Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য ওয়াগনার গ্রুপ: পুতিনের প্রক্সি ওয়ারের মহারথী যারা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই আমেরিকার অধীনে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দ্বন্দ্ব পৃথিবীবাসীর সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হতে শুরু করে। হিটলারের জার্মানি তথা অক্ষশক্তির বিপক্ষে মার্কিন-সোভিয়েত জোট এক হয়ে লড়াই করলেও যুদ্ধ শেষ হতেই দুটি ভিন্ন মতাদর্শের দেশ একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে হাজির হয়। কারণ আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন– দুটি দেশই চেয়েছিল তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতাদর্শ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। দুটি দেশের আধিপত্যের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দেয়, পৃথিবীবাসী ভীত হয়ে ওঠে। দুই দেশের নিত্যনতুন মারণাস্ত্রের উদ্ভাবন ও মজুদ করার প্রবণতা কিংবা আধিপত্যবাদী নীতির প্রবর্তন প্রত্যক্ষ করে যেকোনো শান্তিকামী মানুষের কপালেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের সাময়িক বিরতি ঘটে, পৃথিবী প্রবেশ করে নতুন একটি পর্যায়ে, যেখানে আমেরিকা একমাত্র সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি। এই পর্যায়ে পুঁজিবাদের জয়জয়কার দেখে পুরো বিশ্ব, নব্য-উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের ফলে প্রতিটা দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়, উন্মুক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে ইউরোপে অনেকগুলো ছোট দেশের জন্ম হয় কিংবা দেশগুলো স্বকীয়তা ফিরে পায়, যে দেশগুলোর প্রত্যেককে পুঁজিবাদের পথে হাঁটতে হয়। একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজের অর্থনীতির ঠিক করার দিকে মন দিতে হয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে হয়।

সাবেক কেজিবি গোয়েন্দা ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ানদের ভাবমূর্তির যে সংকট দেখা দিয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে রাশিয়ার উত্তরণ ঘটিয়েছেন পুতিন। স্নায়ুযুদ্ধের পর যে আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয়রা রাশিয়ানদের অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতো, তারাই এখন রাশিয়ানদের সমীহ করতে শুরু করেছে। এর ফলে পুরো রাশিয়াজুড়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক ‘কাল্ট ফিগার’-এ পরিণত হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে প্রায় বিশ বছর রাশিয়া নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। আস্তে আস্তে আবার তারা বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে বড় খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।

গশআএচ
সাবেক কেজিবি গোয়েন্দা, বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনছেন;
image source: rt.com

২০১০ সালের পর থেকে রাশিয়া যে আবার বৈশ্বিক পরিমন্ডলে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করে, এর পেছনে রাশিয়ান মার্সেনারি বা ভাড়াটে সৈন্যদের দল ‘দ্য ওয়াগনার গ্রুপ’-এর বিশাল ভূমিকা আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাশিয়া প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুভাবাপন্ন বিপরীত পক্ষের সাথে লড়াই করেছে, যেখানে ওয়াগনারের মতো সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো।

পুরো বিশ্ব দ্য ওয়াগনার গ্রুপকে রাশিয়ার পুতিন সরকারের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাপ্রাপ্ত সশস্ত্র সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে আসলেও রাশিয়া বরাবরই সেটা অস্বীকার করে এসেছে। এর কারণ দ্য ওয়াগনার গ্রুপ ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি সংগঠন এবং রাশিয়ার সংবিধানে এরকম কোনো সংগঠনকে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের জন্য ব্যবহার করার কোনো অনুচ্ছেদ নেই। বরং রাশিয়ার নিরাপত্তা কিংবা নিজস্ব আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সরকারি বাহিনীকেই ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে না থাকলেও সম্প্রতি অনেকবার রাশিয়ান পার্লামেন্টে প্রাইভেট মিলিটারি সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টিং কোম্পানি (PMSC Company) বা ওয়াগনার গ্রুপের মতো সশস্ত্র বেসামরিক সংগঠনগুলোকে একটি আইনি ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্য জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও সেই চেষ্টা সফলতার মুখ দেখেনি।

রাশিয়া বরাবরই অস্বীকার করে এলেও পুতিন প্রশাসন যে ওয়াগনারের মতো মার্সেনারি গ্রুপগুলোর প্রতি অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, তা খুবই স্পষ্ট। ওয়াগনার গ্রুপ যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে, তা রাশিয়ার সরকারি সামরিক বাহিনীও ব্যবহার করে থাকে। এমনকি তারা একই ঘাঁটিতেও অবস্থান করেছে বিভিন্ন দেশে। রাশিয়ায় ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপের যে ঘাঁটি রয়েছে, সেটিতে পা রাখতে গেলে আগে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার (জিআরইউ) চেকপোস্ট পেরোতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যরা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর বিমান ব্যবহার করে থাকে। ওয়াগনার গ্রুপের সাথে ক্রেমলিনের সুসম্পর্কও পুতিন সরকার ও ওয়াগনার গ্রুপের সম্পর্কের দাবির ভিত্তিকে জোরালো করেছে। ওয়াগনার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উৎকিন রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। আরেকজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনের সাথে পুতিনের দহরম-মহরম দেখার মতো। রাশিয়ায় তাকে ‘পুতিনের রাঁধুনি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

জবিবওবও
দ্য ওয়াগনার গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিঝোঘিনের সাথে ক্রেমলিনের জোরালো সম্পর্ক রয়েছে;
image source: trtworld.com

ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই পুতিন সরকারের কাছে ওয়াগনার গ্রুপের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। ইউক্রেনের সাথে সংঘর্ষের সময় রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ওয়াগনার গ্রুপও গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। অবশ্য ইউক্রেনের সাথে সামরিক সংঘর্ষের আগেই রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দ্য ওয়াগনার গ্রুপের উপর তার আস্থার কথা জানান। ২০১৩ সালে রাশিয়ান পার্লামেন্ট ডুমায় একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পুতিনকে জাতীয় স্বার্থে প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ব্যবহারের কথা জিজ্ঞেস করেন। সেখানে পুতিন সবাইকে আশ্চর্য করে নিয়ে ইতিবাচক উত্তর দেন, রাশিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন।

ইউক্রেনের ঘটনার পর থেকে রাশিয়ান স্বার্থের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। আমেরিকা কিংবা অন্যান্য দেশের প্রাইভেট মিলিটারি গ্রুপগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা যুদ্ধের সময় কখনও একেবারে সামনের দিকে থাকে না বা আক্রমণে অংশ নেয় না। এদের মূল কাজ বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাশিয়ান মার্সেনারি দ্য ওয়াগনার গ্রুপ একেবারে সামনে থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে সরাসরি সামরিক সংঘাতে অংশগ্রহণ করেছে, প্রয়োজনে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। এজন্য অবশ্য ওয়াগনার গ্রুপের ক্ষয়ক্ষতির হারও অনেক বেশি।

হআহআহআ
ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায় সাফল্যের পর থেকে পুতিন অনেক দেশেই ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহার করছেন; image source: atlanticcouncil.org

রাশিয়ার সরকার মূলত ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে সেসব দেশেই তৎপরতা চালিয়েছে, যেসব দেশের সরকার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে এবং সেসব দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে। এজন্য মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দিকেই রাশিয়া বেশি করে বিভিন্ন সংঘাতে যুক্ত হয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল-আসাদের সরকারকে শুরু থেকে রাশিয়া সমর্থন দিয়েছে। কারণ সিরিয়ার তেলের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে হবে। লিবিয়ায় হাফতারের অধীনে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে অস্ত্র, সামরিক উপদেষ্টা ও মার্সেনারি গ্রুপ পাঠিয়ে সহায়তা করছে রাশিয়া, যার পেছনেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ আল-কায়েদার সহযোগী উগ্রবাদী সংগঠনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এসব সংগঠনের বিকাশের ফলে বেকায়দায় পড়ে যায় সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের ক্ষমতাসীন দলের নেতা। তার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় ওয়াগনার। কারণ ক্ষমতাসীন দলের পতন ঘটলে রাশিয়ার যে অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, তাতে নিশ্চিতভাবে ব্যাঘাত ঘটবে। বলে রাখা ভালো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তেলের রিজার্ভগুলোর একটি আবিষ্কার করা হয়েছে সম্প্রতি।

হআহববু
image source: promoteukraine.org

প্রাইভেট সিকিউরিটি গ্রুপ তথা দ্য ওয়াগনারের মতো মার্সেনারি গ্রুপগুলোর মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েও রাশিয়া দায় এড়াতে পারছে সহজেই। কারণ রাশিয়ান সরকার আইনগত কোনো ভিত্তি তৈরি করেনি প্রাইভেট সিকিউরিটি গ্রুপগুলোর জন্য, এজন্য বাইরের দেশগুলো সরাসরি দায়ী করতে পারছে না। যেখানে নিজস্ব সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি জনসম্মুখে প্রকাশ করার মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার থাকে, সেদিক থেকে মার্সেনারির মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধ পরিচালনা অত্যন্ত নিরাপদ। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দ্য ওয়াগনার গ্রুপ যেভাবে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি বাড়বে বৈ কমবে না।

Related Articles