
দীর্ঘ নয় বছরের গৃহযুদ্ধের পরেও বহাল তবিয়তে টিকে আছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। কিন্তু যে সিংহাসনের উপর তিনি বসে আছেন, সেটা দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর লাশের উপর। আরব স্বৈরশাসকদের মধ্যে বাশার আল-আসাদ তুলনামূলকভাবে নবীন। তিনি ক্ষমতায় এসেছেন মাত্র ২০ বছর আগে, ২০০০ সালে। কিন্তু আসাদ রাজবংশের উত্থান আরও আগে। তার বাবা হাফেজ আল-আসাদ ক্ষমতায় এসেছিলেন আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭০ সালের ১৩ই নভেম্বর।
হাফেজ আল-আসাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ৬ অক্টোবর, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলীয় আনসারিয়া পার্বত্য অঞ্চলের কারদাহা গ্রামে। তিনি ছিলেন তার বাবা আলি সুলায়মান আল-আসাদের দ্বিতীয় স্ত্রীর চতুর্থ সন্তান। তার বাবার মোট ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম। তার দরিদ্র কৃষক বাবা দুই পরিবার নিয়ে মাত্র দুই রুমের একটি ইটের তৈরি বাড়িতে বসবাস করতেন। তার জন্মের সময় তাদের গ্রামে প্রায় ১০০টি পরিবার ছিল, যাদের সবাই ছিল সংখ্যালঘু আলাউই সম্প্রদায়ের।
হাফেজদের পারিবারিক উপাধি ছিল ওয়াহ্শ তথা বন্য পশু। হাফেজের দীর্ঘদেহী এবং প্রচন্ড বলশালী দাদা এক বিখ্যাত তুর্কি কুস্তিগীরকে পরাজিত করে এ উপাধি পেয়েছিলেন। সে নামটি স্থায়ী ছিল কয়েক দশক পর্যন্ত। কিন্তু পরবর্তীতে হাফেজের বাবা যখন নিজের সাহসী এবং আপোষহীন ভূমিকার মাধ্যমে গ্রামের গণমান্য ব্যক্তিদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, তখন তারা তাকে ওয়াহ্শের পরিবর্তে আসাদ তথা সিংহ উপাধি প্রদান করে।
হাফেজের জন্মের সময় তাদের গ্রাম ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং অবহেলিত। গ্রামে কোনো মসজিদ, দোকান কিংবা স্কুল ছিল না। গ্রামটির সাথে শহরের যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল একটি কাঁচা রাস্তা। হাফেজের আগে গ্রামের কেউ এমনকি হাই স্কুলেও যায়নি। ১৯৪৪ সালে হাফেজই গ্রামের প্রথম সন্তান হিসেবে লাতাকিয়াতে গিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হন। তিন বছর পর, সিরিয়ার স্বাধীনতার পরপরই যখন বাথ পার্টি গঠিত হয়, তখন ১৬ বছর বয়সী হাফেজ আল-আসাদ স্কুলের বাথ পার্টির ছাত্র শাখায় যোগ দেন।

হাফেজ আল-আসাদের বাথ পার্টিতে যোগ দেওয়ার পক্ষে যৌক্তিক কারণ ছিল। আলাউইরা দীর্ঘদিন ধরেই সমাজে বৈষম্য এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল। ফলে তাদের অনেকেই ফরাসি ম্যান্ডেটের সময় সুন্নিদের থেকে পৃথক হয়ে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। হাফেজের বাবা ছিলেন এরকমই একজন আলাউই নেতা। ১৯৩৬ সালে ৮০ জন বিশিষ্ট আলাউই ব্যক্তির সাথে তিনিও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে আলাউইদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেদন জানান।
ফরাসিরা অবশ্য শেষপর্যন্ত আলাউই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেনি। তারা সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর আলাউইরা স্থানীয় সিরিয়ানদের অনেকের চোখেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ফলে এরকম সময় স্বাধীনতার পর যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই হাফেজ এবং তার মতো অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সেসব দলের প্রতিই আকৃষ্ট হন, যারা ধর্মীয় কিংবা সাম্প্রদায়িক পরিচয় বিবেচনা না করে তাদেরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। বাথ পার্টি ছিল সেরকমই একটি রাজনৈতিক দল।
আরবি বাথ শব্দের অর্থ রেনেসাঁ বা নবজাগরণ। আরব নবজাগরণের উদ্দেশ্য নিয়ে বাথ পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিরিয়ার স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৪৭ সালের ৭ এপ্রিলে। এর প্রধান তিন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে মিশেল আফলাক ছিলেন খ্রিস্টান, সালাহউদ্দীন আল-বিতার ছিলেন সুন্নি এবং জাকি আল-আরসুজি ছিলেন আলাউই। প্রতিষ্ঠাতাদের ধর্মীয় বৈচিত্র্যের মতোই চরিত্রগত দিক থেকে বাথ পার্টিও ছিল সেক্যুলার, যারা সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি বৃহত্তর আরব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে আগ্রহী ছিল।

হাফেজ ছিলেন বাথ পার্টির অত্যন্ত সক্রিয় একজন কর্মী। ছাত্রকাল থেকেই তার মধ্যে সহজাত নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি তার স্কুলের স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তার এ পদবীকে কাজে লাগিয়ে তিনি বাথ আন্দোলনের পক্ষে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও তৎকালীন সরকারেরর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। আর সেটা করতে গিয়ে সেই ছাত্রকালেই প্রথমবারের মতো তিনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল এখুয়ানুল মুসলেমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে। লাতাকিয়ার রাস্তায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক সুন্নি ছাত্রদের সাথে তার হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
হাই স্কুল শেষ করে হাফেজ হোমসের মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন। তার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার, কিন্তু তার বাবার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। ফলে ১৯৫০ সালে তিনি মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন, যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ ফ্রি ছিল। ১৯৫৫ সালে তিনি আলেপ্পোর ফ্লাইং স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে সিরিয়ান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। বিমান বাহিনীতে তিনি দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। ১৯৫৭ সালে মিগ-১৭ যুদ্ধবিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। এক বছর পর যখন তিনি দেশে ফিরে আসেন, ততদিনে সিরিয়ার রাজনীতি পাল্টে গেছে পুরোপুরি।
স্বাধীনতার পরপরই, ১৯৪৯ সালে সিআইএর মদদে সিরিয়াতে সংঘটিত হয়েছিল আরব বিশ্বের প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। সিআইএ সমর্থিত কর্নেল হুসনি আল-জাঈম অবশ্য বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। মাত্র চার মাস পরেই পাল্টা অভ্যুত্থানে বিদায় নিতে হয় তাকে। কিন্তু তার ঐ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সিরিয়ার রাজনীতিতে শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা। ঐ অভ্যুত্থানের ফলে সিরিয়ার জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব চরম আকার ধারণ করে। এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী দিনগুলোতে সিরিয়া ধীরে ধীরে সোভিয়েত ব্লকে ঝুঁকে পড়ে।

হাফেজ যখন আলেপ্পোর ফ্লাইং স্কুলে নিজের ভবিষ্যত নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন, তখন মিসরে উত্থান ঘটছিল এক আরব জাতীয়তাবাদী নেতা, গামাল আবদেল নাসেরের। ইসরায়েল, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের আক্রমণের মুখেও নতি শিকার না করে সুয়েজ খাল সংকট মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরব বিশ্বের জনপ্রিয়তম নেতা। তার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রাম, তীব্র ইসরায়েল বিরোধী মনোভাব এবং আরব বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা অনুরণন তুলেছিল মিসর ছাড়িয়ে সমগ্র আরব বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে।
সিরিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তখন অত্যন্ত শোচনীয়। একের পর এক অভ্যুত্থানে দেশটির অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সংসদীয় ব্যবস্থার আড়ালে দেশটি শাসন করছিল মূলত সেনা কর্মকর্তারা। এছাড়াও সোভিয়েত বলয়ে ঝুঁকে পড়ায় তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এরকম অবস্থায় ১৯৫৮ সালে সিরিয়ার রাজনীতিবিদরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গামাল আবদেল নাসেরের হাতে।
সে সময় বাথ পার্টি ছিল সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বাথ পার্টির মূলনীতিগুলোর একটি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ এবং আরব ঐক্য। ফলে মিশেল আফলাকসহ তাদের নেতাদের অনেকেই মিসরের সাথে একত্রিত হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও সাধারণ সিরিয়ানদের মধ্যেও ঐক্যের ব্যাপারে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল। ফলে ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সিরিয়া এবং মিসরের সমন্বয়ে জন্মলাভ করে নতুন একটি রাষ্ট্র, ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক তথা ইউএআর। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শুকরি আল-কোয়াতলি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। নতুন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন গামাল আবদেল নাসের।

নাসের ঐ মুহূর্তে সিরিয়ার সাথে সংযুক্ত হতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। মূলত সিরিয়ান রাজনীতিবিদদের অনুরোধেই তিনি রিপাবলিক গঠনের ব্যাপারে রাজি হন। কিন্তু তার আগেই তিনি কঠিন কিছু শর্ত জুড়ে দেন। তার শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল, সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করতে হবে। বাথ পার্টির নেতারা নাসেরের এই শর্তেও রাজি হন এবং নিজেদের দল বিলুপ্ত করে নাসেরের নেতৃত্ব মেনে নেন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অনেকের মধ্যে আরব রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে থাকে।
নাসের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি একইসাথে ছিলেন কর্তৃত্বপরায়ণ। সিরিয়ার সাথে সমানভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। তার নিয়োগ করা নতুন সংসদের ৬০০ সদস্যদের মধ্যে ৪০০ জনই ছিল মিসরীয়। বাথ পার্টির নেতাদের অনেককে তিনি মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। সামরিক বাহিনীতেও সিরীয় সেনা কর্মকর্তাদের স্থান ছিল মিসরীয়দের অধীনে। ফলে ধীরে ধীরে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের মধ্যে রিপাবলিক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে।
এরকম সময়ে হাফেজ আল-আসাদ প্রশিক্ষণ শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর তাকে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয় মিসরে। হাফেজ তখনও মিসর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু বাথ পার্টির অন্য অনেক কর্মীর মতোই তিনিও নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। মিসরে থাকার সময় ১৯৫৯ সালে তিনি এবং তার সমমনা চার বন্ধু মিলে এ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন গোপন একটি সংগঠন, মিলিটারি কমিটি।

১৯৬১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর রিপাালিক থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী অংশটি ক্ষমতা দখল করে এবং ইউএআর থেকে সিরিয়াকে বের করে নেয়। নতুন সরকার বাথিস্টদেরকে নাসেরপন্থী বিবেচনায় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। তারা সেনাবাহিনী থেকে প্রচুর বাথিস্ট অফিসারকে চাকরিচ্যুত করে। এদের মধ্যে ছিলেন হাফেজ আল-আসাদসহ মিলিটারি কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যও। চাকরিচ্যুত হওয়ার পরেও তারা বাথ পার্টিকে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে গোপনে কাজ করে যেতে থাকেন। ১৯৬৩ সালের ৮ মার্চ পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় বসান বাথ পার্টিকে।
১৯৬৩ সালের অভ্যুত্থানটি ছিল সিরিয়ার ইতিহাসে বাঁক সৃষ্টিকারী একটি অভ্যুত্থান। এতে বাথ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মিশেল আফলাকের সমর্থন থাকলেও এটি ছিল মূলত বাথ পার্টির খুব ক্ষুদ্র একটি সামরিক শাখার অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই মূলত বাথ পার্টির সামরিক এবং বেসামরিক শাখার মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করে। সিরিয়া চলে যায় মূলত হাফেজ আল-আসদদের মিলিটারি কমিটির হাতে। জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে সিরিয়াতে শুরু হয় বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যে জরুরি অবস্থা স্থায়ী হয় পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশক পর্যন্ত।
১৯৬৩ সালের অভ্যুত্থানের পর মিলিটারি কমিটির সদস্যদেরকে সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয়। ৩৩ বছর বয়সী হাফেজ আল-আসাদকে দেওয়া হয় সিরিয়ান বিমান বাহিনীর দায়িত্ব। কিন্তু বাথ পার্টিতে এবং মিলিটারি কমিটির অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে সংঘটিত হয় আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান। প্রেসিডেন্ট আমিন আল-হাফেজকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিও বাথ নামে বাথ পার্টির চরমপন্থী অংশটি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নূর উদ্দিন আল-আতাসিকে দেওয়া হলেও কার্যত ক্ষমতায় বসেন মিলিটারি কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে পরিচিত জেনারেল সালাহ আল-জাদিদ। মাত্র ৩৬ বছর বয়সী হাফেজ আল-আসাদকে তিনি নিযুক্ত করেন সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সিরিয়া জড়িয়ে পড়ে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে। আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত মিসরও যেখানে ঐ যুদ্ধে ইসরায়েলের শক্তিশালী বিমান বাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে অনভিজ্ঞ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত সিরিয়ান সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভ করাটা প্রায় অসম্ভবই ছিল। কিন্তু তারপরেও এই যুদ্ধে পরাজয়ের দায় এসে পড়ে সরাসরি হাফেজ আল-আসাদের উপর। কারণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রাপ্ত তথ্য ভালোভাবে যাচাই না করেই তিনি ভুল বার্তা প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং এর ফলেই সিরিয়ান বাহিনীর পরাজয় ঘটে।
যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাথ পার্টির ভেতরে এবং মিলিটারি কাউন্সিলে হাফেজ অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল সালাহ জাদিদের সাথে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। সালাহ জাদিদের বিভিন্ন নীতির সাথেও হাফেজ পুরোপুরি একমত হতে পারছিলেন না। তার মতে, সালাহ জাদিদের কট্টর সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলো সিরিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর ছিল। ফলে এর আগের একাধিক অভ্যুত্থানের সময় পেছন থেকে নীরবে কাজ করে যাওয়া হাফেজ আল-আসাদ প্রথমবারের মতো সালাহ জাদিদকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
১৯৭০ সালে হাফেজের সামনে সে সুযোগ চলে আসে। সে সময় জর্ডানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি গেরিলারা জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করলে হুসেইনের বাহিনী তাদেরকে জর্ডান থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে পরিচিত ঐ ঘটনায় সালাহ জাদিদের নির্দেশে হাফেজ ফিলিস্তিনি গেরিলাদেরকে সাহায্য করার জন্য ট্যাংক বহর প্রেরণ করেন। কিন্তু তার এ সাহায্য ছিল সীমিত। ট্যাংক বহর পাঠালেও জর্ডানিয়ান বিমান বাহিনীর আক্রমণ থেকে সেগুলোকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় এয়ার সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা তিনি করেননি। ফলে যুদ্ধে তার বাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে আসে।

ফিলিস্তিনি গেরিলাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে হাফেজের সাথে জাদিদের চিন্তা-ভাবনায় মৌলিক পার্থক্য ছিল। হাফেজ ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোর পরাজয়ের পেছনে গেরিলাদের অনিয়ন্ত্রিত ভূমিকাকে দায়ী করতেন। তার মতে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হওয়া উচিত শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে। গেরিলারা যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যখন-তখন ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে বসে, তাহলে ইসরায়েলের বড় কোনো ক্ষতি তো হবেই না, বরং ঐ আক্রমণগুলোকে উপলক্ষ্য করে তারা অতর্কিত আক্রমণ করে উল্টো আরব রাষ্ট্রগুলোরই ক্ষতি করার সুযোগ পাবে।
১৯৭০ সালের সংকটকেও হাফেজ ফিলিস্তিনি গেরিলাদের কারণে সৃষ্ট একটি অনাকাঙ্খিত সংকট হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। সিরিয়া তখনও ১৯৬৭ সালের পরাজয়ের রেশ থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। যুদ্ধের পর জর্ডান এবং মিসর যেখানে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য পেয়েছিল, সালাহ জাদিদের উগ্র বামপন্থী নীতির কারণে অনেকটা একঘরে হয়ে থাকা সিরিয়া সেরকম কোনো সাহায্য পায়নি। বরং ফিলিস্তিন থেকে আসা শরণার্থীদের চাপ সামলাতেই সিরিয়া বেশি ব্যস্ত ছিল। ফলে ঐ মুহূর্তে ফিলিস্তিনি গেরিলাদেরকে সাহায্য করার জন্য বিমান বাহিনী পাঠিয়ে নতুন করে ইসরায়েলের আক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার কোনো ইচ্ছে হাফেজের ছিল না।

মূলত হাফেজের অসহযোগিতার কারণে জর্ডানিয়ান রয়্যাল এয়ারফোর্সের তীব্র আক্রমণের মুখে পরাজিত হয় সিরিয়ান ট্যাংক ডিভিশন। ক্ষিপ্ত সালাহ জাদিদ হাফেজ আল-আসাদকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে এবং বাথ পার্টির নেতৃত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। হাফেজ অবশ্য আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। ফলে জাদিদের নির্দেশ কার্যকর হওয়ার আগেই পাল্টা এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসেন তিনি।
দিনটি ছিল ১৯৭০ সালের ১৩ই নভেম্বর। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে।