Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাওয়ালপিন্ডি এক্সপেরিমেন্ট: ভারতীয় সিপাহীদের উপরে ব্রিটিশদের নির্মম অস্ত্র-পরীক্ষা

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যে রূপ, রঙ আর জৌলুস ছিলো তার অনেকটাই গড়া তাদের আয়ত্ত্বে থাকা উপনিবেশগুলোর মানুষের রক্ত আর ঘামে। উপনিবেশগুলোতে শাসকশ্রেণীর স্বাধীনতার সীমানা বিশাল বিস্তৃত। এই বিশাল সীমানাকে ব্যবহার করেছে ব্রিটেনের ক্রমোন্নয়নশীল বিজ্ঞানও। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে গিনিপিগ হিসেবেও ব্যবহার করেছে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসা খাতের নতুন ওষুধের কার্যকারিতা থেকে শুরু করে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাব দেখার জন্যে বেছে নিয়েছেন এই সাধারণ মানুষগুলোকে।

ভারতীয় সাধারণ মানুষের উপর চালানো পরীক্ষা নিরীক্ষার একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সিদ্ধার্থ মুখার্জীর ‘The Emperor of All Maladies‘ বই থেকে। ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটেনে চিকিৎসাশাস্ত্রের বেশ উন্নতি শুরু হয়েছিলো। সদ্য পাশ করে বের হওয়া ব্রিটিশ ডাক্তারদের দরকার রোগী। সুদূর ভারতে ব্রিটিশ মালিকানাধীন মিলগুলোর আশপাশের বস্তিগুলোতে রোগীর অভাব নেই। অনেক কম মজুরিতে কাজ করা এই শ্রমিকদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য দলে দলে ডাক্তার পাড়ি জমাতে থাকে ভারতে।

বোম্বের কাপড়ের মিলে কাজ করা শ্রমিকদের উপর চলতে থাকে গবেষণা। আবিষ্কৃত হয় অদ্ভুত সব রোগ। ব্রিটেন কিংবা ইউরোপে রক্তশূন্যতা কিংবা পুষ্টিহীনতার রোগী খুঁজে পাওয়া বেশ দুর্লভ। ১৯২৮ সালে লুসি উইলস ‘লন্ডন স্কুল অফ মেডিসিন ফর উইমেন’ অধ্যয়নকালেই গর্ভাবস্থায় ভারতীয় মহিলাদের রক্তশূন্যতার রোগীর ব্যাপারে কৌতুহলী হয়েছিলেন। তাই পাশ করেই পাড়ি জমান ভারতে। প্রচলিত রক্তশূন্যতা থেকে বেশ আলাদা ছিলো এটি। পরীক্ষানিরীক্ষা করে আবিষ্কার করেন ব্রিটেনে প্রচলিত থাকা ‘মারমাইট’ নামক খাদ্যে এমন কিছু আছে যা এ ধরনের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে। তিনি মারমাইটের মূল উপাদান শনাক্ত করতে না পেরে এর নাম দিয়েছিলেন ‘উইলস ফ্যাক্টর’। অনেক পরে আবিষ্কৃত হয় ‘ফলিক এসিড’ নামক একপ্রকার ভিটামিনের অভাবেই ভারতীয় নারীদের মধ্যে এই সমস্যা প্রকটাকার ধারণ করে।

এভাবে বোম্বের মিলগুলোতে কম মজুরি দেওয়ার ফলে সৃষ্টি হয় এক মানবেতর জীবনযাপন করা শ্রমিকশ্রেণীর। আর তাদের উপরই পরীক্ষা চালিয়ে গেছে ব্রিটেনের ডাক্তার আর বিজ্ঞানীরা। শুধু তাদের উপরই নয়, ব্রিটেনের সামরিক অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীরা ভারতীয় সিপাহীদের উপর রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষাও করেছেন।

তৎকালীন ভারতবর্ষের রাওয়ালপিন্ডিতে স্থাপিত গ্যাস চেম্বারে করা হয় কুখ্যাত সেই পরীক্ষার। ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপেরিমেন্ট’ নামে খ্যাত এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত দীর্ঘদিন ছিলো মানুষের অজানা। জনপ্রিয় ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ব্রিটেনের ন্যাশনাল আর্কাইভে থাকা এই তথ্যগুলো প্রকাশ করা হয়েছে।

পোরটন ডাউ্ন; Image source: gumshoenews.com

পোরটন ডাউন, পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো রাসায়নিক অস্ত্র গবেষণা কেন্দ্র। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সামরিক গবেষণা কেন্দ্রের দায়িত্ব ছিলো ব্রিটিশ বাহিনীকে রাসায়নিক আর জৈব অস্ত্রে সমৃদ্ধ করে তোলা। সেই উদ্দেশ্য অনেকটা সফলও বলা চলে এই প্রতিষ্ঠানকে। ১৯৫০ সাল নাগাদ মাস্টার্ড গ্যাস আর নার্ভ গ্যাসের মতো রাসায়নিক অস্ত্র ছিলো তাদের হাতে। অ্যানথ্রাক্স বোমার মতো জৈব অস্ত্র নিয়ে কাজ করার তথ্যও ছিলো। তবে এই সুদীর্ঘ পথচলায় পোরটন ডাউনের বিরুদ্ধে অভিযোগও ছিলো অনেক। গবেষণার স্বার্থে ‘মানব গিনিপিগ’ ব্যবহারের অভিযোগটি ছিলো সবচেয়ে গুরুতর। মানুষের উপর সরাসরি রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাব নিয়ে কাজ করে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পোরটন ডাউনকে আরো কার্যকরী অস্ত্র বিনির্মাণে সহায়তা করেছে। আর এই গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ করা হয়েছে তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতীয় সেনাদের উপরে।

ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে উদ্ধারকৃত তথ্য; Image source: Frank Baron/Guardian

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছর দশেক আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের রাওয়ালপিন্ডিতে (বর্তমানে পাকিস্তানে) স্থাপিত সামরিক স্থাপনাগুলোতে চালানো হয় এই গবেষণা। পোরটন ডাউনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক বিজ্ঞানী আর ডাক্তাররা চালান এই পরীক্ষানিরীক্ষা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানকে রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা লক্ষ্যেই জোরেশোরে চালানো হতো এই গবেষণা।

ভারতীয় সেনাদের উপর যে রাসায়নিক অস্ত্রের গবেষণা চালানো হয় সেটি পরিচিত ছিলো ‘মাস্টার্ড গ্যাস’ নামে। ভারতীয় সিপাহীদের শুধুমাত্র গ্যাস প্রতিরোধী মাস্ক পরিয়েই গ্যাস চেম্বারে যেতে বলা হয়। বেরিয়ে আসার পর তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কী ক্ষতি হয়েছে তা রেকর্ড করা হয়। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এক সিপাহীর গ্যাস মাস্ক খুলে গিয়েছিলো, ফলশ্রুতিতে সেই সিপাহীর মুখ এবং চোখে পোড়া ক্ষত সৃষ্টি হয়।

মাস্টার্ড গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্ত এক ভারতীয় সেনার শরীর; Image source: Frank Baron/Guardian

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্মতি সৈনিকদের সম্মতি ছাড়াই তাদের উপর এই পরীক্ষা করা হয়েছিলো। কারণ অনেকেই এই পরীক্ষায় অংশ নিতে সম্মত ছিলো না। গ্যাস চেম্বারের যাওয়ার ব্যাপারটিকে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেও প্রচার করা হয়। ১৯৪২ সালে পোরটন ডাউনের গবেষকদের রেকর্ড খাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মারফত জানা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর সৈনিকদের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিলো যে হাসপাতালে ভর্তি করা ব্যতীত কোনো রাস্তাই খোলা ছিলো না। রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীদের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি খারাপ হয়ে যেত। এটি লিখে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীদের শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট; Image source: Frank Baron/Guardian

