১
১৯৪৩ সালের জুন মাসের এক রাতের বেলা; ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দুটো লাইস্যান্ডার অ্যারোপ্লেনে চড়ে দখলকৃত ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে উড়ে চলেছেন বেশ কিছু এসওই (স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ: দখলকৃত ইউরোপ এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা, গুপ্তহামলা এবং নজরদারির উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম নিয়েছিল এই ব্রিটিশ সংগঠনটি) সদস্য।
এই এসওই সদস্যদেরই একজন ছিলেন নূর ইনায়াত খান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরেই (১৯১৪) জন্ম তার, তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মস্কোতে। তবে বাবার দিক থেকে নূরের গায়ে বইছিল ভারতের রক্ত। তার বাবা ইনায়াত রেহ্মাত খান ছিলেন উত্তর ভারতের প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান, যিনি হায়দারাবাদের নিজামের কাছ থেকে ‘তানসেন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নূরের জন্মের বছরেই সপরিবারে ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সুফি সংঘও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
ইনায়াত রেহ্মাত খানের মা খাতিজাবি ছিলেন ‘ভারতের বিটোফেন’ খ্যাত ওস্তাদ মাওলা বক্স খানের কন্যা। ওদিকে মাওলা বক্সের স্ত্রী কাসিম বিবি আবার ছিলেন ইতিহাসের বিখ্যাত বীর যোদ্ধা মহিশূরের শাসনকর্তা টিপু সুলতানের নাতনী। ফলে আমাদের আজকের আলোচনা যে নূর ইনায়াত খানকে নিয়ে, তার গায়ে যে বিপ্লবের রক্ত বইছে, সেটা তার বংশ পরিচয়ই বলে দেয়।
বারো বছর বয়সেই বেশ কঠিন এক পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় নূরের পরিবারকে। কারণ তার বাবা ইনায়াত রেহ্মাত খান হুট করে সিদ্ধান্ত নেন ভারতে ফিরে যাবার; তবে সপরিবারে নয়, একাই। সেখানে যাবার অল্প কিছুদিনের ভেতরেই মারা যান তিনি। এতে বেশ মুষড়ে পড়েন নূরের মা ওরা রে বেকার। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের দেখাশোনা, ছোট ভাই-বোনদের সামলানো- সবকিছুই করতে হচ্ছিল নূরকে। এই সংগ্রামই পরবর্তীতে তাকে একজন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ চরিত্রের নারী হিসেবে গড়ে তোলে।
প্যারিসে শিশুদের জন্য ম্যাগাজিন ও রেডিও প্রোগ্রামে কাজ করতেন নূর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তিনি রেড ক্রসের নার্স হিসেবেও প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু পরবর্তীতে জার্মান সেনাদের অগ্রাভিযানের মুখে বন্ধ হয়ে যায় তার হাসপাতালের কার্যক্রম। তখন সপরিবারেই ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান।
পালিয়ে গেলেও জার্মানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চিন্তা তার তখনও যায়নি। সেই গল্পই করা হবে আজকের লেখার বাকি অংশ জুড়ে। এখানে বলে রাখা ভাল, নূরের ছোট দুই ভাই-বোনও কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ছোট ভাই বিলায়াত যোগ দিয়েছিল ব্রিটিশ নেভিতে, আর ছোট বোন ক্লেয়ার যোগ দেয় এটিএস (আর্মি টেরিটোরিয়াল সার্ভিস)-এ।
২
সেদিন নূরের ফ্রান্স যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল এসওই-র হয়ে রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজ করা। দখলকৃত ফ্রান্সের বিভিন্ন খবরাখবর হেডোকোয়ার্টারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করাই ছিল মূলত তার দায়িত্ব। শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ঠিক ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এই কাজ। দেখা যেত, প্রতি এক-দেড় মাসের মাঝেই এসওই-র কোনো না কোনো রেডিও অপারেটর ধরা পড়ছেন। এতকিছু জেনেও সংগঠনটির প্রথম নারী রেডিও অপারেটর হিসেবে কাজের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন নূর, যাচ্ছিলেন অক্ষশক্তির অধিকৃত একটি অঞ্চলে।
পরিকল্পনামতো ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ১৯০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত অ্যাঙ্গার্স শহরে অবতরণ করে প্লেন দুটো। সেখান থেকে সাইকেলে করে রাতের আঁধারে নূর চলে যান ট্রেন স্টেশনে, কারণ তার কর্মস্থল পড়েছে প্যারিসেই, যেকোনো এজেন্টের জন্য যা ছিল দেশটির সবচেয়ে বিপদজনক এলাকা। তখন তিনি আর নূর ইনায়াত খান না, বরং শিশুদের নার্স ছদ্মপরিচয়ে তার নাম তখন জিন-মেরি রেইনার, কোডনেম মাদেলিন।
