১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে যার পরিচিতি ‘কাল রাত’ হিসেবে। সেদিন রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র, নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনী। মুহূর্তের মধ্যে ভারী অস্ত্রের পৈশাচিক হুঙ্কারে শান্তিপূর্ণ ঢাকাবাসীর জীবনে নেমে আসলো এক দুর্বিসহ অভিশাপ।
সারারাত ধরে চললো হত্যাযজ্ঞ। যখন ঢাকার বুকে নির্বিচার গণহত্যার মহড়া চলছে, তখন পৃথিবীর অপর প্রান্তের শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে স্নিগ্ধ বিকালের পাখি ডাকা প্রশান্তি বিরাজ করছিলো। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন তখন হোয়াইট হাউসের বৈঠকখানায় তার বন্ধু হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে খোশগল্পে মত্ত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে, তাদের দেশে প্রস্তুতকৃত অস্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে তাদেরই বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তান। আর জানবেই বা কেমন করে? অত্যাচারী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী গণহত্যার পূর্বেই ঢাকার সাথে বহির্বিশ্বের সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো।
ঢাকায় অবস্থানরত গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিবিদ এবং বিদেশি সাংবাদিকগণকে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ কড়াকড়ি জারি করা হলো। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পুরো মানবতাকে বন্দী করে রাখার এক অসহায় প্রচেষ্টায় পুরোপুরি সফল হলো হানাদাররা। মানবতার প্রদীপ যখন নিভু নিভু অবস্থায় প্রজ্জ্বলিত হচ্ছিলো, ঠিক তখন বহির্বিশ্বের নিকট বাংলাদেশের কান্নার ধ্বনি পৌঁছে দেয়ার গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন কতক সাহসী সৈনিক। এদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র নাগরিক আর্চার কেন্ট ব্লাড অন্যতম। অসম সাহসিকতার সাথে ঢাকার করুণ অবস্থা বিবরণের মাধ্যমে তিনি বহির্বিশ্বের দরবারে ঢাকার আকুতি তুলে ধরতে সক্ষম হন। আমাদের আজকের প্রবন্ধে সেই ব্লাড এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের পক্ষে তার অদম্য সংগ্রামের গল্প বর্ণিত হবে।
আর্চার কেন্ট ব্লাডকে প্রথম দর্শনে যে কেউ বলে দিতে পারবে লোকটি বই পড়তে খুব ভালোবাসেন। কথাটা একদম মিথ্যে নয়। ভার্জিনিয়ায় জন্ম নেয়া আর্চার ব্লাডের অবসর সময়ের সঙ্গী হিসেবে থাকে বই। একদম ছোট থেকে বইয়ের সাথে সখ্যতা গড়া ব্লাড পেশায় একজন কূটনীতিবিদ। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, হাজারো পেশার ভিড়ে ব্লাডের মতো একজন সম্ভাবনাময় মানুষ কেন একজন কূটনীতিবিদের পথ বেছে নিলেন। ব্লাড মুচকি হেসে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন মার্গারেট ব্লাড তার পক্ষে উত্তর দিয়েছিলেন, “কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অনেক আগেই ও নিজেকে একজন কূটনীতিক হিসেবে দেখতো। এসব কাজের প্রতি ওর দারুণ ঝোঁক! ও সবসময় পৃথিবীর দিকে তাকাতো এবং ভাবতো সবকিছুরই একটি অর্থ আছে।”1 ব্লাড কি কূটনীতির মাঝে পৃথিবীর মানে খুঁজে পেয়েছিলেন? তার মুচকি হাসির নির্মলতায় সেই রহস্যের কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কর্মক্ষেত্রে ব্লাড দারুণ সফল ছিলেন। ফলে খুব দ্রুত তার পদোন্নতি হয়ে যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্লাড ঘুরে বেড়াতে থাকেন সস্ত্রীক। ১৯৬০ সালে ব্লাডের টেবিলে নতুন বদলি নোটিশ আসলো। নতুন গন্তব্যস্থল দারিদ্র্য নিপীড়িত অঞ্চল ভারত উপমহাদেশের নতুন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান। ঢাকা দূতাবাসের ডেপুটি