বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের তৃতীয় পর্ব।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব
ফুতুর বাবার কাছে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না। রাখাইন রাজ্যে পড়াশোনা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল- এক বছর হাই স্কুলে পড়ার খরচ ছিল ১.৮ মিলিয়ন থেকে ২ মিলিয়ন কায়াত (প্রায় ১,২৫০ মার্কিন ডলার)। অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে মাত্র এক সন্তানকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হতো, যদি তাদের অন্য সবগুলো ছেলে মিলে অর্থ উপার্জন করত।
হাই স্কুল শেষ করার পর ফুতু আরেকটি জার্নাল রাখতে শুরু করেন, লাল রঙের ছোট একটি নোটবুক। এতে তিনি নিকটবর্তী ফাঁড়ি থেকে তাদের গ্রামে আসা সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার দ্বারা সংঘটিত ঘুষ, চাঁদাবাজি, মারধর, জরিমানা এবং গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করতে শুরু করেন। ফুতুর বাবা তাকে ছোট একটি দোকান দেওয়ার জন্য টাকা ধার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু ফুতুর ইচ্ছে ছিল তারচেয়েও বড় কিছু করার।
ফুতুর এক বন্ধু, যে সকাল বেলা মাদ্রাসায় এবং বিকেল বেলা মসজিদে শিক্ষকতা করত, সে ফুতুকে দিনের বেলা ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজি এবং বার্মিজ পড়ানোর জন্য একটি ছোট ক্লাস খোলার পরামর্শ দিয়েছিল। বন্ধুটি বলেছিল, এমন অনেক শিশু পাওয়া যাবে, যারা পড়াশোনা শিখতে আগ্রহী।
বন্ধুটির সাথে মিলে ফুতু দুই ডজন ছাত্র সংগ্রহ করেন। তিনি তাদের বাসায় গিয়ে তাদের বাবা-মায়েদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, তাদের উচিত পাঠ্যপুস্তক কেনার জন্য অর্থ সঞ্চয় করা। যেসব পরিবার টাকা জোগাড় করতে পারছিল না, তাদের জন্য ফুতু ধনী ব্যক্তিদের কাছে ধর্না দেন অনুদানের জন্য। সেগুলোও যখন পর্যাপ্ত হচ্ছিল না, তখন তিনি নিজেই পকেট থেকে টাকা দিয়ে ছাত্রদেরকে বই কিনে দেন।
বিশ্বকে আরো ভালোভাবে জানার জন্য ফুতু মংডু থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা এনে দেওয়ার জন্য ভ্রমণকারী ব্যবসায়ীদের সাথে চুক্তি করেন। তিনি ইতিহাস এবং সাহিত্য পছন্দ করতেন। ইংরেজি গান শুনে শুনে সেগুলোর লিরিক লেখার ব্যাপারে তার প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। তিনি বই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, উইনস্টন চার্চিল এবং বিল ক্লিনটন সম্পর্কে তিনি পড়াশোনা করেন। তিনি তার ছাত্রদেরকে গান গেয়ে এবং কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন যেন তারা সেগুলো সহজে মনে রাখতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের বোঝার সুবিধার জন্য তিনি বার্মিজ পাঠ্যক্রম রোহিঙ্গা ভাষায় অনুবাদ করেন। তার নোটবুকের ইতিহাসের মতো, প্রতিটি বিষয় তিনি ব্যাখ্যা করতেন একেবারে গোড়া থেকে।
কয়েক মাসের মধ্যেই ফুতুর শিক্ষার্থীরা পড়তে এবং লিখতে শুরু করে। দুই বছরের মধ্যে তারা মিডল স্কুল পরীক্ষা পাস করতে শুরু করে। রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েরা যখন তাদের রাখাইন সহপাঠীদের চেয়েও ভালো নম্বর পেতে শুরু করে, তখন পার্শ্ববর্তী রাখাইন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান। তারা অবিশ্বাসের সাথে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা পড়ালেখা শিখেছ কীভাবে?
