
১৯৪০ সাল। হিটলারের বাহিনী প্রতিদিনই ইউরোপের নতুন নতুন ভূমি দখল করছে। প্যানজার ট্যাংকের বহর পৌঁছে গেছে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশেই। প্রচণ্ড আক্রমণে একের পর এক দেশ অসহায় আত্মসমর্পণ করছে। পশ্চিমে শুধু একটি দেশই এখন হিটলারের বিরুদ্ধে টিকে আছে। ব্রিটেন নামের দ্বীপরাষ্ট্রটিকে কাবু করতে হিটলারের নতুন কোনো পরিকল্পনা দরকার। যুদ্ধ দাবার ছক হলে বিশাল বিশাল সেনাবহর একটিমাত্র ঘুঁটি মাত্র সেখানে।

দ্বীপরাষ্ট্র হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই ব্রিটেনের ছিল শক্তিশালী নৌবহর। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনে সেনা হামলা করা প্রায় অসম্ভব তাই। বাধ্য হয়েই ভয়াবহ বিমান হামলা শুরু হয় ব্রিটেনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সবার অগোচরে নাৎসি জার্মানি আরেকটি অস্ত্র তৈরি করছিল ব্রিটেনকে ধরাশায়ী করতে। এই অস্ত্রটি কাগজের তৈরি।
যুদ্ধে শুধু বড়সড় সেনাবহর বানালেই চলবে না। তাদের ভরণপোষণ করার মতো শক্তিশালী অর্থনীতি থাকতে হবে। ব্রিটেনের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী ছিল। বিগত ৪৫০ বছর ধরে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের অর্থনীতি বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছিল। জার্মানদের লক্ষ্য এবার ব্রিটিশদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করা। নকল নোট ছড়িয়ে দেয়ার এক পরিকল্পনা করে তারা।
নকল পাউন্ড ব্রিটিশ বাজারে ছড়িয়ে দেয়ার এই পরিকল্পনা ১৯৩৯ সালে প্রথম করা হয়। তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি। জার্মান অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান আর্থার নেব প্রভাবশালী নাৎসি নেতা গোয়েবলসকে এই পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম জানান। অর্থমন্ত্রী ওয়াল্টার ফ্রাঙ্ক এটাকে আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ হবে বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু হিটলারেরও ভালো লেগে যায় এই পরিকল্পনা। শুরু হয় অপারেশন।

১৯৩৯ সালের নভেম্বরকে গ্রিসের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে একজন জার্মান-সোভিয়েত ডাবল এজেন্ট এই ভয়াবহ পরিকল্পনার ব্যাপারকে সতর্ক করেন। ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ছাপানো নোটে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না।
হিটলারের সম্মতিতে নেবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেইনহার্ড হাইড্রিক পুরোদমে জাল পাউন্ড তৈরির কাজে লেগে পড়েন। এসএস বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা Sicherheitsdienst এর আওতায় প্রথম জাল নোটের কারখানা স্থাপন করা হয়। গণিতবিদ, ব্যাংকার এবং নোট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হয় এ কাজের জন্য। পাসপোর্ট, বিভিন্ন দলিল, সিল নকল করলেও এই দলটির মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ নোটকে নিখুঁতভাবে নকল করা। ৭ মাস প্রাণপণ চেষ্টা করে ৩ মিলিয়ন মূল্যমানের নোট উৎপাদন করে এই দলটি। কিন্তু এই নোটগুলো নিখুঁত ছিল না এবং এদের সহজেই নকল হিসেবে শনাক্ত করা যেত। প্রজেক্ট ডিরেক্টর আলফ্রেড নওজক্সের উপর ভরসা হারান হিমলার। এসএস বাহিনীর মেজর বার্নহার্ড ক্রুগার নতুন করে দায়িত্ব পান। শুরু হয় অপারেশন বার্নহার্ড।

ক্রুগার সফলতার জন্য কাজে নতুন মুখ আনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। জার্মান ছাড়াও তার নজর পড়ে বন্দী থাকা ইহুদিদের দিকে। ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নাৎসি কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে টাকা, পাসপোর্ট, দলিল জালিয়াতের অভিযোগে গ্রেফতার ইহুদিদের খুঁজে বের করেন। নির্ভুল স্কেচ করতে জানা ড্রাফ্টসম্যান, খোদাইকর, পেইন্টার এবং ব্যাংকারদেরও মৃত্যুপুরি থেকে নিয়ে আসেন তিনি।
১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৬ জন কয়েদিকে সাখসেনহসেনের জাল টাকা কারখানায় নিয়ে আসেন ক্রুগার। ৪ মাস পর আরো ৮০ জনকে। অর্ধমৃত বন্দীরা তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার পেয়ে এবং বন্দুকের নলের ভয়েই কাজ শুরু করে। সব মিলে ১৪০ জন বন্দী পালা করে কাজ করতো।

সব ধরনের উপকরণ পাবার পরেও রাতদিন খেটে এই দলটি বুঝতে পারছিল না ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কী কাগজে টাকা প্রিন্ট করে। দুর্লভ কোনো গাছের পাতা ব্যবহার না করে সাধারণ মানের লিনেন থেকে কাগজ উৎপন্ন করতো। আর এই লিনেন আসতো পুরনো মেইল ব্যাগ থেকে। কিন্তু একই পদ্ধতি ব্যবহার করেও জার্মানরা একই কাগজ পাচ্ছিল না। কয়েদিদের মধ্যে সেরা জালিয়াত ছিলেন সলোমন। তিনি প্রথম রহস্যভেদ করলেন। কাগজে সামান্য পরিমাণে তুরস্কের শন মেশাতো ব্রিটেন। ব্রঞ্চউইগের কাগজ কারখানা থেকে ১২,০০০ পেপার শিট তৈরি হয়।
দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দেয় কালি নিয়ে। জার্মানদের কালি কাগজ থেকে চুইয়ে পড়তো। কালির উপাদানগুলোও বের করে আনে বিশেষজ্ঞরা।
শেষ বাধা ছিল নোটের নম্বরের অ্যালগরিদম। এলোমেলো মনে হলেও এই নম্বরগুলো একটি প্যাটার্ন বহন করতো, যেটা থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব টাকা আসল কী নকল। অনেকটা এখনকার ফোনের রিচার্জ কার্ডের মতো। অ্যালগরিদমও ভাঙতে সক্ষম হন গণিতবিদরা। ১ বছরের মধ্যে পাউন্ড নকল করতে সক্ষম হয় বন্দীরা।
একটি পেপার শিটে চারটি করে নোট প্রিন্ট করা যেত। নোট উৎপাদনের পর সেটাকে বারবার ভাঁজ করে একটু পুরনো রুপ দেয়া হত। ইচ্ছা করেই হালকা ময়লার আস্তরণ ফেলা হতো। ব্রিটিশরা নোটের উপরে বাম কোনায় পিন দিয়ে টাকার বান্ডিল আটকে রাখত। তাই বারবার পিন দিয়ে টাকা ছিদ্র করা হতো।
এবার টাকাগুলোকে বাজারে ছড়িয়ে দেবার সময়। যুদ্ধে টালমাটাল ইউরোপবাসীর ব্যাংকিংয়ে বিশ্বাস এবং আস্থা ছিল সুইস ব্যাংকগুলোর উপর। অস্থিতিশীল সময়ে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু নিরাপদে রাখতে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর দ্বারস্থ হতে শুরু করে দু’পক্ষের লোকজনই।
জার্মান এজেন্টরা গ্রাহক সেজে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা করতে শুরু করে নকল পাউন্ড। সুইস ব্যাংকের নিরাপত্তাকে বোকা বানিয়ে নোট চলে যায় ভল্টে। খুঁতখুঁতে কিছু গ্রাহকবেশী এজেন্ট জানতে চাইলেন তাদের রাখা নোটগুলো আসল কি না। ব্রিটেন পাঠানো হয় নোটগুলো পরীক্ষা করতে। ব্রিটেনও জানায়- নোটগুলো নির্ভেজাল।
কিন্তু নকল নোট একটি দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে কাবু করতে পারে? দেখে নেয়া যাক।
প্রথমত, কোনো দেশেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা ছাপায় না।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বর্ণের মজুদের উপর ভিত্তি করে টাকা ছাপানো হতো। বর্তমানে ছাপানো হয় মোট জিডিপির ২-৩%। অতিরিক্ত টাকা ছাপালে টাকার প্রবাহ বাড়বে, কিন্তু পণ্য সরবারহ থাকবে আগের মতোই। ফলে অতিরিক্ত অর্থধারীই ভোগ করতে পারবে। অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে। একপর্যায়ে সেখান থেকেই দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, নোট বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। নকল নোটের জন্য রাতারাতি নিঃস্ব হবে অনেকেই। টাকার প্রবাহই বন্ধ হয়ে যাবে। অর্থনীতি ফিরে যাবে আদিম বিনিময় যুগে। যেমন- চুল কেটে দেয়ার বিনিময়ে খাদ্য প্রদান। সবমিলে ব্রিটিশ অর্থনীতির সাথে সারা বিশ্বের অর্থনীতিও ধসে পড়তো।
১৯৪৩ সাল নাগাদ ৬৩,০০০ জাল নোট ছাপায় জার্মানরা, যার বাজার মূল্য ছিল ১৩৪ মিলিয়ন পাউন্ড। আজকের দিনে এর মূল্য ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। পাউন্ডের পর ক্রুগার নকল ডলার তৈরিতেও কয়েদিদের চাপ দিতে থাকে। বন্দীরা উপলব্ধি করে, ডলার তৈরি করে দিলে তাদের আর প্রয়োজন হবে না নাৎসিদের। তখনই তাদের হত্যা করা হবে। ফলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ধীর গতিতে কাজ করতে থাকে। কিন্তু একসময় ধরা পড়ে যায় তারা। হত্যার হুমকি এবং বিবেকের দংশনের পরেও ডলার তৈরি করে দেয় তারা। অ্যালগরিগম ভাংতে সক্ষম না হওয়ায় ২০টি নম্বরবিহীন ডলার তৈরি করে পরীক্ষার জন্য ব্যাংকারদের কাছে পাঠান মেজর ক্রুগার।

এই অপারেশনে কাঁচামাল সংগ্রহ, নোট তৈরি এবং বিপণনে হাজার হাজার জার্মান যুক্ত ছিল। কয়েকজন গ্রেফতার হতেই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জেনে ফেলে এই ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে। ১৯৪৩ থেকে ব্রিটেন ১০ পাউন্ডের বেশি নোট তৈরি বন্ধ করে দেয় এবং দেশের বাইরে থেকে নোট প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ৫ পাউন্ডের সব নোট বদল শুরু হয় পরের বছর থেকে।
এদিকে স্তালিনগ্রাদে পরাজয়ের পর জার্মানি পূর্বে প্রতিদিন পিছু হটছিল। সোভিয়েত বাহিনী ধেয়ে আসছিল বার্লিনের দিকে। সোভিয়েতরা কাছাকাছি চলে আসায় সাখসেনহসেন ক্যাম্প সরিয়ে নেয় তারা। কয়েকবার স্থান বদল করে এক পাহাড়ী গুহায় আশ্রয় নেয় ক্রুগারের দলটি।
পরাজয় আসন্ন বুঝে টপ্লিজৎ লেকে সব যন্ত্রপাতি এবং নোট ফেলে পালায় নাৎসিরা।
এদিকে প্রচুর জার্মান অফিসার মিলিয়ন মিলিয়ন নকল পাউন্ডসহ ধরা পড়তে শুরু করে। মিত্রবাহিনী আঁচ করে বার্নহার্ডের ভয়াবহতা সম্পর্কে। বার্লিনের পতনের পর ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়। টপ্লিজৎ লেক থেকে পাউন্ড ভর্তি বাক্স তুলে আনে ডুবুরিরা।

অপারেশন বার্নহার্ড সম্পূর্ণ সফল না হলেও এটা ব্রিটিশদের বেশ ভুগিয়েছিল। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত লন্ডনে জাল নোট পাওয়া যায়। ১৯৫৫ সালে সাদা-কালো নোটের বদলে রঙিন নোট আসলে জাল নোট সম্পূর্ণভাবে দূর হয়।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধেও জাল নোট ছড়ানোর কথা শোনা যায়। অপারেশন বার্নহার্ড পৌঁছে গিয়েছিল সফলতার খুব কাছাকাছি, যেটা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত দিয়ে যায়।