হিসেবে যোগদান করার উদ্দেশ্যে যথাসময়ে বিমানে চড়ে বসেন তিনি। এর পূর্বে ঢাকা সম্পর্কে ব্লাডের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ঢাকায় পদার্পণের পর থেকেই একের পর এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় ব্লাড দম্পতিকে। মার্গারেট ব্লাডকে ঢাকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হাসতে হাসতে জানান, “এটি কোনো শহর ছিল না। ঢাকা ছিল একটি সাগর।” কারণ, ব্লাড দম্পত্তি তাদের নতুন আবাসস্থলকে আবিষ্কার করলেন প্রায় আধা মিটার জলের নিচে!2
বর্ষার ঢলে সেবার ঢাকার বহু অঞ্চল পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল। এর আগে অনেক কূটনীতিক ঢাকার প্রথম দর্শনেই ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্লাড সেটি করতে নারাজ। ঢাকার বর্ষায় ব্লাড এক অদ্ভুত সৌন্দর্য খুঁজে পেলেন। দূতাবাসের নতুন বাসায় চিলেকোঠায় চালে রিমঝিম বৃষ্টির অনবদ্য ঐকতানের মাদকতায় বাংলাদেশকে এক প্রকার ভালোবেসে ফেললেন আর্চার কে ব্লাড। তিনি ধীরে ধীরে প্রতিবেশী বাঙালিদের মাঝেও ভালোবাসা খুঁজে পান। প্রতিদিন অফিস ফেরত ব্লাডের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো প্রতিবেশী শিশুরা। তাদের সাথে খেলা করতে করতে কখন যে ফের বদলি নোটিশ এসে পড়লো, তা কেউই টের পেলো না। 3
ঢাকার মায়া ত্যাগ করে ব্লাড কয়েক বছর গ্রিসের দূতাবাসে কাজ করলেন। কিন্তু সেখানে মন টিকলো না। তারপর জার্মানি, আফগানিস্তান এবং ভারতে কয়েক বছর কর্মরত ছিলেন। কিন্তু তার মনে পড়ে ছিল ঢাকার সেই ছিমছাম দূতাবাসে। ভাগ্যের জোরে ১৯৭০ সালে পুনরায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করার সুযোগ পেলেন। তিনি ঢাকা দূতাবাসের উপদেষ্টা হিসেবে নতুন পদে যোগদান করেন। ফের সেই পুরাতন ঢাকায় ফিরে গেলেন ব্লাড। ঢাকার বাতাসে তখন বৃষ্টির ভেজা গন্ধ বিরাজ করেছে। চিলেকোঠার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টি স্পর্শ করে তিনি নতুন জীবনকে শুভেচ্ছা জানালেন।4 কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতি তখন উত্তাল। পাকিস্তানী সরকারের অন্যায়, অবিচারের বিপক্ষে তীব্র আন্দোলনে নেমেছে সকল পেশার মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃপ্ত নির্দেশনায় তখন সমগ্র বাংলার মানুষ এক নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
ব্লাড বাংলার মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই আন্দোলনের প্রতিটি স্লোগানে তিনি শিহরিত হয়ে উঠতেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি আন্দোলনের খবর নিতেন। সেবছর নভেম্বরের ১৩ তারিখে বাংলার বুকে এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের আগ্রাসন ঘটে। মানবতাপ্রেমী ব্লাড দম্পতি পর্যাপ্ত অর্থ নিয়ে ঘূর্ণিঝড় কবলিত অঞ্চলে ছুটে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার এক নতুন রূপ দেখতে পান। একইসাথে তার চোখে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের চিত্র। বিভিন্ন বেসরকারি খাত এবং বহির্বিশ্ব থেকে ত্রাণ সহায়তা প্রেরণ করা হলেও পাকিস্তান সরকার থেকে কোনোরূপ ত্রাণ সহায়তা করা হলো না। মার্কিন ত্রাণ কমিটির কর্মকর্তা এরিক গ্রিফেল নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, “পশ্চিম পাকিস্তান সরকার সামান্যতম সাহায্যও করেননি। যেখানে অন্যান্য দেশ যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।” 5
