পশ্চিম ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা আমেরিকার বিখ্যাত সিআইএ– সবাই তখন উন্মুখ হয়ে উঠেছে রিপোর্টটি হাতে পাওয়ার জন্য। তাদের সবারই সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত রাশিয়া থেকে যে রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের স্যাটেলাইট স্টেটগুলোতে, সেটির জন্য মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হলেও তারা রাজি। পশ্চিম ইউরোপ কিংবা আমেরিকার তুখোড় গোয়েন্দারা তখন ভীষণ ব্যস্ত, গোটা ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছেন তারা।
কিন্তু রিপোর্টে কী এমন ছিল যে ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলো ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেল সেটি হাতে পাওয়ার জন্য?
সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন মারা গেলেন ১৯৫৩ সালে। নানা চড়াই-উতরাই পেরোনোর পর স্ট্যালিনের উত্তরসূরী হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা হাতে পেলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসে সাবেক নেতা স্ট্যালিনের নির্মম নীতিগুলোর সমালোচনা করে একটি ভাষণ দেন ক্রুশ্চেভ, যেটি ছিল সেই সময়ে রীতিমতো অভাবনীয় একটি ঘটনা। “অন দ্য কাল্ট অব পার্সোনালিটি এন্ড ইটস্ কনসিকোয়েন্সেস” শিরোনামের এই ভাষণে স্ট্যালিনের তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অক্টোবর বিপ্লবের মহানায়ক লেনিনের আদর্শে পরিচালনার প্রস্তাবনা রাখা হয়।
এই রিপোর্ট হাতে পেলে আমেরিকা ও পশ্চিমের নীতি নির্ধারকরা ক্রুশ্চেভের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতেন। স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে নিজের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে আগাম অনেক কিছু জানার উপায় হিসেবে সেই রিপোর্ট সম্পর্কে অতি আগ্রহী হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। আর রিপোর্টে যেহেতু সাবেক সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন সম্পর্কে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে, তাই সেটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাধারণ মানুষের সামনে প্রকাশিত করতে করতে পারলে সোভিয়েত ভাবমূর্তির উপরও একটি বড় আঘাত হানা যেত। সব মিলিয়ে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও আমেরিকার কাছে এই রিপোর্টটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গোপন অস্ত্রের মতো, যেটি হাতে পাওয়া গেলে রাজনৈতিক দিক থেকে বিশাল সুবিধা পাওয়া যাবে।
কিন্তু রিপোর্টটি হাতে পাওয়া সহজ কোনো বিষয় ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল, যাতে কোনোভাবেই রিপোর্ট বেহাত না হয়। সোভিয়েত থেকে বাকি দেশগুলোতে রিপোর্ট পাঠানোর সময় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। যেসব সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রধানের হাতে ৫৮ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছিল, তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যেন খুব বিশ্বস্ত কাউকে ছাড়া অন্যদের পড়তে দেয়া না হয়।
এত কিছুর পরও কোথায় যেন একটু ফাঁক রয়ে গেল। এই ফাঁকটাকেই কাজে লাগালেন পোলিশ ইহুদি সাংবাদিক ভিক্টর গ্রায়েভস্কি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করলে জাতিতে ইহুদি গ্রায়েভস্কির পরিবার নাৎসিদের রোষানল থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি করে সবকিছু গুছিয়ে পূর্ব ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত দেশ কাজাখস্তানে পালিয়ে যায়। এরপর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তারা চলে গেলেন ফিলিস্তিনে। এর কিছুদিন পর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলে তারা সেখানেই স্থায়ী বসতি গড়লেন।
গ্রায়েভস্কির পরিবার ফিলিস্তিনে চলে গেলেও তিনি ভাবলেন, পোল্যান্ডেই কিছু করবেন। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতার উপর পড়াশোনা শুরু করলেন রাজধানী ওয়ারশ’তে। পড়াশোনা শেষে পোল্যান্ডের সরকারি বার্তা সংস্থায় নিয়োগ পেলেন সাংবাদিক হিসেবে।
ধীরে ধীরে গ্রায়েভস্কির পদোন্নতি হতে শুরু করল। একসময় সম্পাদক হয়ে গেলেন পোল্যান্ডের সরকারি বার্তা সংস্থার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর থেকে আসা খবরগুলো সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার উপর। সেই সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের কারণে তার সাথে অনেক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে ওঠা-বসা ছিল। তাদের বিভিন্ন পার্টিতে তিনি আমন্ত্রিত হতেন, একসাথে বসে মদের গ্লাসে চুমুক দিতেন।
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভিক্টর গ্রায়েভস্কির প্রবল ইচ্ছা ছিল স্বাধীন দেশে গিয়ে তার পরিবারের সাথে দেখা করবেন। এদিকে তার বাবার শারীরিক অবস্থাও বেশি ভালো ছিল না। শেষ পর্যন্ত পোল্যান্ড সরকারের কাছ থেকে ভিসার আবেদন করলে একজন রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে তাকে ভিসা প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন প্রথম পোলিশ নাগরিক, যাকে ইসরায়েলের ভিসা দেয়া হয়েছিল।
ইসরায়েলে গিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করার পর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতেই আবার পোল্যান্ডে ফিরে আসেন গ্রায়েভস্কি। চাইলে ইসরায়েলে পরিবারের সাথে থেকে যেতে পারতেন। সেসময় পুরো বিশ্ব থেকেই ইহুদিরা ইসরাইলে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করছিল। আর জাতিতে ইহুদি হওয়ায় তাকে নাগরিকত্ব পাওয়ার জটিলতায় পড়তে হতো না। কিন্তু তিনি পোল্যান্ডেই ফিরে আসেন।
ইসরায়েলে যে কয়েক মাস অবস্থান করেন, তাতে তার মানসিকতা ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি ইসরায়েলের প্রতি একটি অন্যরকম ইহুদিবাদী টান অনুভব করা শুরু করেন, যে টান আগে কখনও ছিল না। পরবর্তীতে এই মানসিকতাই ইসরায়েলের জন্য তার কিছু করার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। অনেকে ধারণা করেন, ইসরায়েলে যাওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করেন গ্রায়েভস্কি। আর গোপন রিপোর্টটি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে দেওয়া ছিল এজেন্ট হিসেবে তার দায়িত্ব।
প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর গ্রায়েভস্কি পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত এক নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পার্টির বিশাল আমলাতন্ত্রের কোনো উচ্চ পর্যায়ের পদে নিযুক্ত ছিলেন গ্রায়েভস্কির প্রেমিকা।
একদিন প্রেমিকা সাথে একান্ত সময় কাটাচ্ছিলেন গ্রায়েভস্কি। হঠাৎ টেবিলে একটি ফাইলের উপর দৃষ্টি আটকে যায় তার। ‘টপ সিক্রেট’ লেবেল লাগানো সেই ফাইল দেখেই তিনি সন্দেহ করেন, এটি হয়তো সেই রিপোর্ট, যেটি পুরো পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এদুয়ার্দো ওখাবের কাছে খ্রুশ্চেভের পাঠানো রিপোর্টটি আসলে তিনি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যান এটি দেখে। যে স্ট্যালিনকে তারা এতদিন অন্ধভাবে অনুসরণ করে এসেছেন, তার সমালোচনা দেখার মতো একদমই প্রস্তুত ছিলেন না তারা। তিনি ক্রুশ্চেভের নির্দেশমতো পার্টির অন্যান্য উচ্চপদস্থ নেতাদের এটি পড়ার আহ্বান জানান। সেই সাথে গোপনে আরও কিছু কপি ছাপিয়ে নেন এই রিপোর্টের। পরবর্তীতে যেসব ব্যক্তিকে এই রিপোর্ট পড়তে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাদের মধ্যে গ্রায়েভস্কির প্রেমিকাও ছিলেন।
গ্রায়েভস্কি তার প্রেমিকার কাছে সেই টপ সিক্রেট রিপোর্টটি কয়েক দিনের জন্য দেখতে চান। দেখা শেষ হলেই তিনি সেটি আবার ফেরত দেবেন বলে তার প্রেমিকার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন। তার প্রেমিকা, কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতন্ত্রের উচ্চপদস্থ সেই নারী, তাকে রিপোর্টটি দিয়ে দেন। গ্রায়েভস্কি নিজেও পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় খুব বেশি সন্দেহের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। তিনি বিশ্বাস করেই দিয়েছিলেন গ্রায়েভস্কিকে। কিন্তু কে জানতো, এই রিপোর্ট একসময় জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পুরো ইউরোপ আমেরিকায় তুলকালাম অবস্থার সৃষ্টি হবে!
রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর চাইলেই গ্রায়েভস্কি তার সাথে যেসব পশ্চিমা কূটনীতিক রয়েছে, তাদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি না করে রিপোর্টটি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে পৌঁছাবেন বলে মনস্থির করেন। ইসরায়েলে যখন তিনি পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন থেকেই তার মধ্যে ইসরায়েলপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং এই বিষয়টিই তাকে রিপোর্টটি ইসরায়েলের হাতে দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
গ্রায়েভস্কি পোল্যান্ডে তার এক ইহুদি বন্ধুর কাছে রিপোর্টের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। পরে গ্রায়েভস্কির বন্ধু আবার পোল্যান্ডের ইসরায়েলি দূতাবাসের সাথে কথা বলে। ইসরায়েলি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা রিপোর্টের ছবি তুলে নিয়ে রিপোর্ট গ্রায়েভস্কির কাছে ফিরিয়ে দেয়। গ্রায়েভস্কি তারপর রিপোর্টটি তার প্রতিজ্ঞামতো তার প্রেমিকার কাছে ফিরিয়ে দেন।
এদিকে রিপোর্টটি খুব দ্রুত ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত-এর প্রধান আমোস মানোরের হাতে চলে যায়। যে রিপোর্টের জন্য বাঘা বাঘা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গলদঘর্ম হচ্ছিল, সেই স্পর্শকাতর রিপোর্ট এত সহজে হাতে চলে আসায় আমোস মানোর বিস্মিত হন। এরপর নিজস্ব অনুবাদকদের মাধ্যমে রিপোর্টটি হিব্রুতে অনুবাদ করিয়ে নেন তিনি। এছাড়াও এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সোভিয়েত ব্লকে থাকা দেশগুলোতে যেসব ইসরায়েলি গোয়েন্দা নিযুক্ত ছিল, তাদের সহায়তা গ্রহণ করেন। সেই সময়ে আবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড গুরিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করেন আমোস মানোর।
গুরিয়ন রিপোর্টটি হাতে পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন সেটি আমেরিকার হাতে দেবেন। চাইলে মোটা অর্থের মাধ্যমে দিতে পারতেন, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির কথা ভেবে সেটি থেকে বিরত থাকেন। পাঁচ বছর আগে ইসরায়েল ও আমেরিকার চুক্তি হয়েছিল যে, দুটি দেশ ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রমে পরস্পরকে সহায়তা করবে। সেই চুক্তি অনুসারে দ্বিপাক্ষিক বন্ধন আরও জোরদার করার লক্ষ্যে অত্যন্ত গোপনে সিআইএ-র কাছে রিপোর্টটি পাঠানো হয়।
সিআইএ দ্রুত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ারের কাছে রিপোর্টটি হস্তান্তর করে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বোচ্চ মাত্রায় বিব্রত ও বেকায়দায় ফেলার জন্য আইজেনহাওয়ার প্রশাসন সেটি সরাসরি গণমাধ্যমে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে তা বিভিন্ন আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পুঁজিবাদী দেশগুলোর জনগণ রীতিমতো অবাক হয়ে যায় স্ট্যালিনের বিভিন্ন নির্মমতার আখ্যান শুনে। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও এই রিপোর্ট ফাঁসের পর লজ্জায় পড়ে যায়। তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তারা রাজনৈতিকভাবে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সবাই মনে করতো, গোপন রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করার বিষয়টি বোধহয় সিআইএ-র কৃতিত্ব। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, এটা আসলে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার কাজ। গোয়েন্দাগিরি নিয়ে আগ্রহী লেখক কিংবা গবেষকদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত গ্রায়েভস্কির নাম বেরিয়ে আসে।
এই ঘটনার পর ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্কের গভীরতা আরও বৃদ্ধি পায়। যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে অল্প কয়েক বছর আগে, সেই রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা আমেরিকার সিআইএ-কে পেছনে ফেলে নিজেরা সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন রিপোর্ট সংগ্রহ করে আনবে– এরকম কোনো ধারণাই ছিল না আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের। সিআইএ-র সেসময়ের ডেপুটি জেনারেল একে আখ্যায়িত করেন ‘প্রথম শ্রেণীর কৃতিত্ব’ হিসেবে।