
১৯২৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো মারাত্মক আহত ফ্র্যাঙ্ক গুজেনবার্গকে। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। মুমূর্ষু রোগীর গায়ে ১৪টি গুলির চিহ্ন থাকলো পুলিশকে তো তার দায়িত্ব চটজলদি পালন করতেই হবে। “আমাকে কেউ গুলি করেনি,” উত্তর দিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক। এর ঠিক তিন ঘণ্টা পরেই সবাইকে রহস্যের ফাঁদে আটকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফ্র্যাঙ্ক নাম লেখায় ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত দাঙ্গায় নিহত সাত ভিক্টিমের তালিকায়। আজ থেকে প্রায় ৮৯ বছর আগে শিকাগোতে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডটি ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত। কথিত আছে, প্রধান বিরোধী গ্যাং দলের নেতা জর্জ ‘বাগস’ মোরানকে হত্যা করতে খুব সতর্কতার সাথে এই ম্যাসাকার বা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে দুর্ধর্ষ মাফিয়া ডন আল কাপোন।

শিকাগো গ্যাংস্টার বাগস মোরান, যার জন্য এই ম্যাসাকার; Source: history.com
১৯২০ এর দশকের শেষদিক থেকে শিকাগোর রাস্তায় আধিপত্য বিস্তার করতো মাফিয়া গ্যাংগুলো। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর গ্যাংস্টার আল কাপোনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের পৃথিবী থেকে হটিয়ে মাফিয়া সাম্রাজ্যের একক অধিপতি হওয়া। বেআইনি আমদানি-রপ্তানি, জুয়া, পতিতাবৃত্তির ব্যবসার মতো অবৈধ সবকিছুর সাথে জড়িত ছিল সে ও তার দল। গ্যাংগুলোর মধ্যে সারাক্ষণই টুকটাক গণ্ডগোল লেগে থাকত। কিন্তু তাদের এই সহিংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায় ১৯২৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। আল কাপোনের দীর্ঘদিনের শত্রু আইরিশ গ্যাংস্টার জর্জ ‘বাগস’ মোরানের সাত সহযোগীকে গ্যারেজে ফেলে হত্যা করে পুলিশের পোশাকধারী কয়েকজন খুনি। ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি, আল কাপোনের সাথে এই ঘটনার সরাসরি কোনো যোগসাজশ কেউ কখনো প্রমাণ করতে পারেনি। আল কাপোনকে প্রধান আসামি বিবেচনা করে অসমাপ্তই রয়ে যায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার।
স্কারফেসের উত্থান
১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয় শিকাগো পুলিশ। অনিয়ম, অনাচার আর সহিংসতার জন্য ব্যাপক পরিচিতি পায় শিকাগো। আর এই পুরো ব্যাপারটার পেছনে পর্দার আড়াল থেকে মুখ্য ভূমিকায় কলকাঠি নাড়িয়ে গেছে অপরাধচক্রের সেনাপতি আল ‘স্কারফেস’ কাপোন। ১৯২৫ সালে বস জনি টরিওর কাছ থেকে গ্যাংয়ের দায়িত্ব বুঝে নেয় সে। ১৯২৪ সালে সংঘটিত এক আততায়ী হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয় টরিও। অবসরজীবন নির্বিঘ্নে কাটানোর জন্য সে চলে আসে ব্রুকলিনে। ওদিকে সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী মোতাবেক বেআইনিভাবে অ্যালকোহল উৎপাদন ও তার আমদানি-রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে দেয় সরকার। অ্যালকোহল ব্যবসার পাশাপাশি অবৈধ নাইটক্লাব পরিচালনা, জুয়া খেলা, পতিতাবৃত্তি ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতিতে পরিণত হয় আল কাপোন। তখনকার দিনে আল কাপোনের বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলারের মতো। ১৯২৭ সালের দিকে তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

