Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অপারেশন কোন্ডোর: লাতিন আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নির্মম আখ্যান (পর্ব-০১)

প্রতিটি দেশেই সন্ত্রাসবাদ পরিচালনার জন্য কিছু মানুষ থাকে। বিভিন্ন মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী কাজকর্মের জন্য এসব মানুষকে কখনও ‘মাফিয়া’ বলা হয়, কখনও বা বলা হয় ‘গ্যাং’। কখনও কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি যদি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে, তখন তাকে আমরা বলি ‘গডফাদার’। ইতালিয়ান লেখক মারিও পুজোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘গডফাদার’ প্রকাশিত হওয়ার পর পৃথিবীবাসী সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে নতুন করে ধারণা পেয়েছে।

উন্নত কিংবা অনুন্নত– প্রায় সব দেশেই এই ধরনের গ্যাং বা মাফিয়া থাকে, যারা এক বা একাধিক গডফাদারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এদের জন্য সরকারকে সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রাখতে হয়, কখনও বা শুধু এদেরকে দমনের জন্যই ‘বিশেষ ইউনিট’ তৈরি করা হয় সামরিক বাহিনীর ভেতরে। মাঝেমধ্যে এরা এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, এরাই একটি রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা হয়ে বসে, নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে সবকিছু। কিন্তু তাদের কোনোকিছুই স্থায়ী হয় না, একসময় তারা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যায়।

মাফিয়া বা গ্যাং– যারা একটি দেশে যারা সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করে, তাদের নির্মূলের জন্য নাহয় রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী থাকে। এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী সবসময়ই সংখ্যা ও যোগ্যতায় মাফিয়া বা গ্যাংদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। কিন্তু কখনও যদি এমন হয় যে, সন্ত্রাসবাদীরা গুম, খুন, ধর্ষণ কিংবা অপহরণের মতো যে অপরাধ করে থাকে, রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী সেই কাজে জড়িয়ে গেল? রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাজ হলো দেশীয়-বিদেশী শত্রুর গোপন পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়া, প্রয়োজনে বিদেশী রাষ্ট্রে অভিযান পরিচালনা করে গোপন তথ্য উদ্ধার করে আনা। কিন্তু তারাই যদি দেশের নাগরিকের তথ্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে সহায়তা করতে শুরু করে, তাহলে সেটা কি সাধারণ নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? যে রাষ্ট্রের কাজ সন্ত্রাসবাদ দমন করা, সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা, তারাই যদি সন্ত্রাসবাদ শুরু করে, তাহলে কীভাবে হয়?

হডপগেগোহো
ইতালিয়ান লেখক মারিও পুজোর ‘দ্য গডফাদার’ প্রকাশিত হওয়ার পর পুরো বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে নতুন করে জানতে পেরেছে;
image source: jiji.ng

রাষ্ট্রের কাজ সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাসবাদ শুরু করে, তাহলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? কেউ নেই আসলে। রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাসবাদ শুরু করে, তাহলে অসংখ্য নিরীহ মানুষের প্রাণ যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই সন্ত্রাসবাদের শেষ হয়। রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ মানে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব। এই দানব সমস্ত কিছুকে গোগ্রাসে গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের তাৎক্ষণিক সমাধানও সম্ভব নয়, কারণ জনগণকে দিনশেষে বিচারের জন্য রাষ্ট্রের তো হাত পাততে হয়। রাষ্ট্র যখন নিজেই সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত, তখন রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া দিবাস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। বহু বছর পরে কেউ হয়তো পুরনো ফাইল খুলবে, অন্যায়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালাবে। ইতিহাস তো আর চেপে বা ঢেকে রাখা যায় না। তাই একসময় যখন ইতিহাসের নির্মম সত্যগুলো বেরিয়ে আসবে, তখন অন্যায়ের সাথে জড়িত এই খলনায়কদের পরবর্তী প্রজন্ম এদের উপর অভিসম্পাত দেবে।

আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, চিলি ও উরুগুয়ে- এই আটটি দেশের নাম সম্ভবত আপনি আগে থেকেই জানেন। লাতিন ফুটবলের যদি একজন ভক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এসব দেশ সম্পর্কে কিছু ধারণা আপনার আছে। লাতিন আমেরিকার মহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা ‘কোপা আমেরিকা’র খেলা যদি আপনারা দেখে থাকেন, তাহলে এই দেশগুলোর নাম নিশ্চিতভাবেই আপনারা অনেকবার শুনেছেন।

ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে এই দেশগুলো অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে প্রায়ই বৈশ্বিক গণমাধ্যমে এই দেশগুলোর নাম এসে থাকে। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে এই লাতিন আমেরিকান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। একেবারে গোপনে সম্পাদিত হওয়া চুক্তির পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল আমেরিকা। বিভিন্ন কৌশলগত সহায়তাও দিয়েছিল দেশটি। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর এই গোপন অপারেশনের কোডনেম ছিল ‘অপারেশন কোন্ডোর’ (Operation Condor)।

চওআপগেগপগগ
লাতিন আমেরিকা, অপারেশন কোন্ডোরের পটভূমি; image source: policyholderpulse.com

স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, তাতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুটো দেশই তাদের প্রভাব বলয়ের পরিসর বাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কারণ যত বেশি সংখ্যক দেশ নিজেদের নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসা যাবে, নিজেদের মতাদর্শের প্রসার ঘটবে তত বেশি। দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারণে অস্ত্র ও যুদ্ধকেন্দ্রিক আমেরিকান অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠেছিল, আমেরিকা হতে চেয়েছিল বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অভিভাবক, অপরদিকে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা রুশ বিপ্লবীরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নীতিগুলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো পুরো বিশ্বে। এ জন্য আমরা দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই আমেরিকা যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপে ব্যাপক অর্থ সহায়তা দিয়ে দেশগুলোকে পুনর্গঠনে ব্যাপক সহায়তা করে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কিংবা বিপ্লবে গোপনে সহায়তার মাধ্যমে দেশগুলো দখল করে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই সোভিয়েত মদদে গেরিলা বাহিনীর দল গড়ে ওঠে, যেগুলো সেসব দেশের সামরিক জান্তা সরকার কিংবা একনায়কদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। আমেরিকার মাত্র নব্বই মাইল দূরে অবস্থিত কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর হাত ধরে গেরিলা কায়দায় কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হলে আমেরিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল। কারণ আমেরিকার নাকের ডগায় একটি দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হওয়া আমেরিকার জন্য লজ্জাজনকই বটে। বে অব পিগস-এ সিআইএ-র সাজানো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে আমেরিকা আরও বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে চিলিতেও সালভাদর আলেন্দে নির্বাচিত হলে লাতিন আমেরিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে আমেরিকা। ১৯৬০ সালের প্রেডিডেনশিয়াল বিতর্কের সময় জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, “লাতিন আমেরিকাজুড়ে আমাদের কঠিন অধ্যায় শুরু হয়েছে কাস্ত্রোর মাধ্যমে। আমাদের সামনে এখন বড় সংগ্রাম রয়েছে, কাস্ত্রোর প্রভাব যেন অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু না করে সেটি যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে।

ওতপতপআপ
স্নায়ুযুদ্ধের একটি বড় প্রভাব ছিল অপারেশন কোন্ডোরের পেছনে; image source: pinterest.com

কিউবা ও চিলির ঘটনায় আমেরিকা যেকোনো মূল্যে সমাজতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার চিন্তাভাবনা শুরু করে। যেহেতু বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে, তাই লাতিন আমেরিকাকে বিপ্লবের আগুন থেকে রক্ষা করতে আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পরিবর্তে দেশগুলোর সরকারকে দিয়েই বিপ্লবীদের দমন করার পরিকল্পনা শুরু করে। আরেকটি ঘটনা আমেরিকান প্রশাসনের আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছিল। চিলিতে সালভাদর আলেন্দে নির্বাচিত হওয়ার পর কিউবার বিখ্যাত বিপ্লবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফিদেল কাস্ত্রো তার সাথে দেখা করেন এবং একটি কালাশনিকভ রাইফেল (একে-৪৭) উপহার দেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলে থাকেন, ফিদেল কাস্ত্রো এই উপহারের মাধ্যমে আমেরিকাকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। বার্তাটি হচ্ছে– লাতিন আমেরিকায় বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমেরিকার বাড়ির উঠোনে যদি দেশগুলো পুঁজিবাদের পরিবর্তে কমিউনিজমকে গ্রহণ করে, তবে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে যে আমেরিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতো, তা বলাই বাহুল্য। এজন্য আমেরিকা আরও তড়িঘড়ি করে পদক্ষেপ নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

হডিতপতপ
কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ও চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে; image source: telesurenglish.net

এবার অপারেশন কোন্ডোর কিভাবে শুরু করা হয়েছিল, তা জানা যাক। ১৯৬৮ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল রবার্ট পোর্টার প্রথমবারের মতো কিছু নির্দিষ্ট লাতিন আমেরিকার দেশের অভ্যন্তরের নিরাপত্তা বাহিনী ও আমেরিকার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন। ২০১৬ সালে লাতিন আমেরিকার সম্পর্কে সিআইএ-র কিছু ডকুমেন্ট ডিক্লাসিফাইড করা হয়। সেসব ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে উরুগুয়ে, চিলি, বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ের উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা একসাথে মিলিত হন। রাষ্ট্রের জন্য হুমকি– এই ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চরম পর্যায়ের নজরদারি চালানোর জন্য উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা একমত পোষণ করেন। এছাড়া সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরকে অপহরণ ও গুমের পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়, আমেরিকার সিআইএ-র উপস্থিতিতে সেই মিটিংয়েই প্রথমবারের মতো বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

এই সিরিজের পরবর্তী পর্ব

১) অপারেশন কোন্ডোর: লাতিন আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের নির্মম আখ্যান (শেষ পর্ব)

Related Articles