Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্যার নিকোলাস উইনটন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ব্রিটিশ শিন্ডলার’ এর জয়গান

দ্য ডিড স্পিকস-এন্ড অকেশনালি, সামওয়ান লিভস লং এনাফ টু নো ইন হোয়াট ডিগ্রি

– রজার কোহেন, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

প্রাগ সেন্ট্রাল স্টেশনে একটু হাঁটাহাঁটি করলেই দেখা মেলে চশমা পড়া কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোকের। পায়ের কাছে রাখা সুটকেস, এক হাতে ধরে আছেন এক শিশুকে। আর তার কাঁধে মাথা রেখে পরম আস্থায় যেন ঘুমোচ্ছে আরেকটি শিশু। দিন নেই, রাত নেই, বৃষ্টি-বাদলা সব উপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ব্যক্তিটি। ফুলের সুবাস আর মোমবাতির আলোয় আলোকিত তার আশপাশ! স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা স্যার নিকোলাস উইনটনের এই ভাস্কর্যটি কেবল তার অসামান্য কীর্তির ছোট্ট একটি দলিল মাত্র।

প্রাগ সেন্ট্রাল স্টেশনে স্যার নিকোলাস উইনটনের ভাস্কর্যের সামনে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসে প্রায়ই; Image Source: Desert Times

১৯৩৯ সালে, মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে প্রাগের এই থেকে ছেড়ে গিয়েছিল আটটি নির্দিষ্ট ট্রেন। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রী হিসেবে ট্রেনগুলোতে চেপেছিল কিছু নিষ্পাপ শিশু। দেশ-বিদেশের রেষারেষি আর বিশ্বযুদ্ধের সাথে ছিল না তাদের কোনো সম্পৃক্ততা, কিন্তু যুদ্ধের বেপরোয়া থাবা লাখো ভুক্তভোগীর মতো তাদের উপরও পড়তে বসেছিল বৈকি। সাক্ষাৎ মৃত্যু আর অশউইৎজ এর অগ্নিকূপ থেকে তারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল শুধুমাত্র ২৯ বছর বয়সী জার্মান বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ স্টকব্রোকার, স্যার নিকোলাস উইনটনের নিরলস পরিশ্রম এবং তার দূরদর্শিতার কারণেই। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল অন্তত কিছু শিশুকে নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া।

ব্রিটিশ সরকার শুধু ১৯৩৮ সালের নভেম্বরের ‘ক্রিস্ট্যালাঙ্কট’ বা ‘কাঁচ ভাঙ্গা রাত’ এ ইহুদিদের উপর অত্যাচারের পর ইহুদি শিশুদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, তাদের আশ্রয় দিতে কোটা বৃদ্ধি করে। সাথে শর্ত জুড়ে দেয় যে, কোনো ব্রিটিশ পরিবারকে তাদের আশ্রয় দিতে আগ্রহী হতে হবে এবং বন্ধক স্বরূপ ৫০ ডলার পরিশোধ করতে হবে, যাতে বাচ্চাগুলো ব্রিটিশ সরকারের উপর বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।

১৯৩৮ সালের শেষদিকে তিনি তার এক বন্ধুর সাথে পরিকল্পনা করেছিলেন সুইজারল্যান্ড ঘুরে বেড়ানোর, স্কি করার। কিন্তু এক ফোনালাপ বদলে দেয় তার মত আর শত শত নিষ্পাপ শিশুদের ভাগ্য। বন্ধুর আমন্ত্রণে তিনি প্রাগে আসেন ইহুদি ও শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে। আসন্ন যুদ্ধের কবলে পড়া তাদের দুরবস্থা দেখে তিনি বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। নিজের সুরক্ষিত চাকরিজীবন ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন অনিশ্চয়তার দ্বারপ্রান্তে থাকা, প্রাগে অবস্থানরত চেক শিশুদের নিমিত্তে। ধীরে ধীরে তাদের লন্ডনে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা শুরু করলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি বাবা-মা শুধু তাদের সন্তানদের জীবন আর সুরক্ষিত ভবিষ্যতের আশায় তার দুয়ারে ভিড় জমাতে শুরু করে। সাবধানতার সাথে স্যার উইনটন তখন আয়োজন করেন ট্রেনের, লন্ডনে ছেলেমেয়েগুলোর বেড়ে ওঠার জন্য ব্যবস্থা করেন ব্রিটিশ পরিবারের। তিনি ছেলেমেয়েগুলোকে যুদ্ধের তাণ্ডব থেকে মুক্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন তাদের বাবা-মায়েদের দেখিয়েছিলেন। আর উইনটনের দেখানো সেই স্বপ্ন এবং প্রতিশ্রুতির উপর বিশ্বাস রেখে, বুকে পাথর চেপে ছেলেমেয়েদের বিদায় জানিয়েছিল তাদের মা-বাবারা।

যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে এক চেক শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিকোলাস উইনটন; Image Source: WNPR

স্যার উইনটনের এই উদ্যোগের কারণে তার উপর রাখা হয়েছিল কড়া নজরদারি। তার উদ্দেশ্য জানতে এবং বানচাল করতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কেজিবির দুর্ধর্ষ গুপ্তচরদের। কিন্তু নির্ভীক উইনটন করে গিয়েছিলেন তার কাজ। তিনি বাকিসব ব্রিটিশদের মতো করে খাটো করে দেখেননি হিটলারের উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতাকে। বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন সবার আগেই। গড়েছিলেন শিশুদের জন্য তহবিল, তাদের দেখভালের জন্য নিশ্চিত করেছিলেন পরিবার, জোগাড় করেছিলেন দরকারি সব কাগজপত্র ও ভিসা এবং সর্বোপরি বাচ্চাগুলোকে নিরাপদে লন্ডনে পৌঁছানোর জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিলেন কর্তৃপক্ষের সাহায্যের জন্য বসে না থেকে।

স্যার উইনটন দ্বারা ব্যবস্থাকৃত ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’-এ করে লন্ডনে পা ফেলা কিছু ছেলেমেয়ে; Image Source: 10 Gone Viral

এভাবে ৮টি ট্রেনে করে প্রায় ৬৬৯ শিশুকে তিনি নাৎসি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১লা সেপ্টেম্বরেও প্রাগ থেকে ছেড়ে আসার কথা ছিল ২৫১ জন শিশু নিয়ে একটি ট্রেনের! ট্রেনটি ছিল তখন পর্যন্ত স্যার উইনটনের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। কিন্তু সেদিনই হিটলারের আক্রমণে চেকোস্লোভাকিয়ার আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে, চুরমার হয়ে ভেঙ্গে যায় শত শত স্বপ্ন। ট্রেনের শিশুগুলোর আর কোনোদিনই লন্ডনের ভোর দেখা হয়নি।

নিকোলাস উইনটনের এই অসামান্য কীর্তির কথা অপ্রকাশিতই থেকে যেত যদি না তার স্ত্রী, গ্রেটি নিজেদের চিলেকোঠায় খুঁজে পেতেন যুদ্ধের মুখ থেকে ফিরে আসা শিশুগুলোর নাম, পরিচয়, ছবি এবং যে পরিবারগুলোতে তাদের ঠিকানা হয়েছিল সবকিছুর লিখিত বৃত্তান্ত সংবলিত একটি স্ক্র্যাপবুক। যদিও উইনটন তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্ক্র্যাপবুকটি নষ্ট করার, কিন্তু গ্রেটি তা পৌঁছে দেন প্রকাশক রবার্ট ম্যাক্সওয়েলের স্ত্রী এবং হলোকাস্ট গবেষক এলিজাবেথ ম্যাক্সওয়েলের হাতে। এরপর নিকোলাস উইনটনকে নিয়ে দৈনিক ‘সানডে পিপল’ এ প্রবন্ধ ছাপা হয়।

এর পরপরই ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘দ্যট’স লাইফ’ এ নিকোলাস উইনটন স্ত্রীর অনুরোধে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে পুরো পর্বটি সাজানো হয়েছিল শুধুই তাকে নিয়ে। উপস্থাপিকা এসথার রন্টজেন তার স্ক্র্যাপবুকটি থেকে উদ্ধারকৃত ছেলেমেয়েদের সংখ্যা আর পরিচয় দিতে দিতে নিকোলাস উইনটনকে সবার নজরে নিয়ে আসেন। তার পাশে বসে থাকা দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেন উইনটনের সাথে, যারা আদতে সেই ট্রেনগুলোতে করেই ১৯৩৯ সালে পাড়ি জমিয়েছিল লন্ডনে। যখন উপস্থাপিকা উঠে দাঁড়াতে বলেন তাদের, যারা উইনটনের কাছে ঋণী নিজেদের জন্য, প্রায় অর্ধেক হলই সেদিন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল স্যার উইনটনের সম্মানে! সেদিনই প্রথমবার স্যার উইনটনের সাথে সাক্ষাৎ হয় যুদ্ধের সময় তার রক্ষা করা বাচ্চাদের সাথে।

‘দ্যট’স লাইফ’ অনুষ্ঠানে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের জীবনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে; Image Source: Your Daily Dish

ক্রমশই সারা বিশ্বের নজরে আসেন এই মহান কীর্তিমান। ভূষিত হন চেকোস্লোভাকিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব দ্য হোয়াইট লায়ন’ এ। ২০০৩ সালে লাভ করেন নাইট উপাধি। তার সম্মানে একটি ছোট্ট গ্রহেরও নামকরণ করা হয়েছিল, যেটি দুজন চেক নভোচারী ১৯৯৮ সালে আবিষ্কার করেছিলেন। মহাকাশের যে জায়গাটিতে গ্রহটি আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটির নামকরণ করা হয়েছিল তার প্রিয় আরাম-কেদারার নামে। প্রাগ ও লন্ডন স্টেশনে তার দুটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে তার মহানুভবতার স্মরণার্থে। কিন্তু প্রচারবিমুখ এই মহানুভব মানুষটি সারা জীবনই বিনয়ী ছিলেন। পঞ্চাশ বছর ধরে এই ঘটনা গোপন রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বারবার বলে গিয়েছেন একটিই কথা, “আমি কিছু গোপন রাখিনি, আমি শুধু বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে কথা বলিনি“।

লন্ডনের লিভারপুল স্টেশনে স্থাপিত স্যার উইনটনের সম্মানে নির্মিত ‘কিডারট্রান্সপোর্ট’ ভাস্কর্য; Image Source: a3traveller

ট্রেনগুলোতে করে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে আসা সন্তান ও তাদের উত্তরসূরিরা আজও নিজেদেরকে গর্বের সাথে পরিচয় দেয় উইনটন’স চিলড্রেন বা নিকি’স চিলড্রেন বলে। তাকে ভালোবেসে ব্রিটিশ শিন্ডলারও বলা হয়ে থাকে। এই মহৎ কাজ নিয়ে তার বক্তব্য হচ্ছে- তিনি শুধু সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত ছিলেন, এর বেশি কিছু নয়। তিনি আমৃত্যু আক্ষেপ করে গিয়েছিলেন ঐ শেষ ট্রেনটির জন্য, যেটি প্রাগ স্টেশন ছাড়ার আগেই জার্মান সৈন্যরা পোল্যান্ডে হামলা করে বসে এবং সকল বর্ডার আটকে ফেলে। ১০৬ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা নিয়েও উইনটনের বেশ অনুশোচনা ছিল। তিনি ব্যাপারটিতে খুবই কষ্ট পেতেন যে, তিনি এত বছর বেঁচে থাকতে সক্ষম ছিলেন, কিন্তু সেই ২৫১ জন বাচ্চাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তাকে ফেলে আসতে হয়েছিল, তাদেরকে তিনি বাঁচাতে পারেননি।

প্রাগ থেকে লন্ডনগামী ট্রেনটি স্যার উইনটনের নামে নামকরণ করা হয়েছে; Image Source: The Japan Times

হয়ত তিনি নিজে চাইতেন না প্রচার কিংবা প্রসার, কিন্তু পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই নীরব সৈনিককে শ্রদ্ধা জানাতে দেরি করলেও কোনো কমতি রাখেনি। তিনি হয়ত দায়িত্ব ভেবেই করে গিয়েছিলেন মহান সব কাজগুলো, কিন্তু তাকে সম্মান জানানোর সকল প্রচেষ্টা শুধু তার অবদান এবং ত্যাগের কিছু পরিমাণ স্বীকৃতি দেয়ার সম্ভাবনা থেকেই। শুধু এটুকু আশা থেকে যে, তিনি যেন দেখে যেতে পারেন, তার অবদান কত শত মানুষের হৃদয় জয় করেছে, কত জীবনকে তিনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন পরিণাম। তিনি যেন নীরবে-নিভৃতেই অর্জন করে গিয়েছেন অমরত্ব, মানুষের হৃদয়ের মাঝে।

ফিচার ইমেজ-Pinterest

Related Articles