Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পৌরাণিক উপকথায় অশুভ ঘটনার যত ব্যাখ্যা

গল্প-উপন্যাসে দেখা যায় ভালো চরিত্রগুলো শেষমেশ সুখ ও শান্তি নিয়ে বসবাস করছে আর খল চরিত্রগুলো তাদের প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বাস্তবতা গল্প-উপন্যাসের মতো নয়। এদের মাঝে রাত-দিন পার্থক্য বিদ্যমান। বাস্তবে খারাপ ঘটনা ঘটে, এমনকি ভালো মানুষের বেলাতেও ঘটে; প্রতিনিয়তই ঘটে। বাস্তব জীবন কেন উপন্যাসের মতো সরল ও সুখী নয়? কেন খারাপ আর অশুভ ঘটনাগুলো ঘটে মানুষের জীবনে? এই ব্যাপারগুলো খেয়াল করেছে প্রাচীনকালের মানুষেরা। এসব কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম উপকথার জন্ম দিয়েছে। এরকম কিছু উপকথা তুলে ধরার প্রচেষ্টা রইলো এখানে।

খারাপ জিনিস ও অশুভ ঘটনার অস্তিত্ব কেন আছে, তা নিয়ে বেশ কিছু উপকথার মাঝে মিল পাওয়া যায়। অনেক মানুষের বিশ্বাস হলো- তাদের দেবতা পৃথিবীকে সবদিক থেকে নিখুঁত করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কিছু একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে পৃথিবী নিখুঁত হয়নি। এই বাধা বা ত্রুটি আসলে কী ছিল, তা নিয়ে আবার ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রকম কাহিনী প্রচলিত আছে।

পশ্চিম আফ্রিকার ডোগন আদিবাসীরা বিশ্বাস করতো, বিশ্ব সৃষ্টির একদম শুরুর দিকে ছিল একটি মহাজাগতিক ডিম। ডিমের ভেতর ছিল দুই জমজ ভাই। দেবতার পরিকল্পনা ছিল দুই ভাই একই সাথে ডিম ফুটে বের হবে। তারা যদি একই সময়ে বের হয়ে আসতো, তাহলে বিশ্বে কোনো খারাপ বা অশুভ জিনিসের অস্তিত্ব থাকতো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। জমজদের একজন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ডিম ফুটে বের হয়ে যায়। আর এর মাধ্যমে সে দেবতার নিখুঁত পৃথিবী তৈরি করার পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়। ডোগন আদিবাসীদের বিশ্বাস অনুসারে, আগে বের হয়ে যাওয়া এই জমজটির কারণেই বিশ্বে অশুভ ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। একদম শুরুতে যদি পরিকল্পনাতে কোনো বাধা দেখা না দিতো, তাহলে অশুভ কোনোকিছুর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতো না বিশ্বে।

ডিম থেকে দুজন একই সময়ে বের না হবার কারণে সৃষ্টি হয়েছে অশুভ ঘটনা; Credit: Dave McKean

মৃত্যুকে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অশুভ ঘটনা বলা যায়। কোনো মানুষই মরতে চায় না। সুস্থ সবলভাবে বাঁচতে চায় বছরের পর বছর। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কারণে মানুষ তার এই আকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে পারে না। মৃত্যুর মতো অশুভ ঘটনাটি কেন ঘটে তা নিয়েও দেশে দেশে নানারকম উপকথা প্রচলিত আছে। সমগ্র আফ্রিকা অঞ্চলের অধিকাংশ আদিবাসী বিশ্বাস করে যে, দেবতা অমরত্ব ও মৃত্যুকে একসাথে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চিরকালব্যাপী বেঁচে থাকার বার্তা পৃথিবীতে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়েছিলেন একটি গিরগিটিকে। আর মৃত্যুর বার্তা পৃথিবীতে পৌঁছে দিতে পাঠিয়েছিলেন একটি টিকটিকিকে।

গিরগিটিকে দেবতা বলেছিলেন, সে যেন দ্রুত পৌঁছে যায়। গিরগিটিও দ্রুত পৌঁছে যাবে বলে উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু পথে দেখা দিল অন্য সমস্যা। এই প্রজাতির গিরগিটি (Chameleon) স্বাভাবিকভাবেই খুব ধীরে চলে। তাই এটি সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। এই সুযোগে টিকটিকি আগে আগে মৃত্যু নিয়ে এলো পৃথিবীতে। যার কারণে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু বিরাজমান। ঐ গিরগিটির বেগ যদি বেশি হতো, তাহলে প্রাণীজগতে মৃত্যুর অস্তিত্ব থাকতো না।

অমরত্ব নিয়ে গিরগিটির পৌঁছুতে দেরি হওয়ায় জগতে স্থান করে নিয়েছে মৃত্যু; Credit: Dave McKean

পশ্চিম আফ্রিকার আরেক আদিবাসী গোষ্ঠীর উপকথা অনুসারে, চিরকাল বেঁচে থাকার বার্তা পাঠানো হয়েছিল একটি ধীর গতির ব্যাঙের মাধ্যমে আর মৃত্যুর বার্তা পাঠানো হয়েছিল দ্রুত গতির কুকুরের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই কুকুরটি ব্যাঙকে পেছনে ফেলে দেবে। কুকুরটি দ্রুত চলে আসে এবং এর মাধ্যমে মৃত্যুর রাজত্ব শুরু হয় পৃথিবীতে।

