Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তানজিমাত: অটোমান সাম্রাজ্যে উনিশ শতকের সংস্কার পদক্ষেপ

উনিশ শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ছোঁয়ায় ইউরোপ বদলে যেতে শুরু করে। জ্ঞানের বিস্তারের সাথে সাথে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে তার অনিবার্য প্রভাব পড়তে শুরু করে। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিলো। পাশাপাশি মানুষের চেতনার জগতের খোলনলচে পাল্টে যেতে থাকে। সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে ইউরোপ ক্রমান্বয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠতে থাকে। ফলে বিভিন্ন স্থানে জাতীয়তাবাদী মনোভাব বেড়ে যেতে লাগলো।

অটোমান সাম্রাজ্য সেসময় এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিলো। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে জাতীয়তাবাদী চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো। সাম্রাজ্যের ভেতরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মানুষজন নিজেদের অস্তিত্বের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছিলো। পাশাপাশি অমুসলিম জনগোষ্ঠীর একরকম সামাজিক প্রশ্নের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো। এছাড়া ইউরোপীয় বিভিন্ন শক্তির সম্ভাব্য আগ্রাসনের বিষয়টিও মুখ্য ছিলো। সাম্রাজ্যের শাসক ও অভিজাত শ্রেণীও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। এজন্য তারা সাম্রাজ্যে আধুনিকতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি আনার জন্য রাষ্ট্রীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত চলা এই সংস্কার ‘তানজিমাত’ নামে পরিচিত ছিলো।

অটোমান সাম্রাজ্যের ৩০তম সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের উদ্যোগে এই সংস্কার আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিলো। কোনোরকম আমূল পরিবর্তন এই সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিলো না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য তৈরি করা এবং ইউরোপের প্রভাবে বেড়ে চলা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার কমিয়ে আনাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিলো।

৩০ তম অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ
৩০ তম অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ; Image Source: en.peramuzesi.org.tr

আঠারো শতক অবধি অটোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক শক্তি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিতান্ত কম ছিলো না। ১৭৫০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এর শক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়ার সাথে সংঘর্ষের ফলে অটোমান সাম্রাজ্য তার অধীনস্থ বেশ কিছু অঞ্চল হারিয়েছিলো। এদিকে তাদের পুরনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছিলো। ফলে অটোমান শাসক ও অভিজাতবর্গ এই বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের আশঙ্কা করছিলেন। বোঝা যাচ্ছিলো, সাম্রাজ্যের ভেতরের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার না আনা হলে অন্তিম পরিণতি ঠেকানো সম্ভব হবে না।

তৎকালীন সাম্রাজ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে জন্ম নেওয়া নতুন উৎপাদন ও বণ্টন পদ্ধতি সেই মহাদেশের অর্থনীতির গতি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলো। অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি পূর্বে অনেক শক্তিশালী ছিলো। কিন্তু উনিশ শতকে ইউরোপের তুলনায় তা একেবারে নগণ্য হয়ে পড়েছিলো। অটোমান শাসক ও অভিজাতগণ বুঝতে পারছিলেন, অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও বিদেশী হস্তক্ষেপের মোকাবেলা করতে হলে কার্যকরী অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণ করতে হবে।

বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যে বিভিন্ন সংস্কৃতির মুসলিম জনগোষ্ঠী ছাড়াও ইহুদী, খ্রিস্টান, গ্রিক, আর্মেনিয়ান ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিলো। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থানের পেছনে বিভিন্ন খ্রিস্টান মতবাদ ও তাদের প্রবক্তাগণ উৎসাহ হিসেবে কাজ করছিলো। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সেসময় উপনিবেশ বিস্তারে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলো। এর মধ্যে ইংল্যান্ড প্রোটেস্ট্যান্ট ও ফ্রান্স ক্যাথলিক মতবাদ প্রসারে উদ্যোগী ছিলো। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির এই নীতি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফলে বাইরের সম্ভাব্য আগ্রাসনের সাথে সালতানাতের ভেতরের অসন্তোষ যেন যুক্ত না হয়ে পড়ে, সেজন্য সুলতান ও তার পরিষদবর্গ অব্যর্থ কিছু সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করছিলেন।

মূলত আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগ হলেও তানজিমাত উদারপন্থী মন্ত্রীগণ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসা ও উৎসাহ পেয়েছিলো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিদহাত পাশা, সেনাপ সাবাহাদ্দিন, কাবুলি মাহমেদ পাশা, নামিক কামাল, ইব্রাহীম সিনাসি ও মাহমেদ বে।

মিদহাত পাশা
মিদহাত পাশা; Image: alay.com

তানজিমাত সংস্কার মূলত সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের আদেশক্রমে শুরু হয়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তার পুত্র সুলতান প্রথম আবদুল মেজিদ। ১৮৩৯ সালের ৩ নভেম্বর হাত্ত-ই-শরীফ বা রাজকীয় আদেশবলে ‘তানজিমাত ফেরমানি’ বা সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এর উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলো ছিলো- আগেকার ‘মিল্লাত’ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে সকল অটোমান নাগরিককে একটি সমঅধিকার ভিত্তিক কেন্দ্রীয় আইনের অধীনে আনা, দাসপ্রথা নিষিদ্ধকরণ, ব্যাংকনোটের প্রচলন, রাজস্ব ব্যবস্থায় অনিয়ম দূর করা, অমুসলিমদের বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা নিষিদ্ধ করা, টেলিগ্রাফ-ডাকযোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রে অটোমান জাতীয় সঙ্গীতের প্রচলন ও একাডেমী অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা।

ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদের গোলাপ বাগান বা ‘গুলহান’ থেকে তানজিমাত এর আদেশ জারি করা হয়েছিলো বলে একে ‘এডিক্ট অব গুলহান’ নামেও ডাকা হয়। এই আদেশ ধর্মীয় উদারতার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিলো। এই আদেশের ফলে ট্যাক্স বা রাজস্ব আদায়ে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর অবসান হয়। ইউরোপের আদলে বেতনভোগী ট্যাক্স কালেক্টর শ্রেণীর মাধ্যমে কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, অটোমান সাম্রাজ্যের রাজপরিবার ও অভিজাতগণ বুঝেছিলেন, নতুন যুগের রাষ্ট্রের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থনীতি বেশ জরুরি।

উনিশ শতকে তোপকাপি প্রাসাদ
উনিশ শতকে তোপকাপি প্রাসাদ; Image Source: alamy.com

তবে এডিক্ট অব গুলহানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন আইনের শাসন তৈরি করা। পূর্বে আইনের ক্ষেত্রে সুলতানের একক আদেশ সর্বোচ্চ বলে ধরা হতো। জনগোষ্ঠী ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে বিভক্ত ছিলো, প্রত্যেক সম্প্রদায় আইনের দৃষ্টিতে এক একটি ‘মিল্লাত’ বলে গণ্য হতো। প্রত্যেক মিল্লাত এক একটি আলাদা সমাজ ও ভিন্ন ভিন্ন আইনের অধীনে বসবাস করতো। নতুন আদেশের ফলে ধর্ম নির্বিশেষে সকল অটোমান নাগরিকের জন্য একই আইন চালু করা হয়েছিলো। এছাড়া এই নতুন আদেশবলে সরকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আধুনিক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়।

প্রথম অটোমান পার্লামেন্ট
প্রথম অটোমান পার্লামেন্ট; Image Source: dailysabah.com

এই সংস্কার বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও জনসাধারণের কাছে এর প্রতিক্রিয়া সবদিক থেকে আনন্দের ছিলো না। বিশেষ করে আগের মিল্লাত ব্যবস্থার অবসানের ফলে বলকান খ্রিস্টানরা ক্ষুব্ধ হয়। নতুন কেন্দ্রীয় আইনে তাদের আগেকার আলাদা সমাজের সুবিধা কমে যাওয়ার আশঙ্কা ছিলো। এদের বিদ্রোহে ব্রিটিশ সরকার গোপনে সাহায্য সহযোগিতা করতো।

