Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কুরস্ক: রাশিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ সাবমেরিন দুর্ঘটনা

সমুদ্রের ১০০ মিটার গভীরে দুর্ঘটনাকবলিত সাবমেরিনের নাবিক হিসেবে কল্পনা করুন: বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই, বের হয়ে আসা তো অসম্ভব। একটু একটু করে শেষ হয়ে আসছে সঞ্চিত অক্সিজেন, চোখের সামনে মারা যাচ্ছে সহকর্মীরা। উদ্ধার পাবার আশায় থাকলেও আদতে আপনি বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ব্যাপারটি স্রেফ কল্পনা করতেই আমাদের গা শিউরে ওঠে। ঠিক একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল রাশিয়ান সাবমেরিন কুরস্কের ১১৮ জন নাবিক। ২০০০ সালের ১২ আগস্ট ব্যারেন্টস সাগরে এক মহড়ার সময় দুর্ঘটনায় মারা যায় এদের সবাই। আজকের লেখায় আমরা জানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর সাবমেরিন দুর্ঘটনার ঘটনা সম্পর্কে। 

সাবমেরিন K-141 Kursk ছিল অস্কার-২ ক্লাসের পারমাণবিক শক্তিচালিত একটি অত্যাধুনিক ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন। ১৯৯৪ সালে নর্দান ফ্লিটে সার্ভিসে আসা এই জলযান রাশিয়ার কুরস্ক শহরে হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধের স্মরণে নামকরণ করা হয়। ১৬,৪০০ টনের জলদানবটি তৎকালীন বিশ্বের সেরা সাবমেরিনগুলোর মধ্যে একটি। দুটো নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের সাহায্যে এটি পানির উপরে সর্বোচ্চ ৩০ কি.মি. ও পানির নিচে সর্বোচ্চ ৫৯ কি.মি. গতিতে ছুটতে পারত। পানির ৩০০-৫০০ মিটার গভীরে ডুব দেয়ার জন্য সাবমেরিনটির বডি নিকেল, ক্রোমিয়াম ও স্টেইনলেস স্টিলের মিশ্রণের ৫০ মিলিমিটার পুরু শক্তিশালী সংকর ধাতু দিয়ে বানানো হয়েছিল। ৮ মিলিমিটার স্টিল প্লেটের উপর ৮০ মিলিমিটার রাবার প্যাড দ্বারা কভার থাকায় কুরস্ক যেমন রাডার-সোনারে ধরা পড়া কষ্টসাধ্য ছিল, তেমনি শত্রুর একটিমাত্র টর্পেডো হামলায় একে ডোবান অসম্ভব ছিল। এতে অস্ত্র হিসেবে ছিল ৬২৫ কি.মি. রেঞ্জের ২৪টি P-700 Granit সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। এছাড়া ৬টি টিউবের জন্য মোট ২৪টি টর্পেডো ও ১৮টি এন্টি সাবমেরিন মিসাইল ছিল।

রাশিয়ান সাবমেরিন কে-১৪১ কুরস্ক; Image source: thedrive.com

মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও অন্যান্য যুদ্ধজাহাজের মোকাবেলা করতে এই সাবমেরিন বানানো হয়। এজন্য একটানা ১২০ দিন পানির নিচে থাকতে পারত কে-১৪১ কুরস্ক। প্রকান্ড জলযানটি ছিল ৫০৫ ফুট লম্বা যাতে নাবিকদের জন্য থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি ব্যায়ামের জন্য আধুনিক জিমনেসিয়ামও ছিল! পাঁচ বছরের সার্ভিস লাইফে এটি মাত্র একবারই সত্যিকারের মিশনে মোতায়েন হয়। ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধের সময় ভূমধ্যসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর সিক্সথ ফ্লিটের উপর ছয় মাস নজরদারি করে কুরস্ক। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন-পরবর্তী দুর্বল অর্থনীতির রাশিয়া অর্থাভাবে সাবমেরিনটি নিয়মিত ট্রেনিংয়ে নিযুক্ত রাখতে পারেনি। ফলে এর ক্রুরা ছিল অনভিজ্ঞ যা সাবমেরিনের দুর্ঘটনার পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।  

অনুশীলন ও দুর্ঘটনা

২০০০ সালের ১০ আগস্ট রাশিয়ান নৌবাহিনী একটি বড় ধরনের নৌমহড়ার আয়োজন করে। এক্সারসাইজ সামার-এক্স নামের এই মহড়ায় ৩০টি যুদ্ধজাহাজ, ৪টি সাবমেরিনসহ একাধিক ছোট ছোট জাহাজ অংশ নেয়। কুরস্ক কিছুদিন আগেই নর্দান ফ্লিটের সেরা সাবমেরিন হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিল। উক্ত অনুশীলনে এটি ‘ফুল কমব্যাট লোড’ তথা যুদ্ধাবস্থার ন্যায় সত্যিকারের অস্ত্র বহনের অনুমতি পেয়েছিল যা রাশান নৌবাহিনীর গুটিকয়েক সাবমেরিনের ছিল। সাধারণত শান্তির সময়ে সাবমেরিন বা যুদ্ধজাহাজগুলো তার সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার অস্ত্র বহন করে না। অন্যদিকে অনুশীলনে বিস্ফোরকবিহীন ডামি মিসাইল/টর্পেডো সাধারণত ফায়ার করা হয়। কুরস্ককে সত্যিকারের অস্ত্র বহনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর অনুশীলনে সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।

কুরস্কের মতো অস্কার ক্লাস সাবমেরিনগুলো ছিল যেন মিসাইলের গোডাউন; Image source : forbes.com

সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য কুরস্ক তার প্রতি আরোপিত নির্দেশ অনুযায়ী রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে সাগরে ডুব দেয়। অনুশীলনের অংশ হিসবে তাকে খুঁজতে শুরু করে অন্যান্য জাহাজ। কিন্তু তাদের ফাঁকি দিয়ে নির্ধারিত পয়েন্টে পৌঁছে টার্গেটের উদ্দেশ্যে ডামি মিসাইল ফায়ার করে। প্রথম মিশন সফল হওয়ার পর সাবমেরিনটি এবার নর্দান ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপকে ধাওয়া শুরু করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ব্যাটলক্রুজার ‘পিটার দ্য গ্রেট’ এর উদ্দেশ্যে ডামি টর্পেডো ফায়ারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কুরস্ককে। এতে কোনো বিস্ফোরক ওয়ারহেড ছিল না। ফলে নর্দান ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপ আক্রান্ত হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। আধুনিক নৌবাহিনীগুলো এভাবেই সত্যিকারের যুদ্ধ অনুশীলন সম্পন্ন করে থাকে। 

পরিকল্পনা মোতাবেক ১২ আগস্ট, ২০০০ সালে সাবমেরিন কুরস্ক ব্যারেন্টস সাগরের তলায় তার সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নেয়। আগেই বলা হয়েছে যে এতে ‘টাইপ ৬৫’ নামক টর্পেডো ব্যবহার করা হতো যা তাত্ত্বিকভাবে সিঙ্গেল শটে ৫০-১০০ কি.মি. দূর থেকে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডোবানোর মতো শক্তিশালী ছিল। এতে কনভেনশনাল (৫৫৭ কেজি) বা নিউক্লিয়ার (২০ কিলোটন) – দু’ধরনের ওয়ারহেড (বিস্ফোরক) নেয়ার সুবিধা ছিল। অনুশীলনে যেটি ফায়ারের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল তাতে কোনো ওয়ারহেড না থাকলেও সেটি নিজেই ছিল দুর্ঘটনার কারণ।

টাইপ ৬৫ টর্পেডো পানির নিচে অকল্পনীয় গতিতে (ঘণ্টায় ৯৩ কি.মি.) ছুটতে পারত। এজন্য এতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও কেরোসিনকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৯৫৫ সালে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এ ধরনের টর্পেডো ফায়ারের সময় দুর্ঘটনায় পড়ার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ব্যবহার বাদ দিয়ে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু রুশ নৌবাহিনী সেটি করেনি। উল্টো অনুশীলনে ফায়ার করা হবে বিধায় এতে নিম্নমানের ফুয়েল ব্যবহার করা হয়। ক্রুটিপূর্ণ ওয়েল্ডিংয়ের কারণে ফুয়েল লিক ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয় টের পেয়ে একজন ক্রু তার সিনিয়র অফিসারকে জানান। কিন্তু এজন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সকাল ১১:২৮ মিনিটে যখন টর্পেডো ফায়ারের জন্য অ্যাক্টিভেট করা হয়, তখন এটি টিউবের ভেতরই বিস্ফোরিত হয়। ৫০ মিটার দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে টিউবের বাইরের দিকের হ্যাচডোর। তদন্তকারীদের ধারণা, এই বিস্ফোরণের ধ্বংসক্ষমতা ১০০-২৫০ কেজি টিএনটির সমতুল্য ছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ১.৫।

কুরস্কের টর্পেডো টিউবগুলো দেখতে এরকমই ছিল Image source : nationalinterest.org
বিস্ফোরণ ঘটে টর্পেডো রুমে; Image source : vadebarcos.net

সাবমেরিনটি তখন ৩৫৪ ফুট পানির নিচে ছিল। বিস্ফোরণে সামনের টর্পেডো রুমে আগুন ধরে যায়। তদন্তে এই বিস্ফোরণের তাপমাত্রা ২,৭০০ ডিগ্রি ছিল বলে জানা যায়। ফলে ধারণা করা হয়, প্রথম কম্পার্টমেন্ট তথা টর্পেডো রুমের সবাই বিস্ফোরণের সাথে সাথে নিহত হন। এয়ার কন্ডিশনিং ভেন্টের সাহায্যে চতুর্থ কম্পার্টমেন্ট পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কুরস্কের স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা সাথে সাথেই চালু হলেও সব মিলিয়ে প্রথম ধাক্কায় আনুমানিক ৩৬ জন মারা যায়। ততক্ষণে অচল হয়ে পড়েছে সাবমেরিনের মেইন কমান্ড সেন্টার। সেকেন্ডে প্রায় ৯০ হাজার লিটার করে পানি ঢুকতে শুরু করেছে একাধিক কম্পার্টমেন্টে! নিয়মানুযায়ী নাবিকরা সেগুলোর হ্যাচডোর লকডাউনসহ পারমাণবিক বিপর্যয় এড়াতে নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরও শাটডাউন করে দেয়। সাবমেরিনে তখন ইমারজেন্সি জেনারেটরের সাহায্যে পাওয়ার সাপ্লাই করা হচ্ছিল। প্রথম বিস্ফোরণের ঠিক ১৩৫ সেকেন্ড পর দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সত্যিকারের ওয়ারহেডযুক্ত পাঁচ থেকে সাতটি টর্পেডো একযোগে বিস্ফোরিত হয়ে সাবমেরিনের ভেতরটি বিদীর্ণ করে দেয়। এতে ২২ বর্গ ফুটের বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়। তদন্তকারীদের ধারণা, এই বিস্ফোরণের ধ্বংসক্ষমতা তিন হাজার থেকে সাত হাজার কেজি টিএনটির সমতুল্য ছিল! এতে তিনটি কম্পার্টমেন্ট পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, সাথে সাথে মারা যায় আনুমানিক ২৩ জন।

প্রথম বিস্ফোরণের পরপরই ‘রেসকিউ বয়া’ রিলিজ করা হয়। সাধারণত দুর্ঘটনা কবলিত সাবমেরিনের অবস্থান জানানোর জন্য বিশেষ ধরনের সিগন্যাল বয়া ছাড়া হয় যা পানির উপরে এসে ক্রমাগত জিপিএস সিগন্যাল দিতে থাকে। কুরস্কের এই সুবিধা থাকার পরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি সময়মতো কাজ করেনি। ফ্ল্যাগশিপ পিটার দ্য গ্রেটের উপর নির্ধারিত সময়ে টর্পেডো আক্রমণ না হওয়ায় এবং নির্দিষ্ট সময় পরও কুরস্ক রেডিও যোগাযোগ না করায় রাশিয়ান নৌবাহিনী দেশটির ভূকম্পনবিদদের কথায় কান দেয়া শুরু করে। কেননা ব্যারেন্টস সাগরের আশেপাশের একাধিক ইউরোপিয়ান ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ স্টেশন কুরস্কের জোরালো বিস্ফোরণ তাদের সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে রেকর্ড করতে পেরেছিল (এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আরেকটি আর্টিকেল পড়ুন Roar বাংলায়)। এমনকি সাড়ে চার হাজার কি.মি. দূরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সেন্টারও এই বিস্ফোরণ টের পেয়েছিল।

দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ফলে সাগরের এই সামান্য গভীরতায় রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি কেন্দ্র হওয়ার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। সবাই ধারণা করতে শুরু করে যে তাদের কোনো সাবমেরিন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। মহড়া বাতিল করে পুরো রাশান নৌবাহিনী কুরস্ককে খুঁজে বের করতে উঠেপড়ে লাগে। ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর দুর্ঘটনার ১৬ ঘণ্টার মাথায় সাগরের ৩৭৭ ফুট গভীরে কুরস্ককে খুঁজে পাওয়া যায়। ৯ নাম্বার কম্পার্টমেন্টের ভেতর থেকে ধাতব বস্তু দিয়ে মোর্স কোডের শব্দ উৎপন্ন করার মাধ্যমে জানান দিচ্ছে যে কয়েকজন নাবিক এখনো বেঁচে আছে! দ্বিতীয় এস্কেপ ক্যাপসুল সচল থাকলেও ‘ডিকম্প্রেশন’জনিত অসুস্থতার ভয়ে সেটি ব্যবহার করা তাদের পক্ষে তখন সম্ভব নয়। শুরু হয় উদ্ধারের আপ্রাণ প্রচেষ্টা।

নরওয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ স্টেশনের পাওয়া তথ্য; Image source : Norwegian Seismic Array Service
পানির নিচে তোলা ছবিতে মারাত্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কুরস্ক সাবমেরিন Image source : en.topwar.ru

রেসকিউ অপারেশন ও তদন্ত

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নরওয়ে ও ব্রিটেন সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। দেশ দুটোর কাছে তৎকালীন সর্বাধুনিক সাবমেরিন রেসকিউ ভেসেল ছিল। কিন্তু রাশিয়ান নৌবাহিনী সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তাদের কাছে দুটো ভেসেল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর্থিক সংকটে থাকা দেশটি একটি ভেসেল বিক্রি করে দিয়েছিল। অপরটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রুটিপূর্ণ ছিল যা সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এদিকে গোপন তথ্য পাচারের আশঙ্কায় রুশ প্রশাসন প্রথমে বিদেশী নৌবাহিনীর সাহায্য নিতে চায়নি। শেষপর্যন্ত নিজেদের অক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নরওয়ের সাহায্য নেয়া হয়। ততক্ষণে ১১৮ জন নাবিকের সবাই মারা গেছে। ২১ আগস্ট নয় নাম্বার কম্পার্টমেন্টের ভেতর ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন দিমিত্রি কোলেসনিকভের লেখা দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া নাবিকদের নাম লেখা একটি লিস্টও পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই ২৪ জন রিজার্ভ অক্সিজেন শেষ হবার পর মারা গেছেন। পুরো রাশিয়া জুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে। শুরু হয় পুতিন সরকারের তীব্র সমালোচনা। সময়মতো বিদেশী সাহায্য নিলে তারা হয়তো বেঁচে যেত।

তদন্তে আরো একটি মর্মান্তিক ঘটনার কথা জানা যায়। সাবমেরিন কুরস্কে ইমারজেন্সি অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের জন্য কেমিক্যাল জেনারেটর ব্যবহার করা হতো যার ফুয়েল ছিল পটাশিয়াম সুপারঅক্সাইড কার্টিজ। এটি রাসায়নিকভাবে অক্সিজেন ত্যাগ করে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। এই কার্টিজ নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলে দিতে হতো। এই কার্টিজ পানির সংস্পর্শে আসলে প্রচন্ড দাহ্য পদার্থ হয়ে ওঠে। নয় নাম্বার কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে কোমর পর্যন্ত পানি জমে ছিল। একজন ক্রু কার্টিজ বদলানোর সময় ভয়, পিপাসা ও ঠাণ্ডায় তালগোল পাকিয়ে হাত থেকে সেটি ফেলে দেয়। ফলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এতে বেশ কয়েকজনের গায়ে আগুন ধরে যায়। বাকিরা বাঁচার জন্য পানিতে ডুব দেয়। আগুনে ক্রুদের তেমন শারীরিক ক্ষতি না হলেও তার চেয়ে বড় ক্ষতি ততক্ষণে হয়ে গেছে। আগুন ধরায় কম্পার্টমেন্টের অক্সিজেন লেভেল এক লাফে অনেকখানি কমে যায়। পোর্টেবল অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেমের রিজার্ভও তখন প্রায় শেষের দিকে ছিল। এর কিছু সময় পরই সকল নাবিক একে একে মারা যান। ক্যাপ্টেন কোলেসনিকভের লেখা নোটে লেখা ছিল,

It’s dark here to write, but I’ll try by feel. It seems like there are no chances, 10–20%. Let’s hope that at least someone will read this. Here’s the list of personnel from the other sections, who are now in the ninth and will attempt to get out. Regards to everybody, no need to despair. Kolesnikov.

ক্যাপ্টেন কোলেসনিকভের লেখা নোট; Image source: Bashny
নাবিকদের স্বজনদের সাথে কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন; Image source: Kremlin.ru

এই ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিনের ব্যাপক সমালোচনা হয়। দুর্ঘটনার পর তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যর্থতার পাশাপাশি পুরো পাঁচদিন তিনি সোচি শহরে নিজের প্রেসিডেনশিয়াল রিসোর্টে অবকাশযাপনে ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়া কুরস্কের নাবিকদের তাদের স্বজনদের সম্পর্কে তথ্য না দিয়ে বিভিন্ন তালবাহানা করায় রুশ প্রশাসনেরও সমালোচনা হয়। এর মধ্যে একটি ঘটনা ক্ষোভের বারুদে আগুনের যোগায়। সন্তানের খোঁজে পাগলপ্রায় এক মা সংবাদ সম্মেলনে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির প্রতিবাদ করলে তাকে রুশ গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট কর্তৃক চেতনানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে জনসম্মুখে অজ্ঞান করে সম্মেলন থেকে বহিস্কার করা হয়!

ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার

২০০১ সালে ৬৫ মিলিয়ন ডলার চুক্তিতে ডাচ কোম্পানি মামোয়েট এবং স্মিট ইন্টারন্যাশনালের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামকে সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা ‘জায়ান্ট ৪’ নামক একটি ভাসমান বার্জ ক্রেন বানায়। প্রথমেই তারা নিহতদের দেহাবশেষ উদ্ধার করে। ডুবুরিদের তোলা ছবি দেখে বোঝা যায়, সাবমেরিনের সামনের অংশ (bow) এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে সেটা কেটে আলাদা না করলে সাবমেরিন পানির ওপর ওঠানো যাবে না। পরিকল্পনা মোতাবেক টাংস্টেন কার্বাইডের ক্যাবলের সাহায্যে বো-র অংশ পানির নিচেই কেটে আলাদা করা হয়। কাজটি বেশ সতর্কতার সাথে করতে হয়েছিল। কেননা টর্পেডো, মিসাইলসহ অন্যান্য বিস্ফোরক পদার্থ আগেও সরিয়ে নেয়া হলেও সাবমেরিনের ভেতরে বিভিন্ন পকেটে তখনও হাইড্রোজেনসহ অন্যান্য দাহ্য গ্যাস জমে ছিল। কাজটি শেষ হতেই একে বেলুন ও ক্রেনের সাহায্যে পানির উপরে ভাসিয়ে তোলা হয়। একে ক্যাবল দিয়ে টেনে সেভারমরস্ক বন্দরের ভাসমান ড্রাই ডকে ক্রেন দিয়ে তোলা হয়। তদন্ত শেষে কুরস্ককে স্ক্র্যাপ (ভেঙে ফেলা) করা হয়। তবে সাবমেরিনের নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর থেকে সতর্কতার সাথে ইউরেনিয়াম ফুয়েল রড সরানোসহ স্ক্র্যাপ করার কাজ শেষ হয় ২০০৩ সালের শুরুতে। এর আগের বছর কেটে ফেলা বো থেকে টর্পেডো টিউব ও অন্যান্য পরিবেশ ক্ষতিকারক বস্তু অপসারণ করে বিস্ফোরক দিয়ে সেটি ধ্বংস করে দেয়া রাশিয়া।

কুরস্ক সাবমেরিন উদ্ধার প্রক্রিয়া ছিল খুবই জটিল একটি কাজ; Image source : joelertola.com
ড্রাই ডকে তোলা কুরস্কের ধ্বংসাবশেষ; Image source : en.topwar.ru

অফিসিয়াল বক্তব্য এবং কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

রাশিয়ান নৌবাহিনী বেশ কয়েকভাবে এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। এর মধ্যে একটি হলো বিদেশী সাবমেরিনের সাথে ধাক্কা লাগার দাবি করা। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, অচেনা সাবমেরিনের সাথে ধাক্কা লাগার কারণে টর্পেডো রুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়। এছাড়া চেচনিয়ান নাবিকদের বিদ্রোহ, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ডাবল এজেন্টদের সাবমেরিন দখলের প্রচেষ্টা ও স্যাবোট্যাজ, অন্য রুশ যুদ্ধজাহাজ থেকে ভুলক্রমে হামলা (ফ্রেন্ডলি ফায়ার), ন্যাটো সাবমেরিনের হামলা, সিক্রেট ওয়েপন (নতুন ডিজাইনের টর্পেডো) পরীক্ষার সময় দুর্ঘটনাসহ বেশ কিছু মুখরোচক গল্প কুরস্ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে যায়।

তবে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ফুয়েল ও টর্পেডো কেসিং ক্রুটিপূর্ণ ওয়েল্ডিংয়ের ঘটনা সামনে আসার পর বিদেশী সাবমেরিনের এই দাবি নাকচ হয়ে যায়। ভাইস এডমিরাল ভ্যালেরি র‍্যায়াজনেতসভ দাবি করেন, ক্রুদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর সত্যতাস্বরূপ তিনি উদ্ধার করা আধপোড়া ‘সেফটি ইন্সট্রাকশন’ ম্যানুয়ালের রেফারেন্স দেন। সাবমেরিন ক্রুদের একধরনের টর্পেডো দেয়া হলেও তাদেরকে ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়াল দেয়া হয়েছে আরেক ধরনের টর্পেডোর। এডমিরাল ভ্যালেরির ধারণা, টর্পেডো রুমের ক্রুরা কাজে অবহেলা করেছিল। কারণ কুরস্কের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছিল যেন টর্পেডো টিউবে বিস্ফোরণ ঘটলে সেটির ব্লাস্ট ওয়েভের ধাক্কা সাবমেরিনের বাইরে চলে যায়। ক্রুরা তাদের কাজ যথাযথভাবে না করায় তিনগুণ শক্তিশালী ইন্টারনাল ডোর বিস্ফোরণের ধাক্কা ঠেকাতে পারেনি।

বাবার সমাধির সাথে নিহত এক নাবিকের মেয়ে; Image source: rbth.com
কুরস্কের নিহত নাবিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ; Image source: thebarentsobserver.com

শেষ পর্যন্ত দুই বছর পর সরকারের কাছে ১৩৩ ভলিউমের বিশাল রিপোর্ট জমা দেয় রুশ তদন্ত কমিটি। এতে বেশ কয়েকটি কারণকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়। এগুলো হলো- হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ফুয়েলের ১০ বছরের পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ ডামি টর্পেডো, নিম্নমানের ওয়েল্ডিং, ক্রুদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং ও ডিসিপ্লিনের অভাব, দুর্ঘটনার পর দ্রুত সাড়াদানে রুশ নৌবাহিনীর ব্যর্থতা, রেস্কিউ বয়া সময়মতো কাজ না করা, সাবমেরিন থেকে বের হবার এস্কেপ পডে যেতে ক্রুদের ব্যর্থতা, শাটডাউন হয়ে যাওয়া নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর পুনরায় চালু করার সুবিধা না থাকা ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার মেল্টডাউন ঠেকানোর জন্য যে সেলফ লকডাউন সিস্টেম কুরস্কে ছিল, ক্রুরা সেটি ওভাররাইড করার সুবিধা পেলে ব্যাকআপ জেনারেটর ডাউন হবার পরও অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম পুনরায় চালু করা সম্ভব হতো। কিন্তু সেটি সম্ভব না হওয়ায় এবং পটাসিয়াম সুপারঅক্সাইড কার্টিজ দুর্ঘটনায় আগুন ধরায় নির্ধারিত সময়ের ছয় ঘণ্টা আগেই সমস্ত অক্সিজেন শেষ হয়ে ক্রুরা মারা যায়। কুরস্ক সাবমেরিন দুর্ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছে একাধিক গান, নাটক, বই, সিনেমা। Kursk (2018) মুভিতে টর্পেডো দুর্ঘটনার দৃশ্য ও ক্রুদের বাঁচার আকুতি বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর কোনো দেশে না ঘটুক এটাই আমাদের কামনা।

Related Articles