বলা হয়ে থাকে, একটি ছবি এক হাজার শব্দের চেয়েও মূল্যবান। হাই কোয়ালিটি ভিডিও আর থ্রিডি এনিমেশনের যুগে যখন সবার হাতে হাতেই ৮, ১৬ বা ৩২ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা বিশিষ্ট মোবাইল ফোন, তখন হয়তো আমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু আজ থেকে ১৯০ বছর আগে যখন প্রথম ছবি তোলার প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখন সেটা কী আলোড়নই না সৃষ্টি করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সর্বপ্রথম তোলা ছবি থেকে শুরু করে প্রথম যুগের ইতিহাস সৃষ্টি করা কিছু ছবি।
বিশ্বের সর্বপ্রথম ছবি
১৮২৬ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী জোসেফ নিসেফর নিয়েপ্সের তোলা এই ছবিটিকে ধরা হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম ছবি। অথবা বলা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ছবি, যেটা এখনও টিকে আছে। ধারণা করা হয়, তিনি ১৮২৫ সালে সর্বপ্রথম ছবি তোলেন, কিন্তু সেই ছবিগুলো এখন আর টিকে নেই। এই ছবিটি মূলত ফ্রান্সের লে গ্রাসে অবস্থিত তার গ্রামের বাড়ির দোতলার জানালা থেকে তোলা উঠোন এবং দূরের কিছু বিল্ডিংয়ের দৃশ্য, যদিও সেটা বোঝা খুবই কঠিন।
নিয়েপ্স এই ছবিটি তোলেন তার আবিষ্কৃত হেলিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে। হেলিওগ্রাফ শব্দটি এসেছে গ্রীক হেলিও থেকে, যার অর্থ সূর্যের আলোর সাহায্যে তৈরি ছবি। দীর্ঘদিন ছবি তোলার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণার পর নিয়েপ্স এ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তিনি টিনের সঙ্কর ধাতুর একটি পাতের উপর বিটুমেন ও পানির মিশ্রণের প্রলেপ ব্যবহার করেন এবং সেটিকে একটি যন্ত্রের মধ্যে স্থাপন করেন, যে যন্ত্রটিকে এখনকার ক্যামেরার আদিপুরুষ বলা যেতে পারে। ক্যামেরাটি তার বাড়ির জানালা থেকে বাইরের দৃশ্যের দিকে তাক করা ছিল।
প্রায় আট ঘন্টা ধরে আলো পড়ার পর যে জায়গাগুলোতে বাইরের গাছপালা এবং বাড়িঘরের প্রতিচ্ছবি পড়েছিল, ধাতব পাতের সে জায়গাগুলোর বিটুমেনের প্রলেপ ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে। শক্ত না হওয়া বিটুমেনের অবশিষ্ট অংশগুলো ল্যাভেন্ডার তেল এবং অ্যালকোহল দিয়ে তুলে ফেলে পরিষ্কার করে ফেলেন। ফলে তৈরি হয় ধাতব পাতের উপর তোলা স্থায়ী এই ছবিটি।
বিশ্বের প্রথম মানুষের ছবি
নিয়েপ্সের আবিষ্কৃত হেলিওগ্রাফিক পদ্ধতিতে ছবি ঘোলা উঠত এবং সেগুলো বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের মতো লাভজনক ছিল না। ১৮৩০ সালে নিয়েপ্সের সাথে ফরাসি চিত্রশিল্পী লুই ড্যাগারের পরিচয় হয়, যিনি নিজেও ছবি তোলার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। তারা দুজনে মিলে ছবি তোলার পদ্ধতির ব্যাপারে আরও গবেষণা করতে শুরু করেণ। নিয়েপ্সের মৃত্যুর পর ড্যাগার সিলভার আয়োডাইড পাত এবং পারদ বাষ্প ব্যবহার করে ছবি তোলা এবং ডেভেলপ করার কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতি নামে পরিচিতি পায়।
১৮৩৮ সালে ড্যাগার্ড প্যারিসের বুলেভার্দ দ্যু টেম্পলের একটি ছবি তোলেন, যাতে দুজন মানুষ ধরা পড়ে। এই ছবিটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম মানুষের ছবি। ছবির বাম দিকে নিচের কোণে দেখায় যায়, এক ভদ্রলোক তার জুতা পালিশ করাচ্ছেন। ছবিটি তুলতে মোট ৭ মিনিট সময় লেগেছিল।
যদিও সে সময় রাস্তাটি মানুষে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু সবাই চলাচল করছিল বলে তাদের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু এই ভদ্রলোক এবং জুতা পালিশকারক ছেলেটি পুরো ৭ মিনিট সময় ধরে স্থির থাকার কারণেই তাদের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
বিশ্বের প্রথম সেলফি
সেলফি শব্দটি যদিও মাত্র ২০১৩ সালে প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু সেলফি বলতে যদি বোঝানো হয় নিজের ছবি নিজে তোলা, তাহলে নিঃসন্দেহে মোবাইল ফোন আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই সেলফি তোলার প্রচলন ছিল। বিশ্বের সর্বপ্রথম সেলফিটি তুলেছিলেন মার্কিন ফটোগ্রাফার রবার্ট কর্নেলিয়াস। ১৮৩৯ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় তিনি এই সেলফিটি তোলেন।
এই ছবিটিও ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে তোলা। যেহেতু এটি তুলতে অনেক লম্বা সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, তাই কর্নেলিয়াস অন্য কাউকে অনুরোধ না করে নিজেই ক্যামেরার সামনে ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন, যার ফলাফল এই সেলফিটি।
বিশ্বের প্রথম চলমান ছবি
ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার এডওয়ার্ড মাইব্রিজের মাথায় হঠাৎ এই প্রশ্নটা জেগেছিল যে, ঘোড়া যখন দৌড়ায়, তখন কোনো মুহূর্তে কি তার চারটি পা-ই শূন্যের উপর থাকে? খালি চোখে এটা লক্ষ্য করা সম্ভব না, তাই এডওয়ার্ড চলন্ত ঘোড়ার ছবি ধারণ করার চেষ্টা করতে থাকেন। রেল ব্যবসায়ী এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক গভর্ণর লিল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড বিশ্বাস করতেন যে, ঘোড়ার চারটি পা শূন্যের উপর থাকে। কাজেই তিনি এডওয়ার্ডকে নিয়োগ করলেন সেটি প্রমাণের জন্য।
দীর্ঘ ছয় বছর পরিশ্রমের পর এডওয়ার্ড বিশেষ ধরনের ক্যামেরা তৈরি করতে সক্ষম হন, যার মাধ্যমে খুব দ্রুত ছবি তুলতে সক্ষম। ১৮৭৮ সালে এডওয়ার্ড একটি ঘোড়দৌড়ের ময়দানে ১২টি ক্যামেরা স্থাপন করেন। তিনি ঘোড়ার যাওয়ার পথে ১২টি সূক্ষ্ম তার এমনভাবে স্থাপন করেন যে, ঘোড়া যাওয়ার সময় সেগুলোর উপর টান পড়লেই সেগুলোর সাথে সংযুক্ত ক্যামেরার শাটারে চাপ পড়বে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ মুহূর্তের ছবি উঠে যাবে।
তার এ পদ্ধতিতে তিনি অতি ক্ষুদ্র সময়ের ব্যবধানে ছুটন্ত ঘোড়ার পরপর ১২টি ছবি ধারণ করেন। পরে তার বিশেষ প্রদর্শনী যন্ত্রের মাধ্যমে ঘোড়ার দৌড়ের দৃশ্যটি চালিয়ে দেখেন। ফলে দুটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়। প্রথমত, বিশ্বের প্রথম চলমান ছবি বা ভিডিও আবিষ্কৃত হয়। এবং দ্বিতীয়ত, প্রমাণিত হয় যে, ঘোড়া দৌড়ানোর সময় মাঝে মাঝেই তার চারটি পা একসাথে শূন্যে থাকতে পারে।
চাঁদের প্রথম ছবি
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ জন উইলিয়াম ডার্পার ১৮৪০ সালে সর্বপ্রথম চাঁদের এই ছবিটি ধারণ করেন। রাতের বেলা, যথেষ্ট আলো ছাড়া এ ধরনের ছবি তোলা বেশ কঠিন ছিল তখন। ফলে ছবিটি খুব বেশি পরিষ্কার ওঠেনি। পরবর্তীতে ১৮৫০ সালে ডার্পার জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম ক্র্যাঞ্চ বন্ডের সাথে মিলে ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে ভেগা নক্ষত্রপুঞ্জের একটি ছবি তোলেন, যা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার ছিল।
প্রেসিডেন্টের প্রথম ছবি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসের ছবিকে ধারণা করা হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম তোলা কোনো প্রেসিডেন্টের ছবি। ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৮৪৩ সালে, প্রসিডেন্টের ক্ষমতা ছাড়ার বেশ কয়েক বছর পরে। ছবিটি দেড় থেকে আড়াই লাখ ডলারে নিলামে বিক্রি হওয়ার কথা জানা গেছে।
এই ছবিটি মূলত সাবেক প্রেসিডেন্টের। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে প্রথম ছবি তোলা হয় ১৮৪৯ সালে, ১১তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস পোলকের। তবে জন অ্যাডামসেরও আগে, ১৮৪১ সালে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের একটি ছবি তোলা হয়েছিল, পরবর্তীতে যেটির কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।
প্রথম সংবাদের ছবি
বর্তমান যুগে ছবি ছাড়া সংবাদ কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এক সময় সংবাদ মানেই ছিল শুধু কাগজের উপর কালো কালির লেখা। সংবাদের সাথে ছবির প্রচলন শুরু হয়েছিল ১৮৪৭ সালে। ফ্রান্সে এক অপরাধীর গ্রেপ্তারের পর ড্যাগারোটাইপ পদ্ধতিতে তোলা এই ছবিটিকে বিশ্বের প্রথম সংবাদ সম্পর্কিত ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রথম রঙিন ছবি
বিশ্বের প্রথম রঙিন ছবিটি তুলেছিলেন স্কটিশ পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, যিনি তাড়িত চৌম্বক তত্ত্বের জন্যই বেশি বিখ্যাত। ১৮৬১ সালে তিনি এ ছবিটি ধারণ করেন। এটি একটি রঙিন প্যাঁচানো ফিতার (টার্টান রিবন) ছবি। ম্যাক্সওয়েল লাল, নীল এবং হলুদ ফিল্টার ব্যবহার করে মোট তিনটি ছবি তোলেন। পরে সেগুলোকে তিনি একটি ছবিতে রূপান্তরিত করেন, যাতে মূল রংগুলো পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।
আকাশ থেকে তোলা প্রথম ছবি
ড্রোন থেকে ছবি তোলা, ভিডিও করা এখন নিয়মিত ব্যাপার হলেও বিশ্বের প্রথম এরিয়াল ছবিটি কোনো ড্রোন বা প্লেন থেকে তোলা হয়নি। কারণ তখনও প্লেন আবিষ্কারই হয়নি। ১৮৬০ সালে বিশ্বের প্রথম আকাশ থেকে তোলা ছবিটি ধারণ করা হয়েছিল বেলুনে চড়ে। প্রায় ২,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে তোলা এই ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরের। ফটোগ্রাফার জেমস ওয়ালেস ব্ল্যাক ছবিটির শিরোনাম দেন ‘বোস্টন, যেভাবে ঈগল এবং বুনো হাঁস একে দেখে‘।
প্রথম ভুয়া ছবি
লুই ড্যাগার ফটোগ্রাফির জনকদের মধ্যে একজন হলেও তার সাথে দ্বন্দ্ব ছিল আরেকজন ফরাসী ফটোগ্রাফার হিপোলিট বেয়ার্ডের। তাদের মধ্যকার সম্পর্কটি ছিল অনেকটা বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন এবং নিকোলা টেসলার সম্পর্কের মতো। বেয়ার্ড নিজেও সমসাময়িক কালে ছবি তোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। ধারণা করা হয়, বেয়ার্ডই ফটোগ্রাফির প্রথম আবিষ্কারক। কিন্তু ড্যাগার তাকে ধোঁকা দিয়ে তার আগে বিজ্ঞানীদের সামনে নিজের আবিষ্কার প্রকাশ করেন, ফলে তিনি ফটোগ্রাফির প্রথম আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যান।
এই প্রতারণার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বেয়ার্ড নিজের আত্মহত্যার সংবাদ ছড়িয়ে দেন। তিনি প্রচার করেন যে, এই প্রতারণার ঘটনায় হতাশ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তার বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে তিনি পানিতে ডুবন্ত এক ব্যক্তির ছবি তোলেন এবং প্রচার করার ব্যবস্থা করেন যে, এটা তার ছবি এবং তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ১৮৪০ সালে তোলা তার এই ছবিটিই বিশ্বের প্রথম ভুয়া ছবি।
ফিচার ইমেজ- science.tamu.edu