ধীরগতির ব্যাঙ সঠিক সময়ে নিয়ে আসতে পারেনি অমরত্বকে; Credit: Dave McKean

মৃত্যুর পরেই আসে রোগ-শোকের কথা। সারা পৃথিবীর সকল মানুষেরই রোগ হয়, তাই পৃথিবীর নানা দেশে রোগকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের পৌরাণিক উপকথার জন্ম হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজকের যুগে রোগের চিকিৎসা আছে, রোগ আমাদের কাছে মামুলী ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু মানুষের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় জুড়ে রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে রোগ ছিল আশ্চর্য রহস্যময়।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাঘ, সিংহ সহ অন্যান্য ভয়ঙ্কর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, ক্ষুধায় থেকেছে, অনাহারে থেকেছে। এগুলোর সবই খারাপ ব্যাপার। কিন্তু এগুলোকে নিয়ে তেমন উপকথা নেই। কারণ তখনকার মানুষ এসবের সম্বন্ধে জানতো। ইচ্ছা করলে প্রতিহত করতে পারতো। এগুলো নিত্যদিনের বিপদ হলেও এদেরকে নিয়ে রংচঙে গল্প তৈরি হয়নি।

এদের আক্রমণের পাশাপাশি গুটিবসন্ত, কালা জ্বর, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগেরও আক্রমণ ছিল। এদের কারণে অনেকের মৃত্যু হতো। দিনের পর দিন এই রোগগুলো দেহে বসবাস করতো কিন্তু কেউই তাদের রহস্য উদ্ধার করতে পারতো না। তাই এদেরকে ব্যাখ্যা করতে নানা রকমের উপকথার জন্ম হয়েছিল।

রোগ কোথা থেকে আসে? কেন-ই বা আসে? মানুষের ভাগ্যে কেন রোগের আক্রমণে কষ্টকর মৃত্যু লেখা থাকে? আফ্রিকার অধিকাংশ আদিবাসী রোগের পেছনে অশুভ কোনো সত্ত্বাকে দায়ী করে থাকে। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কারো সন্তানের যদি শরীর খারাপ করে, তাহলে তারা ধরে নেয় পাড়া-প্রতিবেশীর কেউ শত্রুতা করেছে। তারা ভাবে, তাদের সাথে কোনো কারণে বিরোধের জের ধরে কেউ হয়তো জাদু-টোনাকারীকে টাকা দিয়ে রোগ তৈরি করিয়েছে। বাংলাদেশেও এরকম বিশ্বাস দেখা যায়। মেয়ের বিয়ে না হলে বলে, অমুক লোকে হিংসায় পড়ে আমার মেয়ের উপরে তাবিজ (জাদু-টোনা) করেছে। কেউ অকালে মরে গেলে বলে, অমুক লোক আমার প্রিয় ভাইটিকে ‘বান’ (মৃত্যুর মন্ত্র) দিয়ে মেরে ফেলেছে।

এদেশের মানুষদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে কোনো তান্ত্রিক বান মেরে বা তাবিজ করে অশুভ কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে থাকে; Credit: Dave McKean

মাঝে মাঝে পাড়া-প্রতিবেশিদের উপর দোষ না চাপিয়ে দেবতার উপরেও চাপানো হয়। কেউ কেউ মনে করে দেবতাকে কোনো ছাগল বা পশু উৎসর্গ করা হয়নি বলে তিনি নাখোশ হয়ে মর্ত্যবাসীর উপর এমন অশুভ জিনিস প্রদান করেছেন। ছোট কোনো মেয়ের যদি দুরারোগ্য কোনো রোগ হয়, তাহলে বাবা-মা কে মাঝে মাঝে বলতে শোনা যায়, ওর জন্মের পর মানতের ছাগল জবাই করে দিতে পারিনি বলে হয়তো উপরওয়ালা এমন করে থাকবেন। এই বিশ্বাসগুলো সমগ্র আফ্রিকার মতো এ দেশেও বিদ্যমান। এদিক থেকে বাংলাদেশ আর আফ্রিকার মাঝে যেন অনেক মিল।

আফ্রিকা এবং বাংলাদেশে অনেকে এও মনে করে- চলার পথে কোনো সাপ বা কুকুর যদি পড়ে, তাহলে যাত্রা অশুভ হয়। এমন সময় যদি ভুলে অশুভ আত্মাকে উদ্দেশ্য করে থুতু ফেলা না হয়, তাহলে এটি মানুষের উপর অশুভ কিছু চাপিয়ে দিতে পারে।

যাত্রাপথে কুকুর পড়লে তা অশুভ সংকেত বহন করে; Credit: Minimal Wallpaper

প্রাচীন গ্রীসে কোনো অভিযাত্রী অসুস্থ হয়ে গেলে তারা আরোগ্য ও ওষুধের দেবতা এসক্লেপিয়াসকে উদ্দেশ্য করে কোনো প্রার্থনালয়ে রাত কাটিয়ে দিতো। তারা বিশ্বাস করতো, আরোগ্যের দেবতা নিজে এসে তাদের ভালো করে দেবে, নয়তো স্বপ্নের মাধ্যমে তাদেরকে সারিয়ে তুলবে। আজকের যুগেও অনেক অনেক মানুষ এরকম বিশ্বাসে বিশ্বাস করে শত শত কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত ভ্রমণ করে চলে আসে কোনো তীর্থে।

এসব তীর্থ বা উপাসনালয়ে যদি পুকুর থাকে তাহলে সেই পুকুরে তারা গোসল করে এবং ভাবে এর পানি ওষুধের মতো কাজ করবে। গোসলের মাধ্যমেই রোগ ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর মাধ্যমে ওষুধের কাজ হওয়া অনেকটা হাওয়ার উপর দিয়ে ট্রাক চলার মতো। এই পানিতে অন্যান্য মানুষ গোসল করেছিল আগে, এখানে গোসল করলে অন্যান্য মানুষের দেহ থেকে নিঃসরিত ভালো/মন্দ উপাদান লেগে যাবে নিজের শরীরে। এর বেশি কিছু নয়।

ইংল্যান্ডের লর্ডসে এরকম একটি পুকুর আছে। এটি সারা বিশ্বে বিখ্যাত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে গোসল করতে আসে। গত ১৪০ বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ ঐ পুকুরটিতে গোসল করেছে অশুভ রোগ দূর করার আশায়।

চট্টগ্রামেও এরকম একটি স্থান আছে। এখানে একটি পুকুরে কয়েকটি বড় কচ্ছপ আছে। রোগ দূর হওয়া সহ মনের অন্যান্য চাহিদা নিয়ে মানুষ কচ্ছপগুলোকে খাবার দেয়। কচ্ছপ যদি তাদের খাবার গ্রহণ করে তাহলে তারা ধরে নেয় তাদের রোগ দূর হবে বা মনের আশা পূর্ণ হবে। আর কচ্ছপ তাদের দেয়া খাবার না খেলে ধরে তারা ধরে নেয়, তাদের রোগ দূর হবে না বা আশা পূরণ হবে না। সেক্ষেত্রে তারা মন খারাপ করে চলে আসে। কিন্তু সত্যিকার বাস্তবতা হচ্ছে, কচ্ছপগুলো যখন ক্ষুধার্ত থাকে তখন সকলের খাবার খায়। যখন খাবার আর কোনো উপায় থাকে না, তখন খায় না। আশা পূরণ হওয়া বা না হওয়ার সাথে কচ্ছপের খাওয়া বা না খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

চট্টগ্রামের কাছিম (কচ্ছপ); Source: Trip Adviser

কচ্ছপের খাওয়া না খাওয়ার সাথে মানুষের রোগ মুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই; Source: Trip Adviser

চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটস মনে করতেন, রোগ সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে ভূমিকম্প। মধ্যযুগে অনেক মানুষ বিশ্বাস করতো, আকাশের গ্রহ ও তারার চলাচলের কারণে রোগ-শোকের জন্ম হয়। গ্রহ-তারার মণ্ডলী দিয়ে মানুষের ভাগ্য ও জীবনকে ব্যাখ্যা করার বিদ্যাকে বলে হয় জ্যোতিষবিদ্যা। জ্যোতিষবিদ্যার মাঝে বিজ্ঞান সম্মত কোনোকিছু তো নেই-ই, বরং পুরোটাই অপ-বিজ্ঞান বা কু-বিজ্ঞান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজকের যুগেও অনেক মানুষ এই জ্যোতিষবিদ্যাকে বিশ্বাস করে। (বিঃ দ্রঃ জ্যোতির্বিদ্যার সাথে জ্যোতিষবিদ্যাকে গুলিয়ে ফেললে আবার হবে না। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। অন্যদিকে জ্যোতিষবিদ্যা একদমই বিপরীতধর্মী।)

রোগ শোকের সাথে তারামণ্ডলীর কোনো সম্পর্ক নেই; Source: Static Brain

অধিকাংশ পৌরাণিক কাহিনীতেই ভালো দেবতা ও খারাপ দেবতার অস্তিত্ব আছে। এসব কাহিনীতে ভালো দেবতারা পৃথিবীতে ভাল ভালো ঘটনাগুলো সংঘটিত করে থাকে। অন্যদিকে খারাপ দেবতারা পৃথিবীতে অশুভ ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে।

কোনো কোনো উপকথায় খারাপ দেবতার পরিবর্তে থাকে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া কোনো শয়তান সত্ত্বা। এই শয়তান দেবতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে দেবতারই বিপক্ষে চলে যায়। কারো কারো বিশ্বাস অনুসারে, এদের কারণেই অশুভ ঘটনাগুলো ঘটে। তারা ভাবে, এই শয়তান যদি দেবতার অধীনে থাকতো বা আদেশের অমান্য না করতো, তাহলে আজকের পৃথিবীতে আর অশুভ ঘটনাগুলো ঘটতো না।

Related Articles