‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ নামে পোখরান-১ পারমাণবিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভারত বিশ্বে নিজেদেরকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তথাপি, পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশের তালিকায় তখনো ঠাঁই হয়নি। স্মাইলিং বুদ্ধকে তো কোনোরকম শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে বলে চালিয়ে দেয়া গেছে, কিন্তু ১৯৭৪ সালের সেই পরীক্ষার পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়েছে ভারতকে।
যতদিন শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক পরীক্ষা বলা হচ্ছে, ততদিন ঠিক আছে। সামরিক শক্তি বর্ধনের চিন্তা করলেই আসতে পারে কঠিন কঠিন সব অর্থনৈতিক অবরোধ আর তীব্র আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া। সেই প্রতিক্রিয়ার জন্য ভারত খুব ভালোভাবেই প্রস্তুত ছিল, প্রস্তুত ছিল অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবিলা করতেও। আর এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। যার মাধ্যমে আমেরিকান নজরদারি পাশ কাটিয়ে ৫টি পারমাণবিক পরীক্ষার সিরিজ সফলভাবে সম্পন্ন করে ৬ষ্ঠ পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় ভারত।
প্রথম থেকে শুরু করা যাক। পোখরান-১ যেখানে শেষ হয়েছিল, পোখরান-২ সেখান থেকেই শুরু করে ভারত। পোখরান-১ এর ইতিহাস জানতে পড়ুন ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ লেখাটি। ১৯৭৪ সালে স্মাইলিং বুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বকে হঠাৎ চমকে দেয়ার পরও ভারতে তেমন ঝক্কি পোহাতে হয়নি। কয়েকটি দেশ সমালোচনা আর আশংকা প্রকাশ করার বাইরে তেমন কিছু করেনি।
যারা এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেই যুক্তরাষ্ট্রও ভারতকে সমর্থনই দিয়েছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের নামে। তবে কেবল শান্তিপূর্ণ শব্দটির মাঝে আটকে থাকলেই চলবে? এশিয়ার পরাশক্তি চীন তো পরমাণু অস্ত্রের জোরেই ভারত থেকে যোজন যোজন এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে পেরে উঠতে হলে কিংবা বিশ্বদরবারে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হলে, পরমাণু অস্ত্র তো ভারতকে বানাতেই হতো।
স্মাইলিং বুদ্ধ সাফল্যের বড় কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন না হলেও, এনএসজি (নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ারস গ্রুপ) কর্তৃক কঠিন প্রাযুক্তিক অবরোধের মুখে পড়েছিল দেশটি। আর এ কারণে পোখরান-১ এরপর ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পের অগ্রগতি স্লথ হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বারংবার আন্তর্জাতিক বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে হয় যে, ভারত এর পারমাণবিক পরীক্ষা সামরিক উদ্দেশ্যে করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না!
উপরন্তু ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সংকট আর ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতন ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পের ভাগ্য প্রায় নির্ধারণ করে ফেলেছিল। তবে এত সব ঝামেলার মাঝেও একটি ইতিবাচক দিক এই যে, ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে ধীর গতিতে হলেও হাইড্রোজেন বোমার নকশা ও অন্যান্য প্রাযুক্তিক দিক নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন দেশীয় পরমাণুবিদ এম শ্রীনিবাসন।
১৯৭৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন শান্তিপ্রিয় হিসেবে সুপরিচিত মোরারজি দেশাই। দেশাইয়ের সরকার প্রাথমিকভাবে কিছুকাল পারমাণবিক প্রকল্পে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। তবে পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে তারা ভাবতে বাধ্য হন যখন পাকিস্তানের গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ বিষয়ক তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। আমেরিকার ম্যানহাটন প্রোজেক্টের অনুরূপ পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রোগ্রামের খবর নিশ্চিত হবার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি দেশাই সরকারও। এরপর ১৯৮০ সালে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন ইন্দিরা গান্ধী। এ সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, ভারতের মিসাইলম্যান খ্যাত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম মিসাইল নিয়ে তার কার্যক্রম শুরু করেন।
পরমাণুবিদ রাজা রামান্ন ৮০’র দশকের প্রথমার্ধ পুরোটাই হাইড্রোজেন বোমা তৈরি অনুমোদন চেয়েই ব্যয় করেছেন। কিন্তু বৈরী আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে ভারত সরকার এই অনুমোদন দিতে ব্যর্থ হয়। এর প্রধান কারণ মূলত পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি পরমাণু প্রকল্পের দিকে ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপ সূক্ষ্মভাবে নজরদারি করছিল প্রতিবেশী দেশটি। ফলে পুরো ৮০’র দশকেই ভারতের পরমাণু প্রকল্পে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি।
বিশ্বে যে গুটিকয়েক দেশ পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত, তারা কখনোই চায় না অন্য কোনো দেশ তাদের সমতুল্য হোক। এই সাম্য অর্থনীতির চেয়ে বেশি সামরিক ক্ষেত্রেই বিবেচিত হয়। যে কারণে ভারতের মিসাইল প্রোগ্রামও সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে সমালোচনা উপেক্ষা করেই সফলভাবে মিসাইল তৈরি করতে সক্ষম হয় ভারত। ১৯৮৮ সালে পৃথবি-১ নামক একটি স্বল্প পাল্লার মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালায় দেশটি। ভারত সরকারও তখন সিদ্ধান্ত নেয় যে, আপাতত মিসাইল প্রোগ্রামে জোর দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, যখন পরমাণু প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে নেয়া যাবে।
১৯৯১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরসীমা রাও। ভারতের অর্থনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্য তিনি পরিচিত। তার সরকার নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে তার পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক প্রশংসিত হয়। অন্যদিকে, ভারতের পারমাণবিক প্রকল্পের প্রতি জনসমর্থন ছিল তুঙ্গে। পরিস্থিতি অনুকূল বিবেচনা করে ১৯৯৫ সালে ধীরে সুস্থে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে ভারত।
গোপনে কাজ চালানোর কথা থাকলে শুরুর কয়েকদিনের মাথায়ই মার্কিন স্পাই-স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে পোখরান টেস্ট রেঞ্জে ভারতের পারমাণবিক কার্যক্রম। আর তাতেই শুরু হয় মার্কিন প্রশাসনের দৌড়-ঝাঁপ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর তদবিরে বিল ক্লিনটন প্রশাসন প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে ভারতের উপর। দুই দেশের মধ্যে চলে একাধিক আলোচনা। ফলে শুরু হবার আগেই থেমে যায় প্রকল্পটি।
১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি)। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সফল প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রবল জনসমর্থনের ভিত্তিতে তিনি ঘোষণা করেন যে, বিশ্বদরবারে প্রাপ্য সম্মানটুকু পেতে হলে ভারতকে এবার পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র থেকে পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্র হতে হবে।
দেশের নিরাপত্তার জন্য তিনি সামরিক ক্ষেত্রে সবরকম প্রক্রিয়ার অনুসরণ করার কথা ঘোষণা দেন, যার মধ্যে পারমাণবিক প্রকল্পের কথাও ছিল। তাছাড়া, এসময় জম্মু-কাশ্মীর ঘটনা ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরের অংশ ছিনিয়ে নেয়ার হুংকার দিয়ে উত্তেজনার পারদ আরো চড়িয়ে দেয় বাজপেয়ী সরকার। কাশ্মীর সীমান্তে একরকম যুদ্ধংদেহী মনোভাব তৈরি হয়, যা আদতে ভারতকে লাভবান করেছিল। এই উত্তেজনা আমেরিকা সহ বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি ভারতের পরমাণু প্রকল্প থেকে কাশ্মীরে নিয়ে আবদ্ধ করেছিল!
১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে ভারতের পারমাণবিক শক্তি বিভাগের প্রধান এবং পরমাণুবিদ আর. চিদাম্বারাম ও ড. আবদুল কালামের সাথে এক জরুরী বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। এ বৈঠকে তিনি আবদুল কালামের নিকট মিসাইল প্রোগ্রামের অগ্রগতি সম্বন্ধে জেনে আশ্বস্ত হন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে পারমাণবিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেন। আর তাতেই স্থির হয়ে থাকা প্রক্রিয়াটি হঠাৎ করেই প্রাণ ফিরে পায় এবং প্রবল বেগে ছুটতে শুরু করে।
একই সময়ে পাকিস্তানও পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল যদিও তাদের সমস্যা ছিল খুব কমই। রাজস্থানের পোখরান অঞ্চলের ছোট ছোট বালিয়াড়িগুলো মার্কিন স্পাই-স্যাটেলাইটের চোখ থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু মার্কিনদের নজরে পড়ে গেলে ১৯৯৫ সালের মতো পুনরায় পরীক্ষাটি বাঁধার সম্মুখীন হতে পারে ভেবে সম্পূর্ণ গোপনীয়তায় প্রস্তুতি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এই গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল রেজিমেন্টের প্রধান কর্নেল গোপাল কৌশিকের কাঁধে। তিনি ‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ তথা ড্রড এর পরিচালক ড. আবদুল কালাম এবং ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি’ বা ডিএইর প্রধান আর. চিদাম্বারামের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে মার্কিন স্যাটেলাইটের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা তৈরি করেন। এই পরিকল্পনা এতটা গোপন ছিল যে, ভারত সরকারের অনেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাও এ সম্পর্কে জানতেন না।
পোখরান নিউক্লিয়ার টেস্ট রেঞ্জে যে ক’জন বিজ্ঞানী কাজ করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের প্রত্যেককেই সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরতে হতো, যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেখানে কী হচ্ছে। তাছাড়া স্যাটেলাইটের চোখ এড়িয়ে চলতে অধিকাংশ কাজই পরিচালিত হয় রাতের বেলা। কাজ শেষে সব যন্ত্রপাতি পূর্বে স্থানে এনে রেখে দেয়া হতো যেন স্যাটেলাইটের ছবিতে মনে হয় সেখানে কিছুই হচ্ছে না।
আর বোমার শ্যাফট যে গর্তে স্থাপন করা হয়, তা উপর দিয়ে জাল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। শাফট পর্যন্ত টেনে নেয়া তারগুলো মাটিতে পুঁতে সেগুলোর উপর স্থানীয় শাকসবজি বুনে দেয়া হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল সেখানে কাজ করা বেসামরিক বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা। তাদের প্রত্যেকের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয় এবং তারা কেউ দল বেঁধে রাস্তায় বেরুতে পারতেন না।
বোমার নকশা প্রণয়ন, ডেটোনেটর, উৎপাদন, ‘হাই ভোল্টেজ ট্রিগার সিস্টেম’ ইত্যাদির জন্য দিনরাত কাজ করে ড্রোডের তিনটি গবেষণাগার। মে মাসের ১ তারিখের মাঝে বোমা সংক্রান্ত যাবতীয় সরঞ্জাম পৌঁছে যায় পোখরানে। মোট ৫টি বোমা দুটি পৃথক গ্রুপে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করা হয়। প্রতি গ্রুপের বোমাগুলো একই সময়ে বিস্ফোরিত হবে।
শক্তি ১-৫ নামে নামকরণ করা হয় বোমাগুলোর। প্রথম গ্রুপে ছিল একটি থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা শক্তি-১, একটি ফিশন বোমা শক্তি-২ এবং একটি সাব-কিলোটন বোমা শক্তি-৩। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিল দুটি সাব-কিলোটন বোমা শক্তি-৪ ও ৫। ৫টি বোমার মাঝে শক্তি-১ আর শক্তি-২ই ছিল প্রধান যেগুলোকে যথাক্রমে মাটির ২০০ ও ১৫০ মিটার গভীরে স্থাপন করা হয়।
১১ মে ১৯৯৮। ভারতের প্রতিরক্ষার ইতিহাসে দিনটি অনন্য হয়ে থাকবে। সেদিন বাতাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে বিকাল ৩টা বেজে ৪৩ মিনিটে গ্রুপ ১ এর তিনটি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আর বিশ্ববাসী টের পায় নতুন পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ পরাশক্তির আগমণ। ২ দিন পর, ১৩ মে অপর বোমা দুটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তবে সেগুলো এতো ছোট পরিসরের পরীক্ষা ছিল যে অধিকাংশ সিজমিক স্টেশন সেগুলো শনাক্তই করতে পারেনি। পারমাণবিক বোমাগুলোর মোট উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ ছিল এরকম-
- শক্তি-১, ৪৩-৪৫ কিলোটন
- শক্তি-২, ১২ কিলোটন
- শক্তি-৩, ২০০ টন
- শক্তি-৪, ৫০০ টন
- শক্তি-৫, ৩০০ টন
ভারতে পোখরান-২ পারমাণবিক বোমার পরীক্ষার ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। ভারতজুড়ে সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে, পত্র-পত্রিকায় বাজপেয়ী সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়, ছাপা হয় অসংখ্য সম্পাদকীয়, টেলিভিশন আর রেডিওতেও হয় ভরপুর চর্চা। তবে সমালোচনা যে হয়নি তা কিন্তু নয়। ভারত যখন এই পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পন্ন করলো, তখন এ দেশটি ৪৪ বিলিয়ন ঋণের বোঝা বইছে।
যদিও বাজপেয়ী সরকার দাবি করেছিল যে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অনাগত অবরোধ মোকাবিলা করার পরিকল্পনা তাদের আছে, তথাপি তা যথেষ্ট সমালোচিত হয়, বিশেষ করে তৎকালীন বিরোধীদল কংগ্রেসের দ্বারা। পরীক্ষাটি নিয়ে নতুন করে সমালোচনা ডালপালা মেলে ২০০৯ সালে যখন ড্রোডের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা কে. সান্তানাম পরীক্ষাটিকে ব্যর্থ বলে অভিহিত করেন। তার মতে, পরীক্ষার প্রধান বোমা শক্তি-১ এর ব্যাপারে ভারত সরকার অত্যাধিক অতিরঞ্জন করেছে। ভারতের দাবি ৪৩-৪৫ কিলোটন হলেও এর মোট উৎপাদিত শক্তি ২০ কিলোটনের মতো ছিল মাত্র!
ভারতের সমতুল্য হতে পাকিস্তান প্রস্তুত। আমাদের সবধরনের সক্ষমতা রয়েছে!
-ভারতের পোখরান-২ পরীক্ষার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গহর আইয়ুব খান
বলা বাহুল্য, ভারতের এই পারমাণবিক পরীক্ষার পর সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দটি থেকে বেরিয়ে এসে পারমাণবিক অস্ত্রের সামরিকায়নে আর কোনো রাখঢাক রাখেনি ভারত। পৃথিবীর ৬ষ্ঠ দেশ হিসেবে তারা হয়ে ওঠে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। অবশ্য পাকিস্তানও ততদিনে পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। অপেক্ষা ছিল কেবল ভারতের। ভারতে পরীক্ষার পর দ্রুতই পাকিস্তান ঘোষণা দেয় তারাও পিছিয়ে থাকবে না। আর পোখরান-২ এর মাত্র ১৫ দিন পর পাকিস্তান পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষার মাধ্যে ৭ম দেশ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে নাম লেখায়।
অন্যদিকে ভারতের এই পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। তারা ভারতের এই পারমাণবিক পরীক্ষা পূর্বেই ধরে ফেলতে না পারাকে নিজেদের গোয়েন্দা ইতিহাসের অন্যতম বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করে। কঠোর সমালোচনার সাথে তারা কেবল মানবিক সাহায্য ছাড়া সকল প্রকার অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। পাশাপাশি প্রায় ২ বছর যাবত ভারতকে ‘কমপ্রিহেনসিভ-নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি’ বা সিটিবিটি নামক একটি চুক্তিতে সই করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে ক্লিনটন সরকার।
ওয়াশিংটনের অনবরত চাপের মুখেও ভারত এই চুক্তিতে সই করেনি এবং নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে অনড় থাকে। জাপান আর কানাডা থেকেও আসে ছোটোখাটো অর্থনৈতিক অবরোধ। এই দৃশ্যপটে রাশিয়া নীরব দর্শক হলেও চীন বারংবার এটিকে একটি ‘গুরুতর ইস্যু’ বলে অভিহিত করেছে এবং আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল জাতিসংঘও।
এত সমালোচনা আর অবরোধের পর দেখা গেল বাজপেয়ী সরকারই বিজয়ী। ভারতের অর্থনীতির উপর সেসব অবরোধের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আসলে বিশাল জনসংখ্যা এবং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভারত ধীরে ধীরে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। ফলে কঠোর অবরোধ আরোপ করে বিশাল বাজার আর সহজলভ্য বিনিয়োগক্ষেত্র হারাতে চাইবে কে? পোখরান-১ যদি সূচনা হয়, পোখরান-২ ছিল পরিণতি। ১৯৭৪ এ যে স্বপ্নের বীজ ভারত বপন করেছিল, তা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ডালপালা মেলেছিল ১৯৯৮ সালে। আর তাতেই হাজারো সমস্যা জর্জরিত হলেও রীতিমতো গর্ব করবার মতো একটি ব্যাপার ঘটে যায় ভারতবাসীর জন্য, রাতারাতি তারা হয়ে ওঠে সমীহ করবার মতো একটি দেশ।