Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিলেটি নাগরী লিপি: বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যসম্পদ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। নানা বৈচিত্র্যও আছে এর। চর্যাপদকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যকার কোনো এক সময়ে এটি রচিত হয়েছিল। সে হিসেবে এই সময়ের মধ্যকার কোনো এক সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। যদিও এ নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।

অনেকের কাছেই হয়ত অজানা, বাংলা ভাষার একাধিক বর্ণমালা বা লিপি ছিল। দুটি বর্ণমালার একটি প্রমিত বাংলা বর্ণমালা, অপরটি সিলেটি নাগরী লিপি। সিলেটি নাগরী লিপিতে রচিত হয়েছে শত শত সাহিত্য, গ্রন্থ, দলিল, চিঠিপত্র। এ লিপিতে পরিচালিত হয়েছে মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কার্যক্রম। কয়েক শতাব্দী জুড়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিলেটি নাগরী লিপির সাহিত্য। সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, ভৈরব, করিমগঞ্জ ও শিলচরে এর ব্যবহার ছিল। তখন এটি ব্যবহৃত হত বাংলালিপির বিকল্প হিসেবে।

নাগরী লিপির নমুনা; Image Source: sylheti.org.uk

সিলেটের মুসলমানরা আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরী লিপির সমন্বয়ে বিশেষ ধরনের একটি ভাষা লিপির প্রচলন করেছিলেন। এটি নাগরী লিপি হিসেবে পরিচিত ছিল। তৎকালীন শ্রীহট্টের মুসলমান সাহিত্যিকরা হিন্দি প্রভাবিত বাংলার পরিবর্তে নাগরী লিপিতে তাদের ধর্মীয় বই পুস্তক ও সাহিত্য চর্চা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ধারণা করা হয়, হজরত শাহজালাল (র.) এর সমসাময়িক মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা এই লিপির প্রসার ঘটিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন তার ‘শিলহটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন,

নাগরীকদের সুবিধার্থে এক সহজ সুন্দর মিশ্র ভাষার প্রচলন করা হইল। দেব নাগরী ও বাঙ্গালা অক্ষরের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া নাগরী অক্ষরের সৃষ্টি হইল। নাগরী অক্ষরগুলি শিখিয়া লইতে মেধাবী লোকদের পক্ষে একটি মাত্র দিনই যথেষ্ট। ফুলের মত সহজ সুন্দর ও আড়ম্বর বিহীন বলিয়া ঐ ভাষার নাম দেওয়া হইল ফুল নাগরী।

‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায় (কার্তিক ১৩৪৩) তিনি লিখেছেন,

আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেইকালে শ্রীহট্টের ভাষা ছিল সংস্কৃতবহুল বাঙ্গালা। বিদেশাগত মুসলমানগণ উত্তরকালে এদেশের ভাষাকে নিজ ভাষা রূপে গ্রহণ করিলেও প্রথমাবস্থায় তাঁহারা তাহা সাম্যক রূপে বুঝিয়া উঠিতেন না। অপরপক্ষে নবদীক্ষিত মুসলমান ও হিন্দু ভাতৃগণ, শাসক ও প্রতিবেশী বিদেশাগত উর্দ্দু, পার্শি মিশ্রিত ভাষা বুঝিতে সক্ষম হইতেন না। দেশের শাসন ও ধর্ম্মপ্রচার কার্য্য চালাইতে গিয়া হিন্দুদের সহিত কথা কহিতে মুসলমান শাসক ও ধর্ম্মপ্রচারক সম্প্রদায়ও বিশেষ অসুবিধা ভোগ করিতেন। আমাদের বিশ্বাস নানা ভাষার সংমিশ্রণে তখনকার শ্রীহট্টের ভাষা এক অপূর্ব আকার ধারণ করিয়াছিল। অতঃপর শাসকগণের গবেষণায় এতদ্দেশীয় হিন্দুগণের রাজকার্জ ও নবদীক্ষিত মুসলমানদের ধর্ম্মকার্য্য ও রাজকার্য্য পরিচালনের সুবিধার্থে সর্ব্বসাধারণের বোধগম্য করিয়া এক সহজ সরল (গ্রাম্য) ভাষার পরিচালনাহেতু বাঙ্গালা ও দেবনাগরী অক্ষরের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া ‘সিলেট নাগরী’ অক্ষরের সৃষ্টি হয়। সহজ ও সুন্দর বলিয়া জনসাধারণ ইহার অপর এক নাম দিয়াছিলেন সিলেটের ‘ফুল নাগরী’।

