২০ লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া প্রস্তরযুগের সমাপ্তি ঘটে ব্রোঞ্জ যুগের উত্থানের পর। বর্তমান যুগের উন্নত সভ্যতার মানুষের তুলনায় প্রস্তরযুগের মানবেরা আদিম গোছের হতে পারে, কিন্তু গুহাবাসীদের চেয়ে জীবন ব্যবস্থায় অনেক উন্নত ছিল। পৃথিবীতে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তারা সেগুলোর অধিকাংশই সমাধান করে ফেলেছিল। টিকে থাকতে পেরেছিল প্রতিকূল পরিবেশের কাঠিন্য ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেও। তাদের উদ্ভাবিত সেরকম কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে এই লেখায়, যা আমরা বর্তমানেও অনুসরণ করে আসছি।
মাংস সংরক্ষণের বিশেষ পদ্ধতি
১৯৯১ সালে ইউরোপের হিমবাহে ৫,৩০০ বছরের পুরনো এক মমির সন্ধান মেলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,২১০ মিটার উঁচুতে দুজন জার্মান হাইকার এটি আবিষ্কার করেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তখনকার লোকেরা মাংস বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা শিখে নিয়েছিল। খাদ্যবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘Cured Meat’ বলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় মাংসে লবণ মাখিয়ে সেটা শুকিয়ে আমসত্ত্বের মতো বানানো হতো, যাতে তা বহুদিন অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
মৃত্যুকালে সেই মানুষের বয়স ছিল ৪০-৫০ এর কাছাকাছি। বিজ্ঞানীদের মতে, ওটজাল আল্পসে ভ্রমণের সময় এক তীরের আঘাতে লোকটির মৃত্যু ঘটে। গবেষকরা তার পাকস্থলীর দিকে নজর দেয়ার পর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওঠেন। তার সর্বশেষ খাওয়া খাবার ছিল ছাগলের মাংস, আর তা ছিল বিশেষ প্রক্রিয়ায় (Curing) সংরক্ষণ করা মাংস। এটা রান্নার বদলে শুকানো হয়েছিল লবণ দিয়ে।
পুরাতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, পর্বত ভ্রমণে বের হবার পর তার কাছে শিকারের কোনো সরঞ্জাম ছিল না বলেই তিনি সাথে করে এই সংরক্ষিত মাংস বহন করছিলেন। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা মমিটির পেটে আলসার তৈরির ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন। মমি বিশেষজ্ঞ আলবার্ট জিংকের মতে, লবণে জারিত শুষ্ক মাংস বা বেকনের প্রচলন শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে থেকেই। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ টাইরেলে যা স্পেক নামে অধিক পরিচিত।
সংগীত আয়োজন
আজ থেকে ৪৩,০০০ বছর আগে মানুষ যখন ইউরোপে স্থায়ী বসতি গড়েছে, তখনই তারা বাঁশি বানানো ও বাজানোর কৌশল আয়ত্ত করে। তখনের বাঁশিগুলো বাঁশ দিয়ে নয়, তৈরি হতো পাখির হাড় ও ম্যামথের দাঁত দিয়ে। বাঁশি থেকে যে মসৃণ ও মোলায়েম সুর নিঃসৃত হতো, তেমনটাও নয়। তবে সেই বাঁশি বিবর্তিত হয়েই আজকের পূর্ণাঙ্গ বাঁশির আকার নিয়েছে। দক্ষিণ জার্মানির হোলে ফেলস (Hohle Fels) গুহা থেকে প্রস্তর যুগের একটি বাঁশির সন্ধান মিলেছে।
গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, বাঁশিটি প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগের। তৈরি করা হয়েছিল গ্রিফন শকুনের ফাঁপা ডানার হাড় থেকে। এতে রয়েছে পাঁচটি আঙুলের গর্ত এবং দুটি ভি-আকৃতির মুখের অংশ। আঠারো সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এই বাঁশিটির ব্যাস ছিল ৮ মিলিমিটার। ওই একই জায়গায় বিজ্ঞানীরা আরও দুটো ম্যামথের দাঁতের ছোট বাঁশি পেয়েছেন।
শকুনের ডানার হাড় থেকে তৈরি বাঁশিটি ছিল আদিম মানুষের এক চমৎকার উদ্ভাবন। কারণ ম্যামথের দাঁত থেকে বাঁশি তৈরি করার প্রক্রিয়া ছিল বেশ কঠিন। তবে একটু কঠিন হওয়ায় তখনকার সমাজে এর চাহিদাও ছিল বেশি। ২০১২ সালে জার্মানির এক গুহায় এমন আরও কিছু বাদ্যযন্ত্রের খোঁজ মিলেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো ব্যবহার করা হতো ধর্মীয় আচার পালন বা বিনোদন সামগ্রী হিসেবে মনের প্রশান্তি আনয়নে। বর্তমানে যার ব্যবহার হরহামেশাই হচ্ছে।
পরিষ্কার বাড়ি ঘর
১৯৬০ সালের দিকে তুরস্কে এক জনবসতির সন্ধান মিলেছিল, যেখান থেকে মানবজীবনের শুরুর দিকে নগরায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা গেছে। নয় হাজার বছর আগে নব্য প্রস্তর যুগের লোকেরা ইটের তৈরি ঘরে বসবাস শুরু করে। ইটগুলো বানানো হতো মূলত মাটি দিয়ে। তারপর সেগুলোকে একের উপর এক স্তরে স্তরে সাজিয়ে মাটি দিয়ে লেপে দেয়া হতো। সবগুলো ঘরই ছিল দেখতে একইরকম এবং আয়তাকার।
গঠনগত দিক দিয়ে বাড়ি-ঘরগুলো ছিমছাম হলেও আধুনিকায়ন স্পষ্ট ছাপ ছিল তাতে। ঘরের ছাদ বহু কাজে ব্যবহার হতো। মানুষজন সেখানে অনেকসময় আড্ডা দিয়েও সময় পার করত। আর ঘরের সমস্ত ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য সরু গলির প্রচলন ছিল। তারা পয়ঃনিষ্কাশনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছিল তখন থেকেই। তাই, বাড়িঘরগুলো বেশ সাফ-সুতরো থাকত সবসময়।
কর্মঠ নারীসমাজ
নারীরা নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করার মঞ্চ অলিম্পিক গেমসের বহু আগে থেকেই নিজেদের পরাক্রম প্রকাশ করে আসছে। প্রস্তর যুগের নারীরা বর্তমান নারী ক্রীড়াবিদদের মতোই ছিল বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী। ‘সায়েন্স অ্যাডভান্স’ এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আজ থেকে সাত হাজার বছর আগের মহিলাদের নৌকায় দাঁড় টানা মহিলাদের চেয়ে শক্তিশালী বাহু ছিল। কারণ, তারা একেবারে ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের সাথে জড়াত। এর মধ্যে মাটি চষা, ফসল গোলাজাত করা, শস্য চূর্ণ করা- সবকিছুই তখনকার মহিলা করত নিজ হাতে। ভারী পরিশ্রমের কাজগুলো তারা পুরুষদের জন্য ফেলে রাখত না।
তখনকার যুগের হাড় পরীক্ষার পর চমকে দেয়ার মতো কিছু তথ্য সামনে উঠে এসেছে। যখন মানব সমাজ শিকার বাদ দিয়ে এক জায়গায় স্থায়ী বসতি গেড়ে কৃষিকাজ শুরু করল, তখন থেকেই মানুষের পা থেকে হাত শক্তিশালী হয়ে উঠল বেশি। কারণ, তারা পশুর পেছনে দৌড়াদৌড়ি বাদ দিয়ে তখন ফসল উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছিল। তখন কৃষিকাজের বেশিরভাগই সামলাত নারীরা, তাই তারা শারীরিকভাবে ছিল বেশ শক্তিশালী।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তি
প্রস্তর যুগের মানুষের কোথাও বসবাসের প্রয়োজন হলে, তারা সাধারণত নতুন করে কোনো বাসস্থান তৈরি করত না। এমনকি থাকার জন্য কোনো খালি গুহাও খুঁজত না। এর পরিবর্তে, তারা তাদের স্থানীয় এলাকার খালি পড়ে থাকা ঘরগুলো সংস্কার করে ফেলত এবং সেটাকে বসবাস উপযোগী বানিয়ে সেটাতেই স্থায়ী আসন গেড়ে বসত। এনটিএনইউ-এর এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক সিলজে ফ্রেথাইম সায়েন্স নর্ডিককে জানান, প্রায় হাজার বছর পর্যন্ত ঘরগুলোতে মানুষ বসবাস করে গেছে। অর্থাৎ, পূর্বপুরুষেরা তাদের বানানো ঘরগুলো তুলে দিয়েছিল উত্তরসূরিদের হাতে। পরবর্তী প্রজন্ম শুধু সময়ে সময়ে ও ব্যবহারের প্রয়োজনে সেগুলো সংস্কার করেছে, যে বৈশিষ্ট্য এখনও মানবসমাজে বিদ্যমান।
তাঁবু খাটানোর চল
সাপ্তাহিক ছুটি কাটানো বা ভ্রমণের জন্য স্কটল্যান্ডের ক্যার্নগর্ম বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয় একটি স্থান। আট হাজার বছর আগের সময় আর বর্তমানের সাথে জায়গাটি একটি মেলবন্ধন জুড়ে রেখেছে। তখনকার মানুষজনও এখানে এসে তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের সাথে কিছু রাত্রিযাপন করে যেত। তারা ঠিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে রাত কাটাত, এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এটা শিকারের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। গবেষক গ্র্যাইমি ওয়ারেন ‘দ্য প্রেস অ্যান্ড জার্নাল’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “পূর্ব স্কটল্যান্ড থেকে পশ্চিম স্কটল্যান্ডে যাতায়াতের জন্য এই জায়গাটা ছিল প্রকৃতির নিজ হাতে নির্মিত একটি পথ। তাই কেউ ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময় এখানে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম নেবার পাশাপাশি শিকারের কাজটাও সেরে নিত।“
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো
১১,৭০০ বছর আগে জলবায়ু যখন নাটকীয় ভঙ্গিমায় পরিবর্তিত হয়েছিল, তখন আজকের উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডে বসবাসরত শিকারি-সংগ্রাহকরা ঠাণ্ডার সাথে লড়াই করার জন্য নিজেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল। গবেষকরা জানতে পেরেছেন, তাপমাত্রা কমে গেলেও তখনকার মানুষেরা অন্য কোথাও যাওয়ার পরিবর্তে তাদের জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন করেছে। সেজন্য তাদেরকে বাড়িঘর নির্মাণ শৈলীতে আনতে হয় ব্যাপক বিচিত্রতা, এবং পরিবর্তিত হয়ে যায় পরনের পোশাক-পরিচ্ছদও। কারণ, তারা তখন যাযাবরের মতো পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
রুটি তৈরির প্রচলন
আজ থেকে ১৪,৪০০ বছর আগের জলখাবারের ধারণা বর্তমানের সাথে মিল থাকতে পারে। উত্তর জর্ডানে পুরাতত্ত্ববিদেরা উনুনে প্রাচীন পাউরুটির সন্ধান পেয়েছেন। রুটি বানানোর প্রক্রিয়া এতটাও সোজা নয়। এজন্য শুধু মাখা ময়দার তাল বানালেই হয় না, শস্য উৎপন্ন করে তাকে ময়দায় রূপ দেয়াটাও কঠোর পরিশ্রমের কাজ। তাই কীভাবে তারা হাজার হাজার বছর আগেই কোনো প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া ময়দা দিয়ে রুটি বানিয়েছে, তা অবশ্যই এক বিস্ময়ের জন্ম দেয়। গবেষকদের ধারণা, রুটিগুলো তৈরি করা হতো কোনো ভোজনোৎসবের উদ্দেশ্যে। তারা রুটি বানানোর প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেছিল, কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির জোয়ার আসার পূর্বেই। তখন মানবসভ্যতা সবেমাত্র পশুপালনের পাশাপাশি শস্য উৎপাদন শুরু করেছে।
পোষা প্রাণী
হাজার হাজার বছর আগেই পোষা প্রাণীকে মানুষের সাথে কবরে সমাহিত করা হতো। গবেষণা অনুযায়ী, এশিয়া অঞ্চলের কুকুরগুলো এশিয়ার নেকড়েদের বংশধর। প্রায় বারো হাজার বছর আগে এই নেকড়েদেরকে পোষ মানানোর মাধ্যমে এশীয় কুকুরদের আগমন হয়। অন্যদিকে, ইউরোপের কুকুরদের আদি বংশধর হচ্ছে পুরাতন প্রস্তর যুগের ইউরোপিয়ান নেকড়ে, যাদের ১৫ হাজার বছর পূর্বে মানুষ বশ্যতা স্বীকার করানোর চেষ্টা করেছিল। সময়ের পরিক্রমায় ওই কুকুরগুলো আজকের ইউরোপিয়ান কুকুরে পরিণত হয়েছে। চীনে সর্বপ্রথম পোষা কুকুরের সন্ধান পাওয়া যায় ৭০০০-৫৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নব্য প্রস্তরযুগে হেনান প্রদেশে। ইউরোপে মধ্য প্রস্তরযুগের কিছু কবরস্থানে, যেমন- সুইডেনের স্টকহোমে কুকুরের সমাধির (খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫০-৩৭০০) সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ তখন থেকেই শিকারিদের সাথে কুকুরের বন্ধুত্ব রয়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকার উটাহ অঞ্চলের ডেঞ্জার গুহায় ১১ হাজার বছর আগের একটি সমাধিতে একটি কুকুরের দেহাবশেষ পাওয়া যায়।
কুকুর পালনের পাশাপাশি মানুষ কৃষিকাজের থিতু হবার দরুন গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস-মুরগিও পালন শুরু করেছিল, যে বৈশিষ্ট্য আমরা বর্তমানেও ধরে রেখেছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন এই আধুনিক জীবন যাপনের কার্যকলাপের সূচনা ঘটিয়েছিল, তখন ইতিহাস লিপিবদ্ধ হওয়া শুরু করেনি। এক্ষেত্রে তাদের কাছে আমরা চিরঋণী যে, তাদের দেখানো আলোর পথে হেঁটেই আমরা বর্তমান সভ্যতায় উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পেরেছি।