ট্যাংক নামক যুদ্ধ-দানবটি ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম বানানো হয়। ব্রিটিশরা নতুন এই অস্ত্র তৈরির প্রজেক্টটি গোপন রাখার জন্য এর নাম ‘ট্যাংক’ দেয় যেন পানির ট্যাংকের সাথে ব্যাটল ট্যাংক মিলিয়ে ফেলে শত্রুপক্ষ বিভ্রান্ত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের প্রত্যেকটি মেজর কনফ্লিক্টে ট্যাংকের ব্যবহার হয়েছে।
ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট-মিসাইল আবিষ্কার হওয়ার পরও দিনের পর দিন ট্যাংক আরো উন্নত ও শক্তিশালী হচ্ছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে সহসাই ট্যাংকের বিকল্প কোনো অস্ত্র আসবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক মানে শত্রুর জন্য আতঙ্ক। একটি সাধারণ আর্টিলারি বা কামান শত্রুর যেরকম ক্ষতি করতে পারে, চলন্ত কামান বলে খ্যাত ট্যাংক নামক যুদ্ধদানবটি দক্ষ কমান্ডারের হাতে পড়লে এর চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে। আজকের লেখায় আমরা জানবো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকজন সেরা ট্যাংক কমান্ডারের গল্প।
সর্বকালের সেরা ট্যাংক কমান্ডার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির দুর্ধর্ষ ট্যাংক কমান্ডার সার্জেন্ট কার্ট নিস্পেলকে সর্বকালের সেরা ট্যাংক কমান্ডার বলা হয়। কেননা তিনি এমন রেকর্ড গড়ে গেছেন যা আজকের আধুনিক ট্যাংকের যুগেও কেউ ভাঙতে পারবে কি না সন্দেহ আছে! তিনি তার ৩ বছরের সার্ভিস লাইফে ১৬৮টি ট্যাংক ও আর্মার্ড ভেহিকেল ধ্বংস করেছেন! আর্মার্ড ভেহিকেল বলতে সৈন্য পরিবহনের কাজে নিযুক্ত শক্তিশালী যানবাহনকে বোঝানো হয়। এগুলো মেশিনগানের গুলিও ঠেকিয়ে দিতে পারে। ১৬৮টি হচ্ছে তার কনফার্ম কিল (Confirm kill) রেকর্ড এবং তিনি ১৯৮টি আনকনফার্মড কিল (Unconfirmed kill)-ও করেছেন।
এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দীর্ঘতম দূরত্বে থেকে ট্যাংক ধ্বংসের রেকর্ডও তার দখলে। প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর থেকে একটি সোভিয়েত টি-৩৪ ট্যাংককে তিনি তার টাইগার ট্যাংক দিয়ে ধ্বংস করেন। এন্টি ট্যাংক মিসাইল ব্যতীত বর্তমানের অত্যাধুনিক গানসাইটের যুগেও ৩ কিলোমিটার দূরে ট্যাংক ধ্বংস যেখানে কষ্টসাধ্য, তিনি সেখানে মান্ধাতার আমলের 2.5x জুম ক্ষমতাসম্পন্ন গানসাইট দিয়ে তা করে দেখিয়েছেন! তিনি ব্যাটল অফ কুরস্কে একদিনে ২৭টি সোভিয়েত টি-৩৪ ট্যাংক ও ১২দিন পর আরও ৪২টি ট্যাংক তার বিধ্বংসী টাইগার ট্যাংক দিয়ে ধ্বংস করেছিলেন।
কার্ট নিস্পেল মাত্র ২০ বছর বয়সে সৈনিক হিসেবে আর্মিতে যোগ দেন। তিনি জার্মান ট্যাংকে লোডার, গানার, ড্রাইভার হিসেবে কাজ করে ধাপে ধাপে উন্নতি করে কমান্ডার হন। এসময় তিনি জার্মান আর্মির সকল ধরনের ট্যাংকে কাজ করেছেন।
শুধুমাত্র কমিশনড অফিসার (লেফটেন্যান্ট বা তার উপরের র্যাংক) না হওয়ার কারণে এবং এক সিনিয়র অফিসার কর্তৃক সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারামারি করায় তিনি জার্মান আর্মির সর্বোচ্চ এনিমি কিলিং রেকর্ড মেডেল ‘নাইট ক্রস’ বাদে বাকি সব পুরস্কারই পেয়েছেন। ঐ ঘটনার কারণে তার প্রমোশন বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া সামরিক সদস্য হয়েও গায়ে উল্কি আঁকা ও চুল বড় রাখাও একটি বড় কারণ। যদিও পরবর্তীতে তাকে নাইট ক্রস পদক দেয়ার জন্য ডাকা হয়, তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ট্যাংক নিয়ে তার এই কৃতিত্বের কারণে তাকে ওসব ঘটনার জন্য তেমন শাস্তি দেয়া হয়নি। তিনিই একমাত্র নন-কমিশন্ড অফিসার যাকে জার্মান গোল্ডেন ক্রস মেডেল দেয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল এক যুদ্ধে তিনি মারা যান। পরে উল্কি দেখেই তার লাশ শনাক্ত করা হয়।
অভাগা কমান্ডার
মার্টিন স্ক্রইফকে অভাগা বলা যেতেই পারে। কেন? কারণ বিভিন্ন সূত্রানুযায়ী তার কিল রেকর্ড ১৬১টি এবং এর বেশিরভাগেরই প্রমাণ নেই! শুধুমাত্র সহযোদ্ধাদের মুখে শোনা কথা ও তার নিজের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে তাকে সর্বকালের সেরা ট্যাংক এইস (Tank ace)-এর তালিকায় স্থান দেয়া হয়। তবে এটা সত্য যে, জার্মান প্রোপাগান্ডা শিবির মাইকেল উইটম্যানকে নিয়ে যতটা মাতামাতি করেছে, তার সামান্যতম মার্টিনের জন্য করা হয়নি। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তোলা তার তেমন কোনো ছবিও নেই।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা
জার্মানির অটো ক্যারিয়াস নামের এক দুর্ধর্ষ ট্যাংক কমান্ডার মিত্রবাহিনীর নিম্ন উচ্চতা দিয়ে উড্ডয়নরত যুদ্ধবিমান ধ্বংসসহ দেড় শতাধিক ট্যাংক কিল রেকর্ডের মালিক! তবে বিমান ভূপাতিত করার কৃতিত্ব তিনি নিজেই তার ট্যাংক গানারকে দিয়েছেন। সাধারণত একটি ট্যাংকের যাবতীয় সাফল্য-ব্যর্থতা কমান্ডারের নামেই লেখা হয়, যেমনটা বাউন্ডারিতে ফিল্ডার দুর্দান্ত ক্যাচ ধরলেও উইকেট লেখা হয় বোলারের নামে।
অটো ক্যারিয়াসের জীবন ক্যাপ্টেন আমেরিকা মুভির স্টিভ রজার্সের মতো। তিনি দু-দুবার আর্মিতে পরীক্ষা নিয়ে ওজন কম থাকায় বাদ পড়েন। তৃতীয়বারে টিকে গিয়ে পদাতিক বাহিনীর জন্য মনোনীত হন। তাকে ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে পাঠানো হয়। ট্যাংক ধ্বংসের এই দুর্দান্ত রেকর্ড কখনও হয়তো তার হতো না যদি তিনি সেদিন মৃত্যুবরণ করতেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কোনো এক যুদ্ধে তিনি হাতে-পায়ে সব মিলিয়ে ৪টি বুলেটের আঘাত খেয়ে গুরুতর আহত হন। এক রাশিয়ান অফিসার তাকে জার্মান আর্মির একজন অফিসার হিসেবে শনাক্ত করে তাকে গ্রেফতার করতে চান যেন পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়। কিন্তু গুরুতর আহত থাকায় বাড়তি বোঝা বহনের চেয়ে তার ঘাড়ে আরেকটি গুলি করেন তাকে মেরে ফেলার জন্য। কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে যান!
পরে জার্মান সৈনিকরা তাকে প্রায় আধমরা অবস্থায় উদ্ধার করে দ্রুত নিজেদের ফিল্ড হসপিটালে পাঠায় এবং অপারেশনের পর তিনি বিস্ময়করভাবে বেঁচে যান। পরবর্তীতে আবারও সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পদাতিক বাহিনী নয়, বাবার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এবার তিনি ৫১২ হেভি প্যানজার ডিভিশনে স্বেচ্ছায় যোগ দেন।
১৯৪৩ সালে ইস্টার্ন ফ্রন্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে এক যুদ্ধে ক্যারিয়াসের প্লাটুন সোভিয়েত ট্যাংক ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসময় তিনি বিখ্যাত টাইগার ট্যাংকের কমান্ডার ছিলেন। যখন ৪ কিলোমিটার দূর থেকে একটি সোভিয়েত ট্যাংকে তিনি আঘাত হানেন, তখন তারা একেবারে চমকে যায়। দূরত্বের কারণে শেলের গতি কমে যাওয়ায় ট্যাংকটি পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও কিছুটা ক্ষতি হয়। এসময় সোভিয়েতরা আর ট্যাংক না পাঠিয়ে বিমান হামলা শুরু করে।
বিখ্যাত IL-2 সোভিয়েত গ্রাউন্ড অ্যাটাক বিমানগুলো মুহুর্মুহু বোমা ফেলছিল আর গুলি করছিল। ক্যারিয়াস তার ট্যাংক নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়েও বিমান হামলা থেকে বাঁচতে পারছিলেন না। এসময় ট্যাংকের উদ্দেশ্যে মেশিনগান দিয়ে গুলি করছিল বিমানটি। বিমানের গুলি টাইগার ট্যাংকের আর্মারের তেমন ক্ষতি করতে না পারলেও গানার খুবই রেগে যান এবং বিমানটিকে শুট করার অনুমতি চান। ক্যারিয়াস অনুমতি দিতেই তিনি ফায়ার করেন। প্রথমবার মিস করলেও দ্বিতীয়বার খুবই নিচু হয়ে ওড়া বিমানটির ডানায় আঘাত হানতে সমর্থ হন গানার!
IL-2 ভূপাতিত হতেই অন্য বিমানগুলো রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায় এবং টাইগার ট্যাংকের বিধ্বংসী ক্ষমতা আবারও প্রকাশ পায়। ১৯৪৫ সালের ৭ মে তিনি ইউএস আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ২১ মে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। যুদ্ধের পর তিনি ফার্মেসি নিয়ে পড়ালেখা করেন এবং ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করেন। টাইগার ট্যাংকের স্মরণে তিনি তার দোকানের নাম দেন ‘Tiger Apotheke’ । তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘Tigers in the Mud’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ক্যারিয়াস মারা যান।
কিলার টাইগার
একটু আগেই বলা হয়েছে যে, সার্জেন্ট কার্ট নিস্পেল যে সর্বকালের সেরা ট্যাংক কমান্ডার সেটি সর্বজনস্বীকৃত। তবে তিনি ১৬৮টি ট্যাংক ধ্বংস করার রেকর্ড গড়ার সময় প্রায় সব ধরনের জার্মান ট্যাংক চালিয়েছেন। কিন্তু এককভাবে একটি মডেলের ট্যাংক দিয়ে শত্রুর উপর তান্ডব চালানোর রেকর্ডটি আরেক দুর্ধর্ষ জার্মান ট্যাংক কমান্ডার মাইকেল উইটম্যানের। এজন্য তাকে সর্বকালের সেরা টাইগার ট্যাংক কমান্ডারও বলা হয়।
উইটম্যান টাইগার ট্যাংক নিয়েই ১৩৮টি ট্যাংক কনফার্ম কিল করেছেন। এছাড়াও ১৩২টি এন্টি ট্যাংক কামান ধ্বংস করেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ব্যাটল অব কুরস্কে তিনি একদিনে ৯টি সোভিয়েত টি-৩৪ ট্যাংকসহ ৫ দিনে ৩০টি ট্যাংক ধ্বংস করেন। ১৯৪৪ সালের জুন মাসে ব্যাটল অফ ভিলার-বোকেশে উইটম্যান মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ১৪টি ট্যাংক, ২টি এন্টি ট্যাংক কামান ও ১৫টি অন্যান্য যান ধ্বংস করেন। জার্মান প্রোপাগান্ডা শিবির তার এই সাফল্যকে ফলাও করে প্রচার করে।
যুদ্ধে মাইকেল উইটম্যান ছিলেন প্রায় অজেয়। তার প্লাটুনকে ধ্বংস করতে তিনগুণ ট্যাংক পাঠানোর পরও দেখা গেলো তিনি বহাল তবিয়তে যুদ্ধক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ মিত্রবাহিনীর সব ট্যাংক ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ব্রাড পিটের Fury মুভিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নির্ভর হলেও এটি ইতিহাস নির্ভর নয়। কিন্তু মাইকেল উইটম্যানের মৃত্যুর সাথে এটির কাহিনীর সামান্য মিল পাওয়া যায়। আগেই বলে রাখি, উইটম্যানের মৃত্যুর ঘটনাটি বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ। পোল্যান্ড, কানাডা, ব্রিটেনের ট্যাংক ডিভিশন, এমনকি ব্রিটিশ বিমানবাহিনীও উইটম্যানের মৃত্যুর ক্রেডিট দাবি করেছে! এখানে কেবল বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ কর্তৃক স্বীকৃত ঘটনাটি তুলে ধরা হবে।
১৯৪৪ সালের ৮ আগস্ট এক যুদ্ধে ৫টি কানাডিয়ান এম-৪ শেরম্যান ট্যাংক মিলে তার টাইগার ট্যাংকে কৌশলে ধাওয়া করে একটি বাড়ির কোণায় বেকায়দায় আটকে ফেলতে সক্ষম হয়। এরপর তারা মাইকেলকে পালানোর সুযোগ না দিয়ে ৫টি শেরম্যান ট্যাংক মিলে একযোগে ফায়ারিং করে ধ্বংস করে দেয়। টাইগার ট্যাংকের আর্মার শেরম্যান ট্যাংকের কয়েকটি আঘাত সহ্য করতে পারে সেটি সত্য। কিন্তু একসাথে ৫টি ট্যাংক ফায়ারিং শুরু করায় তিনি প্রতিরোধ করার সুযোগই পাননি। মাইকেল উইটম্যান তার কিলিং রেকর্ডের জন্য Knight’s Cross with Oak Leaves and Swords মেডেল পান।
টুরিস্ট ট্যাংক কমান্ডার
১২৩টি কিল রেকর্ডের মালিক হ্যান্স স্যান্ডরককে টুরিস্ট বলা হলো কেন? কারণ জার্মানির শীর্ষস্থানীয় প্যাঞ্জার এইসদের মাঝে তিনিই ইউরোপ-আফ্রিকার একাধিক ফ্রন্টে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধ করেছেন।
১৯৩৯ সালে তাকে প্রথমে পোল্যান্ডে পাঠানো হয়। ১৯৪০ সালে ব্যাটল অব ফ্রান্সের সময় তিনি বেলজিয়াম জয় করে ফ্রান্সে ঢুকে মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের ডানকার্ক পর্যন্ত ধাওয়া করেন। এসময় ডানকার্ক উপকূলে ৪ লাখ মিত্রবাহিনীর সৈনিক আটকে পড়ে। ১৯৪১ সালে তাকে ফিল্ড মার্শাল রোমেলের আফ্রিকা কর্পসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আফ্রিকা মিশনে তিনি ১৯৪২ সালে লিবিয়ায় ব্যাটল অফ গাঞ্জালা, ব্যাটল অফ এল আলামিনের বিখ্যাত ট্যাংক যুদ্ধে অংশ নেন। এসময় তিনি আহত হয়ে জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য ফিরে আসেন।
১৯৪৩ সালে সুস্থ হয়ে আবার ইতালিতে মিশনে যান। এসময় তাকে Sturmgeschütz ডিভিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি ছিল মডিফাইড প্যাঞ্জার ৩ সিরিজের ট্যাংক। সোভিয়েত ট্যাংক বহরকে ঠেকাতে তাকে আবারও পোল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখান থেকে হারতে হারতে জার্মান বাহিনীর সাথে তিনি পূর্ব প্রুশিয়া (বর্তমান লিথুনিয়া)-তে প্যাঞ্জার ডিভিশনের সাথে অবস্থান নেন। এসময় তিনি তার ১২৩ তম ট্যাংক কিলিং সম্পন্ন করেন এবং রাজধানী রক্ষা করার নির্দেশ পেয়ে জার্মানিতে ফিরে আসেন। পরে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন এবং সেখান থেকে পালাতেও সক্ষম হন। কিন্তু ইউরোপ জুড়ে তখন মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা চলছে, জার্মানিও দুদিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর হামলার শিকার। তাই তিনি মার্কিন বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তবে এবারও তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং সুইজারল্যান্ডে পরিবারের কাছে চলে যান।
পাইলট থেকে ট্যাংক কমান্ডার
পল এগারের জীবনের গল্প আসলে সিনেমার মতোই রোমাঞ্চকর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জার্মান বিমানবাহিনীতে পাইলট হিসেবে যোগ দেন। তাকে Messerschmitt Bf 109 বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তিনি ইউরোপের দুটি মেজর এয়ার ব্যাটল ‘ব্যাটল অফ ফ্রান্স’ এবং ‘ব্যাটল অব ব্রিটেন’ এর মতো ভয়ংকর সব বিমান হামলার অপারেশনে অংশ নেন। ১১২টি মিশনে মিত্রবাহিনীর উপর বোম্বিং করার সময় তার বিমান মোট ৩ বার শত্রুপক্ষের গুলিতে ভূপাতিত হয়। প্রতিবারই তিনি প্যারাসুট দিয়ে নেমে আসেন এবং নিকটস্থ জার্মান সেনাদের সহযোগিতায় আবারও নিজের বেজে ফিরে আসেন। শেষবার তিনি শুটডাউন হয়ে ইংলিশ চ্যানেলে পতিত হন এবং মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। এ কারণে আর তিনি বিমানবাহিনীতে ফিরতে পারেননি।
পরে নাৎসি পার্টির সামরিক শাখা ওয়াফেন-এসএস এ তিনি ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দেন এবং তাকে ১০২ হেভি প্যাঞ্জার ব্যাটালিয়নে টাইগার ট্যাংকের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
এগার ‘ব্যাটল অব কিয়েভ’-এ ২৮টি ট্যাংক, ১৪টি এন্টি ট্যাংক আর্টিলারি, ৮টি সাধারণ আর্টিলারি ও ৪০টি আর্মার্ড ভেহিকেল ধ্বংস করেন। খার্কভের তৃতীয় যুদ্ধে তার ও অপর একটি ট্যাংক বাদে তার ব্যাটালিয়নের সমস্ত ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় তিনি ৬৫ তম ট্যাংক কিলিং সম্পন্ন করেন। পল এগার সর্বমোট ১১৩টি ট্যাংক ধ্বংস কন এবং সবগুলোই টাইগার ট্যাংক দিয়ে! তিনি Knight’s Cross of the Iron Cross, German Cross in Gold, Iron Cross I Class, Front Flying Clasp of the Luftwaffe ইত্যাদি সম্মাননা অর্জন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ক্রীড়া সাংবাদিক হন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান।
এতক্ষণ যা বলা হলো সবই তো জার্মানদের বীরত্ব। তবে কি মিত্রবাহিনীর এরকম কোনো ট্যাংক কমান্ডার নেই? আছে তো! কিন্তু তাদের রেকর্ড জার্মানদের সাথে তুলনা করলে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক কমান্ডারদের ‘দরিদ্র’ মনে হবে। আসলে জার্মানি সেই শুরু থেকেই যুদ্ধে ছিল। তাছাড়া প্যাঞ্জার সিরিজের ট্যাংকগুলো ছিল জার্মান প্রযুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলোর একটি। এসব কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে ব্রিটেন-ফ্রান্স ও রাশিয়া বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। সময় গড়িয়ে যুদ্ধের হাওয়া আবার মিত্রবাহিনীর দিকে গড়ায়। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রবাহিনীতে যোগ দেয়ার তাদের শক্তি বাড়ে। এসব কারণে জার্মানদের রেকর্ডের ধারে-কাছেও মিত্রবাহিনীর ট্যাংক কমান্ডারদের পাওয়া যায় না। তবে তারাও জীবন বাজি রেখে জার্মান দানবদের মুখোমুখি হয়েছিল- একথা মাথায় রাখতে হবে।
হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন
মিত্রবাহিনীর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিমিত্রি লাভ্রিনেনকোর কিল রেকর্ড ৫২টি। ১৯৩৮ সালে সোভিয়েত আর্মিতে সিনিয়র লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেয়ার পর তাকে উলিয়েন্সক ট্যাংক একাডেমিতে পাঠানো হয়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পোল্যান্ড আক্রমনের সময় প্রথমবারের মতো টি-৩৪ ট্যাংক নিয়ে ময়দানে নামেন। অপারেশন বারবারোসা চলাকালে তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখান।
টি-৩৪ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার খাওয়া ট্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে বেশিরভাগ ট্যাংক ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞের মতে, টি-৩৪ এর গতি, আর্মার, ম্যানুভারিটি ও শক্তিশালী কামানের কারণে এটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সেরা অলরাউন্ডার ট্যাংক। দিমিত্রি তার সবগুলো ট্যাংক কিলিং টি-৩৪ দিয়ে সম্পন্ন করেন।
তার মৃত্যুর ঘটনাটি বেশ করুণ। মাত্রই ৫২ তম জার্মান ট্যাংক ধ্বংস করে একটি গ্রামকে শত্রুমুক্ত করেছেন। সংবাদটি যুদ্ধক্ষেত্রের একটু পেছনে থাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে লেফটেন্যান্ট কর্নেল চেরনোয়ারভকে দিতে নিজের ট্যাংক থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। এমন সময় জার্মানরা বৃষ্টির মতো আর্টিলারি ফায়ারিং শুরু করে। তখনই গোলার আঘাতে তার মৃত্যু হয়। মাত্র আড়াই মাসে ২৮টি মিশনে অংশ নিয়ে মিত্রবাহিনীর পক্ষে সর্বোচ্চ (৫২টি) ট্যাংক কিলিং রেকর্ড নিজের করে নেন দিমিত্রি। মৃত্যুর পর তাকে ‘অর্ডার অফ লেলিন’ ও ‘হিরো অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
Sydney Valpy Radley-Walters :
কানাডা তো বটেই, পশ্চিমা মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে সেরা ট্যাংক এস হচ্ছেন স্যার র্যাডলি ওয়াল্টার, যার কিল রেকর্ড ১৮টি। D-Day এর পরের দিন একটি যুদ্ধে জনৈক জার্মান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তার ট্যাংক বহরের ৯টি ট্যাংক হামলার প্রতিশোধ হিসেবে মিত্রবাহিনীকে এমন ফাঁদে ফেলেন যে, তাদের প্রায় দুই স্কোয়াড্রন ট্যাংক ধ্বংস হয়ে যায়। এসময় র্যাডলি ওয়াল্টার একটি প্যান্থার ট্যাংকে সামনে থেকেই আঘাত করে ঘায়েল করতে সক্ষম হন। আরেকটি ট্যাংকের চাকা অচল করে দেন। তার কাভারিং ফায়ারের মুখে পুরো সেকেন্ড স্কোয়াড্রন পিছিয়ে যায়। তাছাড়া ব্রিটিশ ট্যাংক নিয়ে গঠিত থার্ড স্কোয়াড্রনের সবাই বেঁচে যান। বিস্তারিত ঘটনা নরম্যান্ডির ট্যাংক-যুদ্ধ নিয়ে পরবর্তী আর্টিকেলে আসতে যাচ্ছে।
যুদ্ধ শেষে র্যাডলি ওয়াল্টার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। তাকে কানাডিয়ান আর্মার্ড ওয়ারফেয়ার স্কুলের কমান্ড্যান্ট করা হয়। রাশিয়া বাদে মিত্রবাহিনীর পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ট্যাংক কিলিং রেকর্ড তারই। তবে তিনি ১৯৪৪ সালের ৭ জুন প্রথমবারের মতো ট্যাংক যুদ্ধে নামেন। অর্থাৎ যুদ্ধের একদমই শেষদিকে তিনি অংশ নেন। তার মোট তিনটি শেরম্যান ট্যাংক জার্মান আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনি দুবার আহত হন। তাকে মিলিটারি ক্রস, ডিস্টিংগুইশ সার্ভিস অর্ডার, অর্ডার অব মিলিটারি মেরিট ইত্যাদি সম্মাননা দেয়া হয়।
অন্যান্য
ব্রিটিশদের ল্যান্স কর্পোরাল আলফি নিকলস ব্যাটল অফ এল আলামিনের যুদ্ধে ১ দিনে ৯টি ট্যাংক শিকার করে ফিল্ড মার্শাল মন্টেগোমারির প্রশংসা কুড়ান। তবে তার মোট ট্যাংক কিলিংটি বিভিন্ন শোনা গেলেও নানা দলিলপত্রে ১৩টির কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মার্কিন নাগরিক গ্রিন পুল ১২টি ট্যাংকসহ ২৫৮টি আর্মার্ড ভেহিকেল, সেলফ প্রপেল্ড গানসহ প্রায় ১,০০০ জার্মান সৈনিক হত্যা ও ২৫০ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সেরা ট্যাংক এইস অফ এইসেস হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। এ সময় তার তিনটি শেরম্যান ট্যাংক ধ্বংস হয়। ১৯৪৪ সালের জুন মাসে ফ্রান্সের নরম্যান্ডি যুদ্ধে প্রথম ট্যাংকটি জার্মান এন্টি ট্যাংক রকেটের হামলায় অচল হয়ে যায়। তার দ্বিতীয় ট্যাংক মার্কিন পি-৩৮ যুদ্ধবিমানের ভুল এক হামলায় ধ্বংস হয়।
দুবার বেঁচে গেলেও তার শেষরক্ষা হয়নি। জার্মান ট্যাংক বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা লাইন সিগফ্রিড লাইন অতিক্রম করার সময় একটি প্যাঞ্জার ফাইভ ট্যাংকের হামলার শিকার হন। প্রথমবার আঘাতের পর তারা ট্যাংক ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই দ্বিতীয়বার ফায়ার করে জার্মান ট্যাংক। ফলে গ্রিন পুল ও তার এক ক্রু বাদে বাকি সবাই নিহত হন। তার আঘাতপ্রাপ্ত পা হাঁটুর ৮ ইঞ্চি উপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। যুদ্ধ শেষে তাকে Distinguished Service Cross, Legion of Merit, Silver Star, Purple Heart ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
এছাড়া উত্তর আফ্রিকায় এল আলামিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ ৮ম আর্মার্ড ব্রিগেডকে একাই হামলা করে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করা ইতালির লুইজি আর্বিব প্যাসচুচ্চি, জাপানের অলিম্পিক খেলোয়াড় তাকেইচি নিশি,
রাতের বেলা আক্রমণ করে সোভিয়েতদের আর্টিলারি হামলার প্রস্তুতি নস্যাৎ করে দেয়া তামাদা ইয়োশিও প্রমুখও উল্লেখযোগ্য ট্যাংক কমান্ডার।