সেদিনের ঘটনা বাংলার মানুষকে জানিয়ে দিলো, এই পাকিস্তানি সরকারের অধীনে থাকা অসম্ভব। ধীরে ধীরে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি স্বাধীনতার এক অমর কাব্যে রূপ নিলো। জাতীয় নির্বাচনে জনগণের রায়ে জয়ী হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার তা মেনে নিতে নারাজ। টালবাহনা শুরু করলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। কিন্তু অধিকার সচেতন মানুষ এবার ইয়াহিয়াকে ছাড় দেবে না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক সম্মেলনের ডাক দেয়া হলো। সবার চোখ তখন বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি ঘোষণা দিলেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম!” তার কথায় এক অদ্ভুত জাদু আছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার বাণীতে পুরো বাংলা তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করলো।
বাঙালির আন্দোলনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন জেনারেল ইয়াহিয়া। তবে তিনি মনে মনে এক কুখ্যাত নীল নকশা আঁকতে থাকেন। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র। ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিকট নতুন অস্ত্র সরবরাহের আবেদন করলেন।
যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান অস্ত্র সরবরাহক ছিলো। বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নিক্সনের পাকিস্তানের প্রতি এক সূক্ষ্ম দূর্বলতা কাজ করতো। কারণ, তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। হেনরি কিসিঞ্জারও ইয়াহিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“ইয়াহিয়া মানুষ হিসেবে খুব শক্ত এবং চটপটে। তার চলাফেরায় প্রকাশ পায় যে তিনি একজন সৈনিক। লোকটি মাঝে মাঝে হালকা কৌতুক করতেও পছন্দ করেন। সামাজিকতায় সামান্য দুর্বল হলেও স্যাণ্ডহার্স্টের সবচেয়ে সেরা ক্যাডেটদের মধ্যে ইয়াহিয়াকে গণ্য করতে হবে।” 6
নিক্সন ইয়াহিয়াকে উপমহাদেশের সবচেয়ে তুখোড় নেতা হিসেবে দেখতেন। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী, তা কেউ বলতে পারে না। নিজের দেশের রাষ্ট্রপতির পছন্দের পাত্র ইয়াহিয়াকে আর্চার ব্লাড খুবই অপছন্দ করতেন। তার মতে, ইয়াহিয়ার মতো ধুরন্ধর ব্যক্তি আর দ্বিতীয়টি নেই।7 সব ঝামেলার মাঝেও নিজের স্বার্থ হাসিলে সিদ্ধহস্ত এই ইয়াহিয়া। অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার কিছুদিন পূর্বে জেনারেল ইয়াহিয়া রাষ্ট্রীয় সফরে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ওভাল অফিসের সুসজ্জিত টেবিলে বসে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুনরায় সামরিক অস্ত্র কেনার নতুন চুক্তি করেন। অস্ত্রের পাশাপাশি ছয়টি F-104 যুদ্ধবিমান, সাতটি B-57 বোমারু এবং তিনশত অস্ত্র বহনকারী যান ক্রয় করেন ইয়াহিয়া।
তাছাড়া কয়েক ঘণ্টাব্যাপী আলাপচারিতায় নিক্সন-ইয়াহিয়া-কিসিঞ্জার একে অপরের সাথে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। নিক্সন সেবার ইয়াহিয়াকে আশ্বাস বাণী দেন, “যত দুর্দিন আসুক। আমি সবসময় পাকিস্তানকে সাহায্য করবো।” সাক্ষাত শেষে ইয়াহিয়া গণমাধ্যমকে জানান, “আমি নিক্সনকে স্বাগত জানাই। আমাদের বন্ধুত্ব নতুন নয়। আমরা শত্রু মোকাবিলায় একসাথে কাজ করতে চাই।”8 রিচার্ড নিক্সন তার কথার খেলাপ করলেন না। জাহাজ বোঝাই অস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে পৌঁছালো। সেই অস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়া বাস্তবায়িত করলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক গণহত্যা- ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
