বাধ্য হয়ে পকেট থেকে আরো কয়েকটা মুদ্রা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন উইলফ্রিড ভয়নিচ। বইটি তিনি হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। দোকানি মুদ্রাগুলো পরীক্ষা করে বইখানা ভয়নিচের হাতে দিয়ে দিলেন। সেটি নিজের ব্যাগের ভেতর ভরে বাসার দিকে রওয়ানা দিলেন ভয়নিচ।
ব্যবসার জন্য বই কিনতে বের হয়ে প্রথম তার চোখে পড়ে এই অদ্ভুত হাতে লেখা বইটি। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পরখ করে দেখার পরেই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। কারণ তিনি বইয়ের লেখা কিছুই পড়তে পারছেন না। ভয়নিচ নিজে অনেক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এরকম বর্ণমালা এর আগে কখনো দেখেননি। তাই দেরি না করে কিনেই ফেললেন বইটি।
বাসায় এসে বইটি নেড়েচেড়ে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ বইয়ের ভেতর থেকে একটি খাম মাটিতে পড়ে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ভয়নিচ। বইয়ের ভেতর এই চিঠিটা আবার কার?
একদিকে অচেনা বর্ণমালার গোলকধাঁধা, অপরদিকে খামে ভরা একটি রহস্যময় চিঠি। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির গল্পের শুরুটা ঠিক এখান থেকেই।
১৯২১ সালে বই বিক্রেতা উইলফ্রিড ভয়নিচ কর্তৃক পাণ্ডুলিপিগুলো জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এটি গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে। শুরু হয় এর পাঠোদ্ধারের কাজ। অথচ আবিষ্কারের প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি এসেও এর পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি কেউ। কেউই পড়তে পারেননি ভয়নিচের বিস্ময়কর বইটি। আমাদের আজকের আলোচনা সেই বিখ্যাত ভয়নিচ পাণ্ডুলিপিকে ঘিরে।
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি কী?
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে একটি। এটি মধ্যযুগে লেখা একটি বই। কিন্তু অন্যান্য বই থেকে একে আলাদা করেছে এর লেখার ধরন এবং বর্ণমালার দুর্বোধ্যতা। বইটির অনুসন্ধানদাতা উইলফ্রিড ভয়নিচের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় Voynich Manushcript বা ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি হিসেবে।
চামড়া দ্বারা বাঁধাইকৃত বইটির সর্বমোট পৃষ্ঠার সংখ্যা প্রায় ২৩৪। গবেষকদের মতে কিছু পৃষ্ঠা আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে হারিয়ে গেছে। বইটি লেখা হয়েছে অদ্ভুত বর্ণমালার সাহায্যে। ইতিহাস ঘেঁটে এরূপ কোনো বর্ণমালার অস্তিত্ব বের করতে ব্যর্থ হন ইতিহাসবিদরা। আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে পরীক্ষা চালানোর পরেও এর বর্ণমালার রহস্যের সমাধান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, পাণ্ডুলিপির বর্ণমালায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ধরনের বর্ণের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়াও লিখিত বর্ণনার সাথে বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির সংযোজন বইটিকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে।
আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বইটি থেকে আলাদা ৪টি পৃষ্ঠা নিয়ে কার্বন ডেটিং করা হয়। কার্বন ডেটিং এর ফলাফল অনুযায়ী বইটি সম্ভবত ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের সময় লেখা হয়েছিলো। বইয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন কালির মধ্যে বড় রকমের কোনো পার্থক্য নেই। অন্যান্য বইয়ের মতো এর শুরুতে লেখকের নাম-স্বাক্ষর নেই। তাই সুনির্দিষ্টভাবে এর লেখকের নাম জানা যায়নি।
ক্রয় করার প্রায় ৯ বছর পর ভয়নিচ বইটি College of Physicians of Philadelphia-এর একটি সভাতে প্রদর্শন করেন। এরপর থেকে একে নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। বের হতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
রহস্যময় চিঠি এবং পাণ্ডুলিপির ইতিহাস
উইলফ্রিড ভয়নিচ বইটি ক্রয় করার পর এর ভেতরে একটি চিঠিসহ একটি খামের সন্ধান পান। খামের উপর প্রেরক প্রাপকের ঘরে নাম ঠিকানা লেখা ছিল। বইসহ চিঠিটি ১৬৬৫ সালে বিজ্ঞানী জোয়ানাস মার্কাস মার্সি সুদূর ইতালিতে তার বন্ধু আথানাসিয়াস কার্চারকে প্রেরণ করেন। চিঠিতে তিনি এই বইয়ের অর্থ বের করে দেওয়ার জন্য আথানাসিয়াসকে অনুরোধ করেন। চিঠি অনুযায়ী বইটি হাবসবার্গের রাজা দ্বিতীয় রুডলফের মালিকানাধীন ছিল। পরবর্তীকালে বইয়ের ভেতর রাজা দ্বিতীয় রুডলফের এক সভাসদের স্বাক্ষর পাওয়া গেলে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত হয়।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, বিজ্ঞানী জোয়ানাস কীভাবে বইটি পেয়েছিলেন? এর প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে থাকা গবেষকরা বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমর্থিত ব্যাখ্যাটি তুলে ধরা হলো।
ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজা দ্বিতীয় রুডলফের শাসনকাল ছিল ১৫৭৬ সাল থেকে ১৬১১ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বইয়ের উৎপত্তি আরো ২০০ বছর আগে। এর মানে রুডলফ ঠিক বইটির প্রথম মালিক নন। জোয়ানাসের চিঠি অনুযায়ী তিনি বইটি ৬০০ ডুকাটের মাধ্যমে ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু উৎপত্তি থেকে রুডলফের সভা পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসের কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি গবেষকরা। সম্ভবত জন ডি নামক এক ব্যক্তি বইটি রাজার দরবারে প্রদর্শন করেছিলেন।
তারপর বইটির মালিকানা বদল হয়। কিন্তু পরবর্তী মালিকের কোনো পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত রুডলফের কোনো সভাসদ তার পতনের পর বইটি নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন। কিন্তু এর পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
এরপর বইটি স্থান পায় জর্জ বারেশের লাইব্রেরিতে। পাগলাটে রসায়নবিদ বারেশ কীভাবে বইটি সংগ্রহ করেন তা কেউ জানে না। বারেশ বইটির রহস্যভেদের জন্য অনেক গবেষণা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।
তিনি তখন আথানাসিয়াস কার্চারের নাম জানতে পারেন। কার্চার হায়ারোগ্লিফিক লিপি নিয়ে কাজ করতেন। কিছু দুর্বোধ্য হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করে তিনি তখন বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। বারেশ বইটির কিছু অংশ কার্চারকে প্রেরণ করেন। কিন্তু কার্চার বারেশকে কোনো সমাধান দিতে পারেননি।
বারেশের মৃত্যুর পর বইটি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জোয়ানাস মার্সির মালিকানায় চলে আসে। বারেশের উইল অনুযায়ী তিনি বইটি কার্চারের কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে কার্চারকে তার গবেষণার অগ্রগতির কথা জিজ্ঞাসা করে কোনো আশানুরূপ উত্তর পাননি মার্সি। কার্চারের মৃত্যুর পর তার সংগ্রহে থাকা অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি কলেজিও রোমানোর জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়। এদের মধ্যে ভয়নিচ পাণ্ডুলিপিও অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু হঠাৎ করে সমাজব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন চলে আসে। কলেজিও রোমানোসহ বিভিন্ন বড় বড় সংগ্রহশালায় রুল জারি করা হলো ‘যিশু সমাজ’ সঙ্ঘ থেকে। রুল অনুযায়ী হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি সরিয়ে ফেলার আদেশ দেওয়া হয়। অনেক পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে ফেলা হলো। তবে গুটিকয়েক পাণ্ডুলিপি ভ্যাটিকানের পোপের গোপন লাইব্রেরিতে স্থানান্তরের জন্য মনোনীত করা হয়। কিন্তু পাণ্ডুলিপিগুলো নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রায় নয় বছর লেগে গেলো।
