংহকে বিহারের গভর্নর করে পাঠানো হয়। ১৫৮৯ সালের ডিসেম্বরে তার পিতা ভগবান দাসের মৃত্যুর পর তাকে ‘রাজা’ উপাধী দিয়ে ৫ হাজার সৈন্যের মনসবদারি দেওয়া হয়। এর ১৬ বছর পর তিনি ৭ হাসার সৈন্যের মনসবের অধিকারী হলেন। এ এক বিরল সম্মাননা। কারণ ততদিন পর্যন্ত মুঘল রাজপরিবারের বাইরের কেউ ৭ হাজার সৈন্যের মনসবদারির অধিকারী হতে পারেননি। তবে এতকিছুর পরেও রাজা মানসিংহ সম্রাট আকবরের বানানো হযবরল ধর্ম কিংবা ধর্মীয় নীতি যা-ই বলা হোক না কেন, সেই দ্বীন-ই-ইলাহিকে গ্রহণ করেননি। আর ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’-কে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে আকবরও কখনো কাউকে চাপও দেননি।
২
রাজা মানসিংহ বাংলার দায়িত্ব পান ১৫৯৪ সালের শুরুতে। সে বছরের মে মাসেই তিনি রাজধানী তান্ডায় চলে আসেন। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি রাজধানী অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। নিরাপদ জায়গা হিসেবে রাজমহল তার মনে ধরলো। দক্ষিণ আর পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা রাজমহল সত্যিকার অর্থেই নিরাপদ একটি শহর ছিল। শহরটির উত্তর আর পূর্বাংশ সমতল হয়ে গঙ্গার পাড়ে এসে মিশেছে। ফলে শহরটির সাথে অন্যান্য অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব চমৎকার ছিল। ১৫৯৫ সালের ৭ নভেম্বর রাজমহলের নাম পরিবর্তন করে আকবরনগর রাখা হলো। এই আকবরনগরকেই এরপর রাজধানীর মর্যাদা দেওয়া হলো।
ইতোপূর্বে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরেই নিজ পুত্র হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে ভূষণার জমিদার মুকুন্দ রায়ের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন তিনি। ১৫৯৫ সালের এপ্রিল মাসে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে ভূষণার মুকুন্দ রায় পরাজয়ের পর পুনরায় মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নেন।
রাজধানী পরিবর্তন করার পর মানসিংহ ভাটিতে অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। বর্ষা আসার আগেই ডিসেম্বরের শীতে তিনি ভাটি অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। মানসিংহের বাহিনীর একাংশ রহনপুর, নাজিরপুর আর শাহপুর হয়ে ঘোড়াঘাটে অবস্থান নিলো। মানসিংহ স্বয়ং নৌবহরের সাথে রাজশাহীর বারনই নদী হয়ে বাগমারার ভবানীগঞ্জের কাছাকাছি ফকিরানী নদীর তীরবর্তী একটি স্থানে এসে ঘাটি গাড়লেন। স্থানটি পরে মানসিংহপুর নামে পরিচিত হয়।
মানসিংহ সরাসরি ভাটিতে অভিযান চালানোর আগে ছোট খাট বিদ্রোহী জমিদারদের ঠাণ্ডা করার কথা ভাবলেন। এসব জমিদারদের অনেকেই নামমাত্র মুঘল আনুগত্য স্বীকার করেছিল, কেউ কেউ বা আবার দীর্ঘদিন ধরে কোনো খাজনা দেয়নি। কাজেই মানসিংহ পেছনে ঝামেলা নিয়ে এগোতে চাচ্ছিলেন না।
প্রথমেই আক্রমণ করা হলো রাজশাহীর লস্করপুর পরগণাতে। জায়গিরদার লস্কর খান পরাজিত হলেন। এরপর একে একে কাশিমপুর আর নাজিরপুরে জায়গীর পুনরুদ্ধার করে বিশ্বস্ত লোকেদের কাছে বন্টন করা হলো। অন্যদিকে চলনবিল অঞ্চলে নিজের আধিপত্য কায়েম করলেন মানসিংহের ভাই ভানসিংহ।
এদিকে মানসিংহ রাজশাহী থেকে বগুড়ার শেরপুরে চলে আসলেন। এখানে শের শাহের আমলের একটি দুর্গ ছিল। দুর্গটি সংস্কার করার নির্দেশ দিলেন তিনি। এর ভেতরেই বর্ষা চলে আসায় কিছুটা উত্তরে গিয়ে ঘোড়াঘাটে অবস্থান নিলেন তিনি। কিন্তু ঘোড়াঘাট এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
৩
মানসিংহের নতুন সুবাদারির দায়িত্ব পাওয়ার কথা ঈশা খানের অজানা ছিল না। মানসিংহ যে রাজধানী পরিবর্তন করে ভাটিতে অভিযান চালানোর জন্য বের হয়েছেন, সে খবরও তিনি পেয়েছেন। কাজেই তিনিও নিজের প্রস্তুতি শেষ করে সতর্কাবস্থায় রইলেন। ঘোড়াঘাটে অবস্থানের খবর পেয়ে তিনি মানসিংহকে ঘোড়াঘাট থেকে আর বের হওয়ার সুযোগ না দিয়ে সেখানেই আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে এগুলেন। কিন্তু ঘোড়াঘাট থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে এসে তিনি পরিকল্পনা বাদ দিতে বাধ্য হলেন। এসময় করতোয়া নদীতে পানি খুব কম ছিল। যুদ্ধাবস্থায় পানি স্বল্পতার কারণে নৌবহর আটকে গেলে যে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা ভেবেই তিনি পিছু হটলেন।
ঈশা খানের পিছু হটার সংবাদ শুনে রাজা মানসিংহ তাকে ধাওয়া করার জন্য পুত্র হিম্মত সিংহকে পিছু নিতে বললেন। ঈশা খান দ্রুত এগারসিন্দুরে চলে আসলেন। পিছু পিছু এগারসিন্দুরে আসলেন হিম্মত সিংহও। ঈশা খান এগারসিন্দুর থেকেও পিছু হটলেন। হিম্মত সিংহ এগারসিন্দুর দখলে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের তীরে ঘাটি গাড়লেন। কিন্তু এই ঘাটিতেই একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। ১৫৯৭ সালের মার্চের ১৫ তারিখে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হিম্মত সিংহ মৃত্যুবরণ করলেন।
এগারসিন্দুরে অবস্থানকালে ঈশা খান বুঝতে পারলেন মানসিংহ ভাটির দখল নিতে মরিয়া। ভাটি বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য আত্মসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি বেশিদিন মাটি কামড়ে থাকতে পারবেন না। কাজেই তিনি নতুন আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র খোলার চেষ্টা করলেন। তিনি এবার ‘প্রক্সি ওয়ারের’ দিকে এগোলেন।
৪
যে সময়ের আলোচনা করছি, সেসময় কোচবিহার রাজ্য ‘কামরূপ’ আর ‘কামতা’ নামক দুইটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সংকোশ নদের পূর্বদিকে কামরূপের রাজা ছিলেন রঘুদেব। আর পশ্চিমে কামতা রাজ্যের রাজা ছিলেন রাজা নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ। সম্পর্কের দিক থেকে এই দুই রাজা ছিলেন চাচাতো ভাই। কামতা রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজা রঘুদেব ঈশা খানের নিকট সাহায্য চাইলেন। ঈশা খান রঘুদেবকে সাহায্য করলেন।
ঈশা খানের সমর্থনপুষ্ট হয়ে রঘুদেব কামতায় আক্রমণ চালালেন। নিজ রাজ্য টিকিয়ে রাখতে লক্ষ্মীনারায়ণ ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এই নীতিতে মানসিংহের সাহায্য চাইলেন। মানসিংহও লক্ষ্মীনারায়ণকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। তিনি কোচবিহারের দিকে রওনা হলেন। ঈশা খান আর রঘুদেব দ্রুত কামতা থেকে সরে গেলেন। কামতা লক্ষ্মীনারায়ণকে পুনরুদ্ধার করে দিয়ে মানসিংহ আবার রাজধানীতে ফিরে গেলেন।
কোচবিহার থেকে মানসিংহ সরে যাওয়ার খবর শুনে রঘুদেব আবারও কামতায় আক্রমন চালালেন। মানসিংহকে আবারও কামতায় সেনাবাহিনী পাঠাতে হলো। মুঘল সেনাবাহিনী রওনা হওয়ার সাথে সাথেই ঈশা খান রঘুদেবের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বাহিনী পাঠালেন।
মানসিংহ কিন্তু ঈশা খানের খেলাটা বুঝে ফেলেছেন। তিনি তার আরেক পুত্র দুর্জন সিংহকে পাঠালেন ভাটির উদ্দেশ্যে। ১৫৯৭ সালের ভরা বর্ষায় দুর্জন সিংহ ভাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দুর্জন সিংহ ঈশা খানের অধিকৃত অঞ্চলে অভিযান চালাতে চালাতে কতরাব পর্যন্ত পৌছে গেলেন। ঈশা খান তার সহযোগী মাসুম খান কাবুলিকে নিয়ে বিক্রমপুর থেকে কিছুটা দূরে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
মুঘলরা এমনিতেই ভাটির ভরা বর্ষায় প্রতিপক্ষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে থাকে। ইতোপূর্বে জাঁদরেল অনেক জেনারেলকে দেখা গিয়েছে এই সময়ে ঈশা খানকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে। কিন্তু দুর্জন সিংহ কি মনে করে কে জানে, ঈশা খানের মুখোমুখি হলেন। বর্তমান খিজিরপুর, ঢাকার ডেমরা, সোনারগাঁও, ধলেশ্বরী, মেঘনা আর শীতলক্ষ্যার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই যুদ্ধে মুঘল নৌবাহিনী আরেকবারের মতো শোচনীয় পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। এই যুদ্ধে খোদ দুর্জন সিংহ মারা গেলেন। বিপুল সংখ্যাক মুঘল সৈন্য ঈশা খানের হাতে বন্দী হলো।
৫
হিম্মত সিংহ আর দুর্জন সিংহ দুজনই ছিলেন যোগ্য সামরিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ভাটি তাদের দুজনকেই ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল। হিম্মত সিংহ মারা গেলেন সুপেয় পানির অভাবে, কলেরাতে। আর দুর্জন সিংহ মারা গেলেন ঈশা খানের রণকৌশলে। একে একে দুই যোগ্য পুত্র হারিয়ে রাজা মানসিংহ গেলেন মুষরে। তিনি কিছুদিনের জন্য বাংলা ত্যাগের জন্য আকবরের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আকবর অনুমতি দিলে ১৫৯৮ সালের শুরুর দিকে মানসিংহ বাংলা ত্যাগ করলেন। মানসিংহের স্থলাভিষিক্ত হলেন তার আরেক পুত্র জগৎ সিংহ। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের বদঅভ্যাসের কারনে জগৎ সিংহ আগ্রাতেই মারা গেলেন। বাংলার দায়িত্ব দেওয়া হলো জগৎ সিংহের পুত্র মহাসিংহকে।
একের পর এক পরাজয়ের তিক্ততা আর মৃত্যুশোকে মুঘল শিবির যখন শোকাহত, ভাটির শিবিরে তখন স্বস্তি বিরাজ করছিল। তবে সেই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। পর পর দুইটি মৃত্যুসংবাদে গোটা ভাটি আর ভাটির সহযোগী অঞ্চলগুলো শোকে হতবাক হয়ে গেলো। ভাটি বাংলায় মুঘল বিরোধী শক্তিজোটের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুইজন নেতা মারা গেলেন। সে গল্প থাকছে পরের পর্বে।
[এই সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]