বহু বছর আগে বানানো হয়েছে এই রোলার কোস্টারগুলো। তবুও এখনও পর্যন্ত এগুলো বেশ ভালোমতো কাজ করছে এবং মানুষ উপভোগ করছে ঐতিহাসিক এসব রোমাঞ্চকর রাইড। কোনো কোনোটি পুড়েছে আগুনে, আবার কোনো কোনোটির ডিজাইন একাধিকবার বদলানোও হয়েছে। আজকে কথা হোক সেসব রোলার কোস্টার নিয়েই।
লীপ দ্য ডিপস্ (Leap-the Dips)
পেনসিলভানিয়ার অ্যাটলুনায় অবস্থিত লেকমন্ট পার্কে রয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে পুরাতন রোলার কোস্টারটি। এই রোলার কোস্টারটির নাম ‘লীপ দ্য ডিপস্’। উত্তর আমেরিকার সাইড ফ্রিকশন রোলার কোস্টারগুলোর মধ্যে এটিই একটি, যা এখনও পর্যন্ত স্বমহিমায় বিরাজমান। ১৯০২ সালে ফিলাডেলফিয়ার ই. জয় মরিস কোম্পানি এই রোলার কোস্টারটি তৈরি করে। তারাই সেসময় ফিলাডেলফিয়ার প্রথম কোম্পানি ছিলো যারা বড় পরিসরে বিনোদন পার্কগুলোর জন্য রাইড বানাতো।
১৯৮৫ সালে ভগ্নদশায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটি চালনা করা হতো। পুনরায় চালনা করার জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রচারণা অভিযান শুরু করা হয়। তহবিলের অর্থায়নে এগিয়ে আসেন পেনসিলভানিয়ার সাধারণ জনগণ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি, ঐতিহ্যবাহী জাদুঘর কমিটি এবং স্থানীয় বিভিন্ন ব্যাংক। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে স্মারক দিবসে পুনরায় চালু হয় লীপ দ্য ডিপস্। লীপ দ্য ডিপস্ রোলার কোস্টারটির ঠিক একই জায়গায় যে রোলার কোস্টারটি ছিলো, তার নাম ‘গ্রাভিটি রেইল রোড’। ১৯০১ সালে অগ্নিকান্ডে এটি পুড়ে যাওয়ার পর তৈরি হয় লীপ দ্য ডিপস্। এই গ্রাভিটি রেইল রোডও একই কোম্পানি তৈরি করেছিলো।
৪১ ফুট (১২.৫ মিটার) উচ্চতার এই রোলার কোস্টারটির গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮ মাইল এবং পুরো ট্র্যাকটি লম্বায় ১,৪৫২ ফিট। এতে ছিলো মোট ৭টি গাড়ি এবং প্রতিটি গাড়িতেই ৪টি করে সীট। কিন্তু সাবধানতা অবলম্বনের জন্য, যেমন- গাড়িতে উঠে আরোহীদের বেল্ট বাঁধার কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরো রাইডটি সম্পন্ন করার জন্য ৮টি ট্র্যাক পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করা আছে। পুরো ট্র্যাক সিরিজটি ৯ ফুট গভীরতার ডিপস্ দিয়ে তৈরি করা বলেই এই রোলার কোস্টারটির নাম রাখা হয়েছিলো ‘লীপ দ্য ডিপস্’। এই রাইডের সময় পুরো এক মিনিট। কাঠের তৈরি এই রোলার কোস্টারটি চাকার ঘর্ষণের ফলে ট্র্যাকের উপর দিয়ে চলাচল করে। কোনো কোনো আরোহী জানিয়েছেন, অনেক সময় পেছনের চাকা ট্র্যাক থেকে সরে যায়। এখনকার রোলার কোস্টারগুলোর তুলনায় এটি কম রোমাঞ্চকর হলেও আরোহীদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা কমেনি।
রোলার কোস্টারটি স্থান করে নিয়েছে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব হিস্টোরিক প্লেসেস্’-এ। ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সিনিক রেলওয়ে (Scenic Railway)
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের সবচাইতে পুরাতন থিম পার্ক ‘লুনা’। আজ থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে তৈরি এই থিম পার্কেই রয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন রোলার কোস্টার ‘সিনিক রেলওয়ে’। এছাড়াও এটি বিশ্বের সেই ৩টি রোলার কোস্টারের মধ্যে একটি যেগুলোর মাঝে একজন ব্রেক নিয়ন্ত্রণকারী দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠের তৈরি এই রোলার কোস্টারটি পুরো ‘লুনা’ পার্ককে ঘিরে রয়েছে। পুরো রাইডটির সময় মোট ৩ মিনিট। ১৯১২ সালে তৈরি এই রোলার কোস্টারটি শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আজ অবধি বিরতিহীনভাবে চলে আসছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি ছিলো এক আকস্মিক দুর্ঘটনার এবং এই রোলার কোস্টারটির ইতিহাসে কালো অধায়। ১৯৮৯ সালে এটির লাইনচ্যুতি ঘটে এবং সেই দুর্ঘটনায় মারা যায় ২০ জন মানুষ। এরপরে এমন কিছু আর শোনা যায়নি এবং বেড়াতে আসা সকলে বেশ আনন্দের সাথেই তাদের রাইড শেষ করে থাকেন।
রাসচিবানেন (Rutschebanen)
ডাচ ভাষায় ‘রাসচিবানেন’ শব্দটির অর্থ হলো ‘রোলার কোস্টার’। রাসবিচানেন তৈরি করেন মাধ্যাকর্ষণ রাইডের জনক লা মার্কাস আদনা থম্পসন্। তিনি বরফে ঢাকা পাহাড়ে আরোহণের আদলেই বানিয়েছেন এটি। ডেনমার্কের তিভোলি গার্ডেনের এই রোলার কোস্টারটিও কাঠের তৈরি। রোলার কোস্টারটি তৈরির এক বছর পর্যন্ত ছিলো ব্যাল্টিক ফেয়ারে। এর এক বছর পরই এটিকে নিয়ে আসা হয় তিভোলি গার্ডেন। ১৯১৪ সালে তৈরি এই রোলার কোস্টারটিতে কখনো গুহা, কখনো অন্ধকার জায়গা, কখনো বেশ ঢালু বা কখনো টানেল এর ভেতর দিয়ে গিয়ে পুরো রাইডটি রোমাঞ্চকর করে তোলে। এই রোলার কোস্টারটি চালানোর জন্য এর নির্দিষ্ট একটি সিটে ব্রেকসম্যান বসা থাকে। মূলত তার কাজ হলো রোলার কোস্টারটির গতি বাড়ানো-কমানো এবং সবশেষে থামানো। তাই একেকটি রাইডে আরোহণকারীরা একেক রকম মজা পেয়ে থাকেন।
ওয়াইল্ড ওয়ান-সিক্স ফ্ল্যাগস্ আমেরিকা (Wild One – Six Flags America, Hull, MA)
কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী ‘আউট এন্ড ব্যাক’ নামের এই রোলার কোস্টারটির নকশা করেছেন বেশ কয়েকজন ডিজাইনার মিলে। ১৯১৭ সালে তৈরি এই রোলার কোস্টারের মূল ডিজাইনার ছিলেন জন এ মাইলার। পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে হারব স্কেমেক এটি পুনরায় ডিজাইন করেন। ৯৮ ফিট উঁচু এই রোলার কোস্টারে একসাথে মোট ২৪ জন বসতে পারে। ২ মিনিটের এই রাইডটির গতিবেগ ঘণ্টায় ৫৩ মাইল। ওয়াইল্ড ওয়ানের আগের নাম ছিলো জায়ান্ট কোস্টার (Giant Coaster), তখন এটি ছিলো প্যারাগন পার্কে। পরে ডিন কর্পোরেশন এটি স্থানান্তর করে এর নাম রাখে ওয়াইল্ড ওয়ান। এই রোলার কোস্টারে আরোহণকারীদের উচ্চতা কমপক্ষে চার ফুট হতে হবে।
জ্যাক র্যাবিট (Jack Rabbit)
এর দেখা মিলবে নিউইয়র্কের সীব্রিজ পার্কে। ১৯২০ সালে তৈরি এই রোলার কোস্টারটি সেই সময়ের সবচাইতে দ্রুত গতির রোলার কোস্টার ছিলো। এর একেকটি ড্রপের গভীরতা ছিলো ৭৫ ফুট এবং পুরো রোলার কোস্টারটি ছিলো ২,১৫০ ফুট লম্বা। আরোহণকারীদের উচ্চতা ন্যূনতম চার ফুট হওয়া বাধ্যতামূলক। তাই একেবারে ছোট বাচ্চারা এতে চড়তে পারে না। কাঠের তৈরি এই রোলার কোস্টারটি বেশ বড় একটি টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়ায় রাইডটি অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হয়।
জ্যাক র্যাবিট (Jack Rabbit)
এবারে পাঠক নিশ্চয়ই মনে করছেন একই রোলার কোস্টারের নাম দু’বার লেখা হয়েছে। না, তা নয় মোটেই। একই নামের আরেকটি রোলার কোস্টার রয়েছে। পেনসিলভানিয়ার ওয়েস্ট মিফলিনের কেনিউডে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু এই রোলার কোস্টারটি। ঘণ্টায় ৪৫ মাইল বেগে এটি চলে এবং এরও একটি টানেল রয়েছে।এর সবচাইতে রোমাঞ্চকর দিক হলো, এর ৭০ ফুট ড্রপ ডাবল-ডিপ হওয়ায় উঁচু থেকে রোলার কোস্টারটি যখন ডিপে পড়ে, তখন মনে হয় যেন সিট থেকে সবাই নিচে পড়ে যাবে। জ্যাক র্যাবিটের এই বিষয়টিই আরোহণকারীদের আকৃষ্ট করে বেশি। ১৯২০ সালে তৈরি এই রোলার কোস্টারটি যথার্থভাবে জমির উপরই বানানো হয়েছে, যা একে অন্য সব রোলার কোস্টার থেকে আলাদা করে রেখেছে এবং এর তৈরিতেও খরচ হয়েছে তুলনামূলক কম।
দ্য রোলার কোস্টার (The Roller Coaster)
ইউটাহ্, ফারমিংটন-এর ল্যাগুন পার্কের এই রোলার কোস্টারটি তৈরি করা হয় ১৯২১ সালে। ২,৫০০ ফুট লম্বা এই রোলার কোস্টারটি উচ্চতায় ৬০ ফুট। এর গতিবেগ ঘণ্টায় ৪৫ মাইল। অনেক পর্যটকদের কাছে এটি ‘হোয়াইট রোলার কোস্টার’ নামেও পরিচিত। ১৯৫৩ সালে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং পুনরায় এর সংস্কার কাজ করা হয়। ২০১২ সালে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব হিস্টরিক প্লেসেস’-এ জায়গা করে নেয় এই রোলার কোস্টার।