ঠিক তখনই ইতিহাসের মঞ্চে ত্রাণকর্তা উইলফ্রিড ভয়নিচের পদার্পণ হয়। তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তি করে কিছু পাণ্ডুলিপি অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে নিজের মালিকানায় নিয়ে আসেন। তবে শর্ত ছিলো, এগুলো তিনি বাইরে প্রকাশ করতে পারবেন না। ভয়নিচও রাজি হয়ে যান। সেই রহস্যময় পাণ্ডুলিপিসহ আরো অনেক নথি ভয়নিচ ক্রয় করে ফ্লোরেন্সে পাঠিয়ে দেন। তিনি সংগৃহীত নথিগুলোর মধ্যে সেই ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তিনি এর রহস্যের কোনো কূলকিনারাই করতে পারেননি। তবে চুক্তির শর্ত মোতাবেক ইউরোপে থাকা অবস্থায় ভয়নিচ কখনো পাণ্ডুলিপির কথা প্রকাশ করেননি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভয়নিচ সপরিবারে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে যাওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে তার পাণ্ডুলিপির কথা জানান। তারা ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়েন ভয়নিচের কথায়। শেষপর্যন্ত ১৯২১ সালে ফিলাডেলফিয়াতে তিনি তার পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এরপর তার অনুমতি নিয়ে অনেকেই সেটার রহস্য সমাধান করার চেষ্টা করেন। লোকমুখে তখন এই বইয়ের নাম হয়ে যায় ‘ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি’।
ভয়নিচ ১৯৩০ সালে মৃত্যুবরণ করার পরে তার পরিবার বইটি ওয়াশিংটনে অবস্থিত ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেনরি হায়ভারনেটের নিকট হস্তান্তর করেন। এরপর আরো কয়েক দফা মালিকানা বদলের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে ভয়নিচের সেই বইয়ের কথা। এদিকে ওদিকে গুঞ্জন উঠে, “সেই অদ্ভুত বইয়ের কথা শুনেছো? সেটা নাকি কেউই পড়তে পারে না!”
রহস্যের গন্ধ পেয়ে উৎসাহীরা এগিয়ে আসেন। শুরু হয় গবেষণা।
পাণ্ডুলিপির ভেতর কী লেখা?
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির মূল রহস্য এর বইয়ের পাতায় লেখা বর্ণগুলো। এক অজানা ভাষায় লেখা হয়েছে পুরো বইটি। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কোনো বর্ণমালার অস্তিত্ব না পেয়ে বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, বর্ণগুলো সাংকেতিক বর্ণ। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ২/৩ টি করে অনুচ্ছেদ রয়েছে।
এরপরের রহস্য এর মধ্যে আঁকা বিভিন্ন চিত্রগুলো নিয়ে। হাতে আঁকা এসব ছবি দেখে একবার মনে হয়, এটা কোনো বিজ্ঞানীর নোটখাতা। কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠা পরেই আপনার ভুল ভাঙবে। তখন মনে হবে এটা হয়তো কোনো জ্যোতিষীর ভাগ্যগণনার সহায়িকা। যতই পাতা উল্টাতে থাকবেন, ততই দ্বিধায় ভুগবেন।
কিছু কিছু পাতায় আবার বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, ত্রিভুজ ইত্যাদি জ্যামিতিক নকশায় গুটি গুটি অক্ষরে বাক্য রচনা করা হয়েছে। শেষের দিকের পৃষ্ঠাগুলোয় লেখা বাক্যগুলো লেখা হয়েছে জাপানীদের মতো লম্বভাবে।
সম্প্রতি ভাষাবিদরা জানান বইটির বেশকিছু বর্ণে গ্রিক বর্ণমালার ছাপ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ বর্ণমালা দেখতে প্রাচীন রসায়নবিদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন চিহ্নের মতো মনে হয়। প্রাচীনকালে প্রাপ্ত অন্যান্য পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে প্রায়ই বাক্যে ভুলের কারণে কেটে দিয়ে সংশোধন করার নমুনা রয়েছে। কিন্তু এই রহস্যময় বইটিতে ভুলের সংখ্যা কত জানেন? শূন্য!
একটি বাক্যও সংশোধন করতে হয়নি লেখককে। বিভিন্ন রঙের কালির ব্যবহারে লেখা পুরো বইয়ে বর্ণমালার সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। শুধু এই সংখ্যাটুকুই গবেষকদের ঘুম নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!
