১৮২০ সালের ২০ নভেম্বর। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অশান্ত জলরাশির ওপর একটি তিমি শিকারি জাহাজ- নাম তার এসেক্স। সে জাহাজ থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী ভূখণ্ডও হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। জাহাজে তখন বেশি মানুষ নেই। ক্যাপ্টেন জর্জ পোলার্ডসহ প্রায় সকল নাবিক ও কর্মচারীরা ছোট ছোট হারপুন বোটে চড়ে প্রকাণ্ড সব ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিমি শিকারে ব্যস্ত।
২৩ বছর বয়সী ফার্স্ট মেট ওয়েন চেজ সেদিন জাহাজে ছিলেন, একটা নৌকা সারাই করবার জন্য। হঠাৎ তার নজর পড়লো বেশ খানিকটা দূরে পানির ভেতর ওঁৎ পেতে থাকা আনুমানিক ৮৫ ফুট দীর্ঘ স্থির একটি তিমির ওপর।
দেখতে দেখতেই সে তিমি গতিময় হলো। ঘণ্টায় প্রায় ৫৬৫ কিলোমিটার গতিবেগে কয়েকবার জলের ফোয়ারা ছুটিয়ে সে তেড়ে এলো মি. চেজের দিকে। আঘাত হানলো জাহাজে।
ম্যাসাচুসেটসের নানটুকেট থেকে ১৮১৯ সালের ১৪ আগস্ট ২০ জন ক্রু-মেম্বার নিয়ে যাত্রা শুরু করে এসেক্স। ২৯ বছর বয়সী তরুণ নাবিক জর্জ পোলার্ডের পরিকল্পনা ছিল আড়াই বছর ধরে বিপুল পরিমাণ তিমি-তেল সংগ্রহ করে তবেই দেশে ফিরবেন। কিন্তু নিয়তির পরিকল্পনা ছিল অন্য কিছু!
নোঙর তোলার দু’দিন পর থেকেই শুরু হলো এসেক্স-এর দুর্ভাগ্য। প্রলয়ঙ্কারী এক ঝড়ের কবলে পড়ে এসেক্স। মাস্তুল আর পাল দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডুবতে ডুবতে কোনোক্রমে রেহাই পায় জাহাজটি। দক্ষিণ আমেরিকার আশপাশের সাগর শিকারশূন্য হওয়ায় নাবিকেরা দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে শিকার খোঁজার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিছুকাল সফর করার পর তারা জল ভরার জন্য গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের চার্লস দ্বীপে নামে। নাবিকেরা সে দ্বীপ থেকে ৬০ টি ১০০ পাউন্ডের কচ্ছপ সংগ্রহ করে। আর একজন জাহাজী কৌতুক করে সেখানে জ্বালে আগুন। শুকনো মৌসুমের চঞ্চল হাওয়ায় সে আগুন ক্রমশ দ্বীপময় ছড়িয়ে পড়ে। পোলার্ডের লোকজন কোনোক্রমে রেহাই পেলেও ঐ আগুন থেকে রক্ষা পায়নি চার্লস আইল্যান্ড।
জাহাজ ছাড়ার একদিন পরেও নাবিকেরা সে আগুন দেখতে পায়। অনেক বছর পরেও ঐ দ্বীপ ছিল বন্ধ্যা আর ঊষর। শোনা যায়, ঐ অগ্নিকাণ্ডের ফলেই চার্লস দ্বীপ থেকে ফ্লোরেনা কচ্ছপ আর ফ্লোরেনা মকিং বার্ড চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কয়েকমাস ধরে সাগরে ভাসার পর নভেম্বর থেকে এসেক্স তিমি শিকার শুরু করে। তখন তারা সমুদ্রতীর থেকে বহু যোজন দূরে। হারপুনবিদ্ধ তিমিরা তাদের আরো দূরে- দিগন্তরেখার ওপারে নিয়ে যেতো সময়ে সময়ে। এমন সময় এসেক্সের গলুইয়ে ঘটলো তিমি হামলা!
প্রথমবারের আক্রমণের পর আরো একবার প্রবল-বিক্রমে জাহাজটিতে আঘাত হানে সেই দানবীয় স্পার্ম তিমি। আর তারপর মহাসাগরের অসীম জলরাশির মধ্যে হারিয়ে যায় চিরতরে।
জাহাজে গলগল করে জল উঠতে লাগলো। নৌকা নামিয়ে তাতে রসদ তোলা ছাড়া জাহাজীদের আর কিছুই করার থাকলো না। কাপ্তান পোলার্ড দূর থেকে তার জাহাজের করুণ দশা দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো এবং মি. চেজের কাছে পুরো ঘটনাটি শুনে হতবাক হয়ে গেলো।
তিনটি নৌকায় ২০ জন মানুষ তখন অকূল সমুদ্রে ভাসছে। হিসেব কষে দেখা গেলো, তাদের অবস্থান থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপগুলো মার্কেসাস ও সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জ। পোলার্ডের ইচ্ছে ছিল সেদিকে যাওয়ার, কিন্তু বাধ সাধলো চেজ এবং তার অনুসারী নাবিকেরা। তাদের বক্তব্য ছিল, ঐ দ্বীপগুলোতে নরখাদক বর্বরদের বাস। তাই তাদের দক্ষিণ দিকে যাওয়া উচিত।
এই সিদ্ধান্তটি ছিল সমুদ্র-যাত্রার ইতিহাসে অন্যতম ভুল সিদ্ধান্তগুলোর একটি! তাদের অবস্থান থেকে দক্ষিণের ভূভাগ ছিল অনেক দূরে। তবুও বাণিজ্য-বায়ুর নাগালে এসে অন্য কোনো জাহাজের দৃষ্টি-আকর্ষণের আশায় তারা সেদিকেই রওনা হলো। শুধুমাত্র কাপ্তান পোলার্ড এই সিদ্ধান্তের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন।
পরবর্তীকালে নাথানিয়েল ফিলব্রিক তার বই ‘ইন দ্য হার্ট অব দ্য সি: দ্য ট্রাজেডি অব দ্য হোয়েল শিপ এসেক্স’-এ লিখেছেন,
যদিও নরখাদকদের গুজব চলে আসছিল, তবুও বহু ব্যবসায়ী ঐ দ্বীপগুলোতে নামতো, কিন্তু কখনো কোনো অঘটনের কথা শোনা যায়নি।
যা-ই হোক, তিনটি নৌকা পাশাপাশি ভেসে চললো অকূল পাথারে। জাহাজীদের রুটিসহ যে সামান্য রসদ ছিল, তা সমুদ্রের নোনা জলে ভিজে অখাদ্যে পরিণত হলো। সেসব খাবার খেয়ে একে একে পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হতে থাকলেন সকলে।
তার ওপর আবার বিষুবীয় অঞ্চলের তীব্র সূর্যকিরণ। সবমিলিয়ে এমনিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এমন দুর্যোগের মধ্যেই আবার কাপ্তানের নৌকায় আক্রমণ করে বসলো অন্য একটি তিমি।
এভাবে দু’ সপ্তাহ পার করার পর নাবিকেরা হেন্ডারসন দ্বীপের দেখা পেলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সে দ্বীপ ছিল ঊষর। হেন্ডারসনে সপ্তাহখানেক কাটানোর পর তাদের অবশিষ্ট খাবার শেষ হয়ে গেলো। তিনজন নাবিক সেই দ্বীপেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর অন্যরা আবার ভাসায় তাদের নৌকা- অনিশ্চিত গন্তব্যের আশায়।
কয়েক সপ্তাহ পর, ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে নৌকায় মাত্রাতিরিক্ত পানি উঠতে শুরু করে। রাতে হতে থাকে ভয়াবহ তিমির আক্রমণ। চেজের নৌকার এক নাবিক উন্মাদ হয়ে যায়। একরাত পর অসহনীয় খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে। নাবিকদল প্রথমবার মৃত্যু দেখে!
চেজের লেখনী থেকে জানা যায়, তার সহযাত্রীরা মৃতদেহটির হাত-পা আলাদা করে ফেলে, হাড় থেকে মাংস খুলে নেয়। তারপর শরীরটা চিরে হৃদপিণ্ড বের করে আলতোভাবে দেহটা সেলাই করে সমুদ্রে বিসর্জন দেয় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ঝলসে সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে। পরবর্তী সপ্তাহে আরো তিনজন দেহপাত করে জীবিতদের খাদ্য যোগায়।
ইতোমধ্যে একটি নৌকা হারিয়ে যায়। ওদিকে পোলার্ড ও চেজের নৌকা দু’টিও একে অন্যের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
নরমাংস বেশকিছু দিন ধরে খাবার উপযোগী থাকলেও, জাহাজীরা যত ঐ মাংস খেতো, তত বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তো। চেজের নৌকার লোকেরা দুর্বলতায় বাকশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। তাই নিরুপায় হয়ে, ১৮২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি- চার্লস রামসডেল নামক এক কিশোর সকলের সামনে এক নির্মম প্রস্তাব পেশ করলো। লটারির মাধ্যমে ধার্য করা হবে পরবর্তী মনুষ্য-বলি, যা খোরাক হবে সকলের!
সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো সে প্রস্তাব। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে সমুদ্রের বুকে এটা ছিল স্বাভাবিক নিয়ম- লিখিত দস্তাবেজ থেকে অন্তত সেটাই জানা যায়। যা-ই হোক, এই ভীষণ সিদ্ধান্তের প্রথম বলি হতে হয় ওয়েন কফিনকে। কফিন ছিলেন কাপ্তানের খালাতো ভাই।
জাহাজডুবির ৮৯ দিন পর অর্থাৎ ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে চেজের নৌকার অবশিষ্ট তিনজন দূরে একটি ক্ষুদ্র পাল দেখতে পায়। বহু চেষ্টার পর তারা ইন্ডিয়ান নামক ঐ ইংরেজ জাহাজটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
ওদিকে ৩০০ মাইল দূরে পোলার্ডের নৌকায় শুধুমাত্র কাপ্তান ও রামসডেল বেঁচে ছিলো। আর ছিল মৃতদেহের হাড়। তারা দুজন ঐ হাড়গুলো ভেঙে মজ্জা খাওয়া শুরু করে। দিনে দিনে তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা অস্থিসর্বস্ব হয়ে উঠতে লাগলো।
প্রায় এক সপ্তাহ পর ডফিন নামক একটা আমেরিকান জাহাজ যখন তাদের নৌকার কাছে গেলো, তখন পোলার্ড আর রামসডেল বাঁচার আনন্দে উল্লাস করতে ভুলে গেলো। তার পরিবর্তে তারা নৌকায় ছড়িয়ে থাকা হাড়গুলো কুড়িয়ে পকেটে পুরতে লাগলো! এমনকি জাহাজে তোলার পরেও ঐ উন্মত্ত লোক দু’টিকে সেই হাড়গুলো চাটতে দেখা যায়।
চিলির ভালপারাইসো শহরে জীবিত পাঁচজন পুনর্মিলিত হয়। আরোগ্যলাভের পর তাদের নানটুকেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর যে তিনজন হেন্ডারসনে থেকে গিয়েছিল, তাদেরও মাস চারেক পর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। কিন্তু বাঁচতে পারেনি সেই হারিয়ে যাওয়া নৌকার লোকগুলো। বছরখানেক বাদে ডুসি আইল্যান্ডে সেটিকে খুঁজে পাওয়া যায়- তিনটে নর-কঙ্কাল সমেত!
এসেক্সের এই বিভীষিকাময় ঘটনার বিবরণ দিয়ে ওয়েন চেজ ১৮২১ সালেই লিখেছিলেন দ্য রেক অব দ্য হোয়েল শিপ এসেক্স। কেবিন বয় থমাস নিকারসনের লেখাটির সন্ধান মেলে ১৯৮০ সালে। কিন্তু এই ঘটনা থেকে রসদ নিয়ে হেরম্যান মেলভিল যে উপন্যাসটি লিখেছিলেন, তার জনপ্রিয়তা অন্য সকল বইয়ের পাঠকপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যায়। বইটি হলো, আমেরিকান এপিক খ্যাত মবি ডিক!
শুধু ছাপার হরফে কেন? ২০১৫ সালে সেলুলয়েডেও এসেছে এসেক্সের হৃদয়বিদারী আখ্যান ইন দ্য হার্ট অব দ্য সি। সে ছবিতে ওয়েন চেজ-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন থরখ্যাত অভিনেতা ক্রিস হেমসওয়ার্থ। নিরাপদ অবস্থানে থেকে, উত্তাল সমুদ্রের সৌন্দর্যের ত্রাস আর রক্ত হিম করে দেওয়া সর্বসংহারী রোমাঞ্চ উপভোগ করতে, দেখে ফেলতেই পারেন ছবিটি।