১৮৫৬ সালে ‘তানজিমাত’ এর অধীনে আরেকটি অধ্যাদেশ জারি হয়। এটি ‘এডিক্ট অব ১৮৫৬’ নামে পরিচিত। এই আইনে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়। অটোমান সাম্রাজ্যে এতদিন চলে আসা খোলাখুলি ও গোপন ধর্মান্তর বন্ধ করা ছিলো এর উদ্দেশ্য। এছাড়া ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে শাস্তির নামে একজাতীয় ক্ষমতাবান ধর্মীয় গোষ্ঠীর আধিপত্যের অবসান ঘটানোও এর উদ্দেশ্য ছিলো।

১৮৭৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের সংবিধান প্রণীত হয়। এই সংবিধান কার্যত তানজিমাত সংস্কারের ফলশ্রুতি ছিলো। সংবিধানে সুলতানের হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। 

১৮৭৬ সালে গৃহীত অটোমান সংবিধান
১৮৭৬ সালে গৃহীত অটোমান সংবিধান; Image Source: politika.io

তানজিমাত সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিলো অটোমান সাম্রাজ্যের জনসাধারণের একধরনের উন্নয়ন। শাসকদের বিশ্বাস ছিলো, এই পদক্ষপের ফলে দেশের ভেতরের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা দূর হবে। তবে এই সংস্কারে সুলতানের ক্ষমতার সীমা ও পরিধি নিয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

স্থানীয় আরব আমিরগণ তানজিমাতের বিরোধী ছিলেন। এই সংস্কারের ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের আমলাতন্ত্রে শিক্ষিত আরব যুবকদের উল্লেখযোগ্য হারে প্রবেশ ঘটে। এই যুবকরা পরিবারসহ সাম্রাজ্যের সুবিধা পেতে থাকেন। এছাড়াও তারা সংস্কারবাদী চিন্তাধারায় চালিত ছিলেন। ফলে স্থানীয় আরব নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় এতদিন যে একরকম স্বাধীনতা পেতেন, তা হারানোর ভয় তাদের শঙ্কিত করে।

আধুনিক মেডিকেল শিক্ষিত আরব যুবসমাজ
সংস্কারে গড়ে ওঠা আধুনিক মেডিকেল শিক্ষিত আরব যুবসমাজ; Image Source: dissertationreviews.org

তবুও তানজিমাত সংস্কার অটোমান সাম্রাজ্যে একটি সীমিত পরিসরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলো। পরবর্তীতে তুর্কী জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেরই আবির্ভাব হয়েছিলো এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে। মুস্তফা কামাল পাশা, যিনি পরবর্তীতে কামাল আতাতুর্ক নামে আধুনিক তুরস্কের জনক হয়ে উঠেছিলেন, তিনিও প্রাথমিকভাবে এই তানজিমাত সংস্কারের ধারা দিয়েই বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। শুধু তুর্কী, আরব বা মুসলিমই নয়, এই সংস্কারের ফলে বলকান ও উত্তর আফ্রিকার অনেক মানুষও সময়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

এই সংস্কার মূলত যেসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছিলো, তার অনেকগুলোই পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৬ সাল অবধি চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলে এই সংস্কারের উদ্দেশ্য অনেকখানিই ব্যাহত হয়েছিলো। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের কিছুটা সম্পন্ন হয়েছিলো- তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে শক্তিশালী বৈদেশিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দেশের ভেতরের শক্তি বাড়ানোর উদ্যোগ শেষপর্যন্ত অসফলই থেকে গিয়েছিলো।

This Bangla article is about 'Tanzimat' reform attempt in 19th century Ottoman Empire. This attempt was taken to modernize the administration and economy of this empire. 

References:

01. What was the Impact of the Tanzimat Reforms on the Ottoman Empire in the Nineteenth Century? - Daily History

02. Age of Revolution - History World Some

03. Local Autonomy and the Tanzimat - Ottoman History Podcast

Related Articles