Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সৌদি রাজপরিবারের দামী অলংকার চুরির রোমাঞ্চকর কাহিনী

সৌদি আরবে তখন প্রায় দুই লাখ থাইল্যান্ডের নাগরিক কাজ করে। ১৯৮৯ সালের দিকে একটি দেশের প্রায় দুই লাখ মানুষ বিদেশে কাজ করার বিষয়টিকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। সৌদি আরবে কর্মরত দুই লাখ থাই নাগরিকের পাঠানো বিশাল অংকের রেমিট্যান্স থাই অর্থনীতিতে বিরাট ইতিবাচক অবদান রাখতো। নিম্নমানের থাকার পরিবেশ, উষ্ণভাবাপন্ন আবহাওয়া, প্রতিকূল কর্মক্ষেত্রের মতো চ্যালেঞ্জ থাকলেও দিনে দিনে সৌদি আরবের থাই নাগরিকদের উপস্থিতি শুধুই বাড়ছিল। এদিকে তূলনামূলক কম বেতনে থাই নাগরিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে সৌদি আরবের ধনী পরিবারগুলোরও সুবিধা হচ্ছিল।

ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং ছিলেন সেই সময়ের দুই লাখ থাই নাগরিকের মধ্যে একজন। ভাগ্যের অন্বেষণে আর্থিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে আরও অসংখ্য মানুষের মতো তিনিও সৌদি আরবে পা রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সৌদি রাজপ্রাসাদে একজন পরিষ্কারকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। নিষ্ঠার সাথে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।

নয়নসনসব
সৌদি প্রিন্স ফয়সালের প্রাসাদে কাজ করা তেমোচাংয়ের কাছে রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার ছিল;
image source: scmp.com

পরিস্কারকর্মী হিসেবে রাজপ্রাসাদের একেবারে অভ্যন্তরে প্রতিদিন প্রবেশ করতে হতো তাকে। একসময় তেমোচাং আবিষ্কার করেন, রাজপ্রাসাদের সৌদি প্রিন্সের শোবার ঘরের যে অংশে বহুমূল্য ও দুর্লভ অংকারগুলো রয়েছে, সেখানে শক্ত কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। সেই সাথে বেশিরভাগ সময় সৌদি প্রিন্সের শোবার ঘরে প্রবেশ করতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। এদিকে তিনি যেখানে থাকতেন, সেখানে অন্যান্য থাই নাগরিকদের সাথে জুয়ায় হেরে বেশ বড় অংকের ঋণ হয়ে গিয়েছিল তার। সৌদি আরবের আবহাওয়া, বিরক্তিকর ও একঘেয়ে জীবন– সব মিলিয়ে তেমোচাং আবার নিজ দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ঋণ শোধ করে দিয়ে বড় অংকের অর্থ নিয়ে থাইল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তার কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। কারণ তার কাজের ধরন বিবেচনায় নিলে হুট করে বিশাল অর্থ কামানোর কোনো উপায় নেই। তাই তার মাথায় খারাপ চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করে।

সৌদি প্রিন্স প্রায় তিন মাসের জন্য বিদেশে অবকাশযাপনে গেলেন। রাজপ্রাসাদ পুরো ফাঁকা। পরিষ্কারকর্মীদের তারপরও কাজের খাতিরে নিয়মিত প্রবেশ করতে হয় রাজপ্রাসাদের ভেতরে। ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চাইলেন। সৌদি আরবে চুরি করার জন্য অঙ্গচ্ছেদের মতো ভয়ংকর শাস্তি দেয়া হতে পারে, এটি জানার পরও সেদিকে পা বাড়ালেন তিনি।

সৌদি প্রিন্স ছুটিতে থাকা অবস্থায় একদিন সন্ধ্যাবেলা একটি অজুহাতে দিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন তেমোচাং। সবাই বের না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকলেন। একসময় সবাই রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসলেও তিনি কাজের অজুহাতে থেকে গেলেন, সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। বেশ ঝক্কিঝামেলা পোহানোর পর অবশেষে সৌদি প্রিন্সের শোবার ঘরে প্রবেশ করতে সক্ষম হন তিনি। এবার কাজ শুধু ঠিকমতো অলংকারগুলো নিয়ে নিরাপদে তিনি যেখানে রাতে ঘুমান, সেখানে ফিরে আসা।

সৌদি প্রিন্সের ভল্টে এত পরিমাণ অলংকার ও দামী জিনিসপত্র ছিল যে, তা একবারে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল না। সব একসাথে নিয়ে বের হলে প্রিন্সের রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়তে হতো নিশ্চিত। তাই ঝুঁকি এড়াতে তেমোচাং অভিনব উপায় অবলম্বন করলেন। তিনি প্রিন্সের শোবার ঘরে প্রবেশের সময় সাথে আঠালো টেপ নিয়েছিলেন, যাতে শরীরের সাথে টেপ দিয়ে লাগিয়ে অলংকারগুলো রাজপ্রাসাদের বাইরে আনা যায়। তাছাড়া পরিষ্কার করার জন্য ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যাগ তো ছিলোই। সব অলংকার একসাথে না এনে তেমোচাং রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন জায়গায় মূল্যবান অলংকার ও রাজকীয় জিনিসপত্রগুলো লুকিয়ে রেখে দেন, যাতে পরিষ্কার করতে যাওয়ার কারণে প্রতিদিন অল্প অল্প করে সেগুলো এনে রাখা যায়। তার এই পরিকল্পনা খুবই ফলপ্রসূ হয়। ঘুণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করেনি যে ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং রাজপ্রাসাদের বহুমূল্য অলংকার চুরির সাথে জড়িত রয়েছেন! পুরো একমাসে ধীরেসুস্থে তেমোচাং প্রায় ত্রিশ কেজি দামী অলংকার ও দুর্লভ রাজকীয় জিনিসপত্র রাজপ্রাসাদ থেকে তার থাকার জায়গায় নিয়ে আসেন, যেগুলোর সেই সময়ের বাজার মূল্য ছিল দুই কোটি ডলারেরও বেশি।

য়ননসনসবসসব
ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং– সৌদি অলংকার চুরির নাটের গুরু; image source: bbc.co.uk

সৌদি প্রিন্স অবকাশযাপন থেকে ফেরার আগেই ক্রিয়াংকাই তেমোচাং কার্গো বিমানে করে একটি বড় লাগেজে ত্রিশ কেজি ওজনের সমস্ত অলংকার ও জিনিসপত্র থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। আর কিছুদিন পর তিনিও কাজে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসার জন্য সৌদি বিমানবন্দর থেকে রওনা দেন।

কিন্তু সমস্যা থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টের কর্তৃপক্ষকে নিয়ে। এত বেশি ওজনের লাগেজ দেখতে পেলে স্বাভাবিকভাবেই তারা চেক করবে। তাই রাজপ্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে থেকে সৌদি এয়ারপোর্টের কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে পারলেও নিজ দেশের এয়ারপোর্টে ধরা পড়ে গেলে সমস্ত পরিশ্রম পন্ড হয়ে যাবে। সৌদি আরবে গমনের কারণে থাইল্যান্ডের এয়ারপোর্টের সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমোচাংয়ের ভালো জানাশোনা ছিল। তেমোচাং জানতেন, ঘুষের মাধ্যমে থাই এয়ারপোর্টের কর্মকর্তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তিনি তার অলংকারের লাগেজের সাথে একটি খামের ভেতর বেশ বড় পরিমাণের অর্থ রেখে দিয়ে একটি চিরকুটে লিখেছিলেন, লাগেজের ভেতর ‘পর্নোগ্রাফিক ম্যাটেরিয়াল’ রয়েছে, বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সেগুলো যাতে চেক করা না হয়। থাই বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা তার দেয়া টোপ গ্রহণ করে।

ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং জানতেন তিনি ধরা পড়বেন। এজন্য থাইল্যান্ডে ফিরে দ্রুত সব অলংকার লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করতে থাকেন। এরই মধ্যে সৌদি আরবে এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সৌদি পুলিশের সন্দেহের তীর চলে যায় তেমোচাংয়ের দিকে। সৌদি পুলিশের অনুরোধে ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে থাইল্যান্ডের লাম্পাং প্রদেশে নিজ বাড়ি থেকে তেমোচাংকে গ্রেফতার করে থাই পুলিশ। তার দেয়া তথ্য অনুসারে তদন্ত চালিয়ে অনেক অলংকার উদ্ধার করা হয়। সেগুলো ঠিকঠাকমতো সাজিয়ে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

য়ননসননসন
সৌদি কর্তৃপক্ষের হুশিয়ারিতে থাই পুলিশ চুরি হওয়া অসংখ্য অলংকার উদ্ধার করে;
image source: knowhow.pp.ua

থাইল্যান্ডের পুলিশের উদ্ধার করা অলংকার ও দামী জিনিসপত্র সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়ার পর আবার নতুন কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে। সৌদি আরব দাবি করে, ৮০% চুরি হওয়া অলংকার ও জিনিসপত্র পাঠানো হয়নি। আর যেগুলো পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশ হচ্ছে নকল রেপ্লিকা। অর্থাৎ আসল অলংকারগুলো সরিয়ে রেখে নকলগুলো সৌদি আরবের কাছে পাঠানো হয়েছে। এদিকে বেশ কিছু ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়, যেখানে দেখা যায় কিছু উচ্চপদস্থ থাই কর্মকর্তার স্ত্রীর গলায় যে নেকলেস রয়েছে, তাতে সৌদি আরবের চুরি হওয়া অলংকারের মিল রয়েছে। সৌদি আরব দাবি করে, তাদের চুরি হওয়া অলংকারগুলোর মধ্যে পঞ্চাশ ক্যারেটের নীল রঙের একটি হীরের টুকরা ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরো পৃথিবীতে এত বড় নীল হীরের টুকরো আর দ্বিতীয়টি নেই। এছাড়াও আরও অনেকগুলো দুর্লভ দামী জিনিসের অনুপস্থিতির কথা বলা হয়। এই ঘটনায় সৌদি আরব চরম ক্ষিপ্ত হয়ে হয়ে ওঠে। সৌদি রাজপরিবার তদন্তের জন্য তিনজন কূটনীতিক, যারা আগে থেকেই থাইল্যান্ডে কর্মরত ছিলেন ও একজন ব্যবসায়ী যিনি সৌদি রাজপরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ, মোট চারজনকে দায়িত্ব দেয়।

তদন্তের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দুজন সৌদি কূটনীতিক গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা তাদের হত্যা করে। আরেকজনকে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরেই হত্যা করা হয়। তদন্ত করতে যাওয়া চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যবসায়ী। মোহাম্মদ আল-রুয়াইলি নামের সেই ব্যবসায়ীকে কয়েক সপ্তাহ পরে অপহরণ করা হয়। আজও তাকে পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা করা যায়, বাকি কূটনীতিকদের মতো তাকেও হত্যা করা হয়েছে।

য়ননসনসনসন
সৌদি কূটনীতিক মোহাম্মেদ সাইদ খোজার ভাষ্যে থাই পুলিশের অপকীর্তিগুলো সম্পর্কে জানা যায়; image source: minews.id

২০১০ সালে উইকিলিক্সের একটি ফাঁস হওয়া একটও মার্কিন কূটনৈতিক নোটে দেখা যায়, মার্কিনিরা দাবি করছে সৌদি কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের হত্যার পেছনে হিজবুল্লাহ দায়ী। অর্থাৎ লেবাননের শিয়া মুসলিমদের সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সুন্নী সৌদি আরবের যে দ্বন্দ্ব তার জের ধরেই হত্যা করা হয় সৌদি কূটনীতিকদের। কিন্তু পরবর্তীতে থাইল্যান্ডের পাঠানো একজন সৌদি কূটনীতিকের ভাষ্যে হত্যার নেপথ্যের কারণ জানতে পারা যায়। মোহাম্মেদ সাইদ খোজা নামের সেই সৌদি কূটনীতিকের মতে, থাই পুলিশই হত্যাকান্ডগুলো ঘটিয়েছে। তার দাবি থেকে জানা যায়, থাই পুলিশ সৌদি রাজপরিবারের অলংকার উদ্ধারের পর নিজেরা সেগুলো রেখে দিয়ে সেগুলোর নকল রেপ্লিকা সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এসব বিষয় সম্পর্কে তদন্ত করতে আসা সৌদি কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরা জেনে যাওয়ার থাই পুলিশের অপকর্ম ফাঁসের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই পরবর্তীতে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের মাধ্যমে ও অপহরণের মাধ্যমে তাদেরকে চিরতরে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। থাই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের গলায় থাকা নেকলেসের সাথে সৌদি আরবের হারানো অলংকারের মিল থাকায় এই দাবি আরও জোরালো ভিত্তি লাভ করে।

সৌদি রাজপরিবারের অলংকার চুরি ও পরবর্তীতে সৌদি কূটনীতিক হত্যা ও ব্যবসায়ী অপহরণের মতল ঘটনাগুলোর জন্য সৌদি আরব ও থাইল্যান্ডের সম্পর্ক তলানিতে নেমে আসে। ১৯৯০ সালের দিকে যেখানে প্রায় দুই লাখ থাই নাগরিক সৌদি আরবে কর্মরত ছিল, সেখানে ২০০৮ সালে সংখ্যাটি নেমে আসে পনের হাজারে। এর ফলে থাইল্যান্ডের অর্থনীতি বড় ধরনের আঘাত পায়। পাল্টা আক্রমণ হিসেবে থাইল্যান্ডেও সৌদি নাগরিকদের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এখনও সৌদি আরবের সরকার তাদের নাগরিকদের থাইল্যান্ড ভ্রমণের বিরুদ্ধে নিরুৎসাহিত করে আসছে। আর যে পরিষ্কারকর্মী ক্রিয়াংক্রাই তেমোচাং নাটের গুরু হিসেবে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি করেছিলেন, তাকে থাই আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে জেলখানায় ভালো ব্যবহার ও অনুতপ্তবোধের জন্য তিন বছর সাজা খাটার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

Related Articles