রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে চারদিকে। মাঝে মাঝে শুধু কিছু বাড়ি থেকে আসা আলো দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় নিস্তব্ধ, সুনসান। গাছের ডাল থেকে বরফ ঝরে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কখনো কখনো। তুষার বয়ে নেওয়া শীতের হাওয়ার শনশন শব্দ। এই শব্দ, এই আলো কে শুনবে বাড়িগুলোর পাহারাদারেরা ছাড়া? তাদের চোখেও রাজ্যের ক্লান্তি নেমে আসছে। কার থেকে বাড়ি পাহারা দিয়ে চলেছে তারা? শীতের হাওয়া বুঝি? নাহলে এই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে কোনো চোর-ডাকাতের শখ নেই লোকের বাড়িতে ঢোকার। কিন্তু কোনো কোনো শীতের রাত আর দশটা রাতের মতো হয় না। কোনো কোনো রাত ইতিহাসের পাতার জন্য তোলা থাকে। কোনো কোনো রাত জমে থাকা হিসাব মিটিয়ে নেয়।
এটাও তেমনই এক রাত। ঐ যে শোনা যায় ড্রামের আওয়াজ, দ্রিম-দ্রিম-দ্রিম। অন্ধকারে গুঁড়ি দিয়ে ৪৬ জন রোনিন পাঁচিল টপকালো।
৪৭ রোনিনের গল্প জাপানের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত গল্প, আর এটি একটি বাস্তব ঘটনা।
তোকুগাওয়া যুগে জাপানের শাসক ছিলেন শোগুন বা দেশের সর্বোচ্চ স্থানীয় সেনাকর্মকর্তারা। তারা সম্রাটের নামে দেশ পরিচালনা করতেন। তাদের অধীন ছিল অনেক আঞ্চলিক প্রভু, ‘দামিয়ো’। আঞ্চলিক প্রভুদের আওতায় ছিল সামুরাই যোদ্ধাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সবার জন্য ‘বুশিদো’ নীতিমালা অপরিহার্য ছিল। বুশিদো অনুযায়ী, একজন যোদ্ধা তার নেতার অনুগত থাকবে, আর মৃত্যুর ভয়ে ভীত হবে না কখনো।
১৭০১ সালে সম্রাট হিগাশিয়ামা কিয়োতো থেকে এদো বা টোকিয়োতে শোগুনের দরবারে তার বহর প্রেরণ করেন। কিরা ইয়োশিনাকা নামের একজন উচ্চপদস্থ শোগুন অফিসারের দায়িত্ব ছিল এই ভ্রমণ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবের প্রধান হিসেবে সবকিছুর দেখাশোনা করা। আসানো নাগানোরি আর কামেই সামা নামের দুজন তরুণ দামিয়ো তার অধীনস্থ হিসেবে উপস্থিত ছিল। তাদেরকে দরবারের আদব-কায়দা শেখানোর দায়িত্বও ছিল কিরার উপর। আসানো এবং কামেই ঐতিহ্য অনুযায়ী কিরাকে বিভিন্ন উপহার দিতে চাইলে কিরা তা অপমানের সাথে ফিরিয়ে দেয়। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে কিরা দুজন দামিয়োর সাথে যাচ্ছেতাই দুর্ব্যবহার শুরু করেন।
এত এত মানুষের সামনে বার বার বিনা কারণে অপমানিত হওয়ার পর কামেই চেয়েছিলেন কিরাকে খুনই করে ফেলতে, কিন্তু তখনো আসানো ধৈর্য ধরে ছিলেন।
নিজেদের নেতার মনোভাব বুঝতে পেরেছিল কামেইয়ের অনুসারীরা। তারা আগেভাগেই কিরাকে গোপনে প্রচুর অর্থ ঘুষ দিল। এরপর থেকে কিরা কামেইর সাথে আর কখনো অসদাচরণ করেননি। কিন্তু আসানোর পক্ষ থেকেও বোধহয় তিনি এমন কিছু আশা করতে শুরু করেন। যার ফলাফল দাঁড়ায় ভয়ানক। কামেই আর আসানো দুজনের নির্যাতনের বোঝা এবার আসানোর কাঁধে এসে বর্তায়। তাকে ধৈর্যের শেষ সীমানায় নিয়ে যান কিরা। তারপর একদিন দরবারের প্রধান হলে কিরা যখন আসানোকে ‘অসভ্য গেঁয়োভূত’ বলে আখ্যা দিচ্ছিলেন, আসানোর পক্ষে আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হয়নি। তরবারির খাপ এক টানে খুলে আক্রমণ করে বসে কিরাকে।
যদিও কিরার মাথা অল্প একটু কেটে যাওয়া ছাড়া কিছুই হয়নি, আসানো মস্ত বড় ভুল করে বসেছিল। এদো প্রাসাদে তরবারির খাপখোলা নীতি নীতিমালা বিরোধী কাজের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড ‘সেপ্পুকু’। এই মৃত্যুদণ্ডের বিশেষত্ব হলো- এটা একধরনের আত্মহত্যা। অপরাধী নিজের তরবারিতে নিজে জীবন দিয়ে সেপ্পুকু কার্যকরী করেন। ৩৪ বছর বয়সী আসানোর ভাগ্যেও নেমে এলো সেপ্পুকুর খড়গ।
আসানোর মৃত্যুর পর তার যত খাসজমি ছিল, সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে তার পুরো পরিবারকে সুনিশ্চিত দরিদ্র ও অসহায় ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। তার অধীনস্থ সামুরাইদের পদমর্যাদা সামুরাই থেকে ‘রোনিন’ করে দেওয়া হলো। সামুরাই যোদ্ধাদের কাছে মর্যাদার অবনমন এক অসহনীয় অপমান। তাদের কাছে নেতাহীন রোনিন হওয়ার চেয়ে নেতার সাথে সামুরাই হয়ে জীবন দেওয়া শ্রেয়।
কিন্তু আসানোর ৩২০ জন অনুসারীর ৪৭ জন ঠিক করলেন তারা বেঁচে থাকবেন। নেতার প্রতি হওয়া প্রহসন বিচারের প্রতিশোধ নিয়ে, ইতিহাসে আনুগত্যের এক অনন্য নিদর্শন সৃষ্টি করার জন্য হলেও তাদের বেঁচে থাকতে হবে।
ওইশি ইয়োশিওর নেতৃত্বে ৪৭ জন রোনিনের দলটি শপথ নিল, তারা যেভাবেই হোক কিরাকে হত্যা করবে। এরকম কিছুরই সন্দেহ করছিল কিরা নিজেও। তাই বাড়িতে অসংখ্য পাহারাদার নিযুক্ত রাখলো। কিরাকে চিন্তামুক্ত করতে রোনিনেরা ছড়িয়ে পড়লো দূর-দূরান্তে। তারা সময় কাটাচ্ছিল এই আশায় যে একসময় কিরা সব ভুলে পাহারা শিথিল করবে। রোনিনরা সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে লাগলো। বণিক থেকে দিনমজুর পর্যন্ত সবরকম পেশা অবলম্বন করল। তখন তাদের দেখলে কে বলবে, এই লোক জীবনে কখনো তরবারি ধরেছে! একজন তো কিরার বাড়ি প্রস্তুতকারী রাজমিস্ত্রির পরিবারে বিয়ে করে বসল শুধু কিরার বাড়ির নকশা উদ্ধার করতে।
ওইশি নিজেকে অধঃপাতে যাওয়া মানুষ বোঝাতে মাতাল হয়ে রাস্তায় ঘুরতো। একদিন মাতাল হয়ে যখন সে রাস্তায় পড়ে ছিলো, অন্য এক সামুরাই তাকে চিনতে পেরে জুতা দিয়ে ওইশির মুখে আঘাত করে দু-চারটা গাল দিয়ে গেল। ওইশি জানতো, তার জীবন সুখের হবে না। এমনকি তার দুর্ভাগ্যের বোঝা বহন করতে হবে তার পরিবারের সবাইকে, ঠিক আসানোর পরিবারের মতো। স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে সহ সন্তানদের বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ওইশির সবচেয়ে বড় ছেলেটা থেকে গেল বাবার সাথে।
১৭০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হঞ্জোতে ৪৭ রোনিন শেষবারের মতো একত্র হয়ে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে ফেলল। একজন তরুণ রোনিনকে তারা এলাকায় পাঠিয়ে দিল, যাতে তাদের গল্পগুলো সে সবার কাছে তুলে ধরতে পারে। প্রথমত ৪৬ জন রোনিন কিরার প্রতিবেশীদেরকে নিজেদের অভিসন্ধি জানিয়ে সাবধান করে দিল, তারপর দরকারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিরার বাড়ি ঘেরাও করলো।
নিঃশব্দে তাদের কেউ কেউ পাঁচিল টপকে পাহারাদারকে ধরাশায়ী করে ফেললো। ড্রামের সংকেতে তারা বাড়ির চারদিক থেকে আক্রমণ করলো। ঘুমন্ত কিরার সামুরাইরা কী হয়েছে, বুঝে উঠতে পারেনি তখনো। আওয়াজ শুনে খালি পায়েই তুষারের ভেতর বের হয়ে আসতে হয়েছে। ওদিকে কিরা প্রতিরোধের বদলে শুধু রাতের পোশাকে ভাঁড়ারঘরে লুকিয়ে পড়লো। এক ঘণ্টা ধরে রোনিনরা পুরো বাড়ি চষে ফেলে অবশেষে কিরাকে খুঁজে পেল, ভয়ে গুটিশুটি দিয়ে লুকিয়ে আছে ভাঁড়ারঘরের কয়লার স্তূপের মাঝে।
কপালের চিকন অথচ অমলিন দাগটা ঘোষণা করছে আসানোর প্রতি করা যত অপরাধ; বলছে, “সময় এসেছে, সময় এসেছে।” ওইশি কিরাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করলো। হাতে তুলে দিল ওয়াজিসাকি, সেই ছোট ছুরি, যেটি দিয়ে নিজের প্রাণ নিজেই বের করে এনেছিল আসানো নাগানোরি, এক হতভাগ্য দামিয়ো। সব রোনিন চাইছিল যেন কিরাও আসানোর মতো সেপ্পুকু করে। কিন্তু তাদের বুঝতে দেরি হলো না, কিরার পক্ষে সেপ্পুকু করা সম্ভব নয়, এত সাহস কিরার নেই। বরং সে তখন থরথর করে কাঁপছে ভয়ে, যেন মুখোমুখি হয়েছে শেষ বিচারের। ওইশির মনে তার কাপুরুষ কাঁপাকাঁপি এক ফোঁটাও দয়ার উদ্রেক করেনি। তরবারির একটা আঘাতেই কিরার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিল সে।
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই আকাশ যখন কেবল পরিষ্কার হতে শুরু করেছে, ৪৬ জন রোনিন শহরের মাঝ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো, লক্ষ্য সেনগাকুজি মন্দির। সেখানে শুয়ে আছে তাদের নেতা, তাদের গর্বিত নেতা আসানো। শহরময় তাদের প্রতিশোধের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল । মানুষজন আনন্দোল্লাস করতে করতে তাদের পেছনে আসছিল। ওইশি তার ছোরা ধুয়ে কিরার রক্ত অঞ্জলি দিল আসানোর সমাধিতে।
আকাশে তখন নতুন সূর্য সবে উঁকি দিচ্ছে। তারপর মন্দির প্রাঙ্গণে তারা বসে পড়ল। তাদের প্রতিশোধ নেওয়া শেষ। তবে তারা পালিয়ে যাবে না কাপুরুষের মতো, যা শাস্তি আসে মাথা পেতে নেবে। তারা বসে রইল, শান্ত, ধীর-স্থির ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পুকুরের পানির মতো। তারা অপেক্ষা করছিল কখন তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
বিচার চলাকালে রোনিনদের দামিয়ো পরিবার অনুযায়ী চারটা ভাগে ভাগ করা হয়েছিল- হোসোকাওয়া, মারি, মিদজুনো আর মাতসুদাইরা । ৪৭ রোনিন জাতীয় বীর হয়ে গিয়েছিল। চায়ের কাপ থেকে প্রধান দরবার সবখানের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল তারা। সাধারণ জনগণ আশা করছিল, বুশিদো নীতিমালার প্রতি তাদের নিষ্ঠা আর নেতার প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন দেখানোয় তাদের শাস্তি থেকে রেহাই দেওয়া হবে। সব দেখেশুনে স্বয়ং শোগুনের ইচ্ছাও ছিল না ৪৭ রোনিনের প্রতি কঠোর হবেন। কিন্তু কাউন্সিলররা বেঁকে বসলেন। আদেশ হলো সেপ্পুকুর। যে চারজন দামিয়োর উপর আদেশ ছিল বিচারের, তারাও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ১৭০৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, সেপ্পুকুর আদেশ কার্যকরী করার দিনটিতে দামিয়োরা সারাদিন অপেক্ষা করলেন, একেবারে সূর্য ডোবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত, যদি কর্তাদের মন পরিবর্তন হয়, যদি বাঁচানো যায় সেই ৪৬ জনকে! সেদিন সূর্য ডোবার সাথে সাথে ওইশির ১৬ বছরের ছেলেসহ ৪৬ জন রোনিনের সেপ্পুকু শেষ হলো।
রোনিনদের সবাইকে সমাহিত করা হলো সেঙ্গাকুজি মন্দিরে তাদের নেতার পাশেই। মন্দির প্রাঙ্গন ভ্রমণার্থী-দর্শনার্থীর তীর্থ বনে গেল রাতারাতি। প্রথম দর্শনার্থী ছিলেন সেই সামুরাই, যিনি মদ্যপ ওইশিকে রাস্তায় পেয়ে গালমন্দ করেছিলেন। অনুতাপে পরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ৪৭তম রোনিনের ভাগ্য অস্পষ্ট। কোনো কোনো সূত্রমতে, তিনি যেহেতু ঐদিন উপস্থিত ছিলেন না, আর বয়সে তরুণ ছিলেন, তাই তাকে শোগুন প্রাণভিক্ষা দেয়। তিনি আমৃত্যু তার রোনিন ভাইয়েদের গল্প শুনিয়ে গেছেন সবাইকে। মৃত্যুর পর তাকে বাকিদের পাশেই সমাহিত করা হয়েছিল। জনগণের বাড়তে থাকা ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে শোগুন সরকার আসানোর উপাধি ফেরত দেয়, আর তার এক-দশমাংশ জমি তার সন্তানের কাছে হস্তান্তর করে।
তোকুগাওয়া যুগে জাপান সুখে-শান্তিতেই ছিল। সামুরাই ছিল, কিন্তু করার মতো যুদ্ধ ছিল না। জাপানি নাগরিকেরা ভাবছিল, তাদের ঐতিহ্য-সভ্যতা সব মিলিয়ে যেতে বসেছে। এ সময় ৪৭ রোনিনের ঘটনা তাদের মনে আর জাতীয় জীবনে বিরাট দাগ রেখে যায়। তারা ৪৭ রোনিনের ঘটনা পুতুলনাচে, কাঠের ব্লকে, পাড়ার নাটকে ছড়িয়ে দিতে থাকে, যার বর্তমান রূপ ৪৭ রোনিনকে নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র।
সেনগাকুজি মন্দিরে গেলে এখনো দেখতে পাওয়া যাবে কিরার বন্ধুদের রশিদ, যখন তারা কবর দেওয়ার জন্য কিরার মাথা চাইতে এসেছিল, তখনকার। সাথে ৪৭ জন রোনিন আর তাদের নেতার সমাধি, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ সেখানে ভিড় করে সত্যিকারের মুগ্ধতা অথবা মুগ্ধতা তৈরির প্রচেষ্টায় স্মরণ করছে তাদের।
ফিচার ইমেজ- wikimedia Commons