রেকর্ড খাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরো জানা যায়, সৈনিকদেরকে হাফ প্যান্ট এবং খাকি কটন শার্ট পরেই গ্যাস চেম্বারে যেতে বলা হতো। এতে ফলাফলও দাঁড়াতো ভয়াবহ। কোনো কোনো সৈনিককে এক সপ্তাহ নাগাদ হাসপাতালে থাকতো হতো। দীর্ঘমেয়াদে অনেক সৈনিককে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হতো। তবে পোরটন ডাউনের গবেষকরা কার্যকরী রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে অনেকটা বেপরোয়াই ছিলেন বলতে হবে। ক্রমান্বয়ে তারা ব্রিটিশ সেনাদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছিলো। ভারতীয় আর ব্রিটিশ সেনাদের উপর মাস্টার্ড গ্যাসের তুলনামূলক পরীক্ষাও করেছিলেন তারা। সেই পরীক্ষা থেকেই বেরিয়ে আসে একই পরিমাণ মাস্টার্ড গ্যাস ব্রিটিশদের থেকে ভারতীয়দের অনেক বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। 

বিতর্কিত এবং অমানবিক এই পরীক্ষার অংশগ্রহণের আগে ভারতীয় সেনাদের সম্মতি নেওয়া হয়েছিল কি না সেই ব্যাপারেও অনুসন্ধান শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ আইনজীবী এলান কেয়ারের মতে, “এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ঝুঁকি জেনেও যদি কোনো ভারতীয় সেনা এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সম্মতি দিয়ে থাকে, তবে তা আসলেই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার দাঁড়াবে। তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পরে কী হবে সেই ব্যাপারে অন্ধকারেই রাখা হতো।

রিপোর্টের বেশিরভাগই এখনো গোপন; Image source: Frank Baron/Guardian

শতাধিক ভারতীয় সৈন্যের উপর প্রয়োগকৃত সেই মাস্টার্ড গ্যাস মূলত একপ্রকার ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ। প্রয়োগকারীদের ডিএনএতে ক্ষতি করার মাধ্যমে এই গ্যাস তার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিটি করে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে এই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কথা জানা যায়নি। শুধুমাত্র দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারেই রেকর্ড করা হতো। তখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য ছিলো কী পরিমাণ মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিরোধী সৈন্যদের কাবু করা যাবে। সেই উদ্দেশ্যে সৈনিকদের দীর্ঘমেয়াদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে আমলে নেয়নি পোরটন ডাউন। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরে সাময়িক চিকিৎসা দেওয়া হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের তদারকি করেনি পোরটনের গবেষকরা। আর করা হয়ে থাকলেও ন্যাশনাল আর্কাইভের কোনো ফাইল ক্যাবিনেটেই হয়তো বন্দি হয়ে আছে সেই ঘটনাগুলো।

রাওয়ালপিন্ডি এক্সপেরিমেন্টের অনেক তথ্যই ন্যাশানাল আর্কাইভে বন্দি; Image source: Frank Baron/Guardian

রাওয়ালপিন্ডি এক্সপেরিমেন্টের দীর্ঘদিন পরে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসা এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে পোরটন কর্মকর্তারা বলছেন, এই পরীক্ষাগুলো করা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে, ঐ পরীক্ষাগুলোকে বর্তমানের মানদন্ড দিয়ে পরিমাপ করা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। বিতর্কিত এই ঘটনায় নিয়ে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও মুখে তালা দিয়েছে। গ্যাস চেম্বারে যাওয়া ভারতীয়দেরকে স্বেচ্ছাসেবীও বলা যাচ্ছে না, আবার তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়নি কোনো সম্মতিপত্রও, নেই তাদের সঠিক তালিকা কিংবা ঠিকানা। এই মাস্টার্ড গ্যাস তাদের জীবনকে পরবর্তী সময়ে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা-ও এখনো অজানা। ব্রিটেনের রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ আর গবেষণার মহাযজ্ঞে গ্যাস চেম্বারে যেতে বাধ্য হওয়া সেই ভারতীয় সেনাদের ভূমিকা হয়তো ইতিহাসে এভাবেই ধূসর থেকে যাবে।

Feature image source: gumshoenews.com

Related Articles