সেদিন সহকর্মীদের সাথে নিজের বাড়িতে নৈশভোজ করছিলেন ব্লাড। ভোজনপর্ব শেষে সবার সাথে আলাপচারিতায় মত্ত ব্লাড কাছাকাছি কোথাও বিস্ফোরণের শব্দে ভয় পেয়ে যান। সহকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে তিনি ছাদের উপর উঠে যান। সেখান থেকে তিনি এক নারকীয় দৃশ্য অবলোকন করেন। শহরের কয়েকটি স্থানে অগ্নিপাত করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর প্রচণ্ড শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে বিভিন্ন অস্ত্রের মরণ চিৎকার। নিকষ কালো আকাশ কিছুক্ষণ পর পর মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠছে। একদম আতশবাজির মতো লাগছিলো। কিন্তু সেটি ছিল পাক হানাদারদের বোমার স্ফুলিঙ্গ।9
বিচ্ছিন্ন ঢাকার গণহত্যা সম্পর্কে পুরো বিশ্ব অজ্ঞাত থাকলেও হোয়াইট হাউসের নিক্সন-কিসিঞ্জার সবকিছু আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু তারা কোনোরূপ আপত্তি প্রকাশ করেননি বন্ধু ইয়াহিয়ার প্রতি। উল্টো কিসিঞ্জার ২৭ মার্চ নিক্সনকে জানান, “ইয়াহিয়া সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছেন। আর পারবেনই না কেনো? বাঙালি আর যা-ই করুক, লড়াই করতে পারবে না।”
ঢাকার হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি তাদের হাসির খোরাকে পরিণত হলো।10 ওদিকে আর্চার কে ব্লাড ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের দুর্দশার তথ্য যোগাড় করে ওয়াশিংটন কার্যালয়ে প্রেরণ করতে থাকেন। কিন্তু অপরপ্রান্তে শুধুই নীরবতা। ব্লাড তার তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, “আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আর কতদিন অন্ধকারে চিৎকার করবো? তবে আমি হাল ছেড়ে দেই নি। আমি ওয়াশিংটনের নীরবতার বাঁধ ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলাম।” এবার আর্চার ব্লাড চিরকুট সদৃশ সংবাদ প্রেরণের বদলে পুরোদস্তুর প্রতিবেদন তৈরির কাজে হাত দিলেন। টাইপরাইটারের ঘট ঘট শব্দে বাদামী কাগজে ইংরেজি হরফে ছাপা হলো দুটি শব্দ- ‘Selective Genocide’। মূলত আর্চার ব্লাডই সর্বপ্রথম ২৫ মার্চের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে।11
ব্লাড কোনোকিছুই গোপন করলেন না। তিনি লিখলেন, “ইতিহাসের এক জঘন্য গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আমরা ঢাকায় চুপ করে বসে আছি। এই বর্বরতাকে মেনে নেয়ার মতো অপরাধ আমরা করতে পারি না। শহরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ঘর থেকে বের করে হত্যা করে হয়েছে, যা অসমর্থনযোগ্য।” ওয়াশিংটনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্লাডের প্রতিবেদন যথেষ্ট সাড়া পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের চালিকা কেন্দ্র হোয়াইট হাউসে তা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যাত হলো।
ব্লাড হতাশায় ডুবে পড়লেন। তিনি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উল্টো রিচার্ড নিক্সন আর্চার ব্লাডকে বঙ্গপ্রীতিতে অন্ধ বলে অপবাদ দিলেন। হেনরি কিসিঞ্জার পুরো ব্যাপারটি একরকম হেসে উড়িয়ে দিলেন।12 আর্চার কে ব্লাড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কিন্তু তিনি ২৫ মার্চের পাশবিকতাকে তারও উপরে স্থান দিলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জারের আচরণে ব্লাড ক্ষুব্ধ হয়ে পড়লেন। তবে কিসিঞ্জারের হাসি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। দুদিন বাদেই ব্লাডের প্রতিবেদন হোয়াইট হাউসের নথিপত্র থেকে ফাঁস হয়ে গেলো। কিসিঞ্জার হয়তো এই বিপত্তি সামলে উঠতে পারতেন, কিন্তু ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এই প্রতিবেদন ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বী এডওয়ার্ড কেনেডির নিকট এক গোপন সূত্রের সাহায্যে পৌঁছে গেলো।
নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভদ্রতার ছদ্মবেশ খুলে গেলো। কেনেডি এক সম্মেলনে নিক্সনের পররাষ্ট্রনীতির নিন্দা করেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তুতকৃত অস্ত্রের সাহায্যে এই গণহত্যা পরিচালনায় নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকা পালন করা কিসিঞ্জারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।13
নিক্সন রাগে গজ গজ করতে থাকেন। তিনি ইয়াহিয়ার সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে নারাজ ছিলেন। তাই তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্লাড জানতেন নিক্সন কাজের কাজ কিছুই করবেন না। তাই তিনি ঢাকা দূতাবাসের সহকর্মীদের জরুরি মিটিংয়ে ডাকলেন। তিনি মিটিংয়ে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সবাইকে অবগত করলেন।
ঢাকা দূতাবাসের সবাই নিক্সনের প্রতিক্রিয়ায় বিরক্ত ছিলেন। সবাই ব্লাডকে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। সকলের সম্মতিক্রমে ব্লাড এক কালজয়ী টেলিগ্রাম রচনায় হাত দিলেন। পুনরায় ব্লাডের কক্ষ টাইপরাইটের যান্ত্রিক শব্দে মুখর হয়ে উঠলো। তিনি লিখে চললেন,
“আমাদের সরকার (যুক্তরাষ্ট্র) গণতন্ত্রের চূড়ান্ত পতনকে রুখে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার এক স্বৈরাচারীর অন্যায়কে রুখে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের গণহত্যার অন্ধ সমর্থনে আমরা অপমানিত হয়েছি। এর ফলে বিশ্ব সভ্যতার নিকট যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সরকার বার বার প্রমাণ করছে তারা নৈতিকভাবে দেউলিয়া। মানবতার সমর্থনে সে পাশে দাঁড়াতে অপারগ। এমনকি আমাদের সরকার স্পষ্ট গণহত্যাকে অভ্যন্তরীণ ইস্যুর মুখোশ পরিয়ে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা সকলে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি। সমগ্র জনতা তাদের কর্মকাণ্ডে নিন্দা প্রকাশ করেছে। সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমরা নিক্সন সরকারের ঘৃণ্য নীতির প্রতি বিরোধিতা জ্ঞাপন করছি এবং অতি শীঘ্রই এই নীতি থেকে সরে দাঁড়িয়ে মানবতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কাজ করবে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।”14
আর্চার কেন্ট ব্লাডসহ বিশজন কর্মকর্তার স্বাক্ষরকৃত এই টেলিগ্রামকে ঐতিহাসিকভাবে ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামকরণ করা হয়। এই টেলিগ্রাম যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। কিসিঞ্জারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা স্যামুয়েল হসকিন্সন জানান, “হেনরি পুরো ব্যাপারটি নিয়ে বিরক্ত ছিলো। আমরা বুঝতে পারছিলাম সে রেগে আছে।” নিক্সন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ঢাকার উপদেষ্টা ব্লাড তাকে একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি এই অপবাদে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন।
ওদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো নয়টি বিভাগের কর্মকর্তাগণ ব্লাডের টেলিগ্রামের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। নিক্সন টেলিগ্রামটি গোপন রাখতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের নথিপত্রের মাঝে শোভা পেতে থাকে ব্লাডের সাহসী টেলিগ্রাম। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের নীতিমালাকে ব্যর্থ ঘোষণা করার মতো দুঃসাহস দেখালেন আর্চার ব্লাড। স্বাভাবিকভাবেই ব্লাডের টেলিগ্রাম যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিকে এক চুল পরিমাণ নড়াতে পারেনি। তিনি জানতেন নিক্সন-কিসিঞ্জার কখনও নিজেদের অবস্থান থেকে নড়বেন না। তবে তিনি আরো জানতেন, এই মুহূর্তে অসহায় ক্রন্দনরত বাঙালিদের পাশে দাঁড়াতে হলে তাকে কিছু করতে হবে। তাই এরূপ পরিস্থিতিতেও তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মার্কিন রাজনৈতিক কর্মকর্তা স্কট বুচারের মতে,
“ব্লাড একজন বীর। তিনি জানতেন এই কাজের মাধ্যমে তার বর্ণাঢ্য পেশা জীবনের যবনিকাপাত হবে। তবুও তিনি পিছপা হননি। তিনি ইচ্ছা করলেই পুরো ব্যাপারটি মাথা থেকে ঝেরে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে পারতেন। ব্লাড একজন পেশাদার কর্মকর্তা। আর আপনি জানেন পেশাদারিত্ব কী? এর মানে নিজের অবস্থান থেকে সর্বদা সঠিক কাজ করা।”15
ব্লাডের ন্যায় কর্মকর্তাদের বীরত্বসূচক অবদানে বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন অর্জিত হয়। নিক্সন-কিসিঞ্জারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা একমত হলো না। তারা ইয়াহিয়ার প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে। ব্লাড টেলিগ্রামের মতো সাহসী পদক্ষেপে আমাদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়। ওদিকে ব্লাড জানতেন, তার ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি ফরমানে তাকে ঢাকা দূতাবাস থেকে অব্যাহতি প্রদান করে হলো।
একজন সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রদূতের পথচলা এখানেই শেষ হলো। কিন্তু এতে তার বিন্দুমাত্র আফসোস ছিলো না। তিনি ভুল করেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে আর্চার কে ব্লাডের নাম সম্মানের সাথে উচ্চারণ করা হয়। এই বীর ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিজের বাসভূমে মৃত্যুবরণ করেন। নাইট-রাইডার প্রেসের পাতায় সেদিন লেখা ছিল, “ব্লাডের শেষকৃত্যে তার পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব এবং এবং সমগ্র জাতি ব্যথিত হয়েছিলো। কিন্তু সেই জাতির নাম যুক্তরাষ্ট্র নয়, সেটি বাংলাদেশ।” তার মৃত্যুসংবাদ এদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর শিরোনাম হিসেবে ছাপা হয়েছিলো। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ঐতিহাসিক টেলিগ্রামটি বাংলাদেশ সরকারের হস্তান্তর করে। মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে পরিচিত এই টেলিগ্রাম আমাদের সর্বদা মনে করিয়ে দিবে এক সাহসী কূটনীতিবিদের কথা, যিনি চিলেকোঠার চালে বর্ষার ঐকতানকে বড্ড ভালোবাসতেন। আর ভালোবাসতেন এই বাংলাদেশকে।
তথ্যসূত্র:
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 17
- The Blood Telegram by Garry J. Bass, Random House India Publications, 2013. Page no. 16
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 23
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 2-31
- Inter-Departmental Working Group on East Pakistan Disaster Relief, Daily Status Report, 20 November 1970
- Government of Pakistan, The Report of the Hamoodur Rehman Commission of Inquiry into the 1971 War, Lahore: Vanguard, 2001. Page no. 67
- Pakistan: Eye of the Storm by Owen Bennett Jones, New Heaven, Yale University Press, 2009. Page no. 160
- Nixon-Yahya memcon, 25 October 1970, 10:45 a.m.
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 195-196
- NSA, Nixon-Kissinger telcon, 27 March 1971, 2:05 p.m.
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 213
- The Blood Telegram by Garry J. Bass, Random House India Publications, 2013. Page no. 60
- The Cruel Birth of Bangladesh by Archer K. Blood, Dacca: University Press of Bangladesh, 2002. Page no. 214-215
- The Blood Telegram by Garry J. Bass, Random House India Publications, 2013. Page no. 77
- The Blood Telegram by Garry J. Bass, Random House India Publications, 2013. Page no. 79
ফিচার ইমেজ: The Daily Beast