২০১০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ছিল। সে সময় সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) প্রার্থী দুনসে পাড়ায় একটি নির্বাচনী প্রচারণার আয়োজন করেছিলেন। রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে সংঘটিত সরকারবিরোধী ধারাবাহিক বিক্ষোভ ‘স্যাফরন বিপ্লব’-এর পর ঐ সময় সামরিক জান্তা তাদের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করেছিল। কিন্তু নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন দল ঐ নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনটিকে অ-নিরপেক্ষ বলে নিন্দা জানিয়েছিল।
কিন্তু দুনসে পাড়ায় ইউএসডিপি রোহিঙ্গাদেরকে তাদের ভোটের বিনিময়ে বিভিন্ন অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারা স্থানীয় উন্নয়নের জন্য সাত মিলিয়ন কায়াত দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে এই টাকা ভাগ করে দিলে প্রতিটি পরিবারের পক্ষে এক কাপ চায়ের বেশি কিছু কেনা সম্ভব হতো না। ফুতু তাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সরাসরি স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিতরণ করার পরিবর্তে এই টাকা দিয়ে তাদের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী নিবন্ধিত কোনো প্রাইমারি স্কুলে যেতে চাইত, তাদেরকে পার্শ্ববর্তী রাখাইন গ্রামে যেতে হতো। আর মিডল স্কুল এবং হাই স্কুলের জন্য তাদেরকে যেতে হতো আরো বড় কোনো গ্রামে কিংবা শহরে।
গ্রামের প্রধান ফয়েজ উল্লাহ ফুতুর প্রস্তাবের সাথে একমত হয়েছিলেন, কিন্তু সাধারণ গ্রামবাসীকে রাজি করাতে তাদেরকে বেগ পেতে হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে ফুতু বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েদের সাথে দেখা করেন, গ্রামের লোকদেরকে নিয়ে মিটিং করেন।
ফুতু তার সম্প্রদায়ের এবং তাইং-ইয়িন-থা সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করেছিলেন। তারা হয়তো বলত, “আমার ছেলে বিএ পাস” অথবা, “আমার ছেলের মাস্টার্স ডিগ্রি আছে”। কিন্তু ফুতুর সম্প্রদায়ের লোকেরা বলত, “আমার সাত কানি জমি আছে” অথবা, “আমার দুটি গরু এবং একটি ছাগল আছে”। ফুতু চেয়েছিলেন, রোহিঙ্গারাও তাদের জীবনের মূল্যকে ভিন্নভাবে পরিমাপ করতে শিখুক।
সবাইকে রাজি করানো সম্ভব ছিল না। তাদের অনেকে জানতে চেয়েছিল, “যদি আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বার্মিজ স্কুলে পাঠাই, তারা কি নিজেদের সংস্কৃতি ভুলে যাবে? আমরা তাদেরকে যে মূল্যবোধ শিখিয়েছি, তারা কি সেগুলো অগ্রাহ্য করবে? তারা কি রাখাইনদের মতো বিয়ার পান করতে শুরু করবে?”
তাছাড়া যদি কেউ প্রাইমারি স্কুল, মিডল স্কুল, এমনকি হাই স্কুলও পাশ করে, তাতেও বা কী লাভ? তারা তো কলেজে যেতে পারবে না, ভাল বেতনের সরকারি চাকরি পাবে না, কিংবা পুলিশ বা সেনাবাহিনীতেও যোগ দিতে পারবে না। পরিশ্রমের জন্য এবং ফুটফরমাশ খাটার জন্য গ্রামে ছেলেমেয়েদের দরকার ছিল। ভবিষ্যৎ যেখানে পূর্বনির্ধারিত, সেখানে ঘুষ, বই আর পরীক্ষার পেছনে অর্থ অপচয় করে কী লাভ?
ফুতু যুক্তি দেখিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা যদি শিক্ষিত হয়, তাহলে তারা এই নিয়মগুলোর অবসান ঘটাতে পারবে। তাদের সম্প্রদায় থেকে আরো বেশি মানুষ সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। তাদের মধ্য থেকে যদি এক ডজন প্রতিনিধি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়, এরপর কর্তৃপক্ষ যদি সেখান থেকে দু-একজনকে মেরেও ফেলে, তারপরেও বাকিরা তো রয়ে যাবে! তারা নতুন করে পরিকল্পনা করতে পারবে, কীভাবে তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের মধ্যে আলোকচ্ছটা নিক্ষেপ করা যায়।
গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে ফুতু শেষপর্যন্ত সবাইকে রাজি করাতে সক্ষম হন। সরকারের সাথে যোগাযোগ করে তিনি স্কুলটি নিবন্ধন করানোর ব্যবস্থা করেন। তার ডায়েরিতে তিনি বারবার স্কুল নির্মাণের বাজেটের খসড়া প্রস্তুত করেন। তিনি বুঝতে পারেন, তাদেরকে যে পরিমাণ টাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, স্কুল নির্মাণের জন্য তা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। সঠিকভাবে নির্মিত একটি স্কুলের জন্য ইউএসপিডির দেওয়া অনুদানের অন্তত দশ গুণ বেশি খরচ হবে।
খরচ কমানোর পরিকল্পনা করার জন্য ফুতু একটি কমিটি তৈরি করে দেন। শ্রমিকদের খরচ বাঁচানোর জন্য তারা ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করেন। দেয়ালের খুঁটিগুলোর জন্য তাদের নারকেল গাছের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এক একটি নারকেল গাছ কিনতে এবং পাহাড় থেকে বহন করে আনতে বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় হতো। ফুতু নতুন একটি পরিকল্পনা করেন। গ্রামের অনেকের জমিতে এমন অনেক নারকেল গাছ ছিল, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে কোনো ফল দেয়নি। তিনি সেই গাছগুলো একটি একটি করে চিহ্নিত করেন এবং তাদের মালিকদের কাছে গিয়ে সস্তায় সেগুলো কিনে নেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রামের সমস্ত বন্ধ্যা নারকেল গাছ স্কুলের খুঁটিতে পরিণত হয়ে যায়।
নির্মাণকাজের সময় আরো স্বেচ্ছাসেবী শ্রমিক জোগাড় করার উদ্দেশ্যে তারা সাইটে রাখা লাউডস্পিকার থেকে হিন্দি এবং ইংলিশ পপ গান বাজাতে শুরু করেন। উৎসবমুখর পরিবেশের টানে যখন দর্শনার্থীরা জড়ো হয়, তখন তারা তাদেরকে নির্মাণকাজে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানান।
শিক্ষার্থীরা কূপ থেকে পানি বহন করে এনে আগুনের চুলা জ্বালিয়ে অতিথি শ্রমিকদের জন্য চা বানিয়ে দেয়। চা পান করে স্বেচ্ছাসেবী শ্রমিকরা কাজে লেগে পড়ে। তারা বর্ষাকালের পানির স্রোতধারা থেকে স্কুলের মাঠকে রক্ষা করার জন্য তার চারপাশে বেড়া তৈরি করে দেয়, যেন বাচ্চারা পিছলে না পড়ে। ক্লাসরুমে সতেজ বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য তারা তেরপলের দেয়াল তৈরি করে। বাচ্চাদের যেন চিত্তবিক্ষেপ না ঘটে, সেজন্য তারা রাস্তার দৃশ্য অবরুদ্ধ করে দেয়।
২০১০ সালে যখন তাদের কাজ সম্পন্ন হয়, তখন দুনসে পাড়ার ইতিহাসের প্রথম সরকারি স্কুলটিতে চারটি ক্লাসরুমে ২৬০ জন শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছিল। শুনতে সহজ মনে হলেও শূন্য থেকে একটি গ্রামের স্কুল প্রতিষ্ঠা করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং পর্বতপ্রমাণ একটি কাজ। এটি ছিল গভীর একটি নদীর গতিপথকে পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো বিশাল একটি কাজ।
পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব