১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। ঘড়ির কাঁটায় সময় সকাল ৮.১৫। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ১০,০০০ পাউন্ডের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ একটি বোমা ফেলা হয় জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর। শহরটির প্রায় পুরোটাকেই মুহূর্তের মাঝে ধ্বংস করে ফেলে ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা। জাপানের প্রায় ২,৮০,০০০ অধিবাসী তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান। ঘটনার ঠিক তিনদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর শক্তিশালী আরেকটি বোমা আঘাত হানে হিরোশিমা থেকে ২৫০ মাইল দূরবর্তী নাগাসাকি শহরে।
পরপর দুটি পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে জাপান নিঃশর্ত সমর্পণ করে। তাৎক্ষণিকভাবে যারা মারা যান, তারা আসলে মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। যারা বেঁচে ছিলেন, তারা মৃত্যুর আগ মূহূর্ত পর্যন্ত নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করেছেন; অবশিষ্ট সময়ের পুরোটাই বেঁচে ছিলেন বীভৎসতা আর নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে। এরই মাধ্যমে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকস্মিক সমাপ্তি ঘটে।
ইতিহাসের অন্যতম বর্বর ও পৈশাচিক এই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবিবরণী যে কতটা মিথ্যায় পরিপূর্ণ, তা প্রকাশের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন মার্কিন কবি ও সাংবাদিক জন রিচার্ড হার্সে। তার শৈশব কেটেছিল চীনে। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মা-বাবার সাথে চীনে ছিলেন। সেখানে তার বাবা কর্মরত ছিলেন ইয়াং মেন্স ক্রিশ্চিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন’র (ওয়াইএমসিএ) সচিব হিসেবে। হার্সের মা ছিলেন একজন মিশনারি। ১৯৩৬ সালে হার্সে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি টাইম ও লাইফ ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা হিসেবে পূর্ব এশিয়া, ইতালি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার রচিত উপন্যাস ‘আ বেল ফর অ্যাডানো’ (১৯৪৪) পুলিৎজার পুরস্কার জিতে।
হিরোশিমা-নাগাসাকির বিস্ফোরণের কয়েকমাস পরের ঘটনা। হার্সে তখন নিউ ইয়র্কারের লেখক; এক দুপুরে তার সম্পাদক উইলিয়াম শনের সাথে মধ্যাহ্নভোজ সারতে গেলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উইলিয়াম শন হলেন সেই কিংবদন্তীসম সাংবাদিক, যিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর বিখ্যাত নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে কাজ করে গেছেন। দু’জনের কেউই জানতেন না, সে দুপুরের কথাবার্তা থেকেই উঠে আসবে ইতিহাস বদলে দেওয়া এক অনুসন্ধানী গল্পের সূচনা। দু’জনেরই গভীর সংশয় ছিল, জাপানে চালানো বীভৎসতা ও নারকীয়তাকে লঘু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রোপাগান্ডা চালায়। সরকারি বিবৃতি থেকে যেসব ছবি বা সাক্ষ্যপ্রমাণ আসে, তাতে শুধু দেখা যায় ধূলি ধূসরিত পরিবেশ, ধ্বংস হওয়া ভবন, গাছপালাহীন চারদিক ইত্যাদি।
আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের কোনো ছবি সেখানে উঠে আসেনি। তেজস্ক্রিয়তার যে বীভৎস ফলাফল, সেগুলোকে স্পষ্টতই চেপে যাওয়া হয়। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বিস্ফোরণের স্থানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে দেয় এবং সকল গণমাধ্যমকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে এ সম্পর্কিত খবরাখবর একেবারেই বিশ্লেষণী ও অনুসন্ধানী না হয়। যখন আন্তর্জাতিক ও জাপানি গণমাধ্যমগুলো একের পর এক মৃত্যুর খবর ফলাও করে প্রচার করতে শুরু করে, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিপাকে পড়ে যায়। তারা এসবের পুরোটাকেই সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা বলে আখ্যা দেয় এবং সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেল কংগ্রেসে তেজস্ক্রিয়তার কারণে মৃত্যুকে অত্যন্ত প্রশান্তিকর বলেও মন্তব্য করেন। এ পরিস্থিতি দেখেই হার্সে ও শন সিদ্ধান্ত নেন, প্রকৃত সত্য উদঘাটনের।
হার্সে তখন ৩২ বছরের সদ্য পুলিৎজার বিজয়ী সাংবাদিক। তিনি তার দুঁদে সম্পাদক শনের পরামর্শে জাপানে গিয়ে টানা দু’ সপ্তাহ অবস্থান করে প্রতিবেদন তৈরি করলেন। তিনি ৩০,০০০ শব্দের একটি লেখা জমা দিলেন, যেটি ১৯৪৬ সালে নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত হয়। প্রকল্পটি শন ও হার্সে, দু’জনের জন্যই এতটা আবেগের জায়গা ছিল যে, সে সময়ের নিউ ইয়র্কারের পুরো একটি সংখ্যাতে কেবল এই বিশাল কলেবরের প্রতিবেদনটিই ছাপা হয়। ফলাফল বিশ্ব জুড়ে নিউ ইয়র্কারের অসংখ্য পাঠকের কাছে ম্যগাজিনের ভাবধারারার ইতিবাচক পরিবর্তন আর সাথে দুনিয়া তোলপাড় করা ক্ষোভ ও শোকের মাতম। পরবর্তী সময়ে প্রতিবেদনটি ‘হিরোশিমা’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
শনের অনুপ্রেরণায় হার্সের লেখা ‘হিরোশিমা’ দুটি কারণে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। প্রথমত, হার্সে সাংবাদিকতার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছিলেন। কল্পকাহিনী লেখার ক্ষেত্রে লেখকরা যেসব সাহিত্যিক শৈলী অনুসরণ করে থাকেন, তার বেশ কয়েকটি হার্সে প্রয়োগ করেছিলেন হিরোশিমা লেখার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সাহিত্যের মালমশলা ব্যবহার করা। এটি তৎকালীন আমলে খুব একটা চর্চিত ছিল না। ফলে বলা চলে, পাঠকরা প্রায় সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে একটি বই পেলেন, যার ধারাবিবরণীতে সাংবাদিকতা আর সাহিত্য অসাধারণ পটুত্বে মিশ খেয়েছিল।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, হার্সে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন বিস্ফোরণ পরবর্তী জাপানের অবস্থা চাক্ষুষ দেখে এসে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চালানো নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ হার্সের কাজকে দিয়েছিল এক অবিশ্বাস্য বিশ্বস্ততা ও অসামান্য গ্রহণযোগ্যতা।
পরবর্তী সময়ে অজস্রবার প্রতিবেদনটি বেতারে, টেলিভিশনে এবং অন্যান্য বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। বই আকারে বেরোনোর পরও সেটি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পাঠক বইটিকে যথাযথ মর্যাদার সাথে গ্রহণ করে। খ্যাতনামা বিভিন্ন সাংবাদিক ও সমালোচকদের বিচারে বইটি বিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতায় শ্রেষ্ঠ ১০০টি কাজের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, তৃতীয় স্থানে ছিল প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের পদত্যাগের পেছনে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন।
ফিকশন ও নন ফিকশনের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক তেমনই, স্থাপত্য আর শিল্পের মাঝে সম্পর্ক যেমন। ফিকশন তত্ত্বীয়, আর নন ফিকশন প্রায়োগিক। কোনো স্থাপনা যেমন ভেঙে পড়ে না স্থাপত্য আর নির্মাণশৈলীর দক্ষতায়, ঠিক তেমনি নন ফিকশনকেও হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য, ইহজাগতিক। ‘হিরোশিমা’ প্রতিবেদনটি আক্ষরিক অর্থেই নন ফিকশন, তবুও ফিকশনের ধাঁচে লেখা। সুনির্দিষ্ট কিছু চরিত্র, তাদের যন্ত্রণা, সংলাপ, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা; ফিকশনের প্রায় সব উপাদান বর্ণনামূলক সাংবাদিকতায় কতটা প্রভাব বিস্তারকারী হতে পারে, তার বাস্তবধর্মী উদাহরণ হলো ‘হিরোশিমা’।
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে হার্সেকে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল, যার অধিকাংশই মূল প্রতিবেদনটিতে উঠে আসেনি। হার্সের লক্ষ্য ছিল, অল্প কিছু চরিত্রই থাকবে, তবে তারা যাতে নির্মিতব্য এ উপাখ্যানে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সীমিতসংখ্যক কিছু চরিত্রের এই যে যুদ্ধোত্তর সংকটময়তা, এটিও ‘হিরোশিমা’র অত্যন্ত মৌলিক একটি দিক। বলা বাহুল্য, হার্সের এ কাজের মাধ্যমেই সাংবাদিকতার ভুবনে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়।
হার্সে বরাবরই নিভৃতচারী ছিলেন। নিউ ইয়র্কারে ‘হিরোশিমা’ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার দিন কয়েক আগে তিনি পুরোপুরি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তিনি সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, অথচ নিজে চিরকাল থাকতে চেয়েছেন পর্দার আড়ালে। ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা থেকেই তিনি সকলকে বারণ করে গিয়েছিলেন, তার জীবনী লিখতে। তবে তার এই অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি।