যুগ যুগ ধরে জাদুবিদ্যা সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ, বিস্মিত, হতভম্ব করে এসেছে। কী হচ্ছে তা বুঝতে না পেরে, ছোটখাটো কিছু ছলাকৌশলের ফাঁদে আটকে পড়ে দর্শক মজে যায় জাদুর জগতে। এখনকার দিনে খুব সহজেই ‘১০১ সহজ জাদু’ জাতীয় বই পড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। কিন্তু তাদের কি আদৌ জাদুকর বলা যায়? সেরা জাদুকরদের তালিকায় এমন কিছু নাম খুঁজে পাওয়া যায়, যারা তাদের পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে অনবদ্য সব কলাকৌশল দেখিয়ে জাদুর জগতে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। তেমনি পাঁচ জাদুকরের গল্প নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
হ্যারি হুডিনি
জাদুর জগতে সবচেয়ে পরিচিত নাম হ্যারি হুডিনি। অনেকের কাছে ‘জাদু’ শব্দটি হুডিনির ট্রিক্সের সমার্থক। ১৮৭৪ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান এই জাদুকর মাত্র নয় বছর বয়সে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। সে বয়সেই কার্ড নিয়ে খেলা দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। স্টেজ ম্যাজিশিয়ান এবং স্ট্যান্ট পারফর্মার হিসেবে পরবর্তীতে দারুণ সুনাম অর্জন করেন তিনি। অভিনব উপায়ে পলায়ন কর্মের জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে তার। ইউরোপের এক ট্যুরে গিয়ে তিনি ‘হ্যারি হ্যান্ডকাফ হুডিনি’ খেতাব অর্জন করেন। সেবার পুলিশকে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। শিকল, দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে, পানির নিচে বাক্সবন্দী করেও তাকে আটকে রাখা যায়নি।
১৯০৪ সালে, হাজারো দর্শকের চোখের সামনে লন্ডনের ডেইলি মিরর কর্তৃক সরবরাহকৃত এক বিশেষ হাতকড়া পরা অবস্থায় পালিয়ে যান তিনি। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এছাড়া জীবন্ত কবর থেকে উঠে আসার রেকর্ডও রয়েছে তার। তবে তার এসব জাদুশিল্প বা পালিয়ে যাওয়াকে নিছকই ঠকবাজি বলে দাবি করেছেন অনেকে। সেসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বেশ কিছু সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন হুডিনি। কিন্তু সেখান থেকে খুব ভালো উপার্জন না হওয়ায় সে পথ ছেড়ে দেন খুব দ্রুত। নিজের জাদুকৌশল নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা এই জাদুকরের, বৈমানিক হওয়ারও ইচ্ছে ছিল তার।
ডেভিড কপারফিল্ড
ডেভিড সেঠ কটকিন, নামটি পরিচিত লাগছে? আর যদি বলা হয় ডেভিড কপারফিল্ড, তাহলে কি আর চিনতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা? ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া আমেরিকান এই জাদুকর পেশাগত ক্ষেত্রে ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ নামেই খ্যাতি অর্জন করেছেন। ফোর্বসের মতে, ব্যবসায়িক দিক থেকে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জাদুকর।
কপারফিল্ডের টেলিভিশন সিরিজ ২১টি অ্যামি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। গল্প বলা এবং মোহ সৃষ্টি করা, এই দুটি কাজের দুর্দান্ত সমন্বয় তাকে শতাব্দীর সেরা জাদুকরদের তালিকায় ঠাঁই দিয়েছে অবলীলায়। কপারফিল্ড তার ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন। এছাড়া ‘হলিউড ওয়াক অফ ফেইম’, ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘নাইটহুড’ খেতাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস কর্তৃক ‘লিভিং লিজেন্ড’ বা ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’ সহ অসংখ্য উপাধি অর্জন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত তার জাদু প্রদর্শনীর টিকেট বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন এবং তা থেকে কপারফিল্ডের আয় হয়েছে ৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি! মঞ্চে যখন জাদু দেখান না, তখন বাহামা দ্বীপপুঞ্জে তার ১১টি রিসোর্ট দেখাশোনা করেন কপারফিল্ড। আদর করে এই রিসোর্টগুলোকে তিনি ‘মুশা কায় অ্যান্ড দ্য আইল্যান্ডস অফ কপারফিল্ড বে’ বলে ডাকেন।
ডায়নামো
মঞ্চে তিনি ভক্তদের কাছে ‘ডায়নামো’ নামে পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম স্টিভেন ফ্রেয়ন। ১৯৮২ সালের ১৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা ইংলিশ এই জাদুকর তার টেলিভিশন শো ‘ডায়নামো: ম্যাজিশিয়ান ইম্পসিবল’ দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে চালু হয়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়া শোটি মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই তাকে শতাব্দীর সেরা জাদুকরদের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
