
আমরা রশিদ নাজমুদ্দিনোভ সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ পর্বে এসে পৌঁছেছি। প্রথম পর্বে তার শৈশব, দাবা শেখা এবং প্রাথমিক উত্থানের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে তার টালমাটাল সৈনিক জীবন ও সেখান থেকে ফিরে আসা নিয়ে কথা হয়েছে। এখন আমাদের কাছে আছেন তুমুল ফর্মে থাকা রশিদ। তাকে নিয়েই আলোচনা চলবে।
পারফর্মেন্সের শিখরে
রশিদ তার গতি পরের বছরও ধরে রাখেন। ১৯৫৮ সালে ভিলনিউসে অনুষ্ঠিত ইউএসএসআর টিম চ্যাম্পিয়নশিপে আরএসএফএসআর টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্ডারডগ আরএসএফএসআর টিম নয়টি দলের মধ্যে তৃতীয় হয়। রশিদ নিজেও ব্রোঞ্জ মেডেল পান পাউল কেরেস, ডেভিড ব্রন্সটেইন, এফিম গেলের আর ইসাক বলেস্লাভস্কির চেয়ে এগিয়ে থেকে।


কালো ঘুঁটিতে তিনি গ্র্যান্ডমাস্টার বলেস্লাভস্কিকে গুঁড়িয়ে দেন তার কিংসাইড অ্যাটাকের মাধ্যমে। পরের বছর, ১৯৫৯ সালে রশিদ তালের সাথে একটি জাদুকরী ম্যাচ খেলেন। অনেকের মতে তাদের চারবারের সাক্ষাতে এটিই ছিল বেশি ম্যাজিক্যাল। সেই বছরের তিবিলিসে আয়োজিত ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি তার বয়সের প্রভাবটা বুঝতে পারেন। তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বয়স্ক প্রতিদ্বন্দ্বী। এ টুর্নামেন্টে তার একমাত্র অর্জন ডেভিড ব্রন্সটেইনের কিংসাইড আবারও গুঁড়িয়ে দিয়ে শৈল্পিক বিজয়। তিগ্রান পেত্রসিয়ান টুর্নামেন্ট জেতেন। বন্ধুমহলে রশিদ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য খ্যাত ছিলেন। পরবর্তী দু’বছর খারাপ কাটলেও তিনি তার ইতিবাচক চিন্তায় অবিচল থাকেন। তার সবসময়ের মূলমন্ত্র ছিল, “আমাদেরও সময় আসবে।“
তালের সাথে বন্ধুত্ব
১৯৫৭ সালের ক্রাসনোদরে আয়োজিত ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম তালের নজরে আসেন রশিদ। সেই টুর্নামেন্ট তাল জেতেন, কিন্তু ব্রিলিয়ান্সি প্রাইজ রশিদ পান তালকে হারানোর ম্যাচটির জন্য। তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব চলে আসছিল। নাজমুদ্দিনোভ প্রায়ই তালের বাসায় আসতেন, অনেক রাত পর্যন্ত ব্লিটজ ম্যাচ খেলতেন।

১৯৬০ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এক অনবদ্য আখ্যান রচিত হতে চলেছিল। মিখাইল নেখমেভিচ তাল প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মিখাইল ময়সেভিচ বতভিনিকের সাথে তার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য। সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি তার প্রস্তুতি টিমে রশিদকে আমন্ত্রণ জানান। অনেকেই এতে হতবুদ্ধি হন যে, রশিদ তো একজন গ্র্যান্ডমাস্টারই নন, কিন্তু তাল বলেন, রশিদের প্যারাডক্সগুলোর জন্য তিনি তাকে অনেক সমীহ করতেন। সেগুলো বতভিনিকের সাথে তার ম্যাচে কাজে লাগতে পারে। ফলস্বরুপ রশিদ তালকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতেও সাহায্য করেন। এর ক’বছর পর ছ’বারের লেনিনগ্রাদ চ্যাম্পিয়ন গেনরিখ চেপুকাইতিস তালের বাসায় আসেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে। পরবর্তী ঘটনা শুনুন তার মুখেই,
আমি যখন কড়া নাড়লাম, একজন লম্বা, মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বেরিয়ে এলেন যাকে আমি চিনলাম না। আমি জানতাম তাল মাঝে মাঝে তার চাচা রবার্টের সাথে ভ্রমণ করত, তাই আমি ভেবেছিলাম তিনি হতে পারেন। আমি সময় পার করার জন্য তার সাথে খেলার (দাবা) আমন্ত্রণ গ্রহণ করি। প্রথম খেলায় আমি শোচনীয়ভাবে হেরে যাই, কিন্তু যখন আরও চারটি ম্যাচ এরকম হয়, তখন আমি প্যানিকড হয়ে যাই। এটা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না, আমি তালের সাথে হারতেই পারি, কিন্তু তালের চাচার কাছে? সেটাও আবার এভাবে?
