কোনো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাময়িকভাবে লোকেরা যখন তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে সরে আসে, তখন আমরা তাকে ‘ধর্মঘট’ বলে থাকি। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, কোনো কারখানার শ্রমিকেরা বেতনবৈষম্য ও কর্মক্ষেত্রের অনুন্নত পরিবেশের কারণে মোটেও খুশি নয়। এজন্য তারা হয়তো কারখানার কর্তৃপক্ষকে বেতনবৈষম্য দূরীকরণ ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য দাবি জানাল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মানতে নারাজ, কারণ এতে তাদের মুনাফা কমে আসবে। যৌক্তিক দাবির প্রতি কর্তৃপক্ষের এহেন অবহেলার জন্য শ্রমিকেরা যদি ঘোষণা করে বসে যে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আগপর্যন্ত তারা তাদের পেশাগত কোনো দায়িত্ব পালন করবে না, তাহলে সেটাকে ‘ধর্মঘট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে ধর্মঘট পুরো বিশ্বজুড়ে একটি পরিচিত ঘটনা।
ধর্মঘটের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, অবশ্যই শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কিছু দাবি থাকতে হয়। সেই দাবি মেনে নিতে যখনই কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে গড়িমসি করা হয়, তখন শ্রমিকরা কারখানায় কাজ বন্ধ করে দেয়। এর মাধ্যমে মালিকপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। শ্রমিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকলে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যহত হয়। এরকম অবস্থায় মালিকপক্ষ প্রতি মুহুর্তেই মুনাফা হাতছাড়া করে। যেহেতু শ্রমিক ছাড়া কারখানা অচল, তাই মালিকপক্ষ চেষ্টা করে শ্রমিকরা যেন খুব দ্রুত কাজে ফেরত যায়। এজন্য কখনও তারা হয়তো শ্রমিক-প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসে এবং তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেয়। কখনও আবার পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের মনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের পক্ষেও একটানা অনেকদিন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়, যেহেতু কারখানায় শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই তারা জীবিকা নির্বাহ করে।
১৯১৯ সালে কানাডায় শুরু হয় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্মঘট। প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার শ্রমিক কারখানা ছেড়ে রাজপথে নেমে আসে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ধর্মঘট পালন করা শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে কানাডার সরকার যে পুলিশবাহিনী নিয়োগ দেয়, তারা শেষপর্যন্ত শ্রমিকদের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে। কানাডার উইনিপেগ শহরে সেসময় অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, শহরের মেয়র পুলিশ বাহিনীকে বরখাস্ত করে যুদ্ধফেরত সৈন্যদেরকে নিয়ে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করতে বাধ্য হন। উইনিপেগ শহরের সেই বিখ্যাত ধর্মঘটে শেষপর্যন্ত শ্রমিকদেরই বিজয় হয়। কানাডার শ্রমিকসমাজ আজ যেসব অধিকার ভোগ করছে, সেগুলো আদায় করে নিতে এই ধর্মঘটের ভূমিকা অপরিসীম। শুধু কানাডাতেই নয়, এই শ্রমিক ধর্মঘটের সফলতা অনুপ্রাণিত করেছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নিপীড়িত, শোষিত শ্রমিকসমাজকে।
কানাডার উইনিপেগ শহর ১৮৮০ সালের আগে খুব বেশি পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীতে রেলপথ নির্মাণের ঘটনা শহরের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে শহরের সাথে কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের সংযোগ স্থাপিত হয়, মালামাল পরিবহন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ হয়ে আসে। কৃষি ও অন্যান্য শিল্পের প্রসারে ঘটায় শহরে অনেক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কারখানা চালাতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। এই সুযোগে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ উন্নত জীবিকার আশায় শহরে পাড়ি জমায়। যারা বাইরে থেকে এসেছিল, তারা প্রায় সবাই শহরের দক্ষিণে বসবাস করতো, যেহেতু সেগুলো তাদের কারখানার খুব কাছেই অবস্থিত ছিল। শহরের অর্থনৈতিক অকাঠামোগত সুবিধার কথা ছড়িয়ে পড়লে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুঁজিপতিরা এসে বিনিয়োগ শুরু করেন।
১৮৮১ সালে উইনিপেগ শহরে রেলপথ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারা বজায় ছিল। কিন্তু ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে শহরের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটে। যুদ্ধের জন্য মুদ্রাস্ফীতি ঘটে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায় বহুগুণ। পণ্যের দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায় বাজারের পণ্যের চাহিদা কমে যায়। লোকসান থেকে বাঁচতে ধীরে ধীরে অসংখ্য কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েন। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয় স্প্যানিশ ফ্লু। উইনিপেগ শহরে শ্রমিকরা বাস করত দক্ষিণ দিকে এবং সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল শহরের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি। স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মহামারি সবচেয়ে বেশি হানা দেয় শ্রমিকদের বসবাসের এলাকাগুলোতে। শ্রমিকদের এলাকাগুলোতে অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, জনসংখ্যার অধিক ঘনত্ব ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধির জন্য দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে।
যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য এমনিতেই কারখানাগুলো অসংখ্য শ্রমিক ছাটাই করেছিল। দেখা যায়, শুধু অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিক বাদে বাকি সবাইকেই বেকারত্ব বরণ করতে হয়। যেসব শ্রমিক বহাল তবিয়তে টিকে ছিলেন, তাদেরকেও ঠিকমতো বেতন দেয়া হতো না। যা দেয়া হতো, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকরা নতুন বেতনকাঠামো তৈরির দাবি পেশ করে মালিকপক্ষের কাছে। শ্রমিকেরা অনুরোধ করে যাতে তাদের অধিকার আদায়ের সবচেয়ে বড় সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের সাথে মালিকপক্ষ নতুন বেতনকাঠামো নিয়ে আলোচনায় বসে। কিন্তু মালিকপক্ষ ভেবেছিল পৃথকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংগঠনের সাথে আলোচনায় সুবিধা বেশি, এতে দর কষাকষির সময় তাদের শক্তি বেশি থাকে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মালিকপক্ষ আলাদা করে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। এতে শ্রমিকরা বেশ ক্ষুব্ধ হয়। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শেষমেশ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়।
১৯১৯ সালের ১৫ মে সকাল এগারোটার সময় উইনিপেগ শহরের ধাতুশিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকেরা সমস্ত হাতিয়ার ফেলে কর্মক্ষেত্র থেকে চলে আসে। এরপর অন্যান্য শিল্পের সাথে সংযুক্ত শ্রমিকেরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে, যেসব শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের তালিকায় ছিলেন না, তারাও এদের সাথে যোগ দেয়। কম বেতন, কর্মক্ষেত্রে নোংরা পরিবেশ ও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে অনাগ্রহী মালিকপক্ষের আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে উইনিপেগ শহরের প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার শ্রমিক সাধারণ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফেরত যাওয়া অসংখ্য সৈনিকও এই ধর্মঘটের ডাক দেয়া শ্রমিকদের প্রতি সংহতি জানান। সবমিলিয়ে উইনিপেগ শহরের নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের হাতে এসে পড়ে। এরপর শ্রমিকরা নিজেরা ‘স্ট্রাইক কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করে, যার মূল কাজ ছিল শহরের মানুষদের মৌলিক অধিকার দেখভাল করা এবং ধর্মঘট সঠিক পদ্ধতিতে চলছে কিনা তা যাচাই করা।
উইনিপেগ শহরের অভিজাত ব্যবসায়ীসমাজ এই ঘটনাকে মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে তাদের ব্যবসা থমকে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে শ্রমিকদের যেমন ক্ষতি হয়, সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরাও। যুদ্ধের সময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, অসংখ্য ব্যবসায়ী তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। যুদ্ধ শেষে তারা নতুন করে ব্যবসা চালুর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শ্রমিকদের ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। যু্দ্ধের কারণে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের সংকট দেখা দেয়। সেই সাথে যুক্ত হয় মুদ্রাস্ফীতি। আবার চাইলেও বেশি দামে পণ্য উৎপাদন করে বাজারে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার উপায় ছিল না, কারণ অতিরিক্ত দামের সেসব পণ্য সাধারণ মানুষ কিনতেও পারতো না। এভাবে মুনাফা অর্জন তো দূরের ব্যাপার, উৎপাদন খরচও তোলা সম্ভব ছিল না। সব মিলিয়ে সময়টা খারাপ যাচ্ছিল ব্যবসায়ীদেরও।