আজকে আমরা এমন এক নারীর গল্প জানবো, যার ভূমিকা প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিনি খুব একটা আলোচিত নন। তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ অব্দে। তিনি ছিলেন রানী নেফারতিতি ও মিশরের ফেরাউন আখেনাতেনের কন্যা। তবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো, তিনি হলেন মিশরের বিখ্যাত ফেরাউন তুতেনখামেনের স্ত্রী। নাম তার আনখেসেনামুন। বিষাদময় এই নারীর জীবন ছিল অনেক ঘটনাবহুল। হতভাগ্য এই নারীকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল তার পিতামহ, পিতা ও সৎ ভাইয়ের সাথে।
আমাদের মধ্যে প্রায় সবাই মিশরের বালক রাজা তুতেনখামেনের নাম শুনেছি। কিন্তু তার বোন ও প্রিয় স্ত্রী আনখেসেনামুনকে আমরা অনেকেই চিনি না। প্রাচীন ইতিহাসের বহু নথি ও চিত্রকর্মে আনখেসেনামুনের বিষাদময় জীবনের উল্লেখ রয়েছে। তবে তা কেবলমাত্র তার পিতা আখেনাতেনের রাজত্বকাল থেকে তার ভাই ও স্বামী তুতেনখামেনের মৃত্যু পর্যন্তই। তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর থেকেই আনখেসেনামুনের কথা ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রহস্যময়ভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গিয়েছেন এই নারী। ফলে তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর এই রমণীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা জানা যায়নি আজও।
আনখেসেনামুনের আসল নাম ছিল আনখেসেনপাতেন। পরবর্তীতে তার নাম বদলিয়ে আনখেসেনামুন রাখা হয়। আনখেসেনামুন অর্থ ‘তার জীবন আমুনের’। তিনি ছিলেন প্রাচীন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশীয় একজন রানী। তিনি তার বাবার ৬ কন্যার মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তার বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তাকে তার সৎ ভাই তুতেনখামেনের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তুুুতেনখামেনের বয়স ছিল ৮-১০ বছর। তুতেনখামেনের সাথে বিয়ের আগে আনখেসেনামুনকে বিয়ে দেয়ে হয়েছিল তার বাবা আখেনাতেনের সাথে। এবং তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর ফেরাউন আইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়, সম্পর্কে যিনি ছিলেন আনখেসেনামুনের পিতামহ।
নিজেদের পরিবারের মধ্যে বিয়ে প্রাচীন মিশরীয় রাজপরিবারে ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। সেসময় মিশরীয় ফারাওরা নিজেদেরকে দেবতার বংশোদ্ভূত মনে করতেন। ফলে বংশের ধারা বিশুদ্ধ রাখার জন্য নিজের পরিবারের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল। রাজা তুতেনখামেনের বাবা-মাও সম্পর্কে ছিলেন ভাই বোন।
আনখেসেনামুনের যখন জন্ম হয় তখন মিশর এক ধর্মীয় বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় তার পিতা আখেনাতেন মিশরের প্রাচীন দেবতাদের ত্যাগ করে একক দেবতা ‘আতেন’ এর উপাসনা শুরু করেন। ফলে এতদিন ধরে পূজা করে আসা দেবতা ‘রা’ এর অনুসারীরা আখেনাতেনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং এক বড়সড় বিপ্লবের শুরু হয়।
আখেনাতেন মিশরে একেশ্বরবাদের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। আর তার এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মিশরের ধর্মযাজকরা। সেসময় মিশরে ধর্মযাজক ছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাবান। আখেনাতেন চেয়েছিলেন সন্তান জন্ম দিয়ে তিনি তাদের মাধ্যমে মিশরে এই একেশ্বরবাদের ধারা বজায় রাখবেন। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। আনখেসেনামুনকে বিয়ের আগে আখেনাতেন আনখেসেনামুনের দুই বড় বোনের সাথে সন্তান লাভের আশায় মিলিত হন। তবে এই দুজনের সন্তানই গর্ভাবস্থায় মারা যায়।
আনখেসেনামুনের তার বাবার সাথে বিয়ে হবার পর তিনি মিশরে তার বাবার বিতর্কিত অবস্থান লক্ষ্য করেন। তিনি বুঝতে পারেন, তার বাবা কীভাবে গোটা মিশরের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ওলটপালট করে ফেলেছেন। পরবর্তীতে আখেনাতেনের মৃত্যু হলে তার পুত্র তুতেনখামেন মিশরের নতুন রাজা হন। এ সময় বংশের ধারা বজায় রাখার জন্য আনখেসেনামুনকে বিয়ে দেয়া হয় তার ভাই তুতেনখামেনের সাথে।
তুতেনখামেন সেসময় মিশরের রাজা হলেও তার বয়স ছিল কম। ফলে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তাকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার সাহায্য নিতে হতো। আনখেসেনামুনও তার স্বামীকে রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন। তারা দুজনে মিলে তাদের বাবা মিশরের সমাজ ব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছিলেন তা ঠিক করার চেষ্টা করেন। তবে তুতেনখামেন খুব একটা আরামে রাজত্ব করতে পারেননি। তার একটি পা ছিল খোঁড়া। ফলে তাকে সবসময় একটি লাঠি নিয়ে হাঁটতে হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, তার বাবা-মায়ের অজাচারী সম্পর্কের ফলেই তিনি এই পঙ্গুত্ব লাভ করেন। তবে তুতেনখামেন ও আনসেখেনামুন দম্পতি হিসেবে ভালোই ছিলেন বলে জানা যায়। তারা দুবার সন্তান নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো দুবারই শিশু দুটি গর্ভপাতের ফলে মারা যায়। এর প্রমাণ মেলে তুতেনখামেনের সমাধিতে। মৃত শিশু দুটির মমি পাওয়া যায় সেখানে। গবেষকরা মমি দুটি পরীক্ষা করে দেখতে পান, প্রথম শিশুটি প্রায় পাঁচ মাস ও দ্বিতীয় শিশুটি আট থেকে নয় মাস গর্ভে ছিল। দুটি শিশুর শরীরেই জিনগত সমস্যার কারণে কিছু শারীরিক বিকলাঙ্গতা দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, এই জিনগত সমস্যার কারণ হলো অজাচার।
তুতেনখামেনের বয়স বিশের কাছাকাছি থাকা অবস্থান তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর আনখেসেনামুনকে বিয়ে দেয়া হয় তার পিতামহ আইয়ের সাথে। যদিও এই বিয়ে নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। সম্ভবত আনখেসেনামুন এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। প্রত্নতত্ত্ববিদরা আনখেসেনামুনের লেখা এমন একটি চিঠি খুঁজে পেয়েছেন যেটিতে আনখেসেনামুন হিট্টি রাজা প্রথম সাপ্পিলুলিমাসের কাছে তার একটি পুত্রকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আনখেসেনামুন চেয়েছিলেন যোগ্য ও রাজবংশীয় কেউ যেন মিশরের রাজা হয়। সেদিক দিয়ে হিট্টিরা সেসময় ছিল অনেক শক্তিশালী।
হিট্টি রাজা প্রথম সাপ্পিলুলিমাস তার পুত্র জান্নানজাকে আনখেসেনামুনের কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু মিশরে প্রবেশ করার সময় মিশর সীমান্তে জান্নানজাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পেছনে ছিল হোরেমহেব নামের এক নিষ্ঠুর সেনাপ্রধান, যিনি পরবর্তীতে মিশরের রাজা হন। আর এই হত্যাকান্ডের ঘটনার মধ্য দিয়েই শেষ হয় ইতিহাসে আনখেসেনামুনের অধ্যায়। এর পরে আনখেনামুনের কী হয়েছিল তার উল্লেখ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে গবেষকরা একটি আংটি খুঁজে পেয়েছেন যাতে আনখেসেনামুন ও তার পিতামহ আইয়ের নাম খোদাই করা রয়েছে। এই আংটির মাধ্যমেই বোঝা যায়, হয়তো শেষমেষ আনখেসেনামুন তার পিতামহ আইকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আদৌ সেই বিয়ে হয়েছিল কি না তার জোরালো কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারো কারো মতে, আনখেসেনামুনকে হয়তো পরবর্তীতে হিট্টি রাজার সাথে যোগাযোগের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তবে তুতেনখামেন ও আইয়ের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও আনখেসেনামুনের মৃতদেহ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে জানুয়ারি মাসে আনখেসেনামুনের সমাধি খুঁজে বের করার জন্য একটি অভিযান চালানো হয়। এ সময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরের ‘ভ্যালি অফ দি মাংকিজ’ নামক স্থানে খনন চালান। এখানেই এর আগে ফেরাউন আইয়ের সমাধি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আইয়ের সাথে যদি আনখেসেনামুনের বিয়ে হয়ে থাকে তবে নিয়ম অনুসারে এখানেই তার সমাধি থাকার কথা। এই স্থানটি মিশরের ‘ভ্যালি অফ দি কিংস’ নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধি স্থানের খুব কাছেই অবস্থিত। ‘ভ্যালি অফ দি কিংস’ নামক স্থানটিতে এর আগে তুতেনখামেন সহ মিশরের নানা গুরুত্বপূর্ণ ফেরাউনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়।
সর্বশেষ এই অভিযানে গবেষকরা অনেকগুলো অনাবিষ্কৃত রাজসমাধির খোঁজ পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো এরই কোনো একটিতে চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন মিশরের ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময়ী রানী আনখেসেনামুন। এই সমাধিটি খুঁজে পাওয়া গেলেই হয়তো জানা যাবে কী ঘটেছিল আনখেসেনামুনের ভাগ্যে। ভেদ হবে তুতেনখামেনের প্রেয়সী আনখেসেনামুনের অন্তর্ধান রহস্য।
ফিচার ইমেজ – Wikimedia Commons