নাগরী লিপির নমুনা; Image Source: sylheti.org.uk

বেশ সহজ সরল লিপি হওয়ায় তৎকালীন সময়ে খুব সহজে এই লিপি মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা এই ভাষা শিখে নেন। যেমন- ১৯১৭ সালে প্রকাশিত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে অত্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি বলেছেন, “শ্রীহট্টের মুসলমানদের মধ্যে একরূপ নাগরাক্ষর প্রচলিত আছে। অনেক মুসলমানি কেতাব এই অক্ষরে মুদ্রিত হয়। এই ভাষা (বর্ণ) অতি সহজে শিক্ষা লাভ করা যায়।” গবেষক সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯০২-১৯৮১ খ্রি.) লিখেছেন, “সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে একপ্রকার নাগরী লিপির প্রচলন আছে। এই লিপি দেবনাগরী লিপি থেকে ভিন্ন এবং কেবলমাত্র সিলেট জেলার মুসলমানদের মধ্যে এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।” নাগরী লিপি মূলত মুসলমানি ভাষা লিপি ছিল। সাধারণত হিন্দু অধিবাসীগণ এই বাংলা লিপির সাথে পরিচিত ছিল না। এ বিষয়ে সোনাভানের পুথি গ্রন্থে বলা হয়েছে,

“এই লিপির ব্যবহার প্রধানত সিলেটের মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুরা এই লিপির সঙ্গে মোটেই পরিচিত নন। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চলে – সদর, করিমগঞ্জ ও মৌলভীবাজার মহাকুমায় এই লিপির প্রচলন বেশি ছিল। কাছাড় জেলায় ও ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহাকুমায়ও একসময়ে সিলেটি নাগরী পুথির প্রচলন ছিল।”

জানা যায়, এই লিপি চর্চায় পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি এগিয়ে ছিল। যারা সঠিকভাবে বাংলা ভাষা জানত না তাদের মধ্যেও অনেকে নাগরী লিপিতে স্বাক্ষর করতে পারত। কোনো কোনো প্রাচীন দলিলে নাগরী লিপিতে নাম দস্তখত পাওয়া যায়। সোনাভানের পুথি গ্রন্থে বলা হয়েছে,

কম পরিশ্রম ও কম সময়ে শেখা যায় বলে স্ত্রীলোকের মাঝেও এর বহুল প্রচার ছিল। সাধারণ্যে প্রবাদ ছিল যে, ‘নাগরী লিপি আড়াই দিনেই শেখা যায়’। নাগরী লিপি সংযুক্ত বর্ণ ও অনেক জটিল অক্ষর থেকে মুক্ত। এই কারণে সিলেটি নাগরী লিপি অতি সহজেই শেখা যায়।

নাগরী লিপির একটি নমুনা; Image Source: sylheti.org.uk

নাগরী লিপির উৎপত্তিকাল, এর বিকাশ এবং কীভাবে এই লিপির প্রচলন শুরু হয় এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ড. আহমদ হাসান দানীর অভিমত,

কার্যকারণের সাধারণ যুক্তিতে তাহলে শ্রীহট্ট নাগরীর উৎপত্তিকে আমরা খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগানদের উপনিবেশ স্থাপনের এবং মুদ্রায় এ লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের সহজ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করে নিয়ে দেখতে পারি। অন্যকোনো সময়ে পূর্ববঙ্গে এ লিপির ব্যবহার হয়েছে বলে জানা যায় না, বা অন্য কোনো পথে বা উপায়ে শ্রীহট্টে এই লিপি এসে পৌছেছে এ খবরও আমরা জানিনে।

তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী লিখেছেন,

খ্রিস্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে সিলেটি নাগরীতে লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি না পাওয়ার দরুন কোনোক্রমেই বলা চলে না যে এর পূর্বে সিলেটি নাগরী প্রচলিত হয়নি। সিলেটের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। এই পাণ্ডুলিপিগুলির অধিকাংশই পীর দরবেশ ফকির প্রমুখের লেখা; অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এগুলি নিজেদের গৃহে, মসজিদে বা দরগাতে রেখেছেন এবং হস্তান্তর করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এগুলির উদ্ধার ও আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বের কোনো পাণ্ডুলিপির অস্তিত্ব নেই এ কথা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে সোনাভানের পুথি গ্রন্থে নাগরী লিপির উৎপত্তি নিয়ে বলা হয়েছে,

এ সকল কারণে আমাদের মনে হয় পলাশীর যুদ্ধের পর যখন এদেশ থেকে ফারসি ও উর্দূ ভাষার চর্চা উঠে গেল, তখন সাধারণ মুসলমানরা বাংলা সাহিত্যে নজর দিল। তারা দেখতে পেল বাংলা লিপি- বিশেষত সংযুক্ত বর্ণ অত্যন্ত জটিল। আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রভাবে বাংলা গদ্য তখন জাত বদল করছে। ভারতচন্দ্রের ভাষাকে তখন ‘যাবনী মিশাল’ বলা হচ্ছে। একে তো সিলেটের কথ্যভাষা নদীয়া শান্তিপুরের সাধুভাষা থেকে অনেক পৃথক, তদুপরি সংস্কৃত শব্দের বাহুল প্রয়োগ নিমিত্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের সাধুভাষা মুসলমানদের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য মনে হইলো। কাজেই বাধ্য হয়ে তারা নিজস্ব লিপি ও সাহিত্য সৃষ্টি করতে অগ্রসর হলেন।

নাগরী লিপির নমুনা; Image Source: sylheti.org.uk

এভাবে নাগরী লিপির উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। নাগরী লিপি ও সাহিত্য গবেষকেদের এসব মতামতকে আমরা মোটামুটি তিনটি পক্ষে বিন্যস্ত করে দেখতে পারি। প্রথম পক্ষ মনে করেন, নাগরী লিপির উদ্ভব হয়েছে চর্তুদশ শতকের গোড়াতেই। হজরত শাহজালাল এবং তিনশত ষাট আওলিয়ার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার লাভ করে। তাদের অনুসারীদের দ্বারা নাগরী লিপি সৃস্টি হয়। দ্বিতীয় পক্ষ মনে করেন, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এ অঞ্চলে আফগান উপনিবেশ স্থাপিত হয়। এ সময় তাদের হাত ধরে নাগরী লিপির উদ্ভব হয়। কেননা আফগান মুদ্রায় নাগরী লিপির অক্ষরের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তৃতীয় পক্ষ মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের সময়ে এ লিপির উৎপত্তি হয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ইংরেজ আমলে বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে এবং হিন্দুদের প্রভাব মুক্ত থাকার জন্য এই লিপির আশ্রয় গ্রহণ করে।

তবে হজরত শাহজালালের সময়ে এই লিপির উদ্ভাব হয়েছে বলেই অধিকাংশ ভাষাবিদ মতামত দিয়ে থাকেন, কেননা তার সময়েই অত্র অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মুসলমানি প্রভাব দেখা যায়। ফলে হজরত শাহজালাল ও তার অনুসারীদের মধ্যমেই এই ভাষার প্রচার-প্রসার হয়েছে বলে অনুমান করা যায়।

রাজকার্যের সাথে এই লিপি প্রচলনের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। নাগরী লিপিতে রচিত গ্রন্থের অনেকগুলো নামাজ, রোজা, হজ্জ, ইসলামি জীবনব্যবস্থা, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের উপরে রচিত। কিছু গ্রন্থ ইসলামি মারফত বিষয়ক। কিছু গ্রন্থের পুথিতে পীর ও আউলিয়াদের জীবনী লিখিত। আবার কিছু কিছু গ্রন্থের পুথিতে রয়েছে প্রেম-উপাখ্যান। এই সকল পুথি জনসাধারণের শোক ও দুঃখে সান্ত্বনার বাণী এবং বিশ্রামে আনন্দ প্রদান করত।

নাগরী লিপির নমুনা; Image Source: sylheti.org.uk

এ লিপিতে মোট বর্ণ সংখ্যা ছিল ৩৩টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৫টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি এবং ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন ১টি। স্বরবর্ণ ৫টি হচ্ছে- আ, ই, উ, এ, ও। ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি হচ্ছে- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, শ, হ, ড় এবং একমাত্র ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন হচ্ছে- ং।

এই ৩৩টি অক্ষরের মধ্যে বিভিন্ন ভাষা লিপির প্রভাব রয়েছে বলে ভাষা গবেষকগণ মত প্রকাশ করেছেন। যদিও এই বিন্যাসের মধ্যেও বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় তালিকাটি মোটামুটি নিম্নরূপ-

বাংলা বর্ণমালা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৮টি অক্ষর। যথা- ই, ঘ, জ, ঠ, ড, ঢ, দ এবং ড়।

সিলেটি নাগরীর নিজস্ব বর্ণ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৭টি অক্ষর। যথা- আ, ঝ, ধ, র, ল, হ, ং।

আরবির অক্ষরের উচ্চারণের প্রভাব থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ৪টি অক্ষর। যথা- ক, খ, ফ, ও।

দেবনাগরী ও কাইথি বর্ণের সাদৃশ্য থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ১৪টি অক্ষর। যথা- উ, এ, গ, ঘ, চ, ট, ত, থ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম।

তবে এসব অক্ষর লেখার ভঙ্গি আমাদের বর্তমান বাংলা অক্ষর থেকে ভিন্নতর। নিচে একটি চিত্রের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হল।

সিলেটি নাগরী লিপির অক্ষর সম্বলিত ছক; Image Source: zobonika.blogspot.com

এই ঐতিহ্যবাহী নাগরী লিপি কেন হারিয়ে গেল তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। সম্ভবত উর্দু ভাষার প্রভাবে নাগরী লিপি তার আবেদন হারায়। পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদের লেখায়ও এমন একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি সিলেটি নগরী সম্বন্ধে ১৩১৫ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় লিখেছেন,

শাহজালালের সঙ্গে ৩৬০ জন আউলিয়া আইসেন। ইহাদের অধিকাংশ উত্তর পশ্চিম প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। তখনও বোধহয় আরবী অক্ষরে হিন্দীভাষা লিখিত হইয়া উর্দুভাষারই চর্চা করিয়া দেবনাগরাক্ষরে লেখাপড়া করিতেন। তাহাদের অনুকরণে শ্রীহট্টের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও নাগরাক্ষর প্রসার হইলো। কালক্রমে যদিও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমান সমাজ হিন্দি আরব্য অক্ষরে লিখিত হইয়া আরব্য পারস্য শব্দবহুল হইয়া উর্দুতে পরিণত হইলো এবং সেই উর্দু সমগ্র মুসলমানাধিকৃত ভারতবর্ষে প্রসারিত হইয়া শ্রীহট্টেও পৌছিল, তথাপি এই অঞ্চলের মুসলমানরা নাগরাক্ষর একেবারে পরিত্যাগ করিলো না। তবে এই নাগরাক্ষরের প্রসার অনেকটা খর্ব্ব হইলো। একদিকে স্থানীয় চলভাষা অন্যদিকে মুসলমানদের অালোচ্য আরব্য, পারস্য ও উর্দু ভাষা- এই উভয় সঙ্কটে পড়িয়া নাগরাক্ষরের হীনপ্রভ এবং শীর্ণ ও বিকৃত হইতে লাগিলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইহার অবস্থা এই দাঁড়াইয়াছিল যে, নিম্মস্তরের মুসলমানদের মধ্যে যাহারা বাংলা অক্ষর জানিত না তাহারা পরস্পরের মধ্যে চিঠিপত্রে মাত্র এই অক্ষরের ব্যবহার করিত।

নাগরীলিপিতে রচিত সাহিত্যের পুথি-পুস্তক বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে এই লিপির প্রচলন নেই। অল্প পরিসরে পাকিস্তান আমলেও এই লিপির চর্চা ছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিদের হাতে বিধ্বস্ত হয় সিলেটি নাগরীলিপির একমাত্র ছাপাখানাটি। এরপর থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্তির কবলে পড়ে শ্রীহট্টের এই ঐতিহ্যসম্পদ।

তথ্যসূত্র

  1. সম্পা. মো. আব্দুল মান্নান এবং মোস্তফা সেলিম, সোনাভানের পুথি, উৎস প্রকাশন, ২০১৪
  2. মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, শিলহটের ইতিহাস, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৬
  3. মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন, শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, কার্তিক ১৩৪৩
  4. অত্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি , শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তি, প্রথম খন্ড, কলকাতা ১৯১৭
  5. সৈয়দ মুর্তাজা আলী, সিলেটের নাগরী লিপি ও বাংলা সাহিত্য, প্রবন্ধ বিচিত্রা, বাংলা একাডেমী, জুলাই ১৯৬৭
  6. ড. আহমদ হাসান দানী, শ্রীহট্ট নগরীর উৎপত্তি ও বিকাশ, বাংলা একাডেমী পত্রিকা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৩৬৪
  7. শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী, সিলেটী নাগরী লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, বাংলা একাডেমী পত্রিকা, বৈশাখ-শ্রাবণ, ১৩৬৬
  8. পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩১৫

ফিচার ইমেজ- sylheti.org.uk

Related Articles