
মস্তিষ্ক মানবদেহের সংবেদন আদান-প্রদান ও চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রস্থল। মনস্তত্ত্ববিদ ও স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, মানব মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালী এত জটিল যে, একে মহাবিশ্বের সবচেয়ে ‘কমপ্লেক্স ম্যাটার’ বললেও খুব বেশি বলা হয় না। বিজ্ঞানের অসাধারণ উৎকর্ষের এই যুগেও বিজ্ঞানীরা মানব মস্তিষ্ক, এর বিস্তারিত গঠন ও সুনিয়ন্ত্রিত কার্যপদ্ধতি বিষয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন। তবে মানব মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতি নিয়ে যত মতভেদই থাকুক না কেন, এর প্রকৃত ক্ষমতা নিয়ে সম্ভবত কারো কোনো মতভেদ নেই, যার অনস্বীকার্য প্রমাণ শুধু বিজ্ঞান ও চিন্তাধারার অন্যান্য ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতিই নয়, ইতিহাসের নানা সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অবিশ্বাস্য অথচ সত্য ঘটনা, যা আমাদের নিজেদের নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে। মস্তিষ্কবিজ্ঞানের ইতিহাসে এমনই একটি অবিশ্বাস্য নিদর্শন হচ্ছে ফিনিয়েস গেজ ও তার মস্তিষ্ক নিয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা।

ফিনিয়েস গেজ (১৮২৩-১৮৬০) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন ফোরম্যান শ্রমিক ছিলেন। তিনি রেলপথ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। সময়টা ছিল ১৮৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। নিউ ইয়র্কের রুটল্যান্ড ও বার্লিংটন রেলপথ নির্মাণ শ্রমিকদের দলনেতা হিসেবে কাজের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন গেজ। সম্ভাব্য রেলপথের জন্য পাথর ভরা পথ পরিষ্কার করে জায়গা তৈরি করা হচ্ছিলো। বড় আর অনড় পাথর অপসারণের জন্য একমাত্র পথ ছিলো ডিনামাইট বা অন্য কোনো বিস্ফোরক।
সেদিন বিকেল ৪.৩০ মিনিটে এমনই এক পাথর সরানোর জন্য সহকর্মীদের বিস্ফোরক ব্যবহারের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। এমন সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। আকস্মিক বিস্ফোরণের তীব্রতায় ব্যবহৃত একটি রড অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ফিনিয়েসের হাঁ করা মুখের বাম গাল দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়! রডটির দৈর্ঘ্য ছিলো ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি, ব্যাস ১.২৫ ইঞ্চি এবং ওজনে ৬ কেজি! ঘটনার পরপর রডটিকে তার অবস্থান থেকে ৮০ ফুট দূরে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রডটিতে রক্ত ও মগজ লেগে থাকায় ভেজা ছিলো।

ঘটনার আকস্মিকতায় ফিনিয়েস গেজ মাটিতে পড়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে তখনই তাকে হাত ও পায়ের পেশীতে মালিশ করে দেওয়া হয়। তিনি সচকিত হয়ে ওঠেন এবং নিজের সুস্থতা সম্পর্কে সহকর্মীদের জানান দেন, কারণ প্রকৃত ঘটনা তখনও জানতে বাকি ছিলো! যা-ই হোক, সহকর্মীদের সামান্য সাহায্যে একটি অক্সকার্টে করে গেজকে পৌনে এক মাইল দূরে তার লজিংয়ে নিয়ে আসা হয়। ঠিক ৩০ মিনিট পর স্থানীয় চিকিৎসক এডওয়ার্ড এইচ উইলিয়ামস সেখানে এসে পৌঁছান। তিনি লজে উপস্থিত হয়ে গেজকে সম্পূর্ণ সচেতন হিসেবে দেখতে পান। এমনকি গেজ নিজেই ডাক্তারকে স্বাগত জানান। চিকিৎসক হিসেবে রোগীকে পরীক্ষা করার সময় গেজ একবার বমি করেন। উইলিয়ামসের ভাষ্যমতে, বমির তোড়ে মাথার উপরের ক্ষতস্থান থেকে আনুমানিক আধা কাপ পরিমাণ মগজ মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো!