এরপর আসা যাক ছবির কথায়। বইয়ের ভেতর ফুল, ফল, পাতা, মানুষ, চিহ্নসহ আঁকা ছবিগুলোকে গবেষকরা ৭ বিভাগে ভাগ করেছেন। ভেষজ, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাজাগতিক বস্তু, রাশিচক্র, জীবজগৎ, সাংকেতিক চিহ্ন এবং চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছবি রয়েছে। কিছু কিছু ছবির সাথে জুড়ে দেয়া সংক্ষিপ্ত বাক্য পাওয়া যায়। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এর মধ্যে চীনা পৌরাণিক প্রাণী ড্রাগনের ছবিও পাওয়া যায়।
পাঠোদ্ধারে কোনো আশানুরূপ অগ্রগতি না পাওয়ায়, অনেকেই হাল ছেড়ে দেন। কয়েকজন বিজ্ঞানী পুরো বইটিকেই বানোয়াট বলে দাবি করেন। তাদের মতে এটি অর্থলাভের আশায় ভয়নিচের বানানো তামাশা ব্যতীত আর কিছু নয়। একটা সময় সবাই প্রায় মেনে নিয়েছিলেন, এর কোনো অর্থ হয়তো নেই। কিন্তু তখন লন্ডনের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ গর্ডন রাগ নতুন এক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি ভয়নিচের আদলে আরেকটি সাংকেতিক ভাষা তৈরি করে সে অনুযায়ী বাক্য রচনা করে দেখান। তিনি গাণিতিক উপায়ে প্রমাণ করেন, ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি অর্থবোধক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংখ্যা কখনো মিথ্যা বলে না। তাই বিজ্ঞানীরা আর পূর্বের মতো এক কথায় একে ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন না। এ ব্যাপারে রাগ বিবিসির একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন,
“I don’t think there’s much chance that the Voynich manuscript is simply an unidentified language, because there are too many features in its text that are very different from anything found in any real language.”
পান্ডুলিপির লেখক কে?
ভয়নিচ যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি বিশ্বাস করতেন এই বইয়ের লেখক বিখ্যাত দার্শনিক রজার বেকন। কারণ বইয়ের সাথে পাওয়া খামের ভেতর বিজ্ঞানী জোয়ানাস মার্সি বইটি রজার বেকন কর্তৃক লেখা হতে পারে বলে উল্লেখ করেছিলেন। এ ব্যাপারে ভয়নিচ একমত ছিলেন। তার মতে, রজার বেকনের ব্যক্তিগত নথিপত্রের দায়িত্বে থাকা জন ডি রাজা দ্বিতীয় রুডলফের দরবারে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। জন ডি সেই পাণ্ডুলিপি রুডলফের নিকট বিক্রয় করেন বলে ধারণা করা হয়। তাই ভয়নিচ বিশ্বাস করতেন জন ডি বইখানা রজার বেকনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
ভয়নিচের মৃত্যুর পর কলা বিশেষজ্ঞ এরউইন পেনফস্কি বইয়ের পৃষ্ঠা পরীক্ষা করে এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন। কারণ এ ধরনের পৃষ্ঠা ব্যবহার শুরু হওয়ার অনেক আগেই রজার বেকন মৃতুবরণ করেন।
যদি বেকন বইটির লেখক না হন, তাহলে কে ছিলেন? এক্ষেত্রে রাফায়েল নিশোভস্কিকে এগিয়ে রাখেন গবেষকরা। তিনি ছিলেন জোয়ানাস মার্সির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার জীবদ্দশায় তিনি একবার দাবি করেছিলেন যে, তিনি এমন সাংকেতিক ভাষা আবিষ্কার করেছেন যা কখনই কেউ বুঝতে পারবে না। কথিত আছে, বইয়ের লেখক হিসেবে রজার বেকনের সম্ভাবনার কথা তিনিই প্রথম তুলে ধরেন মার্সির কাছে। গবেষকরা মনে করেন, রাফায়েল তার সাংকেতিক ভাষার সাহায্যে পাণ্ডুলিপিটি রচনা করেন এবং তার সাংকেতিক ভাষার অভেদ্যতা পরীক্ষার জন্য বিষয়টি গোপন রাখেন।
এছাড়াও অনেকের মতে, এই বইয়ের লেখক কোনো ইহুদি চিকিৎসক। আবার অনেকের মতে, বইটি ভয়নিচেরই লেখা। অর্থলাভের আশায় তিনি বইটি রচনা করে রহস্যের সৃষ্টি করেন। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা পুরো ব্যাপারটি ‘ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দেয়ার দলে।
পাঠোদ্ধারে অগ্রগতি এবং রুশ গণিতবিদদের বাজিমাত
১৯২১ সালে শুরু হওয়া গবেষণায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ যোগ দেন। কিন্তু কেউই এর পাঠোদ্ধারে সফল হতে পারেননি। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থা FBI এবং CIA এর কর্মকর্তারাও এর গবেষণায় লিপ্ত আছেন। পাঠোদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেও গবেষকরা বিভিন্ন সময় বেশ কিছু তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে।
এক্ষেত্রে সবার প্রথমে চলে আসে উইলিয়াম নিউবোল্ডের নাম। তিনি শেষের দিকে আঁকা একটি বৃত্তাকার নকশার সাথে মহাকাশে অবস্থিত একটি ছায়াপথের মিল খুঁজে পান। তিনি আরো একটি চিত্রের সাথে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখা কোষের সাদৃশ্য প্রমাণ করেন। কিন্তু তার এই তত্ত্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। তার তত্ত্বের পুরোটাই ভুল প্রমাণ করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জন ম্যানলি।
এরপর রবার্ট ব্রাম্বো নামক এক বিজ্ঞানী ল্যাটিন বর্ণমালার সাহায্যে এর পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি বেশিদূর যেতে পারেননি। তার তত্ত্ব গবেষকরা বাতিল করে দেন। এরপর আরো অনেকেই নানা তত্ত্ব প্রদান করলেও কেউই এর পাঠোদ্ধারের কাছাকাছি যেতে পারেননি।
একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেটের সাহায্যে এর রহস্য মীমাংসা করার চেষ্টা করেন FBI এর গবেষকরা। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হন।
১৯৭৮ সালে জন স্টকিও নামক এক গবেষক তার বই ‘Letters to God’s Eye’-তে ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি নিয়ে তার গবেষণার কথা উল্লেখ করেন। তার মতে, বইটিতে কোনো স্বরবর্ণের ব্যবহার করা হয়নি। তার এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত বাজিমাত করে ফেলেন রুশ গণিতবিদরা। RAS Institute of Applied Mathematics এর গণিতবিদরা এক অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করে। তারা পৃথিবীর বিখ্যাত ভাষাগুলোর বর্ণমালা সংগ্রহ করেন। এরপর সেখান থেকে সব স্বরবর্ণ বাদ দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। স্লাভিক, জার্মান, ইংরেজি, রোমান, বাক, গ্রিক, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষার প্রয়োগের মাধ্যমে তৈরি করা বিশেষ কোডের সাহায্যে তারা একটি বাক্যের বেশ কিছু শব্দের অর্থ বের করতে সক্ষম হন। বাক্যটির প্রায় ৬০ ভাগ লেখায় ইংরেজি, জার্মান এবং রোমান ভাষার সংমিশ্রণ ছিল। কিন্তু তার পরেও যেন কিছুই বের করা হয়নি। কারণ,এখনো অনেক পথ বাকি। কিন্তু তারপরেও আবিষ্কারকরা এই ঘটনাকে বিজয় হিসেবে অভিহিত করেন। গবেষকদের প্রধান ইউরি অরলভ মন্তব্য করেন,
“We now know that this can be done.”
এর মাধ্যমে গবেষকরা আশার আলো দেখতে পান। ঝিমিয়ে পড়া গবেষকরা ফের নতুন উদ্দীপনায় কাজে লেগে যান।
বর্তমানে ভয়নিচের পাণ্ডুলিপিটি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।
বিভিন্ন প্রকাশনা এবং গ্রন্থসমূহ
ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি নিয়ে কয়েকশত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সাহিত্যিক পাণ্ডুলিপির রহস্যে বিমোহিত হয়ে রচনা করেন কল্পকাহিনী। ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রবিন ওয়াসারম্যান এর ‘Book of Blood and Shadow’, জোনাথান মেবেরির ‘Assasin’s Code’ এবং মাইকেল কর্ডির ‘The Source’ পাঠকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়।
এছাড়া ইয়েল বিশ্ববিদ্যায়ের উদ্যোগে ২০০৪ সালে এই রহস্যময় বইটির সম্পূর্ণ চিত্র অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এর ফলে পৃথিবীর যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজেই পুরো পাণ্ডুলিপি ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করতে পারবে।
ভয়নিচের পাণ্ডুলিপির দুর্বোধ্যতা যা আধুনিক প্রযুক্তিকেও হার মানাচ্ছে, নিঃসন্দেহে প্রাচীনকালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। এখনও পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো রহস্য অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। তবে গবেষকরা মনে করেন, সেদিন আর বেশিদূরে নেই, যেদিন পুরো পাণ্ডুলিপির রহস্য সমাধান করা সম্ভব হবে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাহায্যে হয়তো একদিন ঠিকই আমরা এর রহস্যভেদ করতে পারবো। তখন জানা যাবে পাণ্ডুলিপির পাতায় পাতায় লুকিয়ে আছে কোন অজানা তথ্য।