ইংল্যান্ডের ব্যাডফোর্ডে জন্ম নেয়া ফ্রেয়নের মা ইংলিশ হলেও বাবা কিন্তু পাকিস্তানী পাঠান বংশোদ্ভূত। ছোটবেলা থেকেই ‘ক্রন ডিজিজ’ নামক একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিক গঠনের দিক থেকে তিনি বেশ ছোটখাটো ছিলেন। কাজেই অন্যান্য বাচ্চারা তাকে নিয়ে দুষ্টুমি করতো প্রায়ই। তার দাদু তখন তাকে একটি মজার কৌশল শিখিয়ে দেন, যাতে বাকি বাচ্চাদের মনে হয় ফ্রেয়নের ওজন অনেক বেশি। সেই থেকে জাদুর জগতে তার হাতেখড়ি। টেমস নদীর উপর দিয়ে হেঁটে সবাইকে তাক লাগিয়ে এই জাদুকরের বার্ষিক আয় প্রায় ১৯ মিলিয়ন ডলার।
ক্রিস অ্যাঞ্জেল
ক্রিস্টোফার নিকোলাস সারানটাকোস, জন্মের সময় বাবা-মা প্রদত্ত এই নামটি মঞ্চ কাঁপানো ভোজবাজির রাজা ‘ক্রিস অ্যাঞ্জেল’এর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে অনেক আগেই। ১৯৬৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা ৫০ বছর বয়সী এই আমেরিকান জাদুকর তার ক্যারিয়ার শুরু করেন নিউ ইয়র্ক শহরে। মাত্র সাত বছর বয়সে জাদুর জগতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় ক্রিসের। জীবনের প্রথম স্টেজ শোতে অংশ নেন বারো বছর বয়সে। সেই শো থেকে কামিয়েছিলেন দশ ডলার। বিশ্বসেরা জাদুকর হ্যারি হুডিনিকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া বালক জাদুকর হাই স্কুলের চারপাশে যেসব রেস্তোরাঁ ছিল, সেখানে জাদু দেখানো শুরু করে। ক্রিসের প্রথম নজরকাড়া জাদু ছিল নিজের মাকে কিছুক্ষণ হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখা।
‘ক্রিস অ্যাঞ্জেল মাইন্ডফ্রিক’ নামক টেলিভিশন এবং স্টেজ শোর মধ্য দিয়ে তিনি দর্শকদের নজরে আসেন। ২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস স্কয়ারে একটি টেলিফোন বুথ আকৃতির চৌবাচ্চায় নিজেকে প্রায় ১২ ঘণ্টা আটকে রেখে চমকে দেন দর্শকদের। অন্যান্য জাদুকরদের তুলনায় টেলিভিশন প্রাইম টাইমে তার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এবিসি টেলিভিশনে প্রায় একঘণ্টা ব্যাপী একটি শো পরিচালনা করতেন তিনি, অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘সিক্রেটস’। অসংখ্য বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী এই জাদুশিল্পী ছোটবেলায় জাদুকরদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইতেন। ২০০৯ সালে ‘দশকের সেরা জাদুকর’ উপাধিপ্রাপ্ত ক্রিস অ্যাঞ্জেল ‘মাইন্ডফ্রিক: সিক্রেট রেভেলেশনস’ নামক একটি বইয়েরও রচয়িতা।
ডেভিড ব্লেইন
ডেভিড ব্লেইন হোয়াইট, যিনি ডেভিড ব্লেইন নামেই অধিক পরিচিত, আমেরিকান এক জাদুকর, ইল্যুশনিস্ট এবং ধৈর্যশীল শিল্পী। ধৈর্যের জন্যই তিনি বেশি বিখ্যাত এবং এক্ষেত্রে একাধিক বিশ্বরেকর্ড ভাঙার রেকর্ডও রয়েছে তার! টেলিভিশনে যেভাবে জাদুবিদ্যা উপস্থাপন করা হয়, সেখানে বেশ বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন ব্লেইন। জাদু দেখে দর্শকদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটা দেখানোই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। পারফর্মারের বদলে দর্শকসারিতে বারবার ক্যামেরা ঘুরিয়ে তিনি দর্শককে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখানোর নতুন এক পদ্ধতি প্রচলন করেন।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমের মতে, “শত বছরের পুরনো এবং গৎবাঁধা একটি ধারা থেকে বের হয়ে এসে ব্লেইন দর্শককে এমন একটি অনুভূতির সাথে পরিচিত করিয়েছেন, যা তাকে আরও শত বছর লোকমুখে বাঁচিয়ে রাখবে। একেবারেই অভিনব এই ধারণাটি সত্যিই প্রশংসনীয়। নিজের প্রচারণার জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জাদুবিদ্যারই ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন”। অপর এক খ্যাতনামা জাদুকর প্যান জিলেট বলেন ব্লেইনের প্রথম টেলিভিশন শো ‘স্ট্রিট ম্যাজিক’ দেখে বলেছিলেন, “আমাদের জীবদ্দশায় টেলিভিশন ম্যাজিকের জগতে সবচেয়ে বড় অর্জন এটি”। সরাসরি একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা দর্শকরা চোখের সামনে ঘটতে দেখা একের পর এক বিভ্রমকে কীভাবে গ্রহণ করছেন, তা দেখিয়েই দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছেন।
এই পাঁচজনই যে শুধু সেরা তেমনটা কিন্তু নয়, প্যান জিলেট, টেলর হ্যারি ব্ল্যাকস্টোন, ল্যান্স বার্টন, হ্যারি অ্যান্ডারসন, মার্ক উইলসন, স্মুদিনি, জেমস র্যান্ডি, শিন লিম এমন আরও অনেক জাদুকর এই তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য দাবিদার। বাকিদের নিয়ে নাহয় আরেকদিন লেখা যাবে।