সন্ধ্যা ৬টার দিকে সিনিয়র চিকিৎসক জন মার্টিন হার্লো ফিনিয়েস গেজের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ডাক্তার উইলিয়ামসের সাহায্য নিয়ে গেজের মাথার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত, হাড় ও এক আউন্সের মতো মগজ পরিষ্কার করেন! পরিষ্কার করার পর তিনি মাথার হাড়ের কিছু ভাঙা অপরিহার্য অংশ একসাথে জুড়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। এক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা আবশ্যক ছিলো, যা ডাক্তার হার্লো অবলম্বন করেছিলেন। যথাযথ নিরাময়ের জন্য ক্ষত আংশিক খোলা রাখা হয়, গালের ক্ষতও একইভাবে কিছুটা শিথিল করে ব্যান্ডেজ করা হয়। এরপর পুরো ব্যান্ডেজটি আরেক পরত ব্যান্ডেজ দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়।
আক্রান্ত হবার কয়েকদিন পর ফিনিয়েস গেজের মাথার ক্ষতস্থানে ছত্রাক সংক্রমিত হয়। এসময় তার খানিকটা ‘কোমা’য় চলে যাবার মতো অবস্থা দেখা যায়। তার পরিবার সম্ভাব্য মৃত্যুর কথা ভেবে কফিনও তৈরি করেছিলো, যদিও তা তখনই কাজে লাগেনি। দুর্ঘটনার দু’সপ্তাহ পরে ডাক্তার হার্লো ফিনিসের মাথার ক্ষতস্থান থেকে প্রায় ৮ আউন্স পুঁজ বের করেন। ১৮৪৯ সালের প্রথম দিক নাগাদ তিনি বাহ্যিকভাবে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। শারীরিক কারণে ফোরম্যানের চাকরি তার হাতছাড়া হয়ে যায় ।
গেজের এরপরের জীবনে পেশাগত বা পারিবারিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নেই। ১৮৬০ সালে এপিলেপ্সিজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর আগপর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে তার জীবনে সবচেয়ে উলেখযোগ্য হলো প্রাত্যহিক আচরণে অভাবনীয় পরিবর্তন।

দুর্ঘটনার আগে সহকর্মী ও আশেপাশের মানুষজন ফিনিয়েস গেজকে কঠোর পরিশ্রমী, আমুদে, বিচক্ষণ এবং বন্ধুবৎসল লোক হিসেবেই চিনতেন। দুর্ঘটনার পরপর ও চিকিৎসা চলাকালীন এবং পরে তার মধ্যে বেশ আকস্মিক কিছু পরিবর্তন আসে। তার স্মৃতিশক্তি মোটের উপর অপরিবর্তিত থাকলেও আচরণ নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। বেপরোয়া আচরণ, হঠাৎ আবেগে আত্মহারা হওয়া, জিঘাংসায় পেয়ে বসা, অনিয়ন্ত্রিত পাশবিকতা, যৌনতা বিষয়ে বিশৃঙ্খলা, পশুপাখির প্রতি ব্যতিক্রমী আগ্রহসহ আরো অনেক অদেখা আচরণে গেজকে পরে দেখা যেত। অর্থাৎ সামাজিক ও পরিচিত- অভ্যস্ত জগতে মানুষটির আগের পরিচয় সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছিলো।
ফিনিয়েস গেজের মস্তিষ্কের এই দুর্ঘটনাটি তার জীবদ্দশাতেই চিকিৎসা ও মস্তিষ্কবিজ্ঞানের জগতে আলোচিত হতে শুরু করেছিলো। তার নিজের চিকিৎসক ডাক্তার হার্লো এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে প্রথম ‘বোস্টন মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিকেল জার্নাল’ এ একটি কেস রিপোর্ট চিঠি আকারে প্রেরণ করেন। প্রথমে কর্তৃপক্ষ ডাক্তার হার্লোর পাঠানো রিপোর্টকে পাত্তাই দিতে চাননি, কারণ তারা ভেবেছিলেন মানুষের মস্তিষ্কে এ ধরনের গুরুতর আঘাতের পর কারও পক্ষে আর বেঁচে থাকাই সম্ভব নয় (সাধারণ দৃষ্টিতে এ কথাই স্বাভাবিক ও সত্য মনে হবে)।
১৮৫০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক হেনরি জে বাইগ্লো গেজের বিষয়ে দ্বিতীয় রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। এই রিপোর্টে গেজের আচরণিক পরিবর্তনের বিষয় অস্বীকার করা হয় ধারণা করা হয়, তৎকালীন চিকিৎসা জগতে এ বিষয়ে যেরকম অবজ্ঞা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ বিরাজ করছিলো, তার প্রভাব এই রিপোর্টটিতে পড়েছে।
অনেকে মনে করেন, নিজের রোগী হবার কারণে ডাক্তার হার্লো ফিনিয়েস গেজের সার্বিক আচরণিক পরিবর্তনের বিষয়টি প্রকাশ্য দিবালোকে আনায় আগ্রহী ছিলেন না। গেজের মৃত্যুর পর ১৮৬৮ সালে ‘বুলেটিন অব দ্য ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল সোসাইটি’তে ডাক্তার হার্লো তার মস্তিষ্কে আঘাত ও আচরণের নাটকীয় পরিবর্তনের বিষয়ে একটি রিপোর্ট লেখেন। এই রিপোর্টে দুর্ঘটনার ফলে মস্তিষ্কে সৃষ্ট ব্যাঘাত ও তার ফলে জন্মানো আচরণিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। বিস্ফোরনের ফলে রডটির আঘাতে ফিনিয়েস গেজের মাথায় মোট তিনটি গুরুতর ক্ষত তৈরি হয়। তার একটি বাম গালে, একটি বাম অক্ষিগোলকের পাশে আর আরেকটি মাথায়। আঘাতের সময় রডটি পুরো ক্ষতগুলো তৈরিতে অকল্পনীয় কম সময় নিয়েছে। তবে গালের হাড় ভেঙে মস্তিষ্কে প্রবেশ করায় মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং লিম্বিক সিস্টেমের মধ্যে স্নায়বিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যেসময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেসময় আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞান সমৃদ্ধ হতে শুরু করলেও স্নায়ু-মনোবিজ্ঞানের জন্ম হয়নি। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজের প্রকৃতি ও আচরণ বা অভ্যাসের সাথে তার সম্পর্ক বিষয়ে জানতে আরো অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। ১৯৪৪ সালে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী হান্না দেমাসিও ও তার সহকর্মীরা নিউরোইমেজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে গেজের খুলি পরীক্ষা করেন। তারা তাদের পরীক্ষায় বাম ও ডান উভয় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে আঘাতের প্রমাণ পান। যদিও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ত্রিমাত্রিক ছবিভিত্তিক আরেকটি পরীক্ষায় শুধু বাম অংশে আঘাতের প্রমাণ জোরালো হয়েছিলো। মোদ্দাকথা, উনিশ শতকের শেষাংশ ও বিশ শতকের এক বড় অংশ জুড়ে ফিনিয়েস গেজ কেস মস্তিষ্কবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বেশ অপরিহার্য বিষয় হয়ে উঠেছিলো ।

আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞানীরা মনে করেন, লিম্বিক সিস্টেম জৈবিক তাড়না, আবেগ ইত্যাদির সাথে এবং ফ্রন্টাল কর্টেক্স যুক্তি, ব্যক্তিত্ব, আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত। এক অংশের সাথে অন্য অংশ স্নায়ুকোষের বন্ধনের মাধ্যমে উদ্দীপনার যোগাযোগ থাকে। জৈবিক তাড়না ও মানবীয় ব্যক্তিত্ববোধের মধ্যে স্নায়বিক সামঞ্জস্য ব্যাহত হবার ফলে ফিনিয়েস গেজের প্রাত্যহিক আচরণের খোলনলচে বদলে গিয়েছিলো ।
১৮৬৭ সালে ফিনিয়েস গেজের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে তার খুলি ও রডটি ডাক্তার হার্লোর কাছে হস্তান্তর করা হয়। হার্ভার্ড মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন বিভাগের ওয়ারেন অ্যানাটমিক্যাল মিউজিয়ামে এটি এখনও জমা আছে।