Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেরিংকুয়ো: মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক শহর

সময়টা ১৯৬৩ সাল, তুরস্কের নেভশেহির প্রদেশ। এক ভদ্রলোক নিজের বাসা মেরামত করছিলেন। হঠাৎ বাসার একটি দেয়ালে আঘাত করতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে দেয়াল, ধ্বসে যায় মেঝে। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন মাটির নিচের অন্ধকার এক কক্ষে। কক্ষের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখতে পান দরজার ওপারের অন্ধকারে রয়েছে অজানা এক গহ্বর। ভীরু ভীরু পায়ে প্রবেশ করেন সেই গহ্বরে। সেইসাথে নিজের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন ‘ডেরিংকুয়ো’, ২,০০০ বছর পুরানো মাটির নিচের এক শহর। তার সামনে উন্মোচিত হয় মানব সভ্যতার এক অনন্য রহস্যময় শহরের প্রবেশদ্বার।

তুরস্কের নেভশেহির প্রদেশ; Source: wikimedia.org

তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়ার কাপাদোশিয়ায় অবস্থিত এই ভূগর্ভস্থ শহর ডেরিংকুয়ো। মাটির নিচে প্রায় ২৮০ ফুট গভীর এই শহরটির ছিল ১৮টি স্তর। এই স্তরগুলো জুড়ে ছিল স্কুল, গীর্জা, রান্নাঘর, গোয়াল, কবর সহ একটি সম্পূর্ণ শহর। প্রায় ২০,০০০ মানুষের বাসযোগ্য করে তৈরি করা হয়েছিল এটি। ১৯৬৩ সালে সাধারণ একটি বাড়ি মেরামতের সময় আবিষ্কৃত হয় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এ শহরটি। মানুষ খোঁজ পায় হাজার বছর লুকিয়ে থাকা রহস্যময় এক শহরের।

ডেরিংকুয়োর ইতিহাস

তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোসিয়া এলাকাটি ছিল অগ্নুৎপাতের জন্য বিখ্যাত। ৩,৩০০ ফুট উঁচু মালভূমিতে অবস্থিত এই অঞ্চল। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে এই এলাকাটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। সমস্ত এলাকা ডুবে গিয়েছিল ছাই ও লাভায়। পরবর্তীতে এই ছাই ও লাভা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় নরম শিলায়।

আগ্নেয় শিলায় গঠিত কাপাদোসিয়া অঞ্চল; Source: pinterest.com

আনাতোলিয়ার প্রাচীন অধিবাসীরা বুঝতে পেরেছিল, এই শিলা খোদাই করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব। ফলে তারা সেই নরম শিলা খুঁড়ে তৈরি করা শুরু করে ঘরবাড়ি ও আশ্রয়স্থল, মাটির নিচে তৈরি করে শহর। কাপাদোসিয়াতে মাটির নিচে এমন বহু স্থাপনা খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিশাল ও গভীর হলো ডেরিংকুয়ো।

যারা বানিয়েছিলেন এই শহর

কারা ঠিক কোন সময়ে এই শহরটি বানিয়েছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১২০০ অব্দে আনাতোলিয়ায় ছিল ‘হিত্তিতি’দের রাজত্ব। এরপর নানা দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ফলে হিত্তিতি সাম্রাজ্য ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর এই এলাকায় বলকান থেকে ‘ফ্রিজিয়ান’দের আগমন ঘটে। কেউ কেউ ধারণা করেন, ফ্রিজিয়ানদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হিত্তিতিরা ডেরিংকুয়ো নির্মাণ করেছিল। আর হিত্তিতিরা যদি এই শহর তৈরি করে থাকে, তবে তা তারা তৈরি করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগেই।

ডেরিংকুয়োর একটি গোপন প্রবেশ পথ; Source: sometimes-interesting.com

আবার আরেকদল বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মাটির নিচের এই শহর খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দের মধ্যে ফ্রিজিয়ানরাই তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে মিশরীয়, গ্রীক, আমেরিকান, সিরিয়ান লোকজনের আবির্ভাব হয় এই কাপাদোসিয়ায়। ইতিহাসে লিখিতভাবে কাপাদোসিয়ার এসব ভূগর্ভস্থ শহরের কথা সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায় গ্রীক সেনা ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের লেখায়। তিনি বহুকাল ধরে এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তার লেখা ‘অ্যানাবেসিস’ নামক বইতে তিনি লিখেছেন,

এখানকার ঘরগুলো ছিল মাটির নিচে। ঘরের প্রবেশের মুখগুলো কুয়ার মতো হলেও নিচে ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত। গবাদিপশুর যাতায়াতের জন্য ছিল সুড়ঙ্গ। তবে মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতো সিঁড়ি। ঘরগুলোতে ছাগল, ভেড়া, বাছুর সহ বিভিন্ন ধরনের পাখি পোষা হতো এবং প্রতিটি ঘরেই এদের সবার খাবারের ব্যবস্থা ছিল।

কাপাদোসিয়ার একটি ভূগর্ভস্থ শহর; Source: wikimedia.org

অনেকে মনে করেন, বাইজেন্টাইন যুগে ডেরিংকুয়োর বর্ধন ও সংস্করণ করা হয়। এই সময়ে এটি ‘মালাকোপিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টানরা মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এখানে আশ্রয় নিতো। এছাড়াও বহু জাতি বিভিন্ন দুর্যোগের সময়ে এটিকে আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করেছে।

ডেরিংকুয়োর গঠন বৈশিষ্ট্য

গবেষকদের মতে কাপাদোসিয়াতে ভূগর্ভস্থ শহরের সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে সবচেয়ে গভীর ডেরিংকুয়ো। মাটির নিচের এই শহরের খনন কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। আঠারো স্তর বিশিষ্ট এই শহরের মাত্র আটটি স্তর এখন দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।

ডেরিংকুয়োর পর্যটন ম্যাপ; Source: something-interesting.com

পাথরের নরম শিলা খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল এই শহর। শহরটি জুড়ে রয়েছে বড় বড় সুড়ঙ্গ পথ। আর এই সুড়ঙ্গ পথগুলো যুক্ত করেছে খোদাইকৃত বিভিন্ন গুহাকে। এই গুহাগুলোতে প্রায় দশ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারতো।

ডেরিংকুয়োর একটি চলাচলের পথ; Source: ancient-code.com

এসব গুহা ছাড়াও এখানে ছিল কয়েকটি উপাসনালয়, খাবারের দোকান, মদের ভান্ডার এবং স্কুল। এছাড়াও মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য ছিল কয়েকটি গোরস্থান। যতদিন না পর্যন্ত নিরাপদে মাটির উপরে গিয়ে এগুলো সৎকার করা যায়, ততদিন এগুলো মাটির নিচের গোরস্থানে সংরক্ষণ করা হতো। বিভিন্ন ঝোপঝাড়, দেয়াল ও বাড়ির উঠানের আড়ালে লুকানো ছিল প্রায় একশর মতো প্রবেশপথ। মাটির নিচের এই শহরে প্রবেশের প্রতিটি দ্বার বন্ধ করা থাকতো প্রায় ৫ ফুট চওড়া ও ৫০০ কেজি ওজনের গোলাকার পাথরের দরজা দিয়ে।

পাথরের গোলাকার দরজা; Source: historicmysteries.com

গোলাকার পাথরের এই দরজাগুলো শহরকে রক্ষা করতো নানা রকম বিপদের হাত থেকে। প্রতিটি স্তরে এগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছিল যাতে প্রতিটি স্তর আলাদা আলাদাভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায়। পুরো শহরজুড়ে বায়ুচলাচলের জন্য ছিল প্রায় কয়েক হাজার খাঁদ। এগুলোর একেকটি ছিল ১০০ ফুট গভীর।

মদ সংরক্ষণশালা; Source: historicmysteries.com

শহরের তলদেশ দিয়ে একটি নদীর প্রবাহ ছিল। গোটা শহরজুড়ে তৈরি করা হয়েছিল অনেকগুলো কুয়া। এই কুয়াগুলো সেই নদীর সাথে যুক্ত ছিল। কুয়া থেকেই সংগ্রহ করা হতো নিত্যদিনের খাবার পানি।

গবাদি পশু রাখার স্থান; Source: historicmysteries.com

আশ্রয়স্থল কিংবা বাসস্থান থেকেও বেশি কিছু ছিল এই ডেরিংকুয়ো। এটি ছিল একটি দুর্গের মতো। শত্রুর আক্রমণে শহরবাসী যখন মাটির নিচের এই শহরে আশ্রয় নিতো, তখনো এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা অন্যান্য কাজকর্ম থেমে থাকতো না। গণ জমায়েতের জন্য স্থান, মুদির দোকান, বিশাল খাবারের জায়গা এমনকি সম্পূর্ণ বাজারও ছিল এই মাটির নিচের শহরে! অস্ত্রাগারে সবসময় জমা থাকতো অস্ত্র। আর যেকোনো সময়ে এই শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ারও অনেক ব্যবস্থা ছিল এখানে।

ডেরিংকুয়োর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য

অন্য যেকোনো ভূগর্ভস্থ শহরের থেকে ডেরিংকুয়ো ছিল আলাদা। সব দিক দিয়ে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ শহর খুব কমই ছিল তৎকালীন সময়ে।

ডেরিংকুয়োর একটি গোপন প্রবেশপথ; Source: sometimes-interesting.com

ডেরিংকুয়োর তৃতীয় তলায় ছিল খিলানযুক্ত একটি পিপে আকৃতি প্রশস্ত কক্ষ। ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো এটি। প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা অংশ ছিল এই শিক্ষাকেন্দ্রের।

ডেরিংকুয়োর প্রধান কুয়া; Source: historicmysteries.com

একটি ১৮০ ফুট চওড়া খাদ শহরের প্রধান কূপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি মাটির উপর এবং নিচে উভর দিকের মানুষই ব্যবহার করতে পারতো। শহরের তৃতীয় স্তরে ছিল তিন মাইল লম্বা একটি সুড়ঙ্গ। এটি দিয়ে পার্শ্ববর্তী ভূগর্ভস্থ শহর ‘কায়ামাকলি’তে যাওয়া যেত। এই পথটি বর্তমানে ভূমিধ্বসের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

ডেরিংকুয়োর পার্শ্ববর্তী ভূগর্ভস্থ শহর; Source: pinterest.com

বৈরী আবহাওয়া থেকেও সুরক্ষা দিতে এই ডেরিংকুয়ো। প্রচন্ড গরম কিংবা তীব্র ঠান্ডা ও তুষারপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতো এই শহর। উপরে যখন তীব্র গরম কিংবা শীত, নিচের এই শহরে তখন বিরাজ করতো আরামদায়ক আবহাওয়া। ফলে পশুপাখি কিংবা খাদ্যদ্রব্য খুব সহজে সংরক্ষণ করা যেত এই শহরে।

ডেরিংকুয়োর বর্তমান অবস্থা

মাটির নিচের রহস্যময় শহর ডেরিংকুয়ো ১৯৬৯ সাল থেকে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যদিও গোটা শহরের মাত্র ১০ ভাগ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আগত পর্যটকরা প্রতিনিয়ত মানব সভ্যতার এই অনন্য নিদর্শন দেখতে যান। মাটির নিচের এই শহরে প্রবেশ করলে আপনিও চলে যাবেন সেই হাজার বছর আগের এক নগরীতে। পাথুরে দেয়াল স্পর্শ করলে অনুভব করবেন গা শিরশিরে এক অনুভূতি, যা আপনাকে মনে করিয়ে দিবে হাজার হাজার বছর আগের এই শহরে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর কথা!

ফিচার ইমেজ: wikimedia.org

Related Articles