প্রথম পর্ব: অ্যাডলফ বনাম রুডলফ: ঐতিহাসিক যে দ্বন্দ্বে জন্ম নিয়েছিল বিখ্যাত অ্যাডিডাস ও পুমা
ভাগ হয়ে গেল এককালে দুই সহোদর অ্যাডলফ ও রুডলফ ড্যাজলারের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠান Gebrüder Dassler Schuhfabrik, বিভক্ত হয়ে গেলো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো: প্রাতিষ্ঠানিক এ বিভক্তি চূড়ান্ত বিভেদ টেনে ছিল তাদের দুই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্যান্যদের মাঝেও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বোন মেরি চেয়েছিলেন তার দুই ছেলেও যাতে ভাইদের এ কোম্পানিতে চাকরি করে। তবে সেই প্রস্তাব আমলে নেননি রুডলফ। পরিবারের সদস্যদের মাঝে আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার সূত্রপাত এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলে মেরির দুই ছেলে যুদ্ধে চলে যায়। এরপর আর কখনোই ফিরে আসে নি তারা। এজন্য তিনি কোনোদিনই রুডলফকে ক্ষমা করতে পারেন নি। তাই তিনি থাকতে শুরু করেন অ্যাডলফের পরিবারের সাথে। ওদিকে তাদের বাবা মারা গিয়েছিলো আগেই। বড় ছেলের প্রতি আলাদা টান ছিলো মা পলিনার। তাই আমৃত্যু তিনি তাদের সাথেই কাটিয়ে দেন।
সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে অনেক দর কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে তা সম্পন্ন হয়। এর কিছুদিন পরই নিজের কোম্পানির জন্য নাম নিবন্ধন করাতে যান অ্যাডলফ। নিজের নামের দুই অংশ Adolf ও Dassler-কে একত্রিত করে তিনি নাম ঠিক করেন ‘Addas’। কিন্তু এ নামে আগে থেকেই আরেকটি শিশুদের জুতা তৈরির প্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করা ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি ‘Adidas’ নামটিকে বেছে নেন।
ছোট ভাইয়ের দেখাদেখি বসে থাকেন নি রুডলফও। তিনিও ভাইয়ের মতোই নিজের নামের দুই অংশ ‘Rudolf’ ও ‘Dassler’ এক করে নতুন কোম্পানির নাম দেন ‘Ruda’। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এটি পাল্টে নতুন নাম রাখেন ‘Puma’, কারণ পুমা নামটাই তার কাছে বেশি খেলোয়াড়সুলভ মনে হয়েছিল।
ওদিকে দুই ভাইয়ের বিবাদকে কেন্দ্র করে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় গোটা হার্জোগেনোরাখ শহরও। অরাখ নদীর বিপরীত দুই তীরে ছিলো অ্যাডিডাস ও পুমার কারখানা। তাই নদীর দুই তীরে বাস করতো দুই দলের লোকেরা। শহরের অধিকাংশ লোকই হয় অ্যাডিডাস, নয়তো পুমাতে চাকরি করতো। তাই শহরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিলো অনেকটা দুই ভাইয়ের ব্যবসার দ্বারাই।
দু’দলের মাঝে বিবাদ কোন পর্যায়ে গিয়েছিলো তা শুনলে অনেকের হাসিও পেতে পারে। স্থানীয় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমন ছিলো যারা শুধু পুমা কিংবা শুধু অ্যাডিডাসে চাকরি করা লোকদের কাছেই পণ্য বিক্রি করতো। এক কোম্পানিতে চাকরি করা পরিবারের সাথে অন্য কোম্পানিতে চাকরি করা কারো বিয়ে করা ছিলো নিষিদ্ধ! এমনকি শহরটির লোকেরা অপরিচিত কারো সাথে কথা বলার আগেও ঘাড় নিচু করে দেখে নিতো সে কোন কোম্পানির জুতা পড়ে আছে। যদি প্রতিপক্ষের জুতা পায়ে থাকতো, তাহলে তার সাথে কথাই বলতো না তারা! এজন্য এক পর্যায়ে শহরটির নাম হয়ে যায় ‘ঘাড় বাঁকানোদের শহর’।
দেখতে দেখতে একসময় চলে আসলো ১৯৫৪ সাল, আরেকটি ফুটবল বিশ্বকাপের বছর। জার্মানির ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে সেই সালটি। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেই ফুটবল বিশ্বকাপটি অনেক দিক থেকেই ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে। প্রথমত, টেলিভিশনে সম্প্রচারিত প্রথম বিশ্বকাপ ছিলো সেটিই। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সেবারই জার্মানি বিশ্বকাপ ফুটবলে ফিরে আসে।
অন্য দিক দিয়েও বেশ গুরুত্ব ছিলো এ বিশ্বকাপের। মাত্র কয়েক বছর আগে নতুন করে যাত্রা শুরু করা অ্যাডিডাস ও পুমা যেমন নিজেদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলো, ঠিক তেমনি তাদের টেক্কা দিতে হচ্ছিলো অন্যান্য জুতার কোম্পানিগুলোর সাথেও। বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশেই জার্মানিতে তৈরি পণ্য ব্যবহারকে স্বদেশপ্রেমবিরোধী বলে মনে করা হতো। এ বিশ্বকাপটি তাই ছিলো খেলাধুলা ও বাণিজ্যিক সব দিক দিয়েই জার্মানদের নতুন করে ফিরে আসার এক বৈশ্বিক মঞ্চ।
সেই বিশ্বকাপে জার্মান ফুটবল দলটির ম্যানেজার ছিলেন সেপ হারবার্জার। রুডলফ ড্যাজলারের সুবাদে ড্যাজলার ভাইদের সাথে তার আগে থেকেই খাতির ছিলো। আর তখন ফুটবল বুটের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডিডাসের চেয়ে গুণগত দিক দিয়ে এগিয়ে ছিলো পুমাই। সেপ আর রুডলফের মধ্যকার এক ঝামেলাই পাল্টে দেয় সব হিসাবনিকাশ। ঠিক কী বিষয়ে তাদের মাঝে ঝামেলা বেঁধেছিল সেই সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া মুশকিল। তবে অনুমান করা হয় যে জার্মান খেলোয়াড়দের পুমার বুট ব্যবহার নিয়ে দর কষাকষিতেই বাধে সেই গণ্ডগোল।
সেপ আর রুডলফের দ্বন্দ্বের সেই সুযোগটা পুরোপুরিই কাজে লাগিয়েছিলেন অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডলফ ড্যাজলার। সেই বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের জুতা পরেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ট্রফি নিজেদের ঘরে তুলে নেয় পশ্চিম জার্মানি। কিংবদন্তিতুল্য ফেরেঙ্ক পুসকাসের নেতৃত্বাধীন হাঙ্গেরির কাছে প্রথম ১০ মিনিটেই ২-০ গোলে পিছিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। তবুও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতে যায় তারা।
বৃষ্টি ভেজা মাঠে অ্যাডিডাসের জুতায় ব্যবহৃত ‘Screw in Studs’ প্রযুক্তি জার্মানদের জয়ের পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন প্রচলিত Leather Stud এর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিলো এই প্রযুক্তি। এর মূল কৃতিত্ব দেয়া হয় অ্যাডিডাসকে। তবে পুমা এ প্রযুক্তিটি তাদের উদ্ভাবন বলে দাবি করে থাকে। তাদের মতে, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি জুতাই ১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে ‘হ্যানোভার ৯৬’ ক্লাবকে জার্মান চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে সহায়তা করেছিলো।
সত্যিকারের উদ্ভাবক যে-ই হোক না কেন, সবাই মনে রাখলো অ্যাডলফ ড্যাজলারের অ্যাডিডাসকেই। সারা বিশ্ব অ্যাডিডাসকে চিনলো বিশ্বকাপজয়ী দলের ফুটবল বুট হিসেবে। অ্যাডলফ ও তার অ্যাডিডাসকে নেয়া হলো জার্মান ফুটবলের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে। টিম ম্যানেজার হার্বার্জারের সিটের ঠিক পরেই অ্যাডলফের জন্য একটি সিটও নির্ধারিত রাখা ছিলো! ১৯৫৪ সালের সেই বিশ্বকাপজয়ের ফলস্বরুপ আজও জার্মান ফুটবল দলের সাথে যুক্ত আছে অ্যাডিডাস।
এরপর একে একে কেটে গেল ষোলটি বছর। ১৯৭০ সালের কথা। বাহাত্তর বছর বয়সী রুডলফ ড্যাজলারের ছেলে আরমিনই তখন কোম্পানির বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। সেই বছরই তিনি কোম্পানির করণীয় সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন এবং পুমাকে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেন।
খেলোয়াড়দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি করার ব্যাপারটি তৎকালে বেশ ঝামেলারই ছিল। নানান ঝক্কিঝামেলা পেরিয়েই সারতে হতো সেসব চুক্তি। আর যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্যাপারে দুটো কোম্পানি একই ব্যক্তির সাথে চুক্তি করতে চাইতো, তাহলে একে অপরের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে খরচের মাত্রাটা হয়ে যেতো আকাশচুম্বী।
হাল আমলের মেসি-নেইমার-রোনালদোর মতো সেই সময়ের ফুটবলের জগতে পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন পেলে। তাই কোনো ব্যাপারে তার সাথে চুক্তি করতে পারা ছিলো একটি কোম্পানির জন্য আসলেই বিশেষ কিছু। আর অ্যাডিডাস ও পুমা যদি একইসাথে পেলের বুটের স্পন্সর হওয়ার লড়াইয়ে নামে, তাহলে তাদের প্রতিযোগিতা যে অনেক দূর গড়াবে, সেই কথা তো না বললেও চলে। তাই ড্যাজলার ভ্রাতৃদ্বয়ের কোম্পানিদুটো নিজেদের মাঝে এক অদ্ভুত চুক্তিতে আবদ্ধ হলো। ‘দ্য পেলে প্যাক্ট’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক সেই চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি দুটো এই সিদ্ধান্তে আসলো যে, তাদের কেউই পেলের সাথে কোনোরুপ চুক্তি করবে না!
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে যেমন লাভবান হয়েছিলো অ্যাডিডাস, তেমনি পেলে প্যাক্ট থেকে লাভ ঘরে তুলেছিলো পুমা। এজন্য অবশ্য তাদেরকে ছলচাতুরীর আশ্রয়ও নিতে হয়েছিল। সেই গল্পই শোনাচ্ছি এখন।
পেলেকে নিয়ে অ্যাডিডাস ও পুমার চুক্তি হয় ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে। এরপর পুমা তাদের এজেন্ট পাঠিয়ে ব্রাজিল দলের সব ফুটবলারের সাথেই চুক্তি করে নেয়, বাদ থাকেন শুধু পেলে! বেচারা পেলে আশ্চর্য হয়ে শুধু দেখতেন যে, পুমার প্রতিনিধি হ্যান্স হেনিংসন দলের সবাইকে নিজের কোম্পানির জুতা পরাতে কতভাবেই না মন গলানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার দিকে একটিবারের জন্য ফিরেও তাকাচ্ছেন না!
তবে হেনিংসন কিন্তু বসে থাকেন নি। পেলেকে নিয়ে ঠিকই তিনি মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন, আর তা ছিলো পুমা কর্তৃপক্ষের অগোচরেই। তিনি প্রথমেই গোপনে পেলের সাথে একটি চুক্তি সেরে নেন। এরপর আরমিনের সাথে আলোচনা করে তিনি অনেক কষ্টে তাকে রাজি করান। কী ছিল সেই চুক্তিতে?
১৯৭০ বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে পেলেকে ২৫,০০০ ইউএস ডলার এবং পরবর্তী চার বছর মিলিয়ে ১,০০,০০০ ইউএস ডলার দিতে রাজি হয় পুমা। চুক্তির একটি অংশ ছিলো বেশ অদ্ভুত। তাকে শর্ত দেয়া হয়েছিলো যে, কিক অফের আগে কিছুক্ষণ সময় চেয়ে নিয়ে তাকে নিজের পুমা বুট জোড়ার ফিতা বাঁধতে হবে। এতে করে সব ক্যামেরা তখন তার জুতার দিকে ফোকাস করবে! ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে এই কিংবদন্তীর জুতার ব্র্যান্ড সম্পর্কে!
চুক্তির শর্তানুযায়ী ঠিক সেটাই করলেন পেলে। কিক অফের ঠিক আগ মুহূর্তে রেফারির কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়ে নিজের জুতার ফিতাগুলো বাঁধলেন তিনি, পূরণ হলো পুমার উদ্দেশ্য। পরের সময়টা ছিলো পুমার কাছে কেবলই রুপকথার নামান্তর। সেই বিশ্বকাপে পেলের ব্রাজিল ৪-১ গোলের ব্যবধানে ইতালিকে উড়িয়ে দিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা নিজেদের করে নিলো। পেলের সুপারস্টার খেতাবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যবসার পালেও নতুন হাওয়া লাগালো পুমা। তাদের বিক্রিও তখন বেড়ে চলল দ্রুত গতিতেই।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বিবাদ মেটেনি দুই সহোদরের। ১৯৭৪ সালে বড় ভাই রুডলফ ড্যাজলার ও ১৯৭৮ সালে ছোট ভাই অ্যাডলফ ড্যাজলারের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটে কয়েক দশক ধরে চলা এ বিবাদের।