ম্যাসাকারের হোতা গ্যাংস্টার আল কাপোন; Source: history.com
পরের বছরগুলোতে, শিকাগোর অপরাধ জগতে একক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বেশ অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে কাপোন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করে প্রতিযোগিতার মাঠ খালি করে দেয়া ছিল তার অন্যতম প্রধান একটি গেম প্ল্যান। শুধুমাত্র ১৯২৪ সালেই ১৬টি গ্যাং সংক্রান্ত খুনের মামলা পুলিশের হাতে আসে। এই দুরাবস্থা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯২৯ সালে। শুধুমাত্র সে বছরই ৬৪টি মাফিয়া গ্যাংচক্র সংশ্লিষ্ট খুনের হদিস পায় পুলিশ। ফেডারেল কর্তৃপক্ষ, বিশেষত ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন, নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলতেই বেশি পছন্দ করতো। শিকাগোর গ্যাংভিত্তিক লড়াইয়ে মাথা ঘামানো তাদের এখতিয়ারের বাইরে, এ কথা জানিয়ে দিয়ে মামলাগুলোর কোনো সুরাহাই করতো না তারা। কাজেই আরও সাহস পেয়ে যেত মাফিয়া গ্যাংগুলো। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে শিকাগো তখন এক অন্যায়-অবিচারের এক আঁস্তাকুড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’র ম্যাসাকার
১৯২৯ সালের ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে নিজেদের সবচেয়ে কদাকার রূপ দেখায় শিকাগোর মাফিয়া গ্যাংগুলো। এই শহরেরই উত্তর পাশের একটি গ্যারেজে নিজের বেআইনি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা চালাত জর্জ বাগস মোরান, বাগস নামেই যে বেশি পরিচিত। কাপোনের সাম্রাজ্যে সে-ই ছিল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দীর্ঘদিন যাবত দুজনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। এই শীতল যুদ্ধের ইতি টানতে তাই অস্ত্রশস্ত্র নিজদলের ছেলেদের পথের কাঁটা দূর করতে পাঠিয়ে দেয় কাপোন। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে মোরানের প্রধান সাত সহযোগীর লাশ পাওয়া যায় তাদেরই গ্যারেজের অভ্যন্তরে। দেয়ালের দিকে মুখ করে লাইনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে প্রায় ৭০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয় এই সাতজনের উপর। শিকাগোর ৩৬ তম জেলা থেকে পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, তারা জীবিত খুঁজে পায় কেবল ফ্র্যাঙ্ক গুজেনবার্গকে, যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। মারা যাওয়ার কয়েক মিনিট আগেও তার কাছে তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরিবারের কথা বিবেচনা করে সে সময় কেউই মাফিয়া কোনো গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলত না।

ম্যাসাকারে নিহত মোরানের এক সহযোগী; Source: history.com
অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে বের করে পুলিশ। তার কাছ থেকে জানা যায়, পুলিশের পোশাক পরে একদল হাজির হয় উত্তরের গ্যারেজটিতে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল কাউকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে। পুলিশকে তাই আর কেউ ঘাঁটানোর চেষ্টা করেনি। অবশ্য মোরান এবং অন্যান্য মাফিয়া গ্যাংয়ের সদস্যরা তৎক্ষণাৎই দাবী করে, এ কাজ আল কাপোনের ছাড়া আর কারো হতে পারে না। কিন্তু যে পুলিশ এমনিতেই গ্যাং সংক্রান্ত বিষয়ে গা বাঁচিয়ে চলতে পছন্দ করে, তারা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কাপোনের মতো সিংহের গুহায় পা রাখবে, এমনটা ভাবাও বোকামি। কাজেই নির্বিচারে পার পেয়ে যায় আল কাপোন কিংবা হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত অপরাধী। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্যও কোনো আসামিকে কখনো হাজির করা হয়নি।
যে জর্জ বাগস মোরানকে খুন করতে কাপোনের এত পরিকল্পনা, সে কিন্তু দিব্যি বেঁচে গিয়েছিল এই ম্যাসাকারের হাত থেকে। নিজের বাসা থেকে গ্যারেজের দিকেই রওনা দিয়েছিল মোরান। আর কয়েক মিনিট আগে গ্যারেজে পৌঁছে গেলে নিহতের সংখ্যা সাত না হয়ে আট হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল ছিল। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে দু’দিন পর গণমাধ্যমের কাছে দেয়া এক বক্তব্যে সে জানায়, “কেবল কাপোনই এরকম বর্বরভাবে কাউকে খুন করতে পারে”। সাংবাদিকরা তখন কাপোনের ফ্লোরিডার বাসায় গিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে কাপোন জানায়, “শিকাগোতে এরকম খুনের স্টাইল কেবল একজনের সাথেই মেলে, সে হলো মোরান নিজে”। হত্যাকাণ্ডের সময় সে বাড়িতেই ছিল, এ ব্যাপারে যথেষ্ট অ্যালিবাই তার পক্ষে মোট দিয়েছে। এত বড় কাণ্ড কোনো নেতা নিজে গিয়ে ঘটাবে না, তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। শেষপর্যন্ত তাই অমীমাংসিতই রয়ে গেল কুখ্যাত এই মব আক্রমণ মামলা।

এই গ্যারেজেই সংঘটিত হয় হত্যাকাণ্ডটি; Source: history.com
শক্তিমানের পতন
ভালোবাসা দিবসের দিন সংঘটিত ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে ম্যাসাকার’ একদিকে যেমন বেআইনি ব্যবসার জগতে কাপোনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাথা ফাঁকা করে দিয়েছিল, অন্যদিকে শিকাগোতে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের সমাপ্তিও ঘোষণা করেছিল এই একই ঘটনা। প্রচণ্ড সক্রিয় একটি সংগঠন, চোখ চড়ক গাছে উঠিয়ে দেয়ার মতো আয়, নির্মমভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের গায়েব করে দেয়ার মানসিকতা- সব মিলিয়ে খুব দ্রুতই কাপোন দেশের এক নম্বর গ্যাংস্টারে পরিণত হয়। সবাদপত্রগুলো তখন মহাসমারোহে তাকে ‘এক নম্বর গণশত্রু’ উপাধিতে ভূষিত করা শুরু করে। ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে ভ্যালেন্টাইনস ডে ম্যাসাকারের সম্ভাব্য আসামি হিসেবে তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হলে সে নির্দেশ অমান্য করে কাপোন। বিষয়টি ফেডারেল সরকারের জন্য অপমানজনক হওয়ায় তার পুরনো নথিপত্র ঘাঁটতে শুরু করে তদন্তকারীরা। ঘাবড়ে ফিয়ে কাপোন যখন আদালতে আসতে সম্মত হয়, রাষ্ট্রীয় এজেন্টরা তখন আদালত অবমাননার দায়ে তাকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকেই গ্রেপ্তার করে। কয়েকদিনের মধ্যে তাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় দলের সদস্যরা। অবৈধ অস্ত্র বহনের দায়ে মে মাসেই আবার তাকে ফিলাডেলফিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ দফা প্রায় নয় মাস কারাবাস ভোগ করতে হয় কাপোনকে। ভালো ব্যবহারের জন্য দ্রুত জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে।

ট্রায়ালের সময় মঞ্চস্থ ভ্যালেন্টাইনস ডে ম্যাসাকার; Source: history.com
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরও একবার আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাস কুক কান্ট্রি জেলে কারাদণ্ড হয় কাপোনের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কাপোনের ট্যাক্সের কাগজপত্র খতিয়ে দেখা শুরু করে। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৩১ সালে কাপোনের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়। শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার নথি উদ্ধার করে রাজস্ব আদায় কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ১১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় আল কাপোনকে। প্রথমে আটলান্টা ও পরবর্তীতে আলকাট্রাজ কয়েদখানায় রাখা হয় তাকে। ১৯৩৯ সালে মুক্তি প্রাপ্ত কাপোন ১৯৪৭ সালে ফ্লোরিডায় মারা যায়। এতবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একবারের জন্যও সে ভ্যালেন্টাইনস ডে ম্যাসাকারের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেনি। কিন্তু তবুও প্রমাণহীন সেই অপরাধের জন্য জীবনের বাকি দিনগুলো কোনো না কোনোভাবে সাজা পেতে হয় কাপোনকে।
ফিচার ইমেজ- history.com