“হাসতে হাসতে মরে গেলাম!” এই কথাটি প্রায় সবাই-ই বলে থাকেন। বিভিন্ন কৌতুক বা মজার ঘটনা বর্ণনা করার সময়ে হাসতে হাসতে কথাটি হয়তো আপনি নিজেও অনেকবার বলে ফেলেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন এমনও কিছু ব্যক্তি আছেন অতিরিক্ত হাসির ফলে যারা মারা গিয়েছেন! যদিও মৃত্যুর পেছনে হাসির সরাসরি কোনো হাত নেই, তবে কিছু বিশেষ মুহূর্তে হাসি কার্ডিয়াক এরেস্ট বা হার্ট-অ্যাটাক, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, এপোপ্লেক্সি এবং স্ট্রোকেরও কারণ হতে পারে। ফলে অনেকের মৃত্যুও হতে পারে। তাই চলুন আজ জানা যাক এমন কিছু ব্যক্তির সম্পর্কে যারা হাসতে হাসতে মারা গিয়েছিলেন।
১) এলেক্স মিচেল
এলেক্স মিচেল ছিলেন যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত নরফকের বাসিন্দা। তিনি ‘দ্য গুডিস’ নামক টেলিভিশন শো দেখতে খুব পছন্দ করতেন। ১৯৭৫ সালে বিবিসি’র এই কমেডি শোয়ের “কুংফু ক্যাপারস” নামের একটি এপিসোড তিনি দেখছিলেন। এই এপিসোডের একপর্যায়ে দেখানো হয়, এক চরিত্র হাতে কালো পুডিং নিয়ে বিভিন্ন মানুষদের আক্রমণ করছেন এবং তাদের মধ্যে একজন ব্যক্তি একটা ব্যাগপাইপ দিয়ে নিজেকে এই পুডিং-আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। এলেক্সের স্ত্রী নেসি জানান, ঠিক এই দৃশ্যটি দেখে এলেক্স হাসতে শুরু করেন। একটানা ২৫ মিনিট ধরে তিনি হাসতেই থাকেন। সর্বশেষে তিনি বিকট জোরে এক হাসি দিয়ে মারা যান। এলেক্সের এই মৃত্যু সে সময়ে বেশ আলোচিতও হয়েছিল। এমনকি নেসি বিবিসির সেই টেলিভিশন শো ‘দ্য গুডিস’ এ ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন তার স্বামীর শেষ মুহূর্তটাকে এমন আনন্দময় করার জন্য।
২) ড্যামনন স্যান উম
ঘুমের ভেতর মৃত্যুবরণ করা, তা-ও আবার হাসতে হাসতে! ড্যামনন ছিলেন এমন ব্যক্তি যিনি এভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পেশায় একজন আইসক্রিম ট্রাক ড্রাইভার ড্যামনন বাস করতেন থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। তার মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, ২০০৩ সালের ২০ আগস্ট রাতে তিনি ঘুমের ভেতরেই হঠাৎ করে হাসতে শুরু করেন। প্রায় দুই মিনিট ধরে তিনি হাসতেই থাকেন। একসময় তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি মারা যান।
পরবর্তীতে তার স্ত্রী জানান, সেসময়ে তিনি তার স্বামীর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলেন অনেকবার। কিন্তু ড্যামনন ঘুম থেকে উঠেননি বা হাসিও থামাননি। ময়নাতদন্তের পর বলা হয়, হাসির ফলে হয়তো তার হার্ট-অ্যাটাক হয়েছিল, যে কারণে তিনি মারা যান। মেন্টাল হেলথ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর সোমচাই চক্রভন্দ বলেন, তিনি এ ধরনের মৃত্যুর মত ঘটনার সম্মুখীন এর আগে কখনো হন নি। তিনি আরো জানান, ঘুমের ভেতরে অস্বাভাবিক জোরে কান্না করলে বা হাসলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
৩) গ্রিক দার্শনিক ক্রিসিপাস
ক্রিসিপাস ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক যাকে ‘স্টোয়িকবাদ’ এর দ্বিতীয় জনক হিসেবেও ধরা হয়। তার মৃত্যু সম্পর্কে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত। এক তথ্যসূত্রে বলা হয়, ১৪৩ তম অলিম্পিয়াডে অপরিশোধিত ওয়াইন পান করার ফলে তার মৃত্যু হয়েছিল। সেই একই তথ্যসূত্রে বলা হয়েছে ক্রিসিপাস অতিরিক্ত হাসির ফলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তার এই মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, একদিন তিনি দেখেন যে একটি গাধা তার ডুমুর ফল খাচ্ছে। খেতে খেতে একসময় ডুমুর ফলগুলি গাধাটির গলায় আটকে যায়। এটা দেখে তিনি তার এক ভৃত্যকে কৌতুক করে গাধাটিকে পানির বদলে ওয়াইন পান করতে দিতে বলেন। ওয়াইন পান করার ফলে গাধাটি মাতালের মতো উদ্ভট সব আচরণ শুরু করে দেয়, যা দেখে ক্রিসিপাস হাসতে শুরু করেন এবং হাসতে হাসতেই একসময় মারা যান। ক্রিসিপাসের যে ছাত্রটি তার মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিল সে তার নোটে উল্লেখ করেছে এভাবে, “Having laughed too much, he died”
৪) ওলে বেন্টযেন
পেশায় একজন অডিওলজিস্ট ওলে বেন্টযেন ছিলেন ডেনমার্কের বাসিন্দা। তিনি ‘আ ফিশ কলড ওয়ান্ডা’ নামক সিনেমাটির একটি কৌতুক দৃশ্য দেখে হাসিতে ফেটে পড়েন। সেভাবে হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করেন। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত হাসির ফলে তার হার্টবিট বেড়ে প্রতি মিনিটে ২৫০-৫০০ পর্যন্তও উঠেছিলো। যার ফলে তার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং মৃত্যুবরণ করেন। সিনেমার যে দৃশ্যটি দেখে তিনি হাসতে শুরু করেছিলেন সে দৃশ্যটা এমন ছিল যে সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলো তাদের নাকে চিপস ঢোকানোর চেষ্টা করছিল।
এই দৃশ্যে বেন্টযেনের অতিরিক্ত হাসির কারণ হচ্ছে সিনেমার সেই দৃশ্যটি তাকে কয়েক বছর আগে তার নিজের এক হাস্যকর ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো। মূলত কয়েক বছর আগেই তিনি এবং তার পরিবারের সবাই মিলে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। প্রতিযোগিতাটি ছিল এরকম যে নিজেদের নাকের ভেতর ফুলকপি ঢুকিয়ে কে আগে গাজর খেয়ে শেষ করতে পারে। অবশ্যই গাজর খাওয়ার সময় নাক থেকে ফুলকপি পড়া চলবে না! তার এই ঘটনার সাথে সিনেমাটির সেই দৃশ্যের সাদৃশ্যের কারণে তিনি মাত্রাতিরিক্ত হাসতে শুরু করেন এবং হাসতে হাসতেই একসময় মারা যান।
৫) জিউক্সিস
জিউক্সিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। যদিও তার চিত্রকর্মগুলো এখন আর অক্ষত অবস্থায় নেই, তবুও তিনি তার উদ্ভাবনী কৌশলের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। একদিন এক বৃদ্ধ মহিলা তাকে ভালবাসা, সৌন্দর্য এবং আনন্দের দেবী আফ্রোদিতির ছবি এঁকে দিতে বলেন। বৃদ্ধা এরপর জিউক্সিসকে কিছু নির্দেশনাও দিয়ে দেন চিত্রকর্মটি কেমন হবে সে ব্যাপারে। এমনকি বৃদ্ধা নিজেই মডেলিং করেও দেখিয়ে দিয়েছিলেন আফ্রোদিতিকে ঠিক কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে চিত্রকর্মটিতে।
চিত্রকর্মটি সম্পন্ন হবার পরে জিউক্সিস যখন নিজের আঁকা ছবিটি দেখলেন তখন তার সেই বৃদ্ধার কথা মনে পরে গেলো। আফ্রোদিতির রূপে বৃদ্ধাটিকে কল্পনা করে তিনি যারপরনাই হাসিতে ফেটে পড়লেন। সেই হাসি এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি একসময় তাতেই মৃত্যুবরণ করেন। যদিও জিউক্সিসের সেই চিত্রকর্মটির অস্তিত্ব আর নেই, তবুও তার মৃত্যুর এই বিখ্যাত কাহিনী এখনো প্রচলিত রয়েছে সবখানে।
৬) মাংগেশ ভোগাল
হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার সাম্প্রতিক যে ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে তা হলো ভারতে। ২০১৩ সালে মুম্বাইয়ে ঘটনাটি ঘটে। ২২ বছর বয়সী মাংগেশ ভোগাল তার প্রেমিকাকে নিয়ে একটি সিনেমা হলে গিয়েছিলেন ‘গ্রান্ড মাস্তি’ সিনেমাটি দেখার জন্য। সিনেমা হলটির পরিচালক রাকেশ শাহ থেকে জানা যায়, হলের অন্যান্য দর্শকরা জানিয়েছিল সিনেমাটির বিভিন্ন কৌতুক দৃশ্যে মাংগেশ খুব উচ্চস্বরে হাসছিলেন। হাসির একপর্যায়ে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাকে সাথে সাথেই নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্মরত ডাক্তাররা তাকে মৃত বলে ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে পুলিশ মাংগেশের এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে নিবন্ধিত করে।
ফিচার ইমেজ: comedyheights.com