তাল ফিরে আসার পরই গেনরিখ বুঝতে পারেন, লোকটি তালের চাচা নয়, তিনি ছিলেন রশিদ নাজমুদ্দিনোভ।
ক্যারিয়ারের অস্তবেলা
১৯৬১ সালে রস্তভ অন দনে হওয়া চিগরিন মেমোরিয়াল চ্যাম্পিয়নশিপে রশিদ দ্বিতীয় হন। সেই বছর উমস্কে আয়োজিত আরএসএফএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি দ্বিতীয় হন। এর মাধ্যমে তিনি বাকুতে আয়োজিত ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। বরিস স্পাস্কি চ্যাম্পিয়ন হন এতে। সেখানে উনিশতম হলেও তালের সাথে জেতা ম্যাচটির কারণে ব্রিলিয়ান্সি প্রাইজ পান। এসময় তাল তার ক্যারিয়ারের শিখরে অবস্থান করছিলেন। এটি তার ক্যারিয়ারে তৃতীয় জয় তালের বিরুদ্ধে। সাদা ঘুঁটিতে অসাধারণ আক্রমণে চোখ ধাঁধিয়ে দেন রশিদ। ধারাভাষ্যকারগণ উল্লসিত হয়ে ওঠেন “এভারগ্রিন রশিদ” বলে। তাল এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি সাংবাদিকদের পরবর্তীতে বলেন,
This is the happiest day of my life.
দুঃখজনকভাবে পরবর্তী দশক রশিদের জন্য খুব সামান্যই সাফল্য বয়ে আনে। তবুও এর মধ্যে ১৯৬২ সালে সোভিয়েত টিম চ্যাম্পিয়নশিপে ওলেঘ চার্নিকভের সাথে খেলা একটি ম্যাচ বেশ বিখ্যাত। একে বলা হয় ইতিহাসের সেরা কুইন স্যাক্রিফাইসিং গেম। তাছাড়া ১৯৬৪ সালে সাচিতে আয়োজিত চিগোরিন মেমোরিয়াল চ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাক্সিলিম্যান উইতেল্কিকে হারানোর ম্যাচটিও স্মরণীয়।
১৯৬৬ সালে সারাটভে সংঘটিত হওয়া ভ্লাদিমির দিমিত্রিভিচ সার্গিয়েভস্কির সাথে তার ম্যাচটিও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে থাকবে। এই ম্যাচে একটি রুক কম থাকার পরেও রশিদ অনবদ্য আক্রমণ চালিয়ে যান। একপর্যায়ে টিকতে না পেরে সার্গিয়েভস্কি রিজাইন করেন। ১৯৬৭ সালে ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সুযোগ পেলেও তার সেই ধার দেখা যায়নি। ১৯৭৩ সালে ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ রশিদ লাটভিয়ান ওপেন খেলতে দোগ্যাভপিলসে যান। টুর্নামেন্ট চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। সেখানে ভ্লাদিমির কারাসেভের সাথে তিনি বিখ্যাত একটি ম্যাচ খেলেন। রশিদের আক্রমণে টিকতে না পেরে কারাসেভ রিজাইন করেন। তাল এ সম্পর্কে বলেন,
আমি যুগপৎ দুঃখিত এবং আনন্দিত। কারণ, রশিদ তার শেষ টুর্নামেন্ট খেলতে আমার বাসায় এসেছিলেন। চ্যাম্পিয়ন না হলেও তিনি বরাবরের মতোই বিউটি অ্যাওয়ার্ড তিনি নিজের করে নিয়েছেন।
জীবনের শেষ বছরগুলোতেও রশিদ দাবাকে ছেড়ে দেননি। অনেক এক্সিবিশন খেলেন, সাথে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ করেন তা হলো কাজান চেস টিমে কোচিং করাতে থাকেন। একটি নতুন দাবার প্রজন্ম তুলে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন তিনি। ১৯৭৪ এর গ্রীষ্মে রশিদ গিবিয়াতোভিচ নাজমুদ্দিনোভ মৃত্যুবরণ করেন।
স্মরণিকা
যদিও রশিদ কখনোই তা বলেননি, তবুও অনেকেই বলে থাকেন, তিনি তাতার বা মুসলিম হওয়ার কারণে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের মতে, রশিদ দেশের বাইরে খেলতে যাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি হেতু গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া হয়ে ওঠেনি এই দাবাড়ুর। রশিদ অবশ্য নিজেকেই দোষ দেন। তার মতে, কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞান ব্যতীত ১৭ বছর বয়সে দাবার ভূবনে এসে তিনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। তার মূল্যায়ন অবশ্য সমসাময়িক গ্র্যান্ডমাস্টারগণ ঠিকই করতে পেরেছিলেন,
যদি তিনি আক্রমণের সুযোগ পান, তবে যে কাউকে ঘায়েল করার সক্ষমতা তার আছে।
– ইউরি অ্যাভারবাখরশিদ নাজমুদ্দিনোভ আসলে একজন ভার্চুয়াল সউল।
– ডেভিড ব্রন্সটেইননাজমুদ্দিনোভের মতো অন্য কেউ কম্বিনেশন বুঝতে পারে না।
– মিখাইল বতভিনিক

তিনি ছিলেন দাবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের সৌন্দর্যের গ্র্যান্ডমাস্টার।
– ম্যাক্স উ
তালের উক্তি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,
খেলোয়াড়গণ মারা যান, টুর্নামেন্টের কথাও লোকে ভুলে যায়। কিন্তু শিল্পীদের শ্রেষ্ঠতম শিল্পগুলো চিরকালের জন্য বেঁচে থাকে।
তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার লেগ্যাসি আজও সবাইকে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজান চেস স্কুলের নামকরণ তার নামে করা হয়েছে। তার নামে এখন একটি টুর্নামেন্টও আয়োজিত হয়। তার স্মরণে অ্যালেক্স পিশকিন বই লিখেছেন- সুপার নেজ, চেস অ্যাসাসিন।
রশিদের সম্পর্কে জেসিকা ফিশার ইউটিউবে অসাধারণ তিনটি ডকুমেন্টারি ভিডিও (১, ২, ৩) বানিয়েছেন। চেসগেমসে তার ম্যাচগুলো সংরক্ষিত আছে। তার অনবদ্য ম্যাচগুলো নিয়ে অ্যাগাদম্যাটর তার দাবার ইউটিউব চ্যানেলে একটি আলাদা বিশেষায়িত প্লেলিস্ট তৈরি করেছেন। তার সেরা পাঁচটি মুভ নিয়ে চেস ডট কমের ইউটিউব চ্যানেলেও একটি সুন্দর ভিডিও আছে। মোট কথা, রশিদ না থেকেও আজ আমাদের মাঝে সদা বিরাজমান।
এই সিরিজের পূর্বের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ১): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট
২) রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ২): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট