১৬ জুন, ১৯৭৬। দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো অঞ্চল। জায়গাটি তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশের (বর্তমানে গাউটাংয়ের) অন্তর্গত জোহানেসবার্গ শহরের খুব কাছেই অবস্থিত। তখন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের সাম্রাজ্যবাদী সরকার দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতায়। সোয়েটো অঞ্চলটিতে আফ্রিকান কালোদের আধিক্য থাকলেও তাদেরকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না। তাদের মাতৃভাষা ছিল জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে তারা শিক্ষা নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। স্কুল-কলেজগুলোতে তারা এ ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করত।
কিন্তু ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা এ ভাষায় কথা বলত না। তারা কথা বলত জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণে উদ্ভুত ইন্দো-ইউরোপীয় এক ভাষায়, যা আফ্রিকানস নামে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নামিবিয়া অঞ্চলের ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গরা এবং এসব অঞ্চলের বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচরাও এ ভাষায় কথা বলত। তাদের শিশুরা আফ্রিকানস ও ইংরেজি- এই দুই ভাষায় পড়াশোনা করত।
১৯৭৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আফ্রিকানস ভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৬ সালে সরকার সর্বস্তরে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের লক্ষ্যে স্কুলগুলোতে স্ট্যান্ডার্ড ফাইভ পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি এবং আফ্রিকানস ভাষাকে বাধ্যতামূলক ব্যবহারের জন্য এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্কুল কর্তৃপক্ষ গণিত ও সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা আফ্রিকানস ভাষায় এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয় যেমন: গার্হস্থ্য এবং কর্মমুখী শিক্ষা ইংরেজি ভাষায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের পেছনে যে এক গভীর ষড়যন্ত্র ছিল, তা বলাই বাহুল্য। সরকার ভেবেছিল, স্কুলগামী কালো আফ্রিকান ছাত্ররা ক্রমেই উদ্ধত হয়ে উঠেছে। তাদেরকে শৃঙ্খলাপরায়ণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আফ্রিকানস ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যাতে করে পড়াশোনায় তারা নিজেদেরকে আরো ব্যস্ত রাখতে পারে। যতই হোক, ভাষাটি তাদের মাতৃভাষা না। এ ভাষায় শিক্ষা নিলে তারা ইউরোপীয়দের সাথে কোনোমতেই পেরে উঠতে পারবে, না তা সরকারও জানত।
কালোরা এ ভাষায় শিক্ষা নিলেই যে তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, তা খুব কম লোকেই বিশ্বাস করত। বরং, তৎকালীন সরকারের এ মনোভাবের মধ্যে দিয়ে তাদের শোষণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় প্রকাশিত হতে থাকে। কারণ, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী কোনো দেশে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং শাসনকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সে অঞ্চলের ভাষার ওপরই প্রথম আঘাত হানত। শাসকের দল সর্বদা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি উপনিবেশগুলোতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট থাকত, যাতে তারা দীর্ঘস্থায়ীভাবে স্থানীয় সম্পদ ভোগ করতে পারে। মূলত এমন ভাবনা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার সে সময়ের সরকার অন্যায় কাজটি করতে উদ্যত হয়।
সরকার তার এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করে। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং শিশুদের পড়াশোনায় আর্থিক সহযোগিতা করছে। তাই স্কুলগামী শিশুদের শিক্ষার ভাষা কী হবে, তা নির্ধারণ করার কাজটি সরকার চাইলেই করতে পারে। বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয়। শ্বেতাঙ্গ শিশুরা যেখানে বিনামূল্যে স্কুলে পড়াশানা করতে পারত, সেখানে কালো আফ্রিকান শিশুদের পড়াশোনার জন্য তাদের পিতামাতাকে প্রত্যেক শিশুর জন্য বছরে প্রায় অর্ধেক বেতন পরিশোধ করতে হতো।
শুধু তা-ই নয়, স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, পড়াশোনার শিক্ষা উপকরণ যেমন- খাতা, কলম পেন্সিল ইত্যাদি কেনার জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করতে হতো। প্রতি বছর স্কুলের ভবন নির্মাণ খরচে আলাদা করে অনুদান দিতে হতো। তাই কালো শিশুদের পড়াশোনার জন্য তাদের অভিভাবকদেরকে বেশ মোটা অংকের অর্থই ব্যয় করতে হতো।
তখনকার ছাত্রসমাজ সরকারের এই অন্যায় সিদ্ধান্ত নীরবে মেনে নিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই কালোদের এক বিপুল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্কুলগামী সন্তানদের পিতামাতা, কালোদের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন সরকার এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের একক সিদ্ধান্তে খুবই অসন্তুষ্ট হন। এমনকি স্কুলগুলোতে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকাও আফ্রিকানস ভাষায় শিক্ষাদানে অপারগতা প্রকাশ করেন। ১৯৭৬ সালের ষান্মাসিক পরীক্ষায়, আফ্রিকান কালো ছাত্রছাত্রীদের আফ্রিকানস ভাষায় পরীক্ষার জন্য বাধ্য করা হলে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।
১৯৭৬ সালের ১৩ জুন ‘চেতনার জাগরণ’ নামে কালো ছাত্রদের একটি সংগঠন এক সভার আয়োজন করে। ওই সভায় ১৯ বছরের এক তুখোড় ছাত্র সেইতসি মাসিনিনি প্রস্তাব করেন, ১৬ জুন বুধবার আফ্রিকানস ভাষা প্রবর্তনের প্রতিবাদে সব কালো ছাত্ররা জড়ো হবে এবং গণবিক্ষোভে অংশ নেবে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এই আন্দোলনের বিষয়ে তারা কেউই তাদের অভিভাবকদের জানাবে না। তাহলে সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।
ওই আন্দোলনের সাথে জড়িত এক ছাত্রনেতা সেদিনের সোয়েটোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পরবর্তীকালে এক সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান,
“আমাদের পিতামাতারা শ্বেতাঙ্গদের এই অন্যায় শাসন মেনে নিতেই প্রস্তুতই ছিলেন, যেভাবে বছরের পর বছর তারা এই শাসকদের অন্যায্য আইনগুলো মেনে নিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি এই আইনটিকেও দায়মুক্তি দেয়ার জন্য তারা একধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। কিন্তু আমরা ছাত্ররা তা মানতে কিছুতেই রাজি ছিলাম না। নিজ জন্মভূমিতে ক্রীতদাস বানানোর এই চেষ্টা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।”
১৬ জুন, দিনটি ছিল বুধবার। সোয়েটোর আকাশ সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন যেন আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস জানান দিচ্ছে। সেদিন বেশ শীতও পড়ছিল। ছাত্ররা এক এক করে সোয়েটোর স্কুলগুলোর সামনে জড়ো হতে লাগল। ব্যাগের মধ্যে নিজেদের দাবি সম্বলিত নানা প্ল্যাকার্ড, পোস্টার। ছাত্র নেতারা পরিকল্পনা করলেন, ভিলাকিজি স্ট্রিটে অবস্থিত অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুল থেকে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে অরল্যান্ডো স্টেডিয়ামে পৌঁছুবে।
প্রত্যক্ষদর্শীর দেয়া বয়ান থেকে জানা যায়, এই প্রতিবাদ মিছিলে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা পনের থেকে বিশ হাজার ছাত্রছাত্রী উপস্থিত ছিল। সরকারের উর্ধ্বতন মহল বিষয়টি জানতে পেরেই দ্রুত সেখানে বিশাল এক পুলিশ বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে তারা মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর পর মাইকে ছাত্রছাত্রীদেরকে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দিতে থাকে। কিন্তু, ছাত্রছাত্রীরা তাদের আন্দোলনে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দাবি আদায় না করে তারা কিছুতেই ফিরবে না।
ছাত্রদের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ ডগ স্কোয়াডে থাকা কুকুরদের লেলিয়ে দিতে থাকে। কুকুরের আক্রমণে অনেক ছাত্র আহত হয়। তাতেও ছাত্ররা পিছু না হটায় পুলিশ ছাত্রদের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। ছাত্ররা সেই টিয়ার গ্যাসের জ্বালা সহ্য করে এগিয়ে যেতে থাকে। ছাত্ররাও তাদের অবস্থান থেকে পুলিশদের বিরুদ্ধে জবাব দিতে শুরু করে। কেউ হাতে থাকা পানির বোতল, আবার কেউবা রাস্তা থেকে পাথর কুড়িয়ে তা পুলিশদের ওপর নিক্ষেপ করতে থাকে। চারপাশের পরিবেশ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পুলিশ এক পর্যায়ে কোনো রকম নির্দেশ ছাড়াই ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালাতে শুরু করে।
ছাত্রদের ওপর এমন বর্বরোচিত আক্রমণে সকলে হতভম্ব হয়ে পড়ে। কোমলমতি শিশুদের ওপর এমন আক্রমণ হতে পারে, তা কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু সরকার ও তার পুলিশ বাহিনী সেই নিষ্ঠুর কাজটি নির্দ্বিধায় ছাত্রদের উপর প্রয়োগ করল। সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রায় ২০ জন শিশু নির্মমভাবে শহীদ হয়। আহত হয় আরো ২০০ জন ।
শহীদদের এ তালিকায় ছিল বারো বছর বয়সী ছাত্র হেক্টর পিটারসেন। পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার একজন সহপাঠী মবুউইসা মাখুবো তাকে নিয়ে পাশের পিফেনি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। পিটারসনের বোনও সেসময় মিছিলে তার সাথে হাঁটছিল। কান্নারত অবস্থায় সেও তাদের সাথে ক্লিনিকে উপস্থিত হয়। বিশ্ব ফটোগ্রাফার স্যাম নাজিমা সেদিনের সেই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। মিছিলের শেষ মুহূর্তের দৃশ্যগুলো তার ক্যামেরার ল্যান্সে ধরা পড়ে। পরবর্তীকালে এই ছবিগুলো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।
পিটারসন হয়ে উঠে বিদ্রোহের প্রতীক। বিশ্ব দেখল বর্ণ বৈষ্যম্যের এক নির্মম চিত্র। সোয়েটো থেকে আন্দোলন দাবানলের মতো পার্শ্ববর্তী শহর প্রিটোরিয়া, ডারবান এবং কেপটাউনে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করা এশীয় বংশদ্ভূত ছাত্ররাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৭৬ সালের এই আন্দোলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪৫১ জন মারা যায় এবং ৩,৯০৭ জন আহত হয়। সোয়েটো হয়ে ওঠে বিদ্রোহ আর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ নতুন মাত্রা নেয়। বিদ্রোহের আঁচ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়। রক্তের বিনিময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয়লাভ করে। এ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত ঘটে।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা স্বাধীনতা লাভ করে এবং বর্ণ বৈষম্যের অবসান ঘটে। দক্ষিণ আফ্রিকার পরবর্তী সরকার এসব ছাত্রদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৬ জুনকে ‘জাতীয় যুব দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কালোরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন। কালোদের মালিকানাধীন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না, এমন নীতির পরিবর্তন আনা হলো। শহরে কালোদেরকে ডাক্তার, আইনজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবীদের কাজ করার অনুমতি দেয়া হলো। সোয়েটো বিদ্রোহের ৩০ বছর পর ২০০৬ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাবো মবেকি ১৬ জুন, ২০০৬ সালে হেক্টর পিটারসেন স্মারক ও স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এই জাদুঘরে সোয়েটো বিদ্রোহের ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
জাদুঘরের প্রবেশদ্বারে স্যাম নজিমার তোলা একটি ছবি স্থান পেয়েছে, যাতে লেখা রয়েছে,
“স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয়া সেই যুবকদের সম্মানার্থে। ”