৩
নূরের জন্য এসওই-তে যোগ দেয়াটা মোটেও সহজ কোনো বিষয় ছিল না। ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রথমেই তিনি যোগ দেন উইমেন’স অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্স (ডব্লিউএএএফ)-এ একজন রেডিও অপারেটর হিসেবে। পরবর্তীতে এসওই-তে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন তিনি। সেখানে তাকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে।
চাকরি পাবার জন্য নূর চাইলে রঙ চড়িয়ে ব্রিটিশদের প্রতিই আনুগত্য দেখাতে পারতেন। কিন্তু বাবার কাছ থেকে পাওয়া সব সময় সত্য বলবার শিক্ষা তাকে সেটি করতে দেয়নি। বরং তিনি অকপটেই স্বীকার করে নেন, এখন হয়তো তাকে ব্রিটিশদের হয়েই লড়তে হচ্ছে, তবে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্যই লড়বেন। ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে নূর নিজের সততাকে দোষারোপ করেছিলেন কি না তা জানার উপায় নেই, তবে এই সততা তাকে ঠিকই পুরস্কৃত করেছিল।
১৯৪২ সালের ১০ নভেম্বর এসওই থেকে আবার ডাক আসে নূরের। আরেকটি ইন্টারভিউ নিয়ে সেদিনই তাকে এসওই-তে যোগ দিতে বলা হয়। বলতে দ্বিধা নেই, শুরুতে তাকে নিয়ে ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, কারণ তিনি সরাসরিই নিজের আদর্শের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে কর্মক্ষেত্রে নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখে নূর অল্প কিছুদিনের মাঝেই তাদের সেসব সন্দেহকে দূর করে দেন।
এক ব্রিটিশ অফিসারের সাথে আংটি বদলও করেছিলেন নূর। কিন্তু জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়বার ইচ্ছা অতিক্রম করেছিল ভালবাসার টানও। তাই তো ১৯৪৩ সালের ১৬ জুন পশ্চিম সাসেক্সে অবস্থিত রয়্যাল এয়ার ফোর্সের ট্যাংমেয়ার এয়ার ফিল্ডে লাইস্যান্ডার বিমানে চড়ে বসেন তিনি। পেছনে রেখে যান ভালবাসার মানুষটিকে। এগিয়ে যান অক্ষশক্তির কাল থাবার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে।
৪
প্যারিসে পৌঁছে নূর যোগ দেন সিনেমা সার্কিটে, যাদের কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল প্যারিসের বাইরেও। ২২ জুন ভার্সাইয়ের এক কৃষি কলেজ থেকে তিনি এসওই-র হয়ে প্রথমবারের মতো রেডিও ট্রান্সমিশনের কাজ করেন। তখন আবার অনেক এজেন্টই জার্মানদের হাতে ধরা পড়ছিল। এমনকি তারা চলে এসেছিল সেই কৃষি কলেজেও। সৌভাগ্যক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি। সেই সাথে লন্ডনে জানিয়ে দেন এখানকার দূরবস্থার কথাও।
এসওই থেকে নূরকে বলা হয়েছিল চলে আসতে, কিন্তু তিনি ফিরে যেতে রাজি হলেন না। একসময় তিনিই হলেন প্যারিসে থাকা এসওই-র একমাত্র রেডিও অপারেটর। অন্য সবাই ততদিনে ধরা পড়ে গেছে।
নূর তখন তার পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব সবই করছিলেন। অন্য এজেন্টদের প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দেয়া, প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে অস্ত্র পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা, এমনকি যুদ্ধাহত পাইলটদের দেশে ফেরার ব্যবস্থাও তিনি করছিলেন; কেবল তিনি নিজেই দেশে ফেরার চিন্তা মাথায় আনেননি।
৫
জার্মানদের হাতে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে নিয়মিতই স্থান বদলাতে হতো নূরকে। সেজন্য নিজের রেডিও ট্রান্সমিশনের যন্ত্রপাতিগুলো একটি ব্যাগে নিয়ে ঘুরতেন তিনি।
একবার তো দুই জার্মান সেনা এসে সরাসরিই ব্যাগ খুলে দেখতে চাইল। নূরও কোনো রকম দ্বিধা না করে সাথে সাথেই খুলে দিলেন, বললেন, ভেতরে রাখা আছে সিনেমাটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি। এরপর সেটা কীভাবে কাজ করে সেটাও তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন তিনি। তার কাছ থেকে এসব শুনে সত্য ভেবে সেনারা আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। খুশিমনেই চলে যায় তারা, নূরও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
আরেকবার তিনি ট্রান্সমিশনের জন্য এক গাছে চড়ে এন্টেনা ঠিক করছিলেন। এমন সময় এক জার্মান সেনা এসে উৎসাহ দেখিয়ে জানতে চাইল, “আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?” নূর তাতে সায় দিলে সৈনিকটি তাকে এন্টেনা ঠিক করতে সাহায্য করে চলে যায়। যাবার সময় সৈনিকটি জানতো, সে এক সঙ্গীতপ্রেমী নারীকে রেডিও শুনতে সাহায্য করে গেছে! ওদিকে নূরের কার্যসিদ্ধি ততক্ষণে ঠিকই হয়ে গেছে।
৬
এভাবে আর খুব বেশি দিন অবশ্য চললো না। গেস্টাপো (গেহেইম স্টাট্সপোলিজেই, অর্থাৎ গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী, ছিল নাৎসি জার্মানি এবং জার্মানি অধিকৃত ইউরোপে কর্মরত গোপন পুলিশ বাহিনী) সদস্যরা নূরের সম্পর্কে ঠিকই জানতে পেরেছিল। তাই তাকে ধরিয়ে দিলে ১,০০,০০০ ফ্রাঁ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এরপরও তিন মাস তিনি সবার চোখে ধুলো দিয়ে থাকতে সক্ষম হন। কথা ছিল ১৪ অক্টোবর তিনি ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ঠিক আগের রাতেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। গেস্টাপোর সদস্যরা তার অবস্থান সম্পর্কে জেনে যাওয়ায় গোপনে তার বাসাতে অবস্থান নেয়। ঘরে ঢোকামাত্রই আটক হন নূর। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারিসে গেস্টাপোর সদরদপ্তরে। সেখানে তিনি আলাদা বাথরুমে গোসলের অনুমতি চাইলে তা দেয়া হয়। বাথরুমের জানালা খুলে পাঁচতলা ভবন বেয়ে নামা শুরুও করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, পাশের রুমের এক গেস্টাপো সদস্য তাকে দেখে ফেললে আবারও তাকে আটক করা হয়।
বন্দী থাকাকালে জন স্টার নামক এক ইংরেজ এবং লিওন ফায়ে নামক এক ফরাসি এজেন্টের সাথে পরিচয় হয় নূরের। তাদেরকে তিনি পালানোর প্রস্তাব দিলে তারা রাজিও হয়ে যায়। একটি স্ক্রু ড্রাইভার চুরি করে আনেন স্টার। ২৬ নভেম্বর রাতে সেটা দিয়েই একে একে তিনজনের রুমের জানালার শিক খুলে পালানোর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকেই সাথে নিয়েছিলেন নিজেদের রুমের কম্বল, যাতে সেটা দড়ির মতো করে পেঁচিয়ে নিচে নামা যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই চন্দ্রালোকিত রাতেই প্যারিসে আক্রমণ চালায় রয়্যাল এয়ার ফোর্স। ফলে তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, ধরা পড়েন তিনজনই। সেখানে বন্দীশালার প্রধান তাদের প্রথমে গুলি করে হত্যার হুমকি দিলেও পরে প্রস্তাব দেন যেন তারা লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন আর না পালানোর ব্যাপারে। স্টার এতে স্বাক্ষর করলেও অস্বীকৃতি জানান নূর এবং ফায়ে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কিছুদিন পর নূর আবারও জেলখানা থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, সফল হন, আবার ধরাও পড়ে যান! এবার আর তাকে প্যারিসে রাখা নিরাপদ মনে করেনি কর্তৃপক্ষ। তাকে সোজা পাঠিয়ে দেয়া হয় জার্মানিতে। সেখানে একেবারে শিকল পরিয়েই রাখা হয়েছিল তাকে।
১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ভোরবেলায় ঘাড়ের পেছন দিকে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় নূর ইনায়াত খানের। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা ছিল, “Liberté” যার অর্থ “স্বাধীনতা”।
৭
মৃত্যুর পর নূর ইনায়াত খানের সাহসীকতা, হার-না-মানা মানসিকতা উপযুক্তি স্বীকৃতিই পেয়েছে। ১৯৪৯ সালে তিনি মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মাননা অর্জন করেন। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই সম্মাননা কেবল তাদেরই দেয়া হয় যারা চরম বিপদের মুহূর্তে অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। এর পাশাপাশি তিনি রূপালী তারকা সম্বলিত ক্রইক্স দ্য গ্যেরে সম্মাননাও অর্জন করেন। ২০১২ সালে লন্ডনের গর্ডন স্কয়ার গার্ডেন্সে তার একটি ব্রোঞ্জ-নির্মিত আবক্ষ প্রতিমূর্তিও স্থাপন করা হয়।
২য় বিশ্বযুদ্ধ পারমাণবিক বোমা হামলা নিয়ে জানতে পড়তে পারেন এই বইটি:
১) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর জীবন সংগ্রামের সত্য ঘটনা