ভাষার সৃষ্টি মানবজাতির জন্য আশীর্বাদের মতো। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ করার এই মাধ্যম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিত্তি। যে ভিত্তি হাজার বছর আগে সভ্যতা বিনির্মাণের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। ভাষার ব্যবহার ছাড়া সবকিছু যেন স্থবির হয়ে পড়ে। ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সবসময় পানির মতো প্রবহমান। তাই ভাষা যত বিকশিত হয়, ততই পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। এই পরিবর্তনের মাঝেই কিছু ভাষা হারিয়ে যায়, কিংবা রূপান্তরিত হয়ে টিকে থাকে।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে তাদের ভাষা আর সংস্কৃতির মতো ব্যাপারগুলোও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কখনো নতুন স্থানে গিয়ে পুরনো ভাষাটির বিলুপ্তির কারণ হয়েছে নতুন বসতি গড়া মানুষগুলো। কখনো আবার জায়গা বদল করতে গিয়ে তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। আর ভাষার পরিবর্তিত রূপের সঙ্গে আগেকার রূপের অনেক পার্থক্য তৈরি হয়। এটিই কোনো ভাষাকে ধ্বংসের হাত থেকে টিকে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়।
একটি ভাষা কবে সৃষ্টি হয়েছে, তা হুবহু বলে দেওয়া যায় না। কারণ একটি ভাষার লিখিত রূপ পাওয়া না গেলে, সেটির আসল জন্ম সম্পর্কে কেবল আন্দাজই করা যায়। দুঃখজনকভাবে অনেক ভাষাই এভাবে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
বিশ্বে বর্তমানে ৮,০০০ এর কাছাকাছি ভাষা রয়েছে। তবে তাদের ভেতর এক-তৃতীয়াংশের অবস্থা শোচনীয়। এসব বিপন্ন ভাষার কোনোটির আবার মাত্র কয়েক হাজার ব্যবহারকারী রয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষই মাত্র ২৩টি প্রধান ভাষায় কথা বলে। আজকের লেখায় মূলত লিখিতভাবে প্রাপ্ত ভাষাগুলোর কথাই জানব আমরা।
১. হিব্রু
লিখিতভাবে প্রাপ্ত ভাষার ভেতর হিব্রু বেশ পুরনো একটি ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, হিব্রুর জন্ম আজ থেকে প্রায় ৩,০০০ বছর পূর্বে। ইহুদিদের প্রধান ভাষা হিসেবে হিব্রুর ব্যবহার ছিল একসময়। তবে একটা সময় এসে হিব্রুর সাধারণ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে, তখন থেকে এটি কেবল গুটিকয়েক মানুষের ভাষা হিসেবে টিকে ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় কাজেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে পরবর্তী সময়ে ২০ শতকের দিকে যখন জায়োনিজমের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে, তখন থেকেই হিব্রু ভাষা আবার জেগে ওঠে। বর্তমানে হিব্রু অস্থায়ী ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রধান ভাষাগুলোর মাঝে একটি।
ইসরাইলের অন্তত পাঁচ মিলিয়ন মানুষ হিব্রু ভাষায় কথা বলে। তবে তারা বর্তমানে যে হিব্রু ব্যবহার করা হয়, সেটা প্রাচীন হিব্রু থেকে বেশ আলাদা। এমনকি বাইবেল সংস্করণে যে হিব্রু ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, আধুনিক হিব্রুর সঙ্গে সেটার তেমন কোনো মিল নেই। তারপরও আধুনিক হিব্রু ভাষাভাষীরা ওল্ড টেস্টামেন্টের লিখিত রূপ সহজেই পড়তে পারেন। এই অমিল থেকে ভাষাতাত্ত্বিকরা বুঝতে পারেন, আধুনিক হিব্রুর প্রাচীন রূপ ছিল ‘য়িডিস ভাষা’। এই ভাষা থেকেই হিব্রুর বিবর্তন হয়ে আজকের সংস্করণ লাভ করেছে। প্রাচীন অনেক কবিতা এবং ধর্মীয় সাহিত্য থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
২. বাস্ক
পৃথিবীর অদ্ভুত এ ভাষায় কথা বলে স্পেন ও ফ্রান্সের কতিপয় জনপদ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আশপাশের অঞ্চলগুলো তো দূরে থাক, পৃথিবীর কোনো ভাষার সঙ্গে এটির সামান্যতম মিল খুঁজে পাওয়া যায় না! ভাষাতাত্ত্বিকরা কয়েক দশক ধরে চেষ্টা করেও এই রহস্যের কোনো ভালো সমাধান বের করতে পারেননি। কিন্তু তারা একটি ব্যাপারে একমত হতে পেরেছেন যে, এ অঞ্চলে রোমানদের ভাষা বিকশিত হওয়ার পূর্বেই বাস্কের বিকাশ ঘটেছিল। রোমানদের লাতিন ভাষা থেকে পরবর্তী সময়ে ফরাসি এবং স্প্যানিশের মতো ভাষাগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু লাতিনের সঙ্গে বাস্ক ভাষার কোনো সম্পর্ক দৃশ্যমান নয়।
সাম্প্রতিক এক হিসেবমতে, বাস্ক জনগোষ্ঠীতে বাস্ক ভাষায় প্রায় ৫,৪১,০০০ মানুষ কথা বলে। এত বড় একটি জনগোষ্ঠী বাস্ক ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে তারা নিজেরাও জানে না। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ইন্দো-ইউরোপীয়রা যখন ইউরোপের দিকে সরে যেতে শুরু করে, তখনও বাস্ক ভাষার চল ছিল। ফলে, সেখান থেকেই স্থান বদলে ইউরোপে আবাস গড়েছে বাস্ক ভাষায় কথা বলা মানুষগুলো। ভাষাটি নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো বাস্ক ভাষার উৎপত্তি রহস্যের সমাধান হবে।
৩. তামিল
এশিয়া মহাদেশের প্রাচীনতম একটি ভাষা হলো তামিল ভাষা। যার উৎপত্তি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২,২০০ বছর আগে। বর্তমানে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়াতে তামিল ভাষার ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কাতে এটি সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ভারতে তামিল ভাষাভাষীর সংখ্যা ৮০ মিলিয়নের উপরে, যাদের ৯৫ শতাংশের প্রধান ভাষা এটি। বর্তমানে ৭টি দেশের মানুষ তামিল ভাষায় কথা বলে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে বর্তমানেও বেঁচে থাকা একমাত্র শাস্ত্রীয় ভাষার খেতাব কেবল তামিল ভাষার রয়েছে।
ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণে দ্রাবিড় ভাষা থেকে সৃষ্ট বেশ কিছু ভাষা রয়েছে। সেসব ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ভাষাবিজ্ঞানীরা তামিলকে তাই দ্রাবিড় পরিবারেরই একটি ভাষা বলে অভিহিত করেছেন। তারা বেশ কিছু শিলালিপিও আবিষ্কার করেছেন, যেগুলোতে তামিল ভাষার ব্যবহার রয়েছে। তবে বর্তমানের রূপ থেকে প্রাচীন তামিল ভাষার বেশ কিছু ভিন্নতা রয়েছে। এভাবেই প্রাচীন ভাষাটি রূপান্তরের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। জনসংখ্যার দিক থেকে তামিল পৃথিবীর ২০তম প্রধান ভাষা।
৪. ফারসি
পৃথিবীর অনেক মানুষ থাকতে পারেন, যারা ফারসি ভাষা সম্পর্কে জানেন না কিংবা এটির ব্যাপারে শুনেননি। তবে তারা ভাষার কথা না শুনলেও পারস্যের কথা ঠিকই শুনেছেন। এই কথা বলার কারণ হলো, ‘ফারসি ভাষা’ আর ‘পারস্য’ একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান ইরান, তাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তানসহ বেশকিছু দেশের মানুষ ফারসি ভাষায় কথা বলে। ফারসি ভাষা প্রাচীন ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। একসময়ের প্রতাপশালী পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল ফার্সি।
যেখানে অন্যান্য ভাষা বিশেষ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক রূপ লাভ করে, সেখানে ফারসি ভাষার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বর্তমানে ফারসি ভাষার যে রূপ, সেটি স্থায়ী হয়েছিল ৮০০ খ্রিস্টাব্দে। এত বছর পরও আধুনিক ফারসি ভাষা ব্যবহারকারী মানুষ পুরনো ফার্সি ভাষায় লিখিত কিতাবের অর্থ বুঝতে পারেন।
ভাষার ব্যবহার এক হলেও দেশভেদে নামের তারতম্য রয়েছে কিছু। যেমন, তাজাকিস্তান এবং উজবেকিস্তানে ফারসি ভাষাকে ‘তাজিক’ ভাষা বলা হয়। আফগানরা ফারসিকে বলে ‘দারি’। আর ইরানে ফারসিকে ফারসি ভাষাই বলা হয়।
সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ফারসি ভাষার শিলালিপিটি তৈরি করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬ সালের ভেতর, যা রাজা দারিয়ুসের বলে বলে ধারণা করা হয়।
৫. আরবি
আরবি সেমিটিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা, যেটি প্রাচীনকাল থেকে এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর ২৭০ মিলিয়ন মানুষ এ ভাষায় নিজেদের ভাব বিনিময় করে থাকে। সেইসাথে জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ৫ম বৃহত্তম ভাষা। সৌদি আরবসহ বিশ্বের আরও ২৫টি দেশের মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে।
মুসলিমদের কাছে আরবি যতটা না ভাষা, তারচেয়ে বেশি ধর্মীয় ভাবাবেগের একটি ব্যাপার। এই ভাষাতেই ‘কুরআন মাজিদ’ নাযিল হয়েছিল। যার কারণে আরব বিশ্বের যেখানেই ইসলাম স্থান করে নিয়েছে, সেখানেই আরবির প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে একসময় আরবি উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। অনেক ইউরোপিয়ান ভাষা আরবি ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যার কারণে তাদের শব্দভাণ্ডারে আরবি ভাষার শব্দ জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়া হিন্দি, বাংলা, উর্দুসহ অনেক দেশের ভাষার সঙ্গে আরবি ভাষার শব্দ মিশে গিয়েছে।
উপরে উল্লিখিত ভাষাগুলো ছাড়াও অনেকগুলো পুরনো ভাষা রয়েছে, যা আজও সগৌরবে টিকে রয়েছে। মেসিডোনিয়ান, ফিনিশ, জর্জিয়ান, আইরিশ গ্যালিক, চীনা, আইসল্যান্ডিক ইত্যাদি ভাষাও প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ব্যবহার করে আসছে।