ফরাসিদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়ার পরেও নেপোলিয়নের প্রয়োজনে প্রুশিয়া তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সামরিকসহ যেকোন সহায়তা দিতে বাধ্য ছিল। ফরাসিদের বশংবদ হয়ে থাকা প্রুশিয়ার ইচ্ছা নয়। কিন্তু ফ্রেডেরিক উইলিয়াম জানতেন এই মুহূর্তে ফ্রান্সের মোকাবেলা করার সামর্থ্য তার নেই। পঞ্চম কোয়ালিশনে যোগদানের প্রস্তাব তাই তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেলেন।মন্ত্রীসভা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সরকারী কর্মকর্তারা রাজার সাবধানি নীতি সমর্থন করলেও প্রশাসনের অপেক্ষাকৃত কমবয়সী অংশ এবং সাধারণ জনগণের বড় একটি দল চাইছিল নেপোলিয়নের দাসত্ব থেকে মুক্তি।
এদিকে স্পেনের গদিতে নেপোলিয়ন ভাই জোসেফকে বসালে হলি রোমান এম্পেরর প্রথম ফ্রান্সিস চটে যান। অস্ট্রিয়া পঞ্চম কোয়ালিশনে যোগ দেয়। ১৮০৯ সালে অস্ট্রিয়ান মন্ত্রী কাউন্ট স্টাডিওন জার্মানদের ঐক্যবদ্ধভাবে ফরাসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান জানান। পূর্ববর্তী অস্ট্রিয়ার অংশ টিঁয়াহোয় (Tyrol) প্রদেশে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা ফরাসি মিত্র বাভারিয়ার বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়। স্পেনেও স্থানীয় যোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় ফরাসিদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করতে সমর্থ হয়। পর্তুগালে ইংল্যান্ডের অবস্থান দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছিল। প্রুশিয়াতে এসময় জনমত ক্রমেই প্রকাশ্যে ফরাসিবিরোধী হয়ে উঠতে থাকে।
জনরোষের বুদ্বুদ
পঞ্চম কোয়ালিশনের যুদ্ধ ঘোষণার পর রাজা প্রকাশ্যে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করেন। তিনি রাজধানী ছেড়ে কনিগসবার্গে চলে যান। এতে স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। গুজব ডালপালা মেলতে থাকে, ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে উৎখাত করে তার ছোট ভাই উইলিয়ামকে সিংহাসনে বসানো হবে। উইলিয়াম ফরাসিদের মন যুগিয়ে চলা পছন্দ করতেন না। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
এই পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার ব্যাপারে নেপোলিয়ন সন্দিহান ছিলেন, যারা জনরোষকে উস্কে দিচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। ১৮০৮ সালের আগস্টে ব্যারন স্টেইনের একটি চিঠি ফরাসি গুপ্তচরদের হাতে পড়ে, যেখানে তিনি ফরাসিদের বিপক্ষে জার্মান জাগরণের স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। নেপোলিয়ন তৎক্ষণাৎ ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের কাছে স্টেইনের পদত্যাগ দাবি করেন। রাজা এদিক ওদিক করে কয়েক মাস কাটিয়ে দেন। কিন্তু ডিসেম্বরে নেপোলিয়ন মাদ্রিদ দখল করে স্টেইনকে ফ্রান্সের শত্রু ঘোষণা দেন, জার্মানিতে তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার নির্দেশ জারি হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে স্টেইন ১৮০৯ সালের জানুয়ারিতে পালিয়ে যান অস্ট্রিয়ায়। সেখান থেকে ১৮১২ সালের জুনে জার আলেক্সান্ডার তাকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ডেকে পাঠান। তিনি স্টেইনকে নিজ উপদেষ্টাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
১৮০৯ সালের এপ্রিলে পোমেরানিয়াতে কিছু অফিসার বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহের চেষ্টা করলে তাদের ব্যর্থ করে দেয়া হয়। প্রুশিয়ার পশ্চিমের সীমান্তে আল্টমার্কের এক লেফটেন্যান্ট ভন ক্যাট কিছু সমর্থক নিয়ে ওয়েস্টফ্যালেয়াতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি স্টেন্ডায় শহর দখল করে টাকাপয়সা লুট করে নেন। উদ্দেশ্য এই অর্থ দিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পক্ষে লড়াই করা। শুধু ক্যাটে নন, অনেক তরুণ সেনা কর্মকর্তার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল ফরাসিদের উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য। ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯ সালে বার্লিন থেকে আঞ্চলিক প্রশাসনের প্রেসিডেন্ট লুদ্ভিগ ভিঙ্কে রাজার কাছে কনিগসবার্গে চিঠি পাঠিয়ে তাকে অনুরোধ জানালেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজধানীতে ফিরে আসতে, কারণ জনতা ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। তারা ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের নিরপেক্ষতা নীতিতে তিতিবিরক্ত। অনেক সেনা কর্মকর্তা রাজাকে লিখলেন যে তারা নিজেদের অধীনস্থ সৈন্যদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সন্দিহান, এরা যেকোনো সময় দলেবলে অস্ট্রিয়ার বাহিনীতে গিয়ে নাম লেখাতে পারে।
মেজর শ্যে
ফার্দিন্যান্দ ভন শ্যে (Ferdinand von Schill) ছিলেন এক সেনা অফিসার, যিনি চতুর্থ কোয়ালিশনের সময় একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। প্রুশিয়ার কোলবার্গ দুর্গের আশেপাশে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। তিলসিতের শান্তিচুক্তির পর তাকে মেজর পদে উন্নীত করা হলেও তার বাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। ১৮০৮ সালে তিনি বার্লিনে আসলে সাধারণ মানুষ বিপুল উল্লাসে তাকে গ্রহণ করে। মানুষের উচ্ছাস দেখে শ্যে ধারণা করলেন ফরাসিদের বিপক্ষে বিদ্রোহের ডাক দেয়ার এইই উপযুক্ত সময়। তিনি স্বাধীনতাকামী বেশ কিছু সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কনিগসবার্গের লীগ অফ ভার্চু, যার সদস্যরা বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর লোক, আর পোমেরানিয়ার সোসাইটি অফ ফাদারল্যান্ড।
১৮০৯ সালের শুরুতে ওয়েস্টফ্যালেয়ার ফরাসি বিরোধী সংগঠনগুলোও তাকে বিদ্রোহের নেতৃত্ব নিতে চিঠি দেয়। এপ্রিলে শ্যে ওয়েস্টফ্যালেয়াতে বিদ্রোহ আরম্ভ করার জন্য একটি ঘোষণাপত্র লিখে প্রেরণ করেন, কিন্তু তা ফরাসিদের হস্তগত হয়। গ্রেফতার আসন্ন বুঝতে পেরে শ্যে ২৮ এপ্রিল দলবল নিয়ে বার্লিন ত্যাগ করেন। জনতার চোখে তিনি তখন মুক্তিদাতার আসনে, যিনি ফরাসিদের কবল থেকে প্রুশিয়াকে রক্ষা করবেন। মে মাস জুড়েই শ্যের পক্ষে জনতার মধ্যে বিপুল সমর্থন গড়ে উঠে। ব্র্যান্ডেনবার্গের প্রাদেশিক প্রেসিডেন্ট স্যাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডহ্নাকে সতর্ক করেন এই বলে যে বার্লিনের আনাচে কানাচে এখন মেজর শ্যের নাম উচ্চারিত হচ্ছে শ্রদ্ধার সাথে। রাজার ক্ষমতা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য কর্মকর্তারা এমন একটা ধারণা তৈরি করতে চেষ্টা করেন যাতে মনে হয় শ্যের কাজের পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে। এদিকে ৭ মে বার্লিনের পুলিশ প্রধান গ্রুনার রাজাকে জানালেন তার সামনে এখন দুটি পথ খোলা, হয় অস্ট্রিয়ার সাথে জোট বাধা নয়, প্রকাশ্যে ফ্রান্সের পক্ষ নেয়া।
ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে এর কোনোটাই করতে হয়নি। শ্যে যত তেজস্বী আর দেশপ্রেমে বলীয়ানই হোন না কেন, ফরাসি রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি বা লোকবল কোনোটাই তার ছিল না। ৩১ মে এক সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। তার মাথা কেটে নেদারল্যান্ডসের লেইডেন শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রদর্শন করা হলো বিদ্রোহীদের নিরুৎসাহিত করতে। তার আটাশজন অফিসারকে প্রাণদন্ড দেয়া হয়। একই সময় ওয়েস্টফ্যালেয়াতেও বিদ্রোহ দমন করা হয়।
এই সময়টা ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। প্রুশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনমত কাজে লাগিয়ে কর্মকর্তারা রাজাকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ফ্রেডেরিক বুদ্ধিমানের মতো তার ধীরে চলো নীতি বজায় রাখেন। নানা গুজবে বিরক্ত হয়ে তিনি একবার বলেছিলেন যদি রাজ্য চালানোর জন্য যোগ্যতর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তাকে উৎখাত করার দরকার নেই, তিনি নিজেই সানন্দে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। কিন্তু শ্যে বা যুদ্ধের সমর্থকদের প্রতি যতই ভালবাসা থাকুক, প্রুশিয়ানদের মনে হনজোলার্নদের সম্মান ও আনুগত্য অনেক গভীরে প্রোথিত, ফলে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম টিকে গেলেন। নেপোলিয়নের চাপে পড়ে তিনি ১৮০৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর বার্লিনে ফিরে আসেন, যেখানে ফরাসিরা সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখতে পারত। তারা প্রুশিয়ার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সব সময়েই সন্দিহান ছিল।
পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি
১৮১০ সালের ভেতরেই পুরো স্পেনে ফরাসি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু গেরিলা যুদ্ধ চলছিল পুরোদমে। ফলে স্থায়ীভাবে প্রায় ৬০,০০০ সেনা মার্শাল সল্টের অধীনে সেখানে ঘাঁটি করে। এরপর নেপোলিয়নের নির্দেশে জেনারেল মেসানা পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের দিকে অগ্রসর হন, সেখানে ব্রিটিশ কমান্ডার আর্থার ওয়েলেসলির শক্ত অবস্থান তাকে ব্যর্থ করে দেয়। পরের বছর আবার লিসবন দখলের চেষ্টাও একই পরিণতির মুখোমুখি হয়। ব্রিটিশ এবং পর্তুগিজ বাহিনী এবার আইবেরিয়ান উপদ্বীপের দিকে এগিয়ে আসে। স্পেনে ফরাসি কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে।
এদিকে রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সের সম্পর্কের দিকে ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের চোখ ছিল। জার আলেক্সান্ডার পঞ্চম কোয়ালিশনে অংশ নেননি। ফ্রেডেরিক জানতেন রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া দুই শক্তিকেই দরকার নেপোলিয়নকে পরাস্ত করতে গেলে। তিলসিতের চুক্তির পর যদিও রাশিয়া উপরে উপরে ফরাসিদের সমর্থন করছিল, কিন্তু তলে তলে ঠিকই কন্টিনেন্টাল সিস্টেমের বিপরীতে গিয়ে ইংল্যান্ডের সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল।
নেপোলিয়নের কাছে সব খবরই পৌঁছে। ফলে আলেক্সান্ডারের সাথে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। এই তিক্ততা আরো বাড়ে যখন জার্মানির উত্তর-পশ্চিমের ডাচি অল্ডেনবার্গ ফ্রান্স নিজের সীমান্তভুক্ত করে। ডাচির শাসকের সাথে তিলসিত চুক্তি অনুযায়ী আলেক্সান্ডারের বড় বোন ক্যাথেরিনের বিয়ে হয়েছিল। ফলে রাশিয়ানরাও ক্ষেপে যায়। অর্থনৈতিক সমস্যার দোহাই দিয়ে ফরাসি পণ্যের উপরে জার উচ্চহারে শুল্ক জারি করেন, অনেক ফরাসি দ্রব্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। নেপোলিয়ন এবার তার জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি রাশিয়া আক্রমণ করে বসেন।
রাশিয়া আক্রমণের জন্য ফরাসি গ্র্যান্ড আর্মিতে ছিল সাড়ে ছয় লাখের বেশি সৈন্য। তাদের অর্ধেক ফরাসি, বাকিরা মিত্রদেশগুলো থেকে এসেছে। প্রুশিয়া এবং অস্ট্রিয়াকেও বাধ্য করা হয় যথাক্রমে ২০,০০০ এবং ৩০,০০০ সেনা পাঠাতে। ডাচি অফ ওয়ারশ’ প্রচুর পোলিশ সৈন্য পাঠায়, কারণ নেপোলিয়ন তাদের ভজাতে এই ক্যাম্পেইনকে পোলিশদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই বলে দাবি করেন। ১৮১২ সালের জুনে নেপোলিয়ন অভিযান শুরু করেন। রাশানদের বিরুদ্ধে তিনি বেশ কয়েকটি জয় পান, কিন্তু কোনোবারই তিনি সত্যিকারভাবে তাদের কায়দা করতে পারলেন না। পিছিয়ে যেতে যেতে রাশানরা আশেপাশের সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে থাকে, যাতে নেপোলিয়ন সেনাদের জন্য কোনো রসদ না পান।
সেপ্টেম্বরে নেপোলিয়ন মস্কো প্রবেশ করেন। কিন্তু এ কী! শহর তো খাঁ খাঁ করছে। রাশিয়ানরা শহর পুড়িয়ে দিয়েছে যাতে আসন্ন শীতে নেপোলিয়ন কোনো আশ্রয় না পান। তারপরেও তিনি এখানে বসে থাকলেন এক মাস, আশা আলেক্সান্ডার শান্তি প্রস্তাব পাঠাবেন। তিনি বুঝতে পারেননি রাশান সেনাদের থেকে বড় বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে- শীতকাল।
ঠান্ডা পড়তে থাকে। এদিকে এত বড় বাহিনীর খাবার যোগানো ছিল ভয়ঙ্কর কঠিন। নেপোলিয়ন বাধ্য হন ফিরতি যাত্রা করতে (The Great Retreat)। পুরো রাস্তা শীত, রাশান সেনা আর স্থানীয় মিলিশিয়া মিলে গ্র্যান্ড আর্মির নাভিশ্বাস উঠিয়ে ছাড়ে। বলা হয়, রাশিয়া থেকে যখন নেপোলিয়ন বেরিয়ে আসেন তার সাথে ছিল মাত্র ২৭,০০০ সৈন্য।
প্রুশিয়া এবং রাশান ক্যাম্পেইন
১৮১০ সালের ১৯ জুলাই প্রাণপ্রিয় স্ত্রী লুইসা মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে মারা গেলে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম অনেকটাই ভেঙে পড়েন। স্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অভাব তিনি প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছিলেন। দীর্ঘদিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে তিনি কাটিয়ে দেন প্রার্থনাতে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত এগোচ্ছিল যে কোনো একটা হলেও সিদ্ধান্ত নেবার সময় ঘনিয়ে আসে।
১৮১২ সালে রাশিয়া আক্রমণের জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রুশিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার সময় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে নেপোলিয়ন নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের খাবারের সংস্থান করতে। কিন্তু এত বড় সেনাদলের প্রয়োজন মেটানোর মতো যথেষ্ট সম্পদ প্রুশিয়ার ছিল না। ফলে কমান্ডাররা যার যার দলকে নিজেদের মতো করে রসদ সংগ্রহের ক্ষমতা দিয়ে দেন। এর পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। প্রুশিয়ান সাধারণ জনতার ঘরবাড়ি সমস্ত লুটপাট করে নিয়ে যায় ফরাসি সৈন্যরা। কৃষকেরা জমি চাষের শেষ অবলম্বন গবাদি পশুটিও হারায়। নিরীহ মানুষ বুঝতেই পারছিল না তাদের রাজার মিত্র হয়েও ফরাসিরা এরকম করছে কেন। তাদের ব্যবহারে প্রুশিয়ান জনগণের মধ্যে ফরাসিদের ব্যাপারে প্রচন্ড ঘৃণা তৈরি হয়।
এদিকে নেপোলিয়নের সেনাদলে প্রুশিয়ার সেনা পাঠানোতে রাজার অনুগতদের মধ্যেও প্রচন্ড চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তবে ফ্রেডেরিকের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। নেপোলিয়ন নিজে প্রুশিয়ার দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়ে রাজাকে বলেছিলেন তিনি বন্ধু বা শত্রু যেভাবেই হোক প্রুশিয়ার উপর দিয়ে যাবেন। ফলে ফ্রেডেরিক সেনা পাঠানোর আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন বার্লিনের পুলিশ প্রধান গ্রুনার। গ্রুনার প্রাগে চলে গিয়ে সেখানে গোপন সংগঠনের সাথে মিলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মদদ দিতে থাকেন। পরে অস্ট্রিয়ানরাই তাকে গ্রেফতার করে। শ্যেনহর্স্ট দায়িত্ব ছেড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। বয়েন, গিনিয়াসেনইয়ো আর কাউসোউইতজ যোগ দেন রাশান সেনাদলে। সেখানে তারা মিলিত হলেন ব্যারন স্টেইনের সাথে।
প্রুশিয়ার সকলে রাশিয়াতে নেপোলিয়নের অভিযানের পরিণতি জানতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ১৮১২ সালের ১২ নভেম্বরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় নেপোলিয়নের মস্কো ত্যাগের খবর। প্রুশিয়াতে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। ফরাসিদের প্রতি প্রুশিয়ান ঘৃণা অনুভব করে বার্লিনে ফরাসি রাষ্ট্রদূত লেসারো হতবিহবল হয়ে পড়েন। ১৪ ডিসেম্বর এক বুলেটিনের মাধ্যমে বাজে আবহাওয়া এবং মিত্রদের বিশ্বাসঘাতকতার উপর দায় চাপিয়ে রাশান ক্যাম্পেইনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। প্রুশিয়ার অনেক জায়গায় এর ফলে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় মানুষ সশস্ত্র হয়ে পালিয়ে আসা ফরাসি সেনাদের উপর হামলা করে। তবে প্রুশিয়াসহ জার্মানির অন্যান্য রাষ্ট্র ফ্রান্সের প্রতি মিত্রতা থেকে তখনো সরে আসতে রাজি ছিল না। ১৫ ডিসেম্বর নেপোলিয়ন ফ্রেডেরিক উইলিয়ামকে অনুরোধ করেন আরো কিছু সেনা তার কাছে পাঠাতে, যা রাজা সাথে সাথে পালন করেন।
এদিকে প্রুশিয়ান কর্মকর্তারা জনতার বিক্ষুদ্ধ মনোভাব কাজে লাগিয়ে ফ্রেডেরিককে চাপ দিতে থাকে নেপোলিয়নের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আলেক্সান্ডারের সাথে গাঁটছড়া বাধতে, যার সেনারা পলায়রত ফরাসিদের ধাওয়া করে দুর্বার বেগে প্রুশিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে। এই বিষয়ে তিনটি রিপোর্ট ২৫ ডিসেম্বর রাজার সামনে পেশ করা হয়। রাজা সবদিক বিবেচনা করে তার সিদ্ধান্ত দিলেন। অস্ট্রিয়া তখন চেষ্টা করছে নেপোলিয়ন ও আলেক্সান্ডারের মধ্যে শান্তির জন্য, শর্ত মোতাবেক নেপোলিয়ন জার্মানিতে তার অধিকৃত এলাকাগুলো রেখে দিতে পারবেন। রাজা জানালেন, যদি ফরাসি সম্রাট এই চুক্তিতে অসম্মত হন, তাহলেই কেবল তিনি যুদ্ধের ঘোষণা দেবেন, এবং তা-ও অস্ট্রিয়া জোটে অংশ নিলে।