Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেন কিছু কিছু দেশে রাস্তার বাম দিয়ে এবং কিছু কিছু দেশে ডান দিয়ে গাড়ি চলে

জেনে হয়তো অবাক হবেন, বর্তমানে পুরো বিশ্বের মাত্র ৩৫% দেশে হাতের বাম দিয়ে গাড়ি চালানোর নিয়ম। বামে গাড়ি চালানো দেখাই যায় মূলত ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর কয়েকটি দেশে। তবে ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশসহ আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই দেখা যায় রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাতে। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন একেক দেশে একেক দিক দিয়ে গাড়ি চালানোর নিয়ম এবং সে দেশগুলোতে কিভাবেই এই নিয়মটি চালু হলো? আসুন তা দেখা যাক।

এক পাশ থেকে অপর পাশে চলার আইন চালু করলে জনজীবনে প্রথমে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়; Source: Wikimedia.org

ভিন্ন ভিন্ন দেশ এবং সময় অনুযায়ী এই পার্শ্ব বাছাই করার উৎসের মধ্যেও ভিন্নতা রয়েছে। তবে প্রাচীনকালে প্রায় সবখানেই হাতের “বামে চলা” নিয়ম চালু ছিল। মাত্র ক’দিন হলো মানুষ হাতের “ডানে চলা” নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হয়েছে। রাস্তার বামে বা ডানে থাকার নিয়মের প্রথম যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে তার উৎপত্তি হলো রোমান সম্রাজ্যে। যেহেতু রোমান আমলে পুরো ইউরোপ জুড়েই রাস্তাঘাট এবং মাল ও যাত্রীবাহী বাহনের সমাহার ছিল সেহেতু তাদের এমন কিছু নীতিমালার বাস্তবায়নেরও প্রয়োজন ছিল যাতে রাস্তায় মানুষ এবং যানবাহন চলার ব্যবস্থাটা সুষ্ঠ থাকে। প্রত্নতাত্ত্বিক যে প্রমাণগুলো পাওয়া গিয়েছে তা রোমানদের রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলাটাই নির্দেশ করে। যদিও সঠিকভাবে জানা যায় না কেন তারা বাম দিকটাই বেছে নিয়েছিলেন তবে তাদের এই “বামে চলা” নিয়মটাই যে সব জায়গায় প্রায় মধ্যযুগ পর্যন্ত চালু ছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

রোমান সম্রাজ্যে হাতের বামে দিয়ে চলা হতো; Source: penn.museum

মধ্যযুগ পর্যন্ত রাস্তায় চলাচল করাটাও নিরাপদ ছিল না সেভাবে। কারণ রাস্তার সামনে দিয়ে আসা ব্যক্তি বা দলের ব্যাপারে সব সময় সজাগ এবং রক্ষণাত্মক মনোভাবে থাকা লাগতো। ইতিহাসবিদগণ বলেন, রাস্তার বামে দিয়ে চলাচলের রীতিটা আসলে অসিযোদ্ধা এবং অশ্বারোহী যোদ্ধাদের থেকে আসে। যেহেতু পূর্বে প্রায় সকলেই ডানহাতি ছিলেন এবং তলোয়ারের খাপটা বাম পাশে থাকার কারণে সেখান থেকে তলোয়ার বের করে নিজের শক্তিশালী ডান হাত দিয়ে শত্রু মোকাবেলা করা সহজ ছিল। তাদের এই বাম ঘেষা স্বভাবের আরেকটি কারণ ছিল যাতে তাদের তলোয়ারের খাপটি অন্য কাউকে আঘাত না করে। আর বাম ঘেষে চলার ফলে যদি কখনো রাস্তায় যেতে যেতে কোনো বন্ধু বা পরিচিত কারো সাথে দেখাও হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তার সাথে ডান হাত দিয়ে করমর্দন করাও সহজ ছিল।

ডানহাতী অশ্বারোহী যোদ্ধারা বাম দিকে সরে থাকতেন যাতে তাদের ডান হাত শত্রুর নিকটে পৌছায়; Source: enki.ua

তাছাড়াও একজন ডানহাতির জন্য ঘোড়ার বাম দিক দিয়ে আরোহণ এবং নিচে নামাও সহজ। দেহের ডানদিকে তলোয়ারের খাপ থাকলে সেটা শুধু ঝামেলাপূর্ণই হতো। পাশাপাশি রাস্তার ডান পাশের তুলনায় বামেই ঘোড়ায় চড়া বা নামাটা নিরাপদ ছিল। যেহেতু ডান পাশটা বিভিন্ন বাহন এবং মানুষে পূর্ণ থাকতো। তাই কেউ বাম দিক দিয়ে ঘোড়ায় আরোহণ করলে তার ক্ষেত্রে বাম দিকে দিয়েই ঘোড়া চালানোটা যুক্তিযুক্ত ছিল।

এই “বামে চলা” রীতিটা এতটাই প্রচলিত ছিল যে ১৩০০ সালে অষ্টম পোপ বোনিফেস এক বিধি জারী করেছিলেন যে, রোমে আগমনকারী সকল তীর্থযাত্রীকে হাতের বাম দিক দিয়েই আসতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রায় ১৭০০ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল।

সর্বপ্রথম ডানে চলার যে উৎস পাওয়া যায় তা হলো আমেরিকায় ১৮ শতাব্দীতে। আমেরিকায় তখন বড় বড় মালবাহী ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। যেহেতু গাড়িগুলোর আকার বিরাট ছিল এবং তারাই রাস্তাগুলোয় দাপট দেখিয়ে বেড়াতো সেহেতু অন্যান্য সকলকেই গাড়িগুলোর চলার নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নেয়া লাগতো। এই গাড়িগুলোর যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা হলো এখানে ৫-৭টার মতো ঘোড়া যুক্ত থাকতো। চালকের বসার জন্য নির্দিষ্ট কোন আসনও থাকতো না। যার ফলে একজন ডানহাতি চালক সবার বামে যে ঘোড়া থাকতো তার উপর বসতো এবং ডান হাতে একটা চাবুক নিয়ে একসাথে সবগুলো ঘোড়াকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো।

ওয়াগন; Source: loc.gov

এই বামে বসার ফলে তারা সামনে আগমনকারী যেকোনো যানবাহনের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে পারতো যাতে তাদের গাড়িগুলো সামনে দিয়ে আসা কোনো কিছুর সাথে লেগে না যায়। রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলার ফলে, বাম দিক দিয়ে খুব সহজেই দূরের যানবাহন সম্পর্কে অবস্থা বিবেচনা করে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা যেত। এই রীতিটাই ১৮ শতাব্দীর শেষ সময় থেকে ব্যাপক প্রচলিত হয়। এমনকি ১৭৯২ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় ডান দিক দিয়ে চলার জন্য আইনও জারী হয়। এরপর থেকে এ নিয়ম আমেরিকার সর্বত্র এবং কানাডায় ছড়িয়ে পরে।

আমেরিকায় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল শুরু হবার পর এই “ডানে চলা” রীতি পাকাপোক্ত হতে যিনি অবদান রাখেন তিনি হলেন হেনরি ফোর্ড। তার বানানো ফোর্ড “মডেল-টি” গাড়ি আসার আগে প্রচলিত গাড়িগুলোর স্টিয়ারিং হুইল ছিল ডানে, বামে, এমনকি মাঝখানেও।

ফোর্ড “মডেল-টি”; Source: upload.wikimedia.org

ফোর্ড তার এই মডেল দিয়ে বাম দিকে স্টিয়ারিং হুইল বসানোর নিয়ম পাকাপোক্ত করেন। এটার পেছনে তার যে প্রধান যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো যাত্রীরা, বিশেষ করে মহিলারা যাতে সামনের এবং পেছনের সিট থেকে নেমে রাস্তার পাশের কার্ব বা উঁচু বাধাই করা স্থানে নামতে পারেন; এবং যাতে রাস্তার কাঁদা বা নোংরা তাদের পোষাকে যেন না লাগে! ফোর্ডের এই “মডেল টি” হলো বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ি। শুধুমাত্র ১৯০৮ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্তই ১৫ মিলিয়ন ইউনিট বিক্রয় হয়েছিল। তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে, আমেরিকা মহাদেশের অধিকাংশ স্থানেই এই গাড়ির সুবাদে “ডানে চলা” রীতিটি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

তাহলে এই রীতিটা পুরো ইউরোপে কিভাবে ছড়িয়ে পরলো? ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ফ্রান্সের অবদান অনেক বেশি। তবে ফ্রান্সে কেন তাদের চিরাচরিত “বামে চলা” রীতির পরিবর্তে “ডানে চলা” রীতি চালু হয়েছিল তা পরিষ্কার নয়। অনেকে মনে করেন, ফ্রান্সের বিপ্লবীরা চান নি এমন কিছুর প্রচলন থাক যা পোপ জারী করেছিলেন। আবার অনেকে বলেন, ইংরেজদের মতো রাস্তায় চলাচলের নিয়ম তারা অনুসরণ করতে চাননি যার ফলে তাদের এই ডানে চলা রীতির প্রচলন। আবার নেপোলিয়নের জন্যও এই প্রথা চালু হয়ে থাকতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করে থাকেন। যে কারণেই চালু হোক, নেপোলিয়ন পরবর্তীতে যেসব দেশ জয় করেছিলেন তার সবগুলোতেই এই ডানে চলার প্রচলন করেছিলেন। এমনকি তার পরাজয়ের পরেও সেসব দেশ নেপোলিয়নের চালু করা এই নিয়ম মেনেই রাস্তায় চলাচল করেছে।

চিত্রে নেপোলিয়ন; Source: images.iacpublishinglabs.com

বিংশ শতাব্দীতে এই নিয়ম আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যখন জার্মানি ইউরোপের দেশগুলো শাসন করা শুরু করে। তারা একপ্রকার জোর করেই এই “ডানে চলা” রীতি চাপিয়ে দেয় তাদের অধীনে থাকা দেশগুলোর উপর।

এদিক দিয়ে ইংল্যান্ড আবার পুরোই বিপরীত ছিল। আমেরিকানদের ডান দিক দিয়ে চলার পেছনে এই যে বড় বড় মালবাহী গাড়িগুলোর অবদান রয়েছে সেগুলো কিন্তু তেমন সুবিধাই করতে পারেনি ইংল্যান্ডে, কারণ লন্ডনের রাস্তাগুলো ছিল সরু, এবং এ ধরনের গাড়ি চলার জন্য ছিল অনুপযুক্ত। তার সাথে ইংল্যান্ড কখনোই নেপোলিয়ন বা জার্মানির অধীনে ছিল না। তাই তারা তাদের শত বছরের পুরনো “বামে চলা” নিয়মটাই মেনে আসছিলো। ১৭৫৬ সালে এটাকেই আইন হিসেবে জারী করে ব্রিটেন। তারপর যত ব্রিটিশ সম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করে পুরো বিশ্বে তত এই “বামে চলা” রীতিরও প্রসার হতে থাকে। তবে জার্মানির প্রসার এবং “ডানে চলা” রীতির জনপ্রিয়তার কারণে ব্রিটেনের অধীনে থাকা অনেক দেশেই আর এই রীতির প্রচলন নেই। তবে এখনো এশিয়া মহাদেশের কিছু দেশে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলার রীতি এখনো চালু রয়েছে, যার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, জাপান ও বাংলাদেশ অন্যতম।

বামে চলার নির্দেশ; Source: http://churchm.ag

যদিও জাপান কখনোই ইংল্যান্ডের অধীনে ছিল না তবুও এর যানবাহন রাস্তার বাম দিক দিয়েই চলে। এর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৮৭২ সালে জাপানে প্রথম রেললাইনের প্রচলন হয়। এবং তাদের এই রেলওয়ে যানবাহন প্রতিষ্ঠায় ইংল্যান্ড প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সাহায্য করে। যার ফলে প্রচুর রেললাইন এবং রেলওয়ে যানবাহন যেমন ট্রেন, ট্রাম ইত্যাদির চলাচল শুরু হয়। যেহেতু ইংল্যান্ড এগুলো নির্মাণে সাহায্য করেছে এবং ইংল্যান্ডে “বামে চলা” রীতি প্রচলিত ছিল সেহেতু এসব ট্রেন, ট্রাম বাম দিক দিয়েই চলাচল শুরু করে। যার ফলে ১৯২৪ সালে জাপানে রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলার আইনও পাশ হয়ে যায়।

ফিচার ইমেজ- campbellrenaud.com

Related Articles