
লেনিনকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে! কী সাঙ্ঘাতিক কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের মহান বিপ্লবী নেতা লেনিন আর নেই এই কথা মানতেও পারছে না দেশের শ্রমিক জনতা। তা কে করলো এই জঘন্য কাজ? লোকমুখে জানা গেল লেনিন বিরোধী এসারির ফ্যানি কাপলান নামের এক নারী হত্যা করেছে তাদের মহান নেতাকে। লেনিন সমর্থকগোষ্ঠী ক্ষোভে ফেটে পড়লো। অক্টোবর বিপ্লবের পর তারা লেনিনের হাত ধরে যে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, তা এত দ্রুত ভেঙে যাবে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। তাদের ক্ষোভ প্রতিফলিত হলো পরদিনের পত্রিকায়। জাতীয় পত্রিকা প্রাভদা’র শিরোনামে লেখা হলো–
‘সময় এসেছে দেশের বুর্জোয়াগোষ্ঠী দমন করার। হয় দমন করো, নাহয় দমিত হও। শ্রমজীবী জনতার ক্রোধে ফুটে উঠুক প্রতিশোধের গীত।’
কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকদের মাঝে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। ওদিকে খবর এলো বিরোধীদের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। লেনিন বেঁচে আছেন। এই তথ্য তাদের মনোবলকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। সেদিন মস্কোর মিখেলসন ফ্যাক্টরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা ভ্লাদিমির লেনিনের উপর যে ব্যর্থ হত্যা প্রচেষ্টা করা হয়েছিল, তা জন্ম দিয়েছিল দেশব্যাপী এক ত্রাসের। ইতিহাসের পাতায় বলশেভিক প্রতিষ্ঠিত এই ত্রাসের সময়কালের নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য রেড টেরর’।
পেছনের ঘটনা
‘দ্য রেড টেরর’ এর বাংলা অর্থ হচ্ছে লাল ত্রাস। এই লাল ত্রাসের আসল কারণ কী ছিল তা জানার জন্য আমাদের সেই সময়কালের আগের ঘটনাগুলো জানতে হবে। একসময় রাশিয়াতে জারদের শাসন কায়েম ছিল। শত শত বছর ধরে রুশ সিংহাসনে একজন জার একনায়ক হিসেবে আসীন থেকে দেশের সকল সিদ্ধান্ত ফয়সালা করতেন। কিন্তু জার শাসনামলে রাশিয়ায় দূর্নীতি, অরাজকতা এবং অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়। তার উপর রুশো-জাপান যুদ্ধে পরাজয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার ব্যর্থতা দেশের জনতাকে বিষিয়ে তুলেছিল। রাশিয়ার অর্থনীতিতেও ধ্বস নামায় বহু মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলে। দেশের কর্মজীবী জনতা হন্যে হয়ে উঠে বিপ্লবের জন্য। যে বিপ্লবের মাধ্যমে জার শাসনের অবসান হবে, কায়েম হবে কর্মজীবীবান্ধব রাষ্ট্র।

১৯১৭ সালে রাশিয়ান কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে সেই কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের সূচনা হয়, যা ইতিহাসে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামে সমধিক পরিচিতি। লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাম্যবাদী মতবাদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার চেষ্টা করেন। লেনিনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকদের বলশেভিক নামে ডাকা হতো। বলশেভিকদের বিরুদ্ধ ডানপন্থী নেতৃবৃন্দ, লিবারেল এবং সাম্রাজ্যবাদীরা একজোট হয়ে গঠন করে ‘হোয়াইট আর্মি’। লেনিনের উত্থানের পর বলশেভিকদের সাথে হোয়াইটরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

হোয়াইট আর্মির শ্বেত ত্রাস এবং লেনিন হত্যা প্রচেষ্টা
লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পরই কমিউনিস্ট বিরোধী হোয়াইট আর্মি একজোট হয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে হোয়াইট আর্মি এবং তাদের মিত্রদের নির্দেশে সোভিয়েত জুড়ে শুরু হয় সংগঠিত হত্যাকাণ্ড এবং উৎপীড়ন। তাদের উৎপীড়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলশেভিকদের দমন করা। তাদের এই ভয়াল দমন-নিপীড়ন অধ্যায়কে হোয়াইট টেরর বা শ্বেত ত্রাস বলা হয়। হোয়াইট টেররে আনুমানিক ৫ লাখ বলশেভিক নিপীড়িত হয়েছিল। হোয়াইট আর্মি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নেতৃত্বে সংগঠিত ছিল না। তাই তাদের ত্রাস নীতি বলশেভিকদের পুরোপুরি দমন করতে পারেনি।

১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে তারা বলশেভিকদের মহান নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের দিকে নিশানা করে। সেবছর ৩০ আগস্ট লেনিন মস্কোতে কারখানা পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন। সেদিন তাকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে রুশ সমাজতন্ত্র বিপ্লবী পার্টি (এসারি)-র এক নারী সদস্য ফ্যানি কাপলান। শ্রমিক আচ্ছাদিত লেনিন যখন অভিবাদন গ্রহণে ব্যস্ত ছিলেন তখন তাকে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফ্যানি। এরপর লেনিনকে লক্ষ্য করে ৩ বার গুলি ছুঁড়ে সে। গুলিবিদ্ধ লেনিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। লেনিন ছাড়াও পেট্রোগ্রাডের গোপন পুলিশ বাহিনী চেকা’র প্রধান মইসি উরিতস্কি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কাপলানকে ঘটনাস্থলে আটক করা হয় এবং কয়দিন পর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান লেনিন। তবে এই একটি ঘটনা বলশেভিকদের চেতনায় আঘাত করে। তারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয়ে যায় ‘দ্য রেড টেরর’।

বলশেভিক ত্রাসের সূচনা
১৯১৮ সালের আগস্টে বলশেভিকদের কারাগারে মোট ৫১২ জন বুর্জোয়া এবং অভিজাত নেতারা বন্দী ছিলেন। পেট্রোগ্রাডে বলশেভিক বাহিনী তাদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করে ‘দ্য রেড টেরর’-এর সূচনা করেন। এরপর একের পর এক বিরুদ্ধ শক্তিকে শনাক্ত করে হত্যা করতে থাকে তারা। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে আরও ৩০০ জন নেতাকে হত্যা করা হয়। মস্কোতে জনসম্মুখে ৮০ জন নেতাকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ২ জন ডানপন্থী সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন। আরও হত্যা করা হয় জার আমলে পার্লামেন্টের উচ্চতর কক্ষের নেতা ইভান স্কেগ্লোভিতভ। স্কেগ্লোভিতভকে হত্যা করার পূর্বে বলশেভিক সেনা চিৎকার করে বলেছিল,
“এই ব্যক্তি জারের শাসনামলে মন্ত্রী ছিলেন। তিনি আজীবন কৃষক এবং শ্রমিকদের রক্ত চুষে খেয়ে বেঁচেছিলেন।”
ইতিহাসবিদদের মতে, সেবছর প্রায় ৮ হাজার হোয়াইট আর্মি সমর্থক এবং বলশেভিক বিরোধীদের হত্যা করা হয়েছিল। রেড টেরর প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাশিয়ান রেড আর্মি এবং কুখ্যাত গোপন পুলিশ বাহিনী চেকা’র সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই সময়ে তারা সন্দেহভাজন যে কাউকে গ্রেপ্তার করা নির্যাতন করতে পারতো। লেনিন নিজে থেকে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা থেকে বিরত থাকলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনি ছিলে পুরো পরিকল্পনার হোতা। এমনকি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার জন্য আয়োজিত বলশেভিক ভোট দিবস বাতিল করে দিয়েছিলেন।
বলশেভিক নেতাদের সমর্থন
সব বলশেভিক নেতার সমর্থন না থাকলেও রেড টেরর পুরোদমে চলতে থাকে। বলশেভিকদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা গ্রেগরি জিনোভিয়েভ এই হত্যাযজ্ঞের পূর্ণ সমর্থন করেন। তিনি এই ঘটনার সমর্থনে জানিয়েছিলেন যে, বলশেভিক সরকারের শত্রুশক্তি চিরতরে নির্মূল করে দেওয়া প্রয়োজন। লেনিন নিজে লিখেছিলেন এমন কিছু করতে যেন বিরুদ্ধ শক্তি বলশেভিকদের কথায় থর থর করে কাঁপে। রেড টেররে নিহত হওয়া নেতাদের কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

রেড টেররে ঠিক কতজনের প্রাণহানি হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। তবে ১৯১৭ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত বলশেভিকরা নির্বিচারে প্রায় ২০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারের মতো লেনিন বিরোধী নেতাকর্মী ছিল। হোয়াইট টেরর এর জবাব রেড টেরর দিয়ে দিলো বলশেভিকরা। হোয়াইট আর্মিকে নির্মূল করে দেওয়ার মাধ্যমে এই টেররের সমাপ্তি হয়।
রেড টেরর ময়না তদন্ত
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেড টেরর সংগঠনের পেছনে বেশ কিছু ঘটনা দায়ী। এর পেছনে বলশেভিকদের খামখেয়ালিতা ছিল প্রধান কারণ। ক্ষমতা গ্রহণের পর তারা শক্ত হাতে দেশের হাল ধরতে ব্যর্থ হয়। লেনিনের নির্দেশে বহু বিরোধী নেতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্ত নেতারা লেনিনের চিরশত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। বলশেভিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের লঘু শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল যার ফলে তাদেরকে দুর্বল ভেবে ভুল করেছিল হোয়াইট আর্মি।
তবে এই টেরর শুধু লেনিনের একার পরিকল্পনা ছিল না। দেশের বিভিন্ন স্তরে খেটে খাওয়া শ্রমিক, কৃষক, দিন-মজুররা বুর্জোয়াদের দূর্নীতিতে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তারা হোয়াইট আর্মিদের ঘৃণা করতো। এই ঘৃণাকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে রেড টেররের পক্ষে জনসমর্থন আদায় করেছিল বলশেভিকরা। লেনিনের উপর আক্রমণ করার পর এই ঘৃণা কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বলশেভিকদের রেড টেরর বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের বলশেভিকদের অবস্থান শক্ত হয়। গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিজয়ের পেছনে এই পরিকল্পনার অবদান ছিল সুস্পষ্ট। এক কথায় বলতে গেলে, বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্ব পরাশক্তিতে পরিণত করে তুলতে দ্য রেড টেরর-এর মতো